#ধারাবাহিক গল্প
#উপসংহার
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই অথচ এখনও শাবাব নিজের রুম থেকে বের হচ্ছে না। আমার খুব অস্থির লাগছে। ওর রুমের দরজার কাছে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি। সেঁজুতি ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
—-ভাবি, শাবাব কোথায়? ওকি এয়ারপোর্টে পৌঁছেছে?
আমি কি বলবো বুঝে পাচ্ছিলাম না। শুধু বললাম,
—-একটু পর তোমাকে ফোন দিচ্ছি।
এরপর রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-এবার তো দরজাটা ভাঙ্গার ব্যবস্থা করতে হয়। আমার ভীষণ ভয় করছে। তুমি নীচে গিয়ে দারোয়ানকে ডাকো।
আর তখনি শাবাব ওর রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে আমার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো,
—-মা,আমি তোমাকে আর বাবাকে ফেলে রেখে যেতে পারলাম না। এই দু’দিন আমি নিজের সাথে প্রচুর লড়াই করেছি। যে তুমি আমাকে কতো কাঠখড় পুড়িয়ে বড় করেছো তাকে ফেলে রেখে আমি কিভাবে যাই? তোমায় ঘিরে আমার পৃথিবীটা রচিত হয়েছে সেই পৃথিবীটা ছেড়ে আমি কোনোভাবেই ভালো থাকতে পারবো না।
এরপর শাবাব রাহাতের কাছে গিয়ে বললো,
—-যখন আমার জীবনে বাবার প্রয়োজন ছিলো তখন এই মানুষটা আমায় বাবার ভালোবাসা দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। এজন্য মানুষের কাছে তাকে কতো অপমানিত হতে হয়েছে। এমনকি এই মানুষটার পৌরুষত্বের দিকে মানুষ আঙ্গুল তুলেছে। তারপরও মানুষটা আমার হাত ছাড়েনি। বরং আরো শক্ত করে আমার হাত আজ অবদি ধরে রেখেছে। হুট করে কালবোশেখি ঝড়ের মতো এসে যদি কেউ বাবা হতে চায় তাহলে কি বাবা হওয়া যায়? নাকি বাবার জায়গাটা তাকে দেওয়া যায় বলনা বাবা?
আমার আর রাহাতের মুখের ভাষা যেন হারিয়ে গিয়েছে। অঝোর ধারায় আমার আর রাহাতের দুচোখে শ্রাবনের বারিষধারার মতো অবিরাম পানি ঝরছে। মুখে আজ কোনো কথা নেই। আমার বাসার প্রতিটি মানুষের চোখের পাতা সিক্ত হয়ে উঠছে। শাবাব কাঁদতে কাঁদতে আবারও বলা শুরু করলো।
—-আমিতো আমার এই বাবাকেই চিনি যে বাবা আমাকে খাইয়ে দিয়েছে,গোসল করিয়ে দিয়েছে, ঘুমের সাথী হয়েছে,খেলার সাথী হয়েছে। অসুখ হলে রাত জেগে থেকেছে। এই জীবনে এই মানুষটাই আমার সুখ দুঃখের সাথী। তাকে ছেড়ে আমি ভালো থাকবো কি করে?
বাইরে তখন অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে। তার সাথে মেঘের কড়াৎ কড়াৎ শব্দ। হয়তো আমাদের কষ্ট দেখে বাইরের প্রকৃতিতে কষ্টের বর্ষণ শুরু হয়েছে। আজ মনে হলো,জন্ম দিলেই শুধু বাবা মা হওয়া যায় না। বাবা মা হতে গেলে জীবনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমার আর রাহাতের ত্যাগ বিফলে যায়নি। আম্মা এমন সময় বলে উঠলো,
—-যাক বাবা,ঘরের ছেলে আমার ঘরে থেকে গেল। আমি তো চিন্তায় অস্থির আমার নানুভাই না জানি কোন ন্যাংটো মেম সাহেবের পাল্লায় পড়ে যায় কিনা কে জানে?
আম্মার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো। বুবু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-ছেলেকে নিয়ে এবার খেতে বোস। দুপুরে তুই, রাহাত আর শাবাব তোরা কেউই ঠিক মতো খাসনি।
খাওয়ার কথা শুনে শাবাব আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আম্মু আমার আসলেই খুব ক্ষিদে লেগেছে। খেতে দাও।
বুবু আদুরীকে টেবিলে ভাত বেড়ে দিতে বললো। আমি ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। রাহাত আর শাবাব ও ফ্রেস হয়ে আসলো। আমরা টেবিলে যখনি খেতে বসলাম অমনি ডোরবেলটা বেজে উঠলো। রাত তখন বারোটা বাজে। আমার মন বলছে সেঁজুতি এসেছে। আদুরী দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সেঁজুতি ওর বর আর মৌমিতাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে সেঁজুতি বললো,
—-ভাবি,শাবাব এটা কি করলো? ও যদি যেতে না চায় তাহলে এই নাটক করার কোনো দরকার ছিলো না।
আমি কিছু বলার আগেই শাবাব বললো,
—-আমি কিন্তু উনাকে আমার জন্য ভর্তির ব্যবস্থা করতে বলিনি। উনি নিজ থেকেই উদ্যেগ নিয়ে কাজটা করেছেন।
—-আসলে কি বলতো,যেচে কারো ভালো করতে নাই।
শাবাব ও সাথে সাথে উত্তর দিলো।
—-তোমাদের কে বলেছে আমি খারাপ আছি? তোমার ভোলার কথা না আমি ইতিমধ্যে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি।
আমি শাবাবকে চুপ থাকতে বললাম। কিন্তু ও আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বললো,
—-আম্মু,আজ আমাকে চুপ থাকতে বলো না। তাহলে তোমাদের দুজনের প্রতি অন্যায় করা হবে। যখন আমার জীবনে বাবার দরকার ছিলো তখন কি উনি আমার খোঁজ রেখেছেন?
সেঁজুতিও রেগে গিয়ে বললো,
—সেই পথ তো তোমার মা খোলা রাখেননি।
আমি অবাক হয়ে সেঁজুতির সেই স্বরুপ দেখলাম। ওর সাথে এতো বছরের সম্পর্কে আমি ওর এই রুপ দেখিনি। আসলে মানুষের স্বার্থে ঘা লাগলে আসল চেহারা বেরিয়ে আসে।
শাবাবও রেগে গিয়ে বললো,
—আমার মায়ের মতো পরশ পাথরকে যারা ধরে রাখতে পারেনি তাদের সাথে আমারও সম্পর্ক রাখার দরকার নেই।
মৌমিতা দৌড়ে এসে ওর মাকে বললো,
—-আম্মু, তুমি তো কখনও এতোটা রেগে যাও না। আজ তবে ভাইয়ার সাথে এমন করছো কেন?
বুবু সেঁজুতির কাছে গিয়ে বললো,
—-রাগ করে তো কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না সেঁজুতি। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হয়। এরমাঝে জাবেদ ভাই এসে সেঁজুতিকে বললো,
—-এখন বাড়ি চলো। মাথা ঠান্ডা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
সেঁজুতি আমার সাথে কোনো কথা না বলে দুপদাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু এরই মধ্যে আমাদের সবার খাবার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। শাবাব খাওয়া অসমাপ্ত রেখে উঠে যায়। রাহাতও ছেলের পিছু পিছু ওর ঘরে চলে যায়। এদিকে ফয়সল ভাই আমার কাছে এসে বললো,
—-সেঁজুতির মাথা ঠিক নেই। ওর ভাই যেহেতু একা থাকে সেকারণে একাকীত্ব ঘোঁচাতে শাবাবকে আমেরিকাতে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটা এভাবে মাঠে মারা যাওয়াতে ওর মাথা গরম হয়ে আছে।
আমি ফয়সল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—-সত্যি কথা বলতে, এই পৃথিবীতে সবাই নিজের স্বার্থ আগে দেখে।
আম্মা আর বুবু খাওয়া কমপ্লিট করে চলে যায়। আমিও ওষুধ গেলার মতো করে খাবারগুলো পানি দিয়ে পেটের মধ্যে ঢুকালাম। আদুরী আমার অবস্থা দেখে বললো,
—-খালামনি তুমি রেস্ট নাও। আমি এদিকটা গুছিয়ে রাখছি।
আমি বারান্দায় গিয়ে ইজিচেয়ারটায় বসলাম। একপশলা বৃষ্টি হওয়াতে বৃষ্টিভেজা শীতল বাতাসে আমি সিক্ত হলাম আর ভাবলাম,”সেঁজুতি কিভাবে আজ পুরো দোষটা আমার উপর চাপিয়ে দিলো। ওর ভাই আমার সাথে কি আচরণ করেছে তাতো ও ভালো করেই জানে। তারপরও কিভাবে এক ঘর মানুষের সামনে বললো,
“আমিই নাকি সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি।” আসলে এই সমাজ সংসারে মেয়েদের কেউ মুল্যায়ন করে না। বিশেষ করে নারীরাই নারীদেরকে সবচেয়ে বেশী অবমুল্যায়ন করে থাকে। আব্বা আম্মা আমাকে বোঝা মনে করে সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব সারতে চাইলো। অথচ আমার জীবনের দূর্ভাগ্য আমাকেই বইতে হলো। ঘাড়ের উপর কারো হাতের উষ্ণ স্পর্শ পেলাম। তাকিয়ে দেখি রাহাত এসে দড়িয়েছে। আমার পিঠে আলতো করে হাত রেখে বললো,
—ঘুমোবে চলো,তুমি যে কয়েক রাত ঠিক মতো ঘুমাওনি তা আমি তোমার মুখ দেখে বুঝেছি।
আমারও বড্ড ক্লাম্ত লাগছে। মনে হলো অনেকদিন পর দুচোখ জুড়ে ঘুম নামতে শুরু করেছে।
দু’দিন পর একটা দুঃসংবাদ পেলাম।মুশফিক স্ট্রোক করেছে। জাবেদ ভাই মুশফিকের কাছে যাওয়ার জন্য আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। মুশফিক কিছুটা সামলে উঠলে জাবেদ ভাইয়ের সাথে দেশে ফিরে আসে। ঢাকার গুলশানে ওর বিশাল আড়াই হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্লাট আছে। ওখানেই মুশফিক থাকতে শুরু করলো। জাবেদভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললো,”আমি যেন শাবাবকে ওর বাবার কাছে মাঝে মাঝে পাঠাই।”
পাঁচ বছর পর——
শাবাব অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করে ঢাকা ভার্সিটিতেই শিক্ষক হিসাবে জয়েন করেছে। সামনে আমেরিকা পাড়ি জমাবে। ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে ও পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছে। আমার শাবাবের বিয়ে দিয়েছি। পুত্রবধু হিসাবে আদুরীকেই ঘরে এনেছি। শাবাব অমত করেনি। এর মাঝে আমার শাশুড়ী মা মারা যান। সিফাত দিনাজপুর শহরেই থাকে। ওখানেই ওর সংসার। ওর একছেলে একমেয়ে হয়েছপ। তবে শাশুড়ী মারা যাবার পর সিফাত আমাকে মনে হয় ওদের মায়ের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে।খুব সম্মান করে। বছরে একবার আমি দিনাজপুরে যাই। বাড়িতে কত ফসল উঠলো কতটুকু বিক্রি করা হলো সব আমাকে জানিয়ে করে। আমার ননদ সাবেরা ঢাকার মিরপুরে থাকে। স্বামী নিয়ে সুখের সংসার। একটা ছেলে হয়েছে।
আম্মাও বেঁচে নেই। বুবু আর ফয়সল ভাই হিলিতেই থাকে। আমার জীবন নদীটাও বয়ে চলছে জীবনের গতিতে। আমি, রাহাত, শাবাব আর আদুরীকে নিয়ে আমার সুখের সংসার। আল্লাহপাকের কাছে আমার শোকরিয়ার শেষ নেই। জীবনে অনেকবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেও পরমকরুনাময় আল্লাহপাকের রহমতে আমি উঠে দাঁড়াতে পেরেছি। এই পৃথিবীতে জ্ঞানত কখনও কাউকে কষ্ট দেইনি। কারো দায়িত্বে অবহেলা করিনি। আমার জীবনের প্রাপ্তির জায়গাটুকু কানায় কানায় পূর্ণ।
অপরদিকে নিঃসঙ্গতায়, অসুস্থতায় মুশফিকের কাছে জীবন মানে যন্ত্রণায় ভরা এক যুদ্ধক্ষেত্র। ও যেন প্রতিমুহুর্তে মৃত্যুকে কামনা করে। ওকে দেখার জন্য লোক রাখা হয়েছে। শাবাব মাঝে মাঝে যায়। বলা যায় আমিই ওকে ঠেলে পাঠাই। এভাবেই বুঝি মানুষ তার নিজের করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যায়।
সমাপ্ত
কমেন্টের মাধ্যমে জানিও। গল্পটা কেমন লাগলো।