#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-১
শিশির দেখল মেয়েটা রাস্তা পার হতে পারছে না। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। ওর আশেপাশে আরও অনেকেই এসে পার হয়ে যাচ্ছে। গাড়িগুলোও অত জোরে ছুটছে না। তবুও মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। এক পা বাড়িয়ে আবার পিছিয়ে আসছে। কোনো ফোবিয়া আছে কি? কাছাকাছি কোনো ওভারব্রিজও নেই। শিশির আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখল। না, মেয়েটা এখনো দাঁড়িয়েই আছে। ব্যস্ত শহরে কেউ খেয়ালও করছে না ওকে। সাহায্য করছে না রাস্তা পার হতে।
সে এগিয়ে গেল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “হ্যালো।”
মেয়েটা তাকাল। ওর চোখের বড় বড় পাপড়ি খানিকটা কাঁপল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে সে বলল, “আমাকে বলছেন?”
“জি। আমি কি আপনাকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করতে পারি?”
মেয়েটা খানিকটা ইতস্তত করে বলল, “আপনি?”
“হ্যাঁ। আসুন।”
শিশির নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিল। মেয়েটা ওর হাত ধরল। তারপর যেন পরম ভরসায় আর কোনোদিকে না তাকিয়ে শিশিরের সাথে সাথে রাস্তা পার হয়ে গেল।
ওপাড়ে গিয়ে শিশির জিজ্ঞেস করল, “আপনার নামটা জানতে পারি?”
মেয়েটা মৃদু স্বরে বলল, “অধরা।”
“সুন্দর নাম তো!”
অধরা সামান্য হেসে বলল, “ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ কিসের জন্য নামের প্রশংসা করেছি বলে নাকি রাস্তা পার করে দিয়েছি বলে?”
“দুটোর জন্যই।”
“তাহলে দুবার ধন্যবাদ বলা উচিত ছিল!”
“ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!” বলে সে হাঁটতে শুরু করল। একটা রিকশা ধরে উঠে পড়ছে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে আবারও আগ বাড়িয়ে শিশির বলল, “হ্যালো মিস অধরা, আপনার ফোন নম্বরটা পাওয়া যাবে?”
অধরা যেন এবার একটু বিরক্ত চোখেই তাকাল। তার চোখের বড় বড় পাপড়ি আবারও কাঁপছে। তার দৃষ্টিই মনের কথাটা বলে দিচ্ছে, এই সুযোগের জন্যই তবে উপযাচক হয়ে সাহায্য করা?
যদিও মুখে সে কিছুই বলল না। উত্তরই দিল না। শিশির অপেক্ষাও করল না। চট করে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে অধরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে আমার ফোন নম্বর আছে। যোগাযোগ করতে চাইলে করবেন।”
বলেই ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। অধরার রিকশা চলতে শুরু করল উল্টোদিকে। তবুও সে দু’বার পেছনে ফিরে চাইল। ছেলেটাকে আজেবাজে বখাটে ছেলে মনে হয়নি। বেশ ভদ্রই তো মনে হলো। তবে? অবশ্য ভদ্র ছেলেরাই কি কারো ফোন নম্বর চাইলে অভদ্র হয়ে যায় নাকি?
কার্ডটার দিকে তাকাল অধরা। নাম, ফোন নম্বর, ইমেইল আইডি, ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম লেখা। কোনো কোম্পানির নয়, নিজস্ব কার্ড। আজব তো! ছেলেটার নাম তানজীব আহমেদ শিশির।
কার্ডটা অবশ্য সুন্দর, শৌখিন। ওপরের দিকে ছোট্ট একটা লোগোও আছে, তার নামের প্রথম অক্ষরগুলো খোদাই করা, TAS.
খানিকটা চমকালো অধরা। তার নিজের নাম সংক্ষেপ করলেও এটাই আসে। তার পুরো নাম তাসমিয়া অধরা শেখ। সংক্ষেপে TAS.
এলোমেলো ভাবতে ভাবতে কখন যেন গন্তব্যে চলে এলো সে। রিকশা থেকে নামতে গিয়ে খেয়াল করল ইউনিভার্সিটির গেটের সামনেটা কৃষ্ণচূড়ায় লাল হয়ে আছে। পায়ের নিচে চাপা পড়ছে ঝরে পরা ফুল। আকাশটা আজ স্বচ্ছ কাচের মতো। মৃদু মৃদু হাওয়া বইছে। মনের মধ্যে অকারন বাজছে, “আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!”
ক্যাম্পাসে ঢুকে সবুজ ঘাসে হাঁটতে হাঁটতে হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল সে। দেরি হয়ে গেছে। এখন ক্লাসে ঢোকা মানে স্যারের কাছে একগাদা কৈফিয়ত দেয়া এবং অপমানিত হওয়া।
সে একটা ঝাঁকড়া কাঠগোলাপ গাছের নিচে ঘাসের ওপর বসে পড়ল। কার্ডটা তখনো তার হাতে ধরা। আরেকবার ভালো করে দেখে কী মনে করে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। ব্যাগে একটা গল্পের বই আছে। সেটাই বের করে মেলে ধরল চোখের সামনে। মন বসছে না কেন যেন। ঘুরে ফিরে ছেলেটার কথা মনে পড়ছে। সে জোর করে মনকে বইয়ের দিকে ফেরাতে চাইল। এমন সময় টুপ করে একটা কাঠগোলাপ পড়ল তার বইয়ের ওপর।
পেছনে একদল ছেলে গান ধরল, “আমার প্রাণ ধরিয়া মারো টান… মনটা করে আনচান…”
ক্লাস শেষে অধরার বন্ধুরা বেরিয়ে এলে ওকে দেখে এগিয়ে এসে বসল। অবধারিতভাবে প্রশ্ন এলো, “ক্লাস করিসনি কেন?”
অধরা গল্প করতে ভালোবাসে। আজকের ঘটনাটা বন্ধুদের কাছে না বলার প্রশ্নই আসে না। সে আদ্যেপান্ত খুলে বলল, “কাল ক্লাস শেষে আপুর বাসায় গিয়েছিলাম। আপু ফোন করেছিল ওর একটা জরুরি কাজে সাহায্য করতে…. তো ফেরার সময় আর রাস্তা পার হতে পারছিলাম না। জানিসই তো, আমার আবার বড় রাস্তা পার হতে একটু বেশিই ভয় লাগে। আরেকটু সকাল সকাল ক্লাস থাকলে ভাইয়া অফিসে যাওয়ার সময় পার করে দিয়ে যেত। তো দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় একটা ছেলে এসে হাজির। আমাকে বলল…..”
সব শোনার পর এক বান্ধবী জিজ্ঞেস করল, “ছেলেটা দেখতে কেমন রে?”
অধরা খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “মন্দ নয়…”
“তুই কি ওকে ফোন করবি?”
অধরা মশা তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, “ধুর! নাহ!”
আরেক বান্ধবী দুই গালে হাত দিয়ে উদাস স্বরে বলল, “তোদের সাথে কত রোমান্টিক ইন্সিডেন্ট হয়, তোরা পাত্তা দিস না। আর আমি ঘটাতে চাই, কিন্তু কিছু ঘটে না।”
অধরা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “হবে হবে। ছেলেটার সাথে আরেকদিন দেখা হলে আমি তোর নম্বর দিয়ে দেব। যেভাবে আমার সাথে কথা বলল তাতে মনে হলো প্রেম করার জন্য ডেস্পারেট হয়ে আছে।”
“শিওর?”
“আরে শিওর শিওর।”
ওদের গল্প অন্যদিকে মোড় নিল। তবে অধরা মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যেতে থাকল। বন্ধুদের সে সব বললেও কার্ডের কথাটা বলেনি। শুধু বলেছে ছেলেটা ফোন নম্বর দিয়েছে। কিভাবে দিয়েছে সেটা সেও বলেনি, ওরাও জিজ্ঞেস করেনি। কেন বলল না? ওরা কার্ড দেখতে চাইবে তাই? তারপর কেউ যদি ওর আগেই ফোন করে এই ভয়ে? ইশ্ এসব ভাবছে কেন সে?
ছুটির পর অধরা টিউশনিতে ছুটল। ক্লাস নাইনের একটা মেয়েকে পড়ায় সে। নাম সুবর্ণা৷ মেয়েটা খুবই ইন্টারেস্টিং চরিত্র। এত মজা করে কথা বলে যে ওর সাথে কথা বললে অধরার ক্লাস শেষের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ হিসেবে সুবর্ণা যতটা মজার, পড়াশোনায় ততটাই ডাব্বা। তাই ওকে পড়ানো শুরু করলে নতুন করে ঘিরে ধরে বিরক্তি আর ক্লান্তি৷
আজ ওর দুটো উপপাদ্য পড়া দেবার কথা৷ এই জিনিস এই মেয়ের মাথায় ঢোকানো সম্ভব না বুঝেই অধরা বলেছিল সোজা মুখস্থ করে ফেলতে। লিখতে দিয়ে বোঝা গেল ভালো করে মুখস্থ হয়নি৷ সুবর্ণা কাঁচুমাচু মুখে বলল, “আপু একটু বুঝিয়ে দিলে হয়তো পারব।”
অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোঝাতে শুরু করল। সে খারাপ বোঝায় না। সুন্দর করে পুরোটা বুঝিয়ে দেবার পর জিজ্ঞেস করল, “কি বুঝেছ?”
সুবর্ণা বলল, “হুম।” কিন্তু গলায় আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব।
“কোনো লাইন না বুঝলে বলো!”
সুবর্ণা পেন্সিল দিয়ে যে লাইনটা দেখাল সেটা তিন নম্বর লাইন। এটা না বুঝলে বাকিটা বোঝার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
অধরা জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি মুখস্থ করারই চেষ্টা করো আরেকবার। বুঝতে গেলে ব্রেইন খুলে পড়ে যাবে।”
সুবর্ণা খিলখিল করে হেসে বলল, “ঠিক বলেছেন আপু। আমার একটা কাজিন আছে, এখন আমেরিকা থাকে৷ ও যখন ক্লাস টেনে পড়ত, তখন ম্যাথ বোঝার চেষ্টাও করত না। প্রথমে সেটা খাতায় লিখত, দশবার পড়ত, তারপর কাগজটা ছিঁড়ে পানিতে গুলে খেয়ে ফেলত। তাহলে নাকি মাথায় ম্যাথটা পার্মানেন্টলি থেকে যেত। হি হি হি…”
“তোমারও তাই করার ইচ্ছে?”
“নাহ! আমার ইচ্ছে ওর কাছে আমেরিকা চলে যাবার৷ কিন্তু আমাকে পাত্তাই দেয় না!”
অধরা মুখ টিপে হাসি আটকে বলল, “আজকে পড়া না দিতে পারলে আন্টির কাছে বিচার দেব।”
“না না আপু, এই তো পড়ছি।”
পড়ছে বললেও পড়া দিতে পারল না সে৷ অন্য কিছুও পড়া হলো না। ওদের বাসার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অধরা আজও অন্যান্য দিনের মতো ভাবল, টিউশনিটা ছেড়ে দেবে৷ এরকম স্টুডেন্ট পড়ানো যায় না।”
আবার রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, এইতো সামনেই এক তারিখ। সুবর্ণার মা মাস শেষ হতে হতেই বেতনের খাম নিয়ে হাজির হন। খামে থাকে কড়কড়ে এক হাজার টাকার দশটা নোট। এই টাকা দিয়ে সারা মাস নিজের খরচ চলে যায় অধরার। মাকেও কিছু টাকা দিতে পারে। এই টাকার ভরসাতেই মাসের শেষে এসেও মায়ের কপালে ভাজ পড়ে থাকে না। ছোটো বোনের টুকটাক আবদারও মেটাতে পারে সে। নাহ, টিউশনি ছাড়ার কোনো মানে হয় না।
হাঁটতে হাঁটতে সে খেয়াল করল আকাশে কোথা থেকে থরে থরে মেঘ এসে সেজে উঠেছে। মেঘের রঙ ঘন কালো। অধরা বাড়ি ফেরার আগেই বৃষ্টি নামল। কাকভেজা হয়ে সে যখন বাসায় ফিরেছে তখন মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ওর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বললেন, “কতবার বলেছি ছাতা নিয়ে বের হবি। এই সময়ে বৃষ্টির কোনো ঠিক ঠিকানা আছে?”
অধরা কিছু না বলে বাথরুমে ঢুকে গেল। গোসল সেরে শুকনো কাপড় পড়ে নিজের ঘরে বসতেই আরাম বোধ হলো। ওর ঘরের হালকা রঙের চাদর, মিহি কাপড়ের পর্দা, বুকশেলফের বই, কাচের জারে মানিপ্ল্যান্ট, জানালার পাশে হাতে বানানো ড্রিম ক্যাচার সবটায় শান্তি মাখামাখি হয়ে আছে।
মা গরম চা আর টোস্ট নিয়ে এলেন। ছোটো বোন অদিতিও এসে বসল। চায়ে টোস্ট ডুবিয়ে মুখে পুরে মা আর বোনের সাথে গল্প করতে করতে অধরার সারাদিনের ক্লান্তি দূর হতে থাকল একটু একটু করে।
তার ব্যাগের বইপত্র মা বের করে শুকাতে দিয়েছেন। শুধু ছোট্ট পকেটে রাখা কার্ডটা ভিজে ন্যাতন্যাতে হয়ে গেছে। ফোন নম্বরের সংখ্যা রঙ ছড়িয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তার খবর কেউ রাখেনি।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু