মায়ামঞ্জরী পর্ব-০৩

0
1

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৩

এলার্মের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল শিশিরের। সে স্বপ্ন দেখছিল দেশে নির্বাচন হয়েছে। সে নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছে। ব্যাপক খুশি সবাই। বাবা ট্রাক ভর্তি করে মিষ্টি এনেছেন। মা দোলনায় দোল খেতে খেতে ফোনে সবাইকে খবরটা দিচ্ছেন। তাকে দ্রুত শপথ গ্রহনের অনুষ্ঠানে যেতে হবে। কিন্তু সে কোনো জামাকাপড় খুঁজে পাচ্ছে না৷ আলমারি থেকে যাই বের করছে তাই দেখছে ছেঁড়া। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। সে তাকিয়ে দেখল সেই রাস্তা পার করে দেয়া মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে প্যাকেট। মেয়েটা বলল, “স্যরি আপনাকে ফোন করতে ভুলে গিয়েছিলাম। এই নিন, আপনার জন্য একসেট জামা এনেছি। এটা পরে বঙ্গভবনে যান।” শিশির প্যাকেট খুলে দেখল ভেতরে একটা আন্ডারওয়্যার আর গোলাপী টিশার্ট৷ টিশার্টের ওপর লেখা, “It’s a hot day.”

সে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটার হাতে একটা অদ্ভূত যন্ত্র। সেটা তার কানের সামনে ধরতেই ক্রিং ক্রিং শব্দ একেবারে কানের ভেতর ঢুকে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসে সে দেখল এলার্ম বাজছে। আশেপাশে কোনো মেয়ে নেই। সে প্রধানমন্ত্রীও হয়নি। কিন্তু এত সকালে এলার্ম বাজে কেন? সোয়া চারটায় উঠে তার কী দরকার? ধুর! এদিকে স্বপ্নটা মাথা থেকে যাচ্ছেও না।

আবারও শুয়ে পড়েই মনে পড়ে গেল সব। স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠল সে। কেক আনতে হবে! ফ্রেশ হয়ে বাসার কাপড় পরেই বেরিয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। মেয়েটা লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছিল। গুগল ম্যাপ দেখে চলে যাওয়া যাবে৷

এত ভোরে সে সাধারণত বের হয় না। মনে হচ্ছে ভোর তো নয়, নিশুতি রাত। অবশ্য একটু পরেই নামাজের জন্য লোকেরা বের হতে থাকল। তার মনে হলো নামাজ পড়ে গেলে ভালো হতো। কিন্তু তাতে দেরি হয়ে যাবে।

মেয়েটার বাসা একটু ভেতরের দিকে। পাঁচটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে সেখানে পৌঁছুল সে। বাড়ির চারদিকে সীমানা প্রাচীর দেয়া। পুরানো দেয়ালে শ্যাওলা পড়ে গেছে। ওপাশে কিছু গাছপালা দেখা যাচ্ছে। কলিংবেল নেই। সে গাড়িতে বসেই অদিতি’স কিচেনের ফোন নাম্বারে ফোন করল।

মেয়েটা প্রায় সাথে সাথেই ধরে বলল, “কেক রেডি ভাইয়া৷ আপনি কি এখন আসবেন?”

“আমি আপনাদের গেটের সামনে।”

“ওকে ভাইয়া। কাইন্ডলি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি নিয়ে আসছি।”

“ওকে।”

কলটা কেটে দিয়ে শিশির গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়াল। সুন্দর ভোরের বাতাস বইছে। একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছে চারপাশ।

এদিকে অদিতি ফোন রেখে তার বড় আপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “চলে এসেছে রে! প্যাকিং করা বাকি।”

অধরা বলল, “তুই এই ঝামেলা নিলি কেন? রাত জেগে কেক বানানোর কোনো দরকার ছিল?”

“লোকটা বিপদে পড়েছিল।”

“তোর কি ঠেকা পড়েছে দুনিয়ার সবাইকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার? আগেরবার তিন রাত জেগে কেক বানিয়ে চিকনগুনিয়া হয়েছিল মনে আছে?”

“চিকনগুনিয়া মশার কামড়ে হয়েছিল, কেক বানিয়ে না।”

“চিকনগুনিয়ার মশাগুলি রাতে কাউকে না পেয়ে সবকটা মিলে তোকে কামড়েছিল। কেক না বানিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে কামড়াতো না।”

“তুমি চুপ করবে? কাজ করতে দাও প্লিজ! লোকটা আবার ফোন করবে এক্ষুনি।”

কেকটা রেডি হতে দশ মিনিট লাগল। ফোন এলো না অবশ্য এর মধ্যে। সব রেডি করার পর অদিতি একবার নিজের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে অধরার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এভাবে যাব কেক দিতে? বাবাও তো নামাজ পড়তে গিয়ে ফেরেনি।”

অধরা বোনের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর অবস্থা খারাপ। জামাকাপর কেক আর কালারে মাখামাখি। এটা অবশ্য ওর কেক বানানোর জামা। কাপড়-চোপর নষ্ট হয় বলে কেক বানানোর আগে এটা পরে নেয় সে। এখন কাপড় বদলে যাবার সময়ও নেই।

অধরা বলল, “আমি যাচ্ছি।”

“থ্যাংক ইউ।”

অধরা কেক নিয়ে বের হয়ে বাইরের গেট খুলে উঁকি দিল। আধো আলোতে ছেলেটাকে দেখা গেল। কালো টিশার্ট আর ট্রাউজার পরা এলোমেলো চুলের একটা ছেলে। ঘুম থেকে উঠেই বোধহয় চলে এসেছে। আবার আস্ত গাড়িও নিয়ে এসেছে! বাব্বাহ! এখন সে মনোযোগ দিয়ে তাদের সীমানা প্রাচীর বেয়ে ওপাশে নেমে যাওয়া মধুমঞ্জরী ফুল দেখছে।

অধরা ডাকল, “এক্সকিউজ মি!”

শিশির এগিয়ে আসতেই একটা ধাক্কা খেল। আরে এটা তো সেই মেয়েটা। ভুল দেখছে না তো? সে চোখ কচলে আবার তাকাল। না, চেহারা বদলে যায়নি। ওই মেয়েই।

এদিকে অধরা প্রথমটায় ছেলেটাকে চিনতে পারেনি। তবে কয়েক সেকেন্ড দেখতেই মনে পড়ে গেল। এই শুনশান ভোরবেলা ছেলেটাকে দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। এ তো কালকের ছেলেটা! তাকে ফলো করে আসেনি তো? এর উদ্দেশ্য কী? তার পেছনে কেন পড়েছে? তাকে কিডন্যাপ করতে চায়? এজন্য গাড়ি নিয়ে এসেছে? এই ছেলে কি গুন্ডা দলের কেউ? সে কাকে কী করেছে? গত মাসে ছাত্র ইউনিয়নের লিডার টাইপ এক গুন্ডামার্কা ছেলেকে সে জুতো দেখিয়েছিল বাজে প্রস্তাব দেয়ার জন্য৷ সেই ছেলে কি একে পাঠিয়েছে? এরকম আদুরে দেখতে একটা ছেলে কেমন করে গুন্ডা হতে পারে? এসব ভাবতে ভাবতে ফ্রিজ হয়ে গেল অধরা।

শিশিরই প্রথমে কথা বলল। কিন্তু প্রথম চেষ্টায় পারল না৷ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় বলল, “অদিতি’স কিচেন?”

অধরা ভয়ে ভয়ে মাথা ওপর নিচ করল। তার নজর ছেলেটার হাতের দিকে। কোনো ছুরি চাকু বা এসিড তো দেখা যাচ্ছে না। পকেটে নেই তো?

শিশির বলল, “আমিই কেক কর্ডার দিয়েছিল।”

অধরা যন্ত্রের মতো কেক এগিয়ে দিল। শিশির মানিব্যাগ করতে পকেটে হাত দিতেই অধরা চেঁচিয়ে পেছনে সরে গেল। শিশির অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। “কী হয়েছে?”

অধরা দোয়া পড়তে পড়তে তাড়াতাড়ি গেট বন্ধ করে দিল। শিশির হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা কি পাগল নাকি? আহারে! এত মায়াবী একটা মেয়ে মেন্টালি চ্যালেঞ্জড? এজন্যই বোধহয় রাস্তা পার হতে পারছিল না। এরা বাড়ি থেকে বের হয় কেন যে! সে কেকটা খুলে দেখল। চমৎকার হয়েছে! যারা স্বাভাবিক হয় না তারা হাতের কাজ দারুণ পারে এর আরেকটা প্রমাণ পাওয়া গেল। কিন্তু টাকা নিল না কেন?

ফোন করল সে। কেউ ফোন রিসিভ করল না। টাকা যদিও পরে পাঠিয়ে দেয়া যাবে, তবে মনটাই খারাপ হয়ে গেল শিশিরের। এটা সে মোটেও আশা করেনি। সারা রাস্তা সে শুধু ‘আহারে! আহারে!’ বলতে বলতেই গেল।

অধরা এদিকে এক ছুটে ভেতরে ঢুকে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগল, “ও একটা গুন্ডা। আমাকে দু’দিন ধরে ফলো করছে। আজকে খুন করতে এসেছিল।”

অদিতি হা হয়ে তাকিয়ে রইল। “অ্যাঁ! গুন্ডা? কোথায় গুন্ডা?”

“বাইরে।”

“বলো কী! আমার কেক কোথায়?”

“নিয়ে গেছে।”

“কে নিয়ে গেছে?”

“গুন্ডা।”

অদিতি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। গুন্ডা কেক নিয়ে গেলে সে কাস্টোমারকে দেয়ার জন্য আরেকটা কেক পাবে কোথায়?

এমন সময় কাস্টোমারের ফোনটা এলো। অদিতি ভয়ে ফোন ধরল না। ধরে কী বলবে? আচ্ছা লোকটা না বলল বাইরেই আছে? সে গুন্ডার খপ্পরে পড়ল না তো?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু