মায়ামঞ্জরী পর্ব-০৪

0
5

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৪

ইভা ফ্যাশন ডিজাইনিং হাউজটাতে চাকরি নিয়েছে এক সপ্তাহ হলো। তার কাছে ফ্যাশনের চেয়ে স্পোর্টস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সবসময়। কিন্তু যতই ডেডিকেশন থাকুক না কেন, ভাগ্য সবসময় সবার সাথী হয় না। স্পোর্টসে তাই খুব একটা সুবিধা হয়নি। তবুও সুযোগ পেলেই সাঁতার কাটতে কিংবা বাস্কেটবল খেলতে চলে যায় সে৷ ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের একটা কোর্স সে করেছিল কলেজে থাকার সময়, সেই সুবাদেই ছোট্ট একটা হাউজে চাকরিটা হয়ে গেছে। বেতন অল্প, তবে তার একার ঠিকই চলে যাবে৷ ভেবেছিল জীবনটা এবার তার নির্ঝঞ্ঝাট কাটবে। কিন্তু ঝামেলা শুরু করেছে একটা অদ্ভূত লোক।

লোকটা প্রথম দেখাতেই তাকে একটা কার্ড দিয়ে বসেছে যেখানে তার পরিচয় এবং ব্যক্তিগত সেলফোন নম্বর দেয়া। সে একজন ডিটেকটিভ। তার সাথে ডিটেকটিভের কী দরকার ইভা বুঝতে পারছে না। তার ওপর লোকটা তাকে ফলো করছে। পরপর চারদিন সে লোকটাকে তার অফিস বিল্ডিংয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখেছে। সে চাইছেটা কী? সত্যিই কি লোকটা ডিটেকটিভ নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? দেখতে শুনতে তো ভালোই। কিন্তু ব্যবহার সুবিধার মনে হচ্ছে না।

এসব ভাবতে ভাবতে একমনে কাজ করছিল ইভা। হঠাৎ তার ফোনে একটা কল এলো। ইভা কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো কথাগুলো। “মিস ইভা, আমি ডেভিড। ডেভিড স্পাইক। গত সোমবার আমাদের লিফটে দেখা হয়েছিল। আপনি আজ আমার সাথে দেখা করবেন প্লিজ? ইটস আর্জেন্ট। আপনার অফিস বিল্ডিংয়ের তিন তলায় যে কফিশপ আছে সেখানে আমি বসে থাকব ঠিক পাঁচটা৷ পাঁচটায়ই তো আপনার ছুটি হয় তাই না? প্লিজ আসবেন। খুবই জরুরি।”

ইভাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কলটা কেটে দিল ডেভিড। ইভা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে চেয়ে রইল। এত জরুরি ভিত্তিতে লোকটা তার সাথে দেখা করতে চাইছে কেন? তার কী করা উচিত? দেখা করা? নাকি পাঁচটার আগেই বাড়ি চলে যাওয়া?

বাড়ি চলে যাবার ইচ্ছেটা বাতিল করে দিল ইভা। ডিটেকটিভ লোকটা পরে খুঁজে খুঁজে ঠিকই তার বাড়িতে চলে যাবে। তখন কী হবে? তারচেয়ে দেখা করে সোজাসুজি কথা বলে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলাই ভালো।

*******

শিশির ফিরে দেখল বাবা মাত্র নামাজ পড়ে এসে বারান্দায় বসেছেন। মা চা বানাচ্ছে রান্নাঘরে। সে কেকটা টেবিলে সাজিয়ে রেখে রান্নাঘরে এসে মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যাপি এনিভার্সারি মা।”

মা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, “সেকি! কার?”

“কার আবার? তোমার আর বাবার।”

“কত তারিখ আজকে?”

“আগস্টের বারো তারিখ।”

মা কয়েকবার চোখ পিটপিট করে বললেন, “ওমা তাই তো! দেখেছিস, ভুলে গেছি!”

শিশির হেসে বলল, “তোমরা এমন উল্টো কেন বলো তে? কোথায় বাবা সব দিন তারিখ ভুলে যাবে, আর তুমি মনে করিয়ে দেবে, মনে না রাখার অপরাধে বাবার সাথে দু’দিন কথা না বলে গাল ফুলিয়ে রাখবে তা না, তুমিই সব ভুলে বসে থাকো।”

রান্নাঘরের দরজা থেকে বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন মা ছেলের কথা। বললেন, “তোর সাহস তো কম না, মাকে উল্টোপাল্টা বুদ্ধি দিচ্ছিস। মন্থরার জেন্টস ভার্সন!”

শিশির মুখ টিপে হেসে বলল, “হ্যাপি এনিভার্সারি।”

“থ্যাংস। এখান আমরা এখানে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি কেকটা কাটব?”

“তুমি কেক দেখেও ফেলেছ?”

“একটুখানি ভেঙে খেয়েও ফেলেছি। ভালো কেক। চলো কবিরের মা কেকটা কেটে ফেলি তাড়াতাড়ি।”

মা একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, “ধুর এই বয়সে আবার এসব কেন?”

শিশির মায়ের কাঁধ জড়িয়ে টেনে নিতে নিতে বলল, “কত বয়স হয়েছে তোমার বলোতো? আশি নাকি নব্বই?”

“যাহ! জ্বালাস না তো!”

কেক কাটা শেষে বাবা এক পিস শিশিরকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন, “তোর ওপর রাগ করতে আমার একটুও ভালো লাগে না। রাগ করার মতো কাজ করিস না আর।”

“চেষ্টা করব বাবা।”

বাবার সাথে সব ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ায় শিশিরের মনের মেঘ দূর হয়ে গেল। মায়ের চা বানানো হয়ে গেছে। সে চায়ের কাপ হাতে পত্রিকা খুঁজতে গেল। এই বাড়িতে দুটো পত্রিকা রাখা হয়। একটা ইংরেজি, একটা বাংলা। বাংলাটা বাবা পড়েন, সে পড়ে ইংরেজিটা৷ এক হাতে পত্রিকা আর এক হাতে চা নিয়ে সে চলে গেল ছাদে। সকালের রোদে বসে চা খেতে খেতে খবর পড়তে বেশ লাগে! এ সময় সে ফোন সাথে রাখে না। রাখলে দেখতে পেত বেশকিছু কল এসেছে একটা অচেনা নাম্বার থেকে।

যদিও খবরে তেমন একটা মনোযোগ দিতে পারল না সে। মাথায় সকালের মেয়েটা ঘুরতে লাগল। সে আবারও বিড়বিড় করে বলল, “আহারে!”

******

অধরা যখন নিজের ভুলটা বুঝতে পারল তখন চারদিকে রোদ ঝিকমিক করছে। অদিতি স্বচ্ছ কাচের জারে রাখা মানিপ্ল্যান্টের পানি বদলে দিয়েছে। সকালের রোদে চকচক করছে সেটা। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল অধরা। কী করল সে এটা?

তাদের চেঁচামেচি শুনে মা তখন ছুটে এসেছিলেন৷ সব কথা খুলে বলার সময় তার নিজেরই মনে হয়েছে সে সব গুবলেট করে ফেলেছে। শুনশান সকালে আধো অন্ধকারে পরিবেশের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়েই কি না কে জানে, সে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরে অদিতি ছেলেটার ফেসবুক আইডি থেকে ছবি বের করে চেহারা দেখালে সে নিশ্চিত হয়ে বলেছে, এই ছেলেটাই কেক নিয়েছে। অদিতি তখন তাকে ছেলেটার প্রোফাইল দেখিয়েছে। এই ছেলের গুন্ডা হবার সম্ভাবনা জিরো পারসেন্ট।

তখন থেকেই নিজের কাজের জন্য লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে অধরার। মনে হচ্ছে পাতালে ঢুকে পড়তে পারলে ভালো হতো। কিশোরী বয়সে একবার এমন লজ্জার কাজ করেছিল সে। কলেজ থেকে ফিরে বসার ঘরে ঢুকতেই দেখেছিল এক লোক তার বাবার মোবাইলটা চার্জার থেকে খুলে নিচ্ছে। সে হঠাৎ ভেবেছে লোকটা চোর। ‘চোর! চোর!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠার করার পর মা এসে একটা চড় দিয়ে ওকে নিয়ে গেছেন। পরে সে জানতে পেরেছিল লোকটা বাবার বন্ধু। সদ্য বিদেশ থেকে এসেছেন বলে সে চিনত না। তিনি নিজের মোবাইল চার্জ দেবার জন্য বাবারটা খুলছিলেন। কী লজ্জার ব্যাপার! কোট পরা একটা লোককে সে চোর ভেবে বসল!

সেরকম লজ্জা সে আবার নতুন করে পেল। ঝকঝকে গাড়িতে চড়ে আসা ভদ্রলোককে সে গুন্ডা ভেবে মুখের ওপর দরজা আটকে চলে এলো!

বাবার সেই বন্ধুকে সে স্যরি বলতে পারেনি। অনেক চেষ্টায়ও তাকে ওনার সামনে নেয়া যায়নি। কিন্তু এই ছেলেটাকে স্যরি বলা উচিত। হাজার হোক, বোনের ক্লায়েন্ট৷ বোনের বিজনেসটা যদি নষ্ট হয়? যদি ছেলেটা নেগেটিভ রিভিউ দেয়? অন্তত বোনের খাতিরে স্যরি বলবে সে।

অদিতির কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে সে শিশিরের নাম্বারে ফোন করল। শিশির ধরল না৷ অনেকবার কল করার পরেও যখন পেল না তখন অধরা মোবাইল রেখে চলে গেল রান্নাঘরে। এসব চিন্তা থেকে বাঁচার একটাই উপায়। রান্না করা। রান্নাবান্না করলে মানসিক অশান্তি কমে।

কিন্তু খুব একটা সুবিধা হলো না। মাথায় সেই ছেলেটাই ঘুরতে থাকল। রান্নাঘরে মিনিট পনেরো এটা সেটা ঘাঁটাঘাঁটি করেও সে ঠিক করতে পারল না কী রাঁধবে! এমন সময় ফোনের শব্দে দৌড়ে নিজের ঘরে গেল। শিশিরের কল!

খানিকটা শঙ্কা নিয়েই কলটা ধরল সে। “হ্যালো।”

“কে বলছেন? কল এসেছিল আপনার নাম্বার থেকে।”

“জি। আমি অধরা।”

“অধরা… স্যরি চিনতে পারছি না। কোন অধরা?”

“আর সকালে আপনি কেক নিয়ে গেলেন যার কাছ থেকে…”

“ওহ আচ্ছা! কিন্তু আপনি অধরা নাকি অদিতি?”

“অদিতি আমার ছোটো বোন। ওই কেক বানায়৷ আমি জাস্ট দিতে গিয়েছিলাম আপনাকে।”

“ওহ আচ্ছা।”

“আমার আচরনের জন্য স্যরি। আসলে…”

“আসলে?”

“আসলে আমি ভেবেছিলাম…”

“কী ভেবেছিলেন?”

“ভেবেছিলাম আপনি গুন্ডা।”

“হোয়াট?”

অধরা ঢোক গিলে বলল, “আই অ্যাম সো স্যরি! গতদিন আপনার সাথে দেখা হলো, আবার আজ আমাদের বাড়িতে এলেন বলে ভুল বোঝাবুঝিটা হয়েছে।”

“আমাকে গুন্ডা ভেবে আপনি চিৎকার করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন?”

অধরা চোখ বুজে ফেলে বলল, “হুম।”

“আর ইউ ইনসেইন?”

অধরা কিছুই বলল না। ছেলেটা এখন বাড়াবাড়ি করছে। সে স্যরি বলার পরেও এভাবে কেন কথা বলছে?

অবশ্য আওয়াজটা বদলে গেল দ্রুতই। ছেলেটা বলল, “আই অ্যাম স্যরি টু!”

“হোয়াই?”

“আমি আপনাকে পাগল ভেবেছিলাম।”

“মানে?”

“মানে আপনার ব্যবহারটাই ওরকম ছিল।”

অধরা ঠোঁট কামড়ে ব্যাপারটা হজম করে বলল, “ইটস ওকে!”

“ইটস ওকে টু!”

“ওকে বাই।”

“বাই মিস অধরা।”

“আপনি কিভাবে জানলেন আমি মিস?”

“ওহ স্যরি, আপনি মিসেস?”

“আমি মিস নাকি মিসেস সেটা জানার দরকার কী? ফোন রাখছি।”

“আমি ফোন রেখেই দিচ্ছিলাম, আপনি কথা বাড়ালেন।”

“আচ্ছা আমার ভুল হয়েছে, স্যরি।”

“বাই মিস কিংবা মিসেস স্যরি।”

“জি?”

“আপনার নাম আমি ‘স্যরি’ লিখে সেভ করে রাখছি।”

“তার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার সাথে এটাই আমার শেষ কথা।”

“শেষ নাকি শুরু সেটা সময় বলে দেবে।”

“ওকে বাই।”

“বাই মি…”

শিশিরের কথা শোনার অপেক্ষা করল না আর অধরা। ফোন কেটে দিল। দিয়ে নিজেই বলল, “মামলা ডিসমিস! কেস ক্লোজড!”

কিন্তু যতই কেস ফাইল বন্ধ করে দিক না কেন, মনের ভেতর সকালের কথাই ঘুরেফিরে আসছে। আচ্ছা ছেলেটা না একটা কার্ড দিয়েছিল? সে কার্ডটা ব্যাগের ছোটো পকেট থেকে বের করে দেখল গতকাল বৃষ্টিতে ভিজে সেটা রঙ ছড়িয়ে নষ্ট হয়ে গেছে৷ এর থেকে লেখা উদ্ধার করা সম্ভব না। অবশ্য কার্ড দিয়ে এখন করবেই বা কী? নাম্বার আর ফেসবুক আইডি তো সে জানে!

সে নিজের অজান্তেই কখন শিশিরের ফেসবুক আইডি বের করে স্ক্রল করা শুরু করল নিজেও বুঝতে পারল না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু