#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-১১
শিশিরের কথা প্রথমটায় অধরার মাথাতেই ঢুকল না। এ বলছেটা কী? পাগল টাগল হয়ে গেল না তো? শিশিরের দিকে বেশ কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে থেকে অধরা নিশ্চিত হয়ে গেল যে শিশির সত্যিই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেও স্বপ্নে ঘটছে না, একেবারে বাস্তবে দিনের আলোতে হচ্ছে। শিশির দাঁড়িয়ে আছে অত্যন্ত সিরিয়াস ভঙ্গিতে। যেন এইমাত্র সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করে ফলাফল জানার অপেক্ষায় আছে। অধরা বড় করে শ্বাস টেনে মগজে বেশি করে অক্সিজেন ঢোকানোর চেষ্টা করল। মস্তিষ্কের কোষগুলো জড়তা কাটিয়ে কাজ করতে শুরু করল হঠাৎ খাওয়া ধাক্কা সামলে নিয়ে। অধরা শিশিরের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে ধীর স্বরে বলল, “না।”
শিশির ভাবেনি অধরা সরাসরি না বলে দেবে। সে ভেবেই নিয়েছিল অধরা হয়তো একটু লজ্জা পাবে, ছুটে পালিয়ে যাবে, তারপর জোরাজুরি করলে বলবে, পরে ভেবে জানাচ্ছি। কিন্তু এ তো সোজা না করে দিল! শিশিরের জীবনে অল্প ক’টা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে এটা একটা৷
শিশির যে একটু বেশিই আত্মবিশ্বাস অর্জন করে ফেলেছিল তার কারন তার নিজের প্রতি গর্ব নয়, বরং বলা যায় তার আশেপাশের মানুষেরাই তার সম্পর্কে সবসময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে তাকে এমন এক মানসিক স্থিতিতে নিয়ে গেছে যেখানে থেকে সে ভাবতেই পারে না যে তানজিব আহমেদ শিশির কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যান হতে পারে! সে খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে অধরার দিকে চেয়ে বলল, “কেন?”
অধরা বেশ রেগে গিয়ে বলল, “আপনার বাড়িতে এসেছি বলে আপনি যা খুশি তাই বলতে পারেন না। একজন ভদ্রলোকের কাছে আমি এরকম কোনোকিছুই আশা করি না। দেখুন, আপনার সাথে আমার ফেক আইডি দিয়ে মজা করাটা উচিত হয়নি। কিন্তু তার মানে এই না যে প্রতিশোধ নেবার জন্য আপনি আমার সাথে এত নোংরা মজা করবেন। আমি আপনাকে স্যরিও বলেছি৷ তারপরেও কি আর কোনো কথা থাকে? আপনি আমার সাথে যা করলেন সেটা ঠিক করলেন না৷ আপনার থেকে আমি এটা আশা করিনি।”
কথাগুলো বলে চোখমুখ শক্ত করে অধরা নিচে নেমে গেল। শিশির বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কী ভেবেছিল আর কী হলো! এরকম হতে পারে তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। মানুষ এত অপ্রত্যাশিত কেন হয়? এই মেয়ে যে অভদ্র তা তার প্রথমদিনেই বুঝে যাওয়া উচিত ছিল। খামোখা এর পেছনে সময় নষ্ট করে নিজের ইমেজের চৌদ্দটা বাজানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। শিশিরের ইচ্ছে হলো নিজের গালে নিজেই চড় মারতে।
সে নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তেধীরে নিচে নামল সন্ধ্যা নামার পরে।
***********
অদিতি কেকটা নিয়ে বেশ ঝক্কিতে পড়ে গেছে। এত বিশাল কেক সামলাতে গিয়ে তার ঘাম ছুটে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে গেছে। বড় কেকটা আইসিং করতে গিয়ে সে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে৷ একদিক দিয়ে সুন্দর ফিনিশিং এলে অন্যদিকে আসতে চায় না। আবার একদিক উঁচু একদিক নিচু এমন ঝামেলা তো হচ্ছেই। সে ভাবল দুটো মিনিট বিশ্রাম নিয়ে নেবে। আসার পর থেকে খাওয়া বাদে আর থামেনি অদিতি। মনে হচ্ছে বিশাল এক রেসে অংশ নিয়ে ফেলেছে সে। দৌড়ে এসেছে কয়েক হাজার মাইল।
সে একটু বসতেই দেখল অধরা ঢুকছে। ওর চোখমুখ অন্ধকার৷ তবে অদিতি নিজের ক্লান্তিতে বোনের দিকে নজর দিতে পারল না৷ বলল, “আপু একটু এদিকে আসবে?”
অধরা এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালে অদিতি অধরার গায়ের ওপর শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল। ক্লান্তি দূর করে নতুন করে কাজ করার উদ্যম ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল। এখন সবচেয়ে কঠিন অংশটাই বাকি। ডেকোরেশন ভালো না হলে সব পরিশ্রম বৃথা যাবে!
অধরা অদিতির মাথা টিপে দিল কিছুক্ষণ। পাঁচ মিনিট হতেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অদিতি। কাজ বাদ দিয়ে বিশ্রাম করলে সেটাও সহ্য হয় না। গা জ্বালা করে তার। আবার কাজ শুরু করল সে৷ অধরা একটু আধটু সাহায্য করল।
কেক রেডি হতে হতে দেখা গেল মেহমান আসতে শুরু করেছে। বাইরে শব্দ শোনা যাচ্ছে অনেকগুলো সম্মিলিত গলার। শিশিরের মা এসে দেখে গেলেন কেকের অগ্রগতি কতদূর। বলে গেলেন, “রিলাক্সে কাজ করলেও হবে। খাওয়াদাওয়ার পর কেক কাটা হবে।”
তিনি বেরিয়ে গেলে অদিতি কেকটার দিকে ভালো তাকিয়ে বলল, “আপু, এটা কি আদৌ আজকে শেষ হবে?”
“হবে হবে। তুই করতে থাক, দেখবি হয়ে যাবে।”
অতিথিদের ডিনারের সময় হয়ে একে শিশিরের মা ওদের খেতে ডাকতে এলেন৷ ওরা জানিয়ে দিল দু’জন পরে খাবে। কেকটা আগে শেষ হোক।
অদিতি বলল, “ডিনার আর কতক্ষণ লাগবে বলো? তারপরই কেক খুঁজবে। ডেকোরেশন তো বাকি।”
“চিন্তা করিস না তুই, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
অদিতি ঠিক করেছিল পুরোটা ফ্লোরাল হবে, অনেক রকমের ফুল তৈরির নজেল এনেছিল সে৷ কিন্তু সেটা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সে ভাবেনি কেকের বেস তৈরি করতে এত সময় লাগবে। এখানে কম সময় লাগলে ওই ডিজাইন সহজেই হয়ে যেত।
অধরা এই ফাঁকে নজেলগুলো একটা একটা করে পরীক্ষা করে দেখল কোনটা দিয়ে কেমন ডিজাইন বের হয়৷ তারপর দুটো সিলেক্ট করে বলল, “এইযে এটা দিয়ে চারপাশে লাইনিং করে দে৷ আর এই ফুলটা মাঝে মাঝে বসিয়ে দিবি। পুরো কেক ফুল ফুল করার সময় নেই।”
“আচ্ছা।” অদিতি মেনে নিল, যেহেতু তার মাথা আপাতত কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
অদিতি লাইনিং দিতে দিতে অধরা কেকের মাঝে মাঝে মার্ক করে ফেলল যেখানে যেখানে ফুল বসানো হবে। তাতে অদিতির কাজ সহজ হয়ে গেল। ফুল তোলা শেষ হলে তার ওপর ছড়িয়ে দেয়া হলো ছোটো মাঝারি আর বড় সাইজের এডিবল চকোলেট বল যেগুলো কেক বেক হবার ফাঁকে অদিতি বানিয়ে রেখে দিয়েছিল ফ্রিজে।
সব মিলিয়ে বেগুনী লাইনিং দেয়া হালকা বেগুনী ফুল আর সোনালী বল দিয়ে সাজানো কেকটা বেশ ভালোই দেখতে হলো। সিম্পল হলেও দেখতে ভালো লাগছে৷ অদিতি দেখেশুনে বলল, “নাহ, খারাপ হয়নি৷ একটা চোখের আরামের মতো কেক হয়েছে। গর্জিয়াছ করতে চেয়েছিলাম, এটা সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াছ হয়ে গেছে।”
অধরা হেসে ফেলল ওর কথা শুনে। তখনই তাকিয়ে দেখল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে শিশির।
অদিতি তাকে দেখে একটু কাঁচুমাচু মুখে বলল, “ভাইয়া, কেকটা যেমন চেয়েছিলাম তেমন হয়নি। পুরোটা দেখলে কেমন যেন একটা সমস্যা মনে হয়।”
শিশির ভালো করে এপাশ ওপাশ থেকে দেখে বলল, “সাইজটা কিছুটা বিসদৃশ হয়েছে, তবে ডেকোরেশন খারাপ হয়নি৷ তারচেয়ে বড় কথা কেকের ডিজাইনের চেয়ে স্বাদটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
সে কয়েকজনকে নিয়ে এসেছিল কেক নিয়ে যেতে। শিশির চলে গেলে অধরা স্বস্তি পেল, তবে অদিতির টেনশন শুরু হয়ে গেল। স্বাদের ব্যাপারটা সে তেমন ভাবেনি। তার তৈরি কেকের স্বাদ নিয়ে অন্তত কোনোদিন কোনো অভিযোগ আসেনি। তাই একপ্রকার নিশ্চিন্তই ছিল সে। কিন্তু এত বড় কেকের ক্ষেত্রে সেই সুনাম থাকবে তো? এত লোকের সামনে পরিবেশন করা হবে কেক! ভাবতেই কেমন যেন হাত পা শিরশির করে উঠছে অদিতির।
ওরা দুই বোন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। পুরো লন লোকে লোকারণ্য। এত লোক আসবে তারা ভাবেনি৷ সবাই স্যুটেড বুটেড ব্যবসায়ী লোকজন। বাইরেই একপাশে বুফে খাবার আয়োজন করা হয়েছে৷ খাওয়াদাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে৷ এবার হয়তো কেক কাটা হবে।
শিশিরের মা ওদের কথা ভোলেননি৷ এসে জিজ্ঞেস করলেন, “এবার খাবে তো? চলে এসো।”
অদিতি বলল, “এভাবে যাব?”
অদিতির অবস্থা পুরোপুরি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। আন্টি ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বললেন, “তোমার যদি আনইজি লাগে তাহলে বাইরে যেতে হবে না। এখানেই বসো। আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি৷”
একটু পর নাসিমা ওদের জন্য খাবার নিয়ে এলো। ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার পর্ব শেষ হলো ওদের। খাওয়ার মাঝেই সম্মিলিত কন্ঠে হ্যাপি বার্থডে রব আর হাততালি শোনা গেল। বুঝল কেক কাটা হচ্ছে। অদিতির গলায় খাবার আটকে যেতে থাকল। কোনোক্রমে খাবার শেষ করে উঠল ওরা৷ এমন সময় আন্টি হাসিমুখে দুজনের জন্য কেক নিয়ে ঢুকে বললেন, “কেকটা সবাই খুব পছন্দ করেছে। এত ফ্রেশ আর মজা ছিল কেকটা! সবাই জিজ্ঞেস করছে কোথা থেকে নিয়েছি আমরা৷ শিশির বলেছে সবাইকে তোমার পেজটা রেফার করে দেবে। থ্যাংক ইউ অদিতি এত মজার কেক খাওয়ানোর জন্য।”
কথাগুলো বলে আবার বাইরে ছুটলেন তিনি। অদিতি ততক্ষণে স্বস্তিতে গা এলিয়ে দিয়েছে। বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষে এখন মন চাইছে ঘুমিয়ে পড়তে। মনের আরাম পেয়ে গেছে, এখন শরীরের আরাম প্রয়োজন।
অতিথিরা বিদায় নেবে হয়তো একটু পর। ঘড়িতে নয়টা বাজে। অধরা উসখুস করতে শুরু করেছে। মা একটু পরপর ফোন করে জানতে চাইছেন ওরা বের হয়েছে কি না। অধরা অদিতিকে বলল, “চল আমরা চলে যাই৷ শিশির এই সব গেস্ট বিদায় করে তারপর আমাদের দিতে যাবে। ততক্ষণে আমরা বাসায় গিয়ে শুয়ে পড়তে পারব।”
অদিতিও সম্মত হলো। কথাটা শিশিরে মাকে বলতেই তিনি হা হা করে উঠলেন৷ “না না কিছুতেই না৷ এত রাতে দুটো মেয়েকে আমি একা ছাড়ব না। ড্রাইভারের সাথেও আমি তোমাদের পাঠাতে রাজি নই। আমার ছেলে পৌঁছে দেবে তোমাদের। অপেক্ষা করো আরেকটু।”
এরপর আর কথা চলে না। ওরা আরো আধঘন্টা বসে থাকার পর শিশির মোটামুটি ফ্রি হলো। এখনো কিছু মেহমান আছেন, হয়তো তারা তত গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়। তাই শিশির এলো ওদের বাড়ি পৌঁছে দিতে। অধরা খেয়াল করল শিশির ওর দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত।
গাড়িতে এখন আর সকালের মতো বসা হলো না। অদিতি নিজেই গিয়ে শিশিরের পাশে সামনের সিটে বসে পড়ল। অধরা পেছনে বসে ভাবল ভালোই হলো।
গাড়ি চলতে থাকল। অদিতি আর শিশির কেক বিষয়ক বকবক করতে থাকল। অধরার একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে ভালো লাগল, শিশির তার ওপরের রাগ বা বিরক্তির কিছুই অদিতির ওপর প্রকাশ করেনি।
যেতে যেতে একটা আইসক্রিম পার্লার দেখে অদিতি পেছনে ফিরে বলল, “আপু, এখানকার কথাই তোমাকে বলি। তুমি তো আসো না। যা মজা এখানকার বাটারস্কচ ফ্লেভারের আইসক্রিমটা!”
শিশির গাড়ি থামিয়ে বলল, “খাবে? দোকান তো খোলা এখনো।”
“আরে না ভাইয়া। আমি আপুকে দেখালাম জাস্ট৷ আমি বান্ধবীদের সাথে দুবার এসেছি, ওর কাছে গল্প করেছি তাই আরকি…”
শিশির বলল, “আরে চলো, ভারী খাবার পর আইসক্রিম খেলে খারাপ লাগবে না। তাছাড়া গরমও লাগছে।”
সে নেমে পড়লে অদিতি আর অধরাও নামল। অধরা গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। শিশির আর অদিতি ভেতরে ঢুকে গেল। একটু পর দেখা গেল শিশির দুটো কোণ হাতে বেরিয়ে এসেছে। অদিতি নেই। অধরা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “অদিতি কোথায়?”
“ওয়াশরুমে। বানিয়ে ফেলেছে বলে দুটো নিয়ে এলাম। নিন।”
অধরার সংকোচ বোধ হচ্ছিল। তবে সে আইসক্রিম নিল। শিশির ওর পাশে দাঁড়িয়ে গাড়িয়ে হেলান দিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে বলল, “প্রত্যেকটা মানুষেরই একটু আধটু সম্মান থাকে। কেউ কোনো প্রপোজাল দিলে সেটা রিজেক্ট করারও ভদ্রতা থাকে। কেউ প্রপোজ করলে তাকে অপমান করাটা অভদ্রতার পরিচয়, আপনার কাছ থেকে যেটা কখনোই আশা করিনি।”
অধরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তবে অদিতি চলে আসায় আর বলা হলো না।
এরপর ওরা চুপচাপ আইসক্রিম শেষ করে গাড়িতে উঠল। ওদের পৌঁছে দিয়ে শিশির আর ভেতরে ঢুকল না, চলে গেল গাড়ি ঘুরিয়ে।
সেই রাতে অধরার নাম্বার থেকে শিশিরের কাছে একটা মেসেজ গেল, “শুনুন, আমি অতি মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ একটা মেয়ে। দেখতেও আহামরি কিছু নই। আপনার স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আমার কোনোভাবেই যায় না। এ ধরনের অসম সম্পর্কগুলোই বিবাহিত জীবনে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা বয়ে আনে। আমার তখনকার ব্যবহারে আপনি হয়তো ভাবছেন আমি অভদ্র। কিন্তু আমার জায়গায় থাকলে আপনি বুঝতে পারতেন আপনার অবস্থানের একটা মানুষ আমার অবস্থানের কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনই উদ্ভট। তার ওপর আমাদের পরিচয় পর্ব খুবই সংক্ষিপ্ত। আপনাকে আমি ঠিকমতো চিনি না। দুম করে বিয়ের কথা বলে ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান হবার আশা করাটাই তো ভুল।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-১২
এক ছুটির সকালে ইভা উপহার পাওয়া ডায়েরিটা নিয়ে বসল। তার অনেক কথা জমে আছে। চাইলে লিখে পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলতে পারে অনায়েসে। কিন্তু কখনো লেখার শখ হয়নি। আজ মনে হচ্ছে আরো আগে শুরু করা উচিত ছিল লেখা। লিখতে লিখতে তার মনের ভার কমে আসছে ক্রমশ। বুকের ভেতর শত বছরের পাক খেতে থাকা হাহাকার বেরিয়ে আসছে কলমের খোঁচায়৷ সে লিখছে-
“আমার জন্মের আগে মা ঠিক করে রেখেছিলেন আমার নাম রাখা হবে স্নো। কারন যেদিন বাবা মাকে প্রপোজ করেছিলেন সেদিনটাতে সেই বছরের প্রথম তুষারপাত হয়েছিল। মা ভেবে নিয়েছিলেন তার ভালোবাসার প্রথম সাক্ষী তুষার, তাই মেয়ের নাম হবে স্নো। মা কিভাবে যেন জানতেন আমি মেয়ে হয়ে জন্মাব। কিন্তু স্নো নামের অধিকারী আমি আর হতে পারিনি। মা আমার নাম রাখতে পারেননি। আমি জন্মানোর সময় মায়ের আয়ু ফুরিয়ে গিয়েছিল। যে হসপিটালে আমার জন্ম, সেখানেই আমার মায়ের মৃত্যু। সেই একই বেডে, একই দিনে। কী অদ্ভূত! আমি কোনোদিন জন্মদিন পালন করতে পারি না। কারন দিনটা আমার মায়ের মৃত্যুদিনও। আমি সেই দিনে ফিরে গিয়ে নিজের জীবনের আয়ুটুকু ভাগ করে মা’কে দিত চাই। কিন্তু পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর। সে আমার ইচ্ছে পূরন করবে না কোনোদিন। যেমন মায়ের শেষ ইচ্ছে খালা পূরন করেননি। বাবার স্মৃতিও জড়িয়ে আছে বলে তিনি আমার নাম স্নো না রেখে রেখেছিলেন ইভা।
মায়ের ব্যাপারে আমি যতটুকু জেনেছি তার পুরোটাই খালার কাছে। খালা আমাকে মানুষ করেছেন নিজের সন্তানের মতো আদর দিয়ে। খালা বিয়ে করেননি। তার নাকি বিয়ের শখই হয়নি কোনোদিন। হয়তো বড় বোনের থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন।
আমার বাবার নাম জোসেফ পার্কার। তিনি কী করতেন, কেমন দেখতে ছিলেন কিছুই খালা আমাকে বলেনি। তিনি বেঁচে আছেন কি না তাও আমি জানি না। বাবার সাথে মায়ের সম্পর্ক হয়েছিল আমার জন্মাবার দু’বছর আগে। আমার মা বাবার প্রেমে পড়েছিলেন গভীরভাবে। তার ভালোবাসায় কোনো খাঁদ ছিল না। বাবাকে পাঠাতে না পারা মায়ের কিছু চিঠি আমি খুঁজে পেয়েছিলাম মায়ের জিনিসপত্রের মধ্যে। সেগুলো পড়েই আন্দাজ করতে পারি কী গভীর আবেগে মা বাবার কাছে চিঠিগুলো লিখতেন। কিন্তু বাবার আগ্রহ ফুরিয়েছিল খুব দ্রুত। মা প্রেগনেন্ট হবার পরপরই তার ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়। তিনি মাকে ছেড়ে চলে যান। খুব দ্রুতই নতুন পার্টনার জুটিয়ে ফেলেন। মা তখন পুরোপুরি ভেঙে পড়েন৷ খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেন, রক্তশূন্যতা দেখা দেয় তার শরীরে। এরপর আমাকে জন্ম দিয়েই তার ইহজীবনের কাজ সমাপ্ত করে দিয়ে চলে যান।
আমি জন্ম থেকেই অপুষ্টিতে ভোগা শিশু ছিলাম৷ খালা প্রাণ দিয়ে যত্ন নিয়ে চেহারা ফিরিয়েছিলেন আমার। আমি শিশুকালে খালাকেই মা বলে জানতাম।
আমার শৈশব খুবই নিরানন্দ কেটেছে। কেন জানি না কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করত না, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করত না। বাড়ি ফিরে একা একা সময় কাটাতে ভালো লাগত। উইকেন্ড আমি খালার সাথেই পার করতাম বাড়িতে বসে। খালা আমাকে বাইরের সবার সাথে মেশানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন।
তবে আমি পড়াশুনা বা খেলাধুলায় মনোযোগী ছিলাম৷ বিশেষ করে বাস্কেটবল আমার অতি প্রিয় খেলা। খেলতেও পারি ভালো। আর এই বাস্কেটবল খেলতে গিয়েই আমার রিকের সাথে পরিচয় হয়৷ তখন আমার ষোলো বছর বয়স, রিকের উনিশ। ইন্ট্রাস্কুল টুর্নামেন্ট দেখতে গিয়ে প্রথম দেখা হয় ওর সাথে। ও তখন কলেজে পড়ে। দারুণ হ্যান্ডসাম আর বাকপটু। ওর সাথে কেমন করে মিশে গিয়েছিলাম ঠিক জানি না। তবে এটা জানি যে আমাকে ও ফেলে দিয়েছিল অতল কোনো সমূদ্রে, যেখানে আমি শুধু ডুবেই যাচ্ছিলাম। পরে বুঝতে পেরেছিলাম ওটা ছিল মোহের সমূদ্র।
আমি দিন দিন বদলে যাচ্ছিলাম। আমার জীবনটা যেন একটা বৃত্তকে ঘিরে ঘুরছিল যার কেন্দ্রে ছিল রিক। আমি পড়াশুনা, খেলাধুলা, এমনকি নিজেকেও ত্যাগ করে যেন শুধু ওকেই আপন করে নিয়েছিলাম৷ খালা আমার এই পরিবর্তনে সন্তুষ্ট ছিলেন না৷ আমাকে হাজার বার নিষেধ করেছিলেন ওর সাথে মিশতে। কিন্তু আমি তখন ছুটছিলাম বহ্নিপতঙ্গের মতো৷ খালার কথা শুনব কেন?
এক পর্যায়ে এসে আমি খালাকে ছেড়ে রিকের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম৷ খালা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। আমাকে শুধু বলেছিলেন যেন মায়ের মতো ভুল না করি৷ যেন অল্প বয়সে গর্ভবতী না হয়ে পড়ি৷
রিকের সাথে আমি চার মাস ছিলাম৷ সেই চার মাস আমার ঘোরের মধ্যে কেটেছিল। সেই ঘোরের জগতে আমি ছিলাম তার রানী। কত কত স্মৃতি আমাদের.. নাহ্ এখন আর সেসব মনে করে রোমাঞ্চিত হই না। বরং নিজের ওপর করুণা হয়। আবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদও দেই এই কারনে যে খুব দ্রুত আমাকে তিনি সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
রিকের সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন সে প্রায়ই আমাকে না বলে নানা জায়গায় চলে যেত৷ কখনো রাতে ফিরত না, ফিরে বলত কাজের প্রচুর চাপ ছিল৷ আমাকে সে সময় দিত, তবে তার কাজের বাইরেও যেন অন্য কারো জন্য সময় রাখা ছিল। আমার তবুও কোনো সন্দেহ হয়নি। আমি তাকে বিশ্বাস করতাম অন্ধের মতো। মায়ের সাথে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনাও আমার চোখ খুলে দিতে পারেনি। যেন আমি আগের জীবন ফেলে নতুন জীবনে প্রবেশ করেছিলাম৷
একদিন ক্লাসের পর ক্যান্টিনে আমি কিছু মেয়েকে কথা বলতে শুনি। ওদের সাথে আমি মিশতাম না, ওরাও আমার সাথে মিশত না৷ ওরা ছিল ভীষণ আধুনিকা। জীবনটা ওদের কাছে ফুর্তি করেই কাটানোর জায়গা বলেই মনে হতো। ওদের কথাবার্তায় আমি প্রথম রিকের নাম শুনি। আমার কান খাড়া হয়ে যায়। ওরা জানত না আমি রিকের সাথে থাকি। রিক আমাদের সম্পর্কের কথা সবাইকে বলতে নিষেধ করত। আমিও তাই কাউকে বলতে যেতাম না। এজন্যই সেখানে আমার উপস্থিতি তারা গায়ে লাগাল না। আমি তাদের নিকটতম টেবিলে গিয়ে বসলাম।
তারা খুব নোংরা বিষয়ে আলোচনা করে হাসাহাসি করছিল। কিছু ছেলেকে নিয়ে কথা বলছিল তারা। সেসব ছেলেদের সবার সাথেই ওদের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। কার সাথে শারীরিক সম্পর্কে তারা সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছে সেটাই ছিল তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু৷ একসময় তারা সিদ্ধান্তে আসে রিকের সাথেই সবার সবচেয়ে ভালো সময় কেটেছে। বিছানায় ওর মতো ভালো পারফর্ম আর কেউ করতে পারে না৷
আমার কান গরম হয়ে যাচ্ছিল। আমি কিনে নিয়ে আসা স্যান্ডউইচটা চিবিয়ে যাচ্ছিলাম যন্ত্রের মতো। ওরা রিকের শরীর নিয়ে আলোচনা শুরু করলে আমি আর থাকতে পারলাম না, উঠে পড়লাম।
সেদিনই চলে এলাম ওর কাছ থেকে। রিক আমাকে আটকাবার চেষ্টা করেনি। তার সেটার প্রয়োজনও ছিল না৷ অনেক মেয়ে তার দোরগোড়ায় তৈরিই ছিল। আমি না থাকলে তার কিছুই যায় আসত না। সে হেসে বলেছিল, “আমি কি তোমাকে কখনো বলেছি তুমি আমার জীবনের একমাত্র মেয়ে?”
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, “কিন্তু তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে ভালোবাসো।”
“আমি তোমাকে অবশ্যই ভালোবাসি হানি৷ কিন্তু তার মানে তো এটা নয় যে অন্য কাউকে ভালোবাসা যাবে না!”
ওর কাছে ভালোবাসা মানে কী ছিল আমি জানি না। জানার চেষ্টাও করিনি। শুধু সেদিন থেকে একটা জিনিস জেনে গিয়েছিলাম, পৃথিবীতে সত্যিকার ভালোবাসাগুলো সবসময় একপাক্ষিক হয়। দু’জন মানুষ দু’জনকে একই সাথে ভালোবাসতে পারে না।
রিকের পর আমি কারো সাথে সম্পর্কে জড়াইনি। ছেলেদের এড়িয়ে চলেছি। এমনকি মেয়েদেরও। অনেক প্রপোজাল পেয়েছি, কোনোটাই একসেপ্ট করতে সাহস হয়নি। আর এখন তো ইচ্ছেটাই মরে গেছে। আমি আর নতুন করে কষ্ট পেতে চাই না। জীবনটা নাহয় নিরানন্দই কাটুক৷ খালার সাথেই আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব।
ইদানীং আবার এক নতুন মক্কেল জুটেছে। হাস্যকর বিষয় হলো, যে ডায়েরিতে লিখছি সেটাও তার দেয়া। সে পরিচয়ের দ্বিতীয় দিন আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। এত অদ্ভূত ঘটনা আমার জীবনে আর ঘটেনি। সাধারণত ছেলেদের রিজেক্ট করা হলে তারা মেনে নেয়। কিন্তু এই ছেলে আঠার মতো লেগে আছে পেছনে। কবে ছাড়বে কে জানে!
তবে ও খালার সাথে দারুণ সম্পর্ক গড়ে ফেলেছে। খালাও আমার মতো ছেলেদের অপছন্দ করে। কিন্তু ডেভিডকে সে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে। কিভাবে করল কে জানে! আমি ভাবতাম খালা মানুষ চেনেন৷ সত্যিই কি তিনি ডেভিডকে চিনতে পেরেছেন? ডেভিড মানুষটা কেমন? খুবই রহস্যময় সন্দেহ নেই, সেই সাথে একটু পাগলাটেও।
সে যেটাই হোক, আমি অবশ্য তাকে বিশ্বাস করার কঠিন কাজটা করার ইচ্ছে রাখি না। সে জীবন থেকে বিদায় হলে বরং খুশি হব।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু