#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৪৫ (১ম অংশ)
কিছুক্ষণ মাথা চেপে ধরে বসে রইল ডেভিড৷ তারপর আস্তে আস্তে শুরু থেকে ভাবতে লাগল সে। কোথায় তার ভুলটা হলো সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগল।
সে সকালে ইভাকে বেড়াতে যাবার জন্য রাজি করিয়ে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে। মেকআপ নিতে কোনো ভুল করেনি। যথাসময়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে নিজের ফ্যাকাল্টির দিকে চলে গেছে সে। ক্লাস করেছে দুটো। ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে বসে জনের সাথে বাজি ধরে জিতেছে একটা হটডগ। সেখানেও সন্দেহজনক কিছু হয়নি৷ এরপর আস্তেধীরে সে চলে গেছে নেশাখোরদের আড্ডায়। আড্ডায় এদের মাঝে কিছুটা অসন্তোষ চলছিল। তার মূল কারন কিছুদিন ধরে সাপ্লাই আসা কমে গিয়েছে। দু’জন ওদের ড্রাগ সাপ্লাই দিত। তার মাঝে একজন আচমকা গায়েব হয়ে গেছে। তার গায়েব হবার পেছনে অবশ্য ডেভিডেরই হাত আছে। সেই ধরিয়ে দিয়েছে লোকটাকে। কিন্তু তার পেট থেকে কোনো কথা বের করতে পারেনি ওদের সংস্থা৷ কিন্তু সেজন্য দলের কেউ ডেভিডকে সন্দেহ করেনি। অহরহ ওদের দলে নতুন ছেলে জড়ো হচ্ছে৷ তাই তাকে সন্দেহ করাবে এমনটা সে ভাবেনি পর্যন্ত। বাকিদের সাথে বসে এগুলো নিয়েই কথা হচ্ছিল তার।
সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে সে চলে গিয়েছিল দ্বিতীয় আসরে। একই ড্রাগ নেয়া দুটো গ্রুপ হবার কারনটা রাজনৈতিক। তবে ডেভিড যেমন দুটো গ্রুপেই যাতায়াত করে তেমন আরো কয়েকজন করে। এতে দুই গ্রুপের আপত্তিও নেই। দুই গ্রুপই তাকে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করে। সে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো গা বাঁচিয়ে থাকে।
এটাই যে তার ভুল হয়েছে সেটা সে বুঝতে পারছে এই সময়ে এসে। যে ব্যক্তি ক্যাম্পাসের ভেতরে থেকে এই র্যাকেট চালাচ্ছে, কর্তৃপক্ষকে চোখ থাকতেও অন্ধ করে রেখেছে তাকে খুঁজে বের করার জন্য কোনো একটা গ্রুপে পুরোপুরি মিশে যাওয়া দরকার ছিল। ইভা ঠিকই বলেছিল। সোফিকে চুমু খাওয়ার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না! বরং সোফি টাইপ চ্যাপ্টার পুরোপুরি বাদ দিয়ে উচিত ছিল সামগ্রিকভাবে একদিকে মনোযোগ দেয়া। চারদিক সামলাতে গিয়ে গন্ডগোল হয়েছে।
সম্ভবত সেই সাপ্লায়ারদের একজন গুম হবার পেছনে নতুনদের সন্দেহ করা হয় আর তাদের সবার পেছনে চর লাগানো হয়। ডেভিড প্রচুর সতর্কতা অবলম্বন করলেও দিনশেষে সে ডেভিড হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। সারাক্ষণ যে বাড়ি থেকে পল সেজে বের হয় তাও না। অনেক সময় আসল রুপেও বেরিয়ে পড়ে।
আরেকটা সমস্যা সম্ভবত হয়েছে সে হাসপাতালে ভর্তির দিন। সেদিন রকম্যান এসেছিলেন। সেখান থেকে তার পরিচয় ফাঁসেরও একটা সম্ভাবনা আছে।
যাই হোক, সে দ্বিতীয় গ্রুপে বসে ড্রাগ নিয়েছে। সম্ভবত ড্রাগের সাথে আরো কিছু মেশানো ছিল, যেটার কারনে সে জ্ঞান হারিয়েছে। আর তারপর তাকে নিয়ে আসা হয়েছে এই অন্ধকার ঘরে।
সে জানে, যারা ওই পাগলা বৈজ্ঞানিকের লেজে পা দিতে চায় তাদের সবাইকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গুম করে ফেলা হয়। ডেভিড নিশ্চিত, এটাই সেই জায়গা।
সে ঢোক গিলে খসখসে হয়ে যাওয়া গলাটা একটু ভিজিয়ে নেবার চেষ্টা করে চিৎকার করল, “কেউ আছেন?”
কোনো উত্তর এলো না। সে আবার জিজ্ঞেস করল, “কেউ আছেন? প্লিজ হেল্প মি!”
এবারও চারদিক শুনশান। ডেভিড চারদিকে হাতড়ে দেখল খাবার বা পানি জাতীয় কিছু তাকে দেয়া হয়েছে কি না৷ কিন্তু কিছুই পেল না৷ তার এত দুর্বল লাগছে কেন? সে কতদিন ধরে বন্দি? কতদিন ধরে পেটে কিছু পড়ে না?
ডেভিড আবারো উঁঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল কষ্ট করে। দেয়াল ধরে আস্তে আস্তে দাঁড়াল। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। এতক্ষণ চেয়ে থেকেও এই গাঢ় অন্ধকার চোখে সয়ে আসছে না। বেশিক্ষণ এই অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকতেও অসহ্য লাগছে
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব- ৪৫ (পরের অংশ)
শিশিরকে সকালের চা হাতে এগিয়ে আসতে দেখে বাবা একটু অবাক হলেন। তিনি বসেছিলেন বারান্দায়। সকালের ঝিলমিলে রোদে বাগানটা দেখতে ভারি সুন্দর লাগে। এখানে বসে প্রকৃতি দেখা তার রোজকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশির চায়ের ট্রে নামিয়ে আরেকটা চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করল, “আজ শরীর কেমন লাগছে বাবা?”
বাবা হেসে বললেন, “ভালো।”
শিশির নিজের কাপ তুলে নিয়ে আনমনে একটা চুমুক দিল। বাবাও চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “আজকাল অনেক ব্যস্ত থাকো দেখা যাচ্ছে। কী করছো? নতুন কিছু?”
শিশির মাথা ঝাঁকাল। “হুম। সেজন্যই আরো এলাম তোমার সাথে ডিসকাস করতে।”
“কী শুরু করতে চাইছো?”
“বিজনেস।”
বাবা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বললেন, “তুমি ভেবে বলছো?”
শিশির হেসে ফেলে বলল, “আমি কাজ কিছুটা এগিয়েও ফেলেছি।”
“কিরকম? বিজনেস করতে সবার আগে মূলধন দরকার। সেটা ম্যানেজ করবে কোথা থেকে?”
“ম্যানেজ হয়ে গেছে।”
“কিভাবে?”
“কলরবের সাথে কথা হয়েছে। ও আর আমি পার্টনারশিপে বিজনেস করব। ও টাকা দেবে, আমি শ্রম।”
বাবা কিছুটা চিন্তা করে বললেন, “এত ভালো বন্ধুত্বের মধ্যে বিজনেস আনাটা কি উচিত হচ্ছে?”
শিশির একটু ভেবে বলল, “জানি না। চাকরি করেটরে পোষাচ্ছে না। অনলাইনে তো আরো বিরক্ত লাগে। বড় কিছু না করলে শান্তি লাগবে না। হাজার হোক আমি তোমারই ছেলে। ছোটো কিছুতে পোষাবে নাকি বলো। কলরব তো আমাকে পুরো টাকা ধার দিতে চেয়েছিল। এটাও বলেছিল শোধ দিতে পঞ্চাশ বছর লাগলেও সমস্যা নেই। আমিই ওকে বলেকয়ে পার্টনারশিপে রাজি করালাম।”
“কেন? ভয় পাচ্ছো?”
“হ্যাঁ বাবা। এতগুলো টাকা নিয়ে রিস্ক নিতে ভয় তো হচ্ছেই। তার ওপর নিজের ওপর থেকে কনফিডেন্স উঠে যাচ্ছে বারবার।”
বাবা শিশিরের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “না পড়লে হাঁটতে শিখবে কেমন করে?”
শিশির বাবার দিকে চাইল আশান্বিত দৃষ্টিতে। বাবা কিছু বললে ভরসা লাগে। বাবা বললেন, “শোনো, তুমি যদি নিজের ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারো তাহলে একাই বিজনেস শুরু করো। শোধ ঠিকই হবে একদিন না একদিন। পার্টনারশিপে একসময় না একসময় ঝামেলা হয়ই। সেটা যত ভালো বন্ধুই হোক না কেন। বিজনেস বাড়তে শুরু করলে ঝামেলা বাড়তে থাকবে। সত্যিই বড় কিছু করতে চাইলে পার্টনারশিপে যেও না।”
“বাবা ভরসা দিচ্ছো?”
“আমি তোমাকে ভরসা করি শিশির।”
শিশির কয়েক পলক চেয়েই রইল বাবার দিকে। তারপর হেসে বলল, “ঠিক আছে।”
“এবার বলো ব্যবসাটা কিসের করবে?”
“কয়েকটা আইডিয়া নিয়ে ভাবছি। কোনটা ভালো হবে বুঝতে পারছি না। সেজন্যই তোমার সাথে কথা বলতে এলাম। আলোচনা করলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।”
বাবা কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, “শুরু করো। তার আগে তোমার বউকে বলে এলো আরো এক কাপ চা দিতে। যা চা বানায়, এক কাপে হয় নাকি?”
শিশির হেসে উঠে গেল অধরাকে খুঁজতে। পাওয়া গেল রান্নাঘরেই। একা আছে। মনোযোগ দিয়ে একটা ইউটিউবের রেসিপি দেখছে। শিশিরের হঠাৎ দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপল। সে পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকে অধরার একেবারে কাছে চলে গিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরল তাকে। অধরা ভয়ে একেবারে ছিটকে উঠল। শিশির এক হাতে ওর কোমর, আরেক হাতে মুখ চেপে ধরেছে বলে চিৎকার করতে পারল না অধরা। শিশির ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, “যা আছে সব দাও, নইলে কিন্তু কেড়ে নেব!”
অধরা ভয়ে প্রায় আধমরা হয়ে যাচ্ছিল। কানে শিশিরের গলা যেতেই ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো। সেই সাথে রাগও হলো। এরকম করার মানে কী? তাকে অবশ্য কিছু করার সুযোগ দেয়া হলো না। শিশির ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে। সেই হাত বিচরণ করছে অন্যত্র৷
অধরা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “এটা তোমার বেডরুম না। যে কেউ চলে আসবে।”
“আসুক। আমি কি পাশের বাসার ভাবিকে জড়িয়ে ধরে আছি নাকি?”
“ওইযে মা!” চেঁচিয়ে উঠল অধরা।
শিশির লাফিয়ে সরে গিয়ে আশেপাশে তাকাল। মা আসেনি। সে চোখ মটকে আবারও এগিয়ে গেল অধরার দিকে৷ এ সময় রুনু খালা এসে ঢুকল। খালাকে দেখে শিশির হতাশ ভঙ্গিতে অধরাকে বলল, “এইযে জনাবা, আপনার শ্বশুরমশাই আরেক কাপ চা চেয়েছেন। সাথে মনে দয়ামায়া থাকলে স্বামীর জন্যও এক কাপ বানিয়ে দিয়ে যাবেন।”
অধরা হেসে বলল, “তথাস্তু।”
শিশির চলে গেলে অধরা চায়ের পানি বসাল চুলায়। গুনগুন করে একটা গান ভাজতে লাগল আপনমনে। অনেকদিন পর শিশিরের সাথে এমন খুনসুটি হলো।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব- ৪৬
বাবার সাথে ব্যবসা নিয়ে কথা বলাটা শিশিরের রোজকার রুটিন হয়ে দাঁড়াল। বাবা না থাকলে ব্যবসা শুরু করার ব্যাপারে এত এত ইন্সট্রাকশন পৃথিবীর কোথাও পেত বলে মনে হয় না। বাবার কারনেই নিজেকে রীতিমতো ধনী মনে হতে থাকল তার। তার ওপর আত্মবিশ্বাসও দিন দিন বাড়তে লাগল। মনে হতে লাগল, কিছু একটা সে করবেই।
এর মাঝে অধরার চাকরিতে জয়েনিং ডেট চলে এলো। যেদিন সে জয়েন করবে তার আগের রাতে একটা ঘটনা ঘটল।
অধরার শুধু থেকেই কেন যেন মনে হচ্ছিল শিশির তার চাকরি করার ব্যাপারটা পছন্দ করছে না। যদিও মুখে সে কিছুই বলেনি। তবুও অনেক কথা না বললেও বুঝে নেয়া যায়। তার জয়েনিং ডেটের আগের রাতে মনে হলো অন্তত আজ শিশিরের সাথে ভালোভাবে কথা বলা দরকার। যথেষ্ট ব্রড মাইন্ডেড এই ছেলে কেন তার চাকরি করা অপছন্দ করতে পারে এটা অধরার মাথায় কোনোভাবেই ঢুকছিল না। এই শিশিরই অদিতির মাথায় কেকের বিজনেস নিয়ে সিরিয়াস হবার পোকা ঢুকিয়েছে। সেই অদিতির বিজনেসে সাহায্য করতে নিজেদের বাড়ির অনুষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। এমন তো নয় যে সে মেয়েদের কাজ করার বিরোধী। তবে?
রাত অনেক তখন৷ গরম পড়ে গেছে। ঘরে ফ্যান ছেড়ে বসে থাকার চেয়ে বারান্দায় বসলে বেশি আরাম লাগে। নদী কাছে থাকায় চমৎকার বাতাস বয়ে যায় বাইরে। শিশির সেখানেই বসেছিল ল্যাপটপ নিয়ে। অধরা এক কাপ চা নিয়ে এসে ওর পাশে বসল। চা খাবে শিশির। রাগ জাগে বলে অধরাকে সে বলে রাখে ঘুমোবার আগে এক কাপ চা করে দিয়ে যেতে।
অধরা চা দিয়ে সাধারণত চলে যায়৷ আজ আরেকটা চেয়ার টেনে কাছে বসল। ভণিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “একটা কথা বলি?”
শিশির স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “হুম বলো।”
“কাল আমার জয়েনিং।”
“জানি তো। কেন কী হয়েছে?” বলে শিশির ওর দিকে চাইল।
অধরা শিশিরের চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার ধারণা আমার জব করাটা তুমি পছন্দ করছো না।”
তার এমন অকপট কথায় শিশির খানিকটা হকচকিয়ে গেল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কেন এমন মনে হলো? আমি কিছু বলেছি?”
“বলোনি, কিন্তু তোমার সামগ্রিক ব্যবহারে এমনটা মনে হয়েছে।”
শিশির কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইল। তারপর ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তোমার সিরিয়াসলি এমন মনে হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“যদি এমন কোনো ব্যবহার করেও থাকি, আমি ইচ্ছে করে করিনি।”
“তোমার মনে যদি কোনো কথা থাকে, আমাকে বলতে পারো।”
শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ে ছোটো ছোটো চুমুক দিতে দিতে বাইরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। বাতাসে তার চুল উড়ছে, চোখ আনমনা, ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত, মুখের পেশিগুলো যেন কিছুটা শক্ত হয়ে আছে। ভাবছে কিছু গভীরভাবে। অধরা বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না ওর দিকে। মনে হলো মরে যাবে। তার ভালোলাগা দিন দিন যেন বাড়ছে। দূরত্ব বাড়লেও ভালোলাগা বাড়তে থাকে? এই মুগ্ধতা কি ওপাশ থেকেও আছে নাকি শুধু তার দিক থেকেই?
চা শেষ করে শিশির অধরার দিকে চেয়ে বলল, “অধরা, তোমার জব করা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই। এখানে কেউ যদি সমস্যা তৈরি করে থাকে তাহলে সেটা পরিস্থিতি। যে সময়টাতে তোমার জবের কথা উঠল সে সময় আমি মাত্রই চাকরি হারিয়ে আরেকটা নতুন কিছুর সাথে স্ট্রাগল করতে শুরু করেছি। এই ফ্যামিলির দায়িত্ব মাথায় নিয়ে চেষ্টা করেও কিছু করতে না পারাটা নিজের ভেতর এক ধরনের হতাশা, এক ধরনের ইন্সিকিউরিটির জন্ম দিয়েছিল। নিজেকে ইউজলেস মনে হচ্ছিল। হতে পারে সেজন্যই আমার ব্যবহারে তোমার কাছে সমস্যা মনে হয়েছে।”
অধরা শিশিরের হাতে হাত রেখে বলল, “আমি যদি চাকরি করি তাতে কি তোমার কোনো হেল্প হবে না? আমি কি তোমার সাথে দায়িত্ব শেয়ার করব না?”
শিশির অন্যদিকে চেয়ে বলল, “এটাই আসল কথা। এটাই,…”
“কোনটা?”
“আমার বারবার মনে হচ্ছে আমার না পালন করতে পারা দায়িত্ব আমি তোমার কাঁধে তুলে দিচ্ছি। এই ব্যাপারটাই নিজেকে আরো ইউজলেস ফিল করাচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি সবসময় চাই তুমি অনেক বড় হও। তোমার সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই অধরা। তোমার ক্যারিয়ারের মাঝে দাঁড়িয়ে যাব এতটা সস্তা মেন্টালিটিও না আমার।”
“আমরা তো একে অপরের কম্পিটিটর নই তাই না? বরং আমাদের পাশাপাশি হাতে হাত রেখে চলার কথা। তা না করে বরং আমরা দূরে সরে যাচ্ছে। তুমিই বলো, বিয়ের পরের সেই মিষ্টি সম্পর্কটা কি আর আছে আমাদের মাঝে?”
“আই অ্যাম সরি অধরা।”
“তুমি যদি সত্যি সত্যি বিষয়টা বুঝতে পারো তাহলে আমি খুব খুশি হব।”
শিশির তার ল্যাপটপ সরিয়ে অধরাকে কাছে টেনে নিল। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমার খারাপ সময়ে আমার হাত ধরেছ। সবসময় পাশে থাকতে চেয়েছ। আমিই তোমাকে দূরে সরিয়েছি। কাছে ডেকেও তোমার থেকে দূরে চলে গেছি নিজের অজান্তেই। অধরা, আমি সত্যিই স্যরি। আমরা কি আবার নতুন করে শুরু করতে পারি?”
অধরার চোখে তখন শ্রাবণের ধারা নেমেছে। সে কথা বলতে পারছে না। শুধু কাঁদতে কাঁদতে শিশিরে বুকে মুখ গুঁজে না বলেও তাকে জানিয়ে দিল, যে কোনো সময় সে নতুন করে শুরু করতে রাজি।
পরদিন অধরার প্রথম অফিস। সে কিছুটা নার্ভাস ছিল। তবে গতরাতে শিশিরের সাথে খোলাখুলি অনেক কথা হওয়ায় তারও আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।
প্রথমদিন কাজ বুঝে নিতে আর কলিগদের সাথে পরিচিত হতে হতেই দিন কেটে গেল। ভালোই লাগল অধরার। নতুন একটা জীবনে প্রবেশ করল সে। নতুন জার্নি। সেটা কেমন হতে যাচ্ছে সে জানে না, তবে ভালোর আশা তো করাই যায়।
দিনশেষে ফেরার সময় বেশ অনেকটা পথ আসতে হলো মায়ামঞ্জরীতে পৌঁছুতে। সারাদিন ব্যস্ত থাকায় বাড়ির কথা অত মনে করার সুযোগ পায়নি সে। কিন্তু যতই বাড়ির কাছাকাছি যেতে থাকল, ততই যেন তার মন কেমন করতে লাগল। বাড়ির দরজার সামনে রিকশা থেকে নামতেই মনে হলো সে যেন বহুদিন পর নিজের আপনার জায়গায় ফিরে এসেছে।
ভেতরে ঢুকল সে। রুনু খালা বাদে কারো সাথে দেখা হলো না নিচতলায়। সে দেখা করতে গেলও না। সোজা চলে গেল ওপরে। নিজেদের ঘরে উঁকি দিল। শিশির জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অধরার পাশের শব্দে ফিরে চাইল সে। দু’জনের চোখাচোখি হলো এক পলক। তারপর অধরা ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিশিরের ওপর। ঠিক যেমনটা বিয়ের পর শিশির প্রথম অফিস করে ফেরার পর হয়েছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে অধরা আর শিশির দু’জনেরই মনে হলো, জীবনটা ভীষণ সুন্দর।
অধরা ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে শিশির নিজের হাতে চা বানিয়ে নিয়ে এলো। চা আর বিস্কুট খেতে খেতে অধরা তার প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা বলে গেল। যেমনটা সে ছোটোবেলায় স্কুল থেকে ফিরে মাকে সবটা শোনাত, তেমন। শিশিরও খুব আগ্রহ করে শুনল। সে না ঘুমিয়ে কাজ এগিয়ে রেখেছিল, যাতে অধরাকে এই সময়টুকু সে দিতে পারে। গতকাল অধরার সাথে কথা হবার পর তার মনে হয়েছে এভাবে কাজে ডুবে জীবনটাকে তিক্ত বানিয়ে ফেলার মতো বোকামি আর কিছু হয় না। সময় থাকতে ভুলটুকু শুধরে নেয়াই ভালো।
************
ইভা রকম্যানের দেয়া ঠিকানায় পৌঁছে গেল। এটা একটা এপার্টমেন্ট৷ একুশ তলার ওপরে একটা নির্ধারিত ফ্ল্যাটে পৌঁছুল সে। কলিংবেল চাপল গুনে গুনে চারবার, চার সেকেন্ড বিরতি দিয়ে দিয়ে। এটাই সিগন্যাল। চতুর্থবার বেল চাপার পরপরই দরজা খুলে গেল। রকম্যান না, খুলল অন্য কেউ। লম্বা চওড়া বডিবিল্ডার লোকটাকে দেখে ইভার খানিকটা ভয়ই লাগল। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ইভাকে।
ভেতরটা আসলে একটা অফিস৷ রকম্যান বসে আছেন ভেতরের দিকের একটা কক্ষে। সুদৃশ্য ঘরে গোল কাচের টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসে ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কিছু টাইপ করছেন তিনি৷
ইভাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন, “এখানে এসো বসো। কিছু দেখাব।”
ইভা রকম্যানের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল। লোকটা ল্যাপটপে একটা ফাইল বের করে দেখালেন, ডেভিড কী কী কাজে অগ্রগতি করেছে।
“এই দেখো, সে বের করেছে ড্রাগ কার কার কাছে সাপ্লাই হয়, কে কে সাপ্লাই করে, তারা সেটা কোথা থেকে পায়, এই ড্রাগ মূলত কোথা থেকে আসে, কে কে এর পেছনে আছে সবটা আছে এই ফাইলে। শুধু এসবের সাথে যেসব মূল হোতা জড়িত তাদের পর্যন্ত পৌঁছানোই বাকি ছিল ডেভিডের। কিন্তু এটাই করতে পারল না।”
“আপনার কাছে কি কোনো ক্লু নেই সে কোথায় থাকতে পারে?”
রকম্যান মাথা নেড়ে বলল, “নাহ। তবে আশা করি পেয়ে যাব। ওর পথ ধরে হাঁটলেই ওকে পাওয়া যাবে।”
“আপনারা প্লিজ ওকে খুঁজে বের করুন।”
“অবশ্যই করব। তোমাকে কেন ডেকেছি জানো?”
“কেন?”
“তোমার নিজেরও লাইফ রিস্ক আছে। যারা ডেভিডকে ধরেছে তারা হয়তো এখন তোমাকে টার্গেট করবে। হয়তো ভাববে তুমি সব জানো।”
“তাহলে আমি কী করব?”
“এখানে থাকো।”
“এখানে?”
“হ্যাঁ। তোমাকে দেখে টায়ার্ড মনে হচ্ছে। পাশেই একটা শোবার ঘর আছে, সেখানে শুয়ে বিশ্রাম নাও। ডেভিডকে পেয়ে গেলে তুমিও চলে যেতে পারবে।”
“কিন্তু আমি এই সময়ে এখানে থাকব কেমন করে?”
“তুমি বাইরে থাকলে কিছুই করতে পারবে না৷ উল্টো বিপদে পড়বে। তার থেকে ভালো এখানে সেফ থাকা। ডেভিড ফিরে নয়তো আমাকেই দোষ দেবে, আমি তোমাকে সুরক্ষা দিতে পারিনি বলে।”
ইভা ভেবে দেখল সত্যিই তার কিছু করার নেই। সে রাজি হয়ে গেল।
রকম্যান বেল চাপতেই একটা মেয়ে এসে ইভাকে পাশে একটা শোবার ঘরে নিয়ে গেল। একটা বিছানা, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আর একটা রাইটিং টেবিল আছে তাতে। ইভাকে ভেতরে বসতে বলে মেয়েটা বেরিয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথেই ফিরে এলো ট্রেতে খাবার নিয়ে। জোর করতে লাগল খাবার জন্য।
ইভার প্রচন্ড ক্ষুধা পেলেও অল্পই খেতে পারল। খাওয়া হলে মেয়েটা চলে গেল।
ইভা বিছানায় এসে বসতেই প্রচন্ড ঘুম পেল তার। গত কয়েক নির্ঘুম কেটেছে। তার ওপর ভয়াবহ টেনশন। সব মিলিয়ে তার স্নায়ু অবশ হয়ে এলো। সে ঘুমে তলিয়ে গেল বিছানায়।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু