#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৫৩
অধরার শরীরটা ভালো যায় না ইদানীং। দুর্বল লাগে সারাক্ষণ। কয়েকদিন অফিস ছুটির পর আবার যখন জয়েন করল, তিন-চারদিন গিয়েই আরো অসুস্থ হয়ে পড়ল। এতখানি জার্নি করে যাওয়া আসাটা কষ্ট হয়ে যায় শরীরের এই অবস্থা নিয়ে। শিশির প্রথম থেকেই চাইছিল অধরা চাকরিটা ছেড়ে দিক। এবার যখন বেশ ভালোই অসুস্থ হয়ে পড়ল, আর ডাক্তারও বলে দিলেন রেস্ট করতে, তখন সে জোর করেই বলল চাকরিটা ছেড়ে দিতে। চাকরিটা চালিয়ে যাবার মতো শরীরের জোর না থাকলেও মনের জোরে অধরা হয়তো পারত, কিন্তু সেই মনের জোরটাই বা কতক্ষণ বজায় থাকে? আর এই সময়ে বাচ্চার যাতে কোনোরকম ক্ষতি না হয় সেটা দেখাই জরুরি। তাই সে শিশিরের কথায় আপত্তি জানাল না।
চাকরিটা অধরাতে অন্যরকম একটা মানসিক শক্তি দিয়েছিল। নিজের টাকায় সবার জন্য কেনাকাটা করা, নিজের টুকটাক খরচ চালানো, এগুলো সে ইউনিভার্সিটির সময় থেকে করে আসছে। কারো থেকে টাকা চেয়ে নেবার অভ্যাসটাই তৈরি হয়নি। তাই ওর মন যে কিছুটা ছোটো হয়ে রইল তা বলাই বাহুল্য। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা মানিয়ে নিল সে৷ বিশেষ করে শিশির এত সাপোর্টিভ যে মন খারাপের কোনো সুযোগ নেই। যে সময়টা শিশির তাকে দিতে পারত না, সেটাও সে কেমন করে যেন ম্যানেজ করে ফেলে। দ্রুত বাড়ি ফেরে, দিনের বাকি কাজটা বাড়িতে বসে ল্যাপটপে সেরে ফেলে। শুক্রবারে পুরো দিনটা না পারলেও অর্ধেক দিন বাড়িতে থাকার চেষ্টা করে। আর অধরার পার্সে সময়ে অসময়ে টাকা রেখে দেবার ব্যাপারটা তো আছেই। অধরার তাই মনটাও আর ছোটো হয়ে থাকে না। বেশ ফুরফুরে লাগে।
এক রাতে সে শিশিরকে জিজ্ঞেস করে ফেলল, “তুমি এত খেয়াল রাখা কোথা থেকে শিখলে বলো তো?”
শিশির গম্ভীর ভঙ্গিতে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে রেখেই বলল, “এত কথা বলা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ঘুমাও।”
“তুমি দিন দিন আনরোমান্টিক হয়ে যাচ্ছো। সুন্দর একটা উত্তর দিতে পারতে!”
“ছেলেরা বাবা হলে আনরোমান্টিক হয়ে যায়। তুমি বুঝবে না।”
“তার মানে কী?”
“দায়িত্ব বাড়ে, রোমান্টিকতা কমে।”
“দায়িত্ব তো মায়েদেরও বাড়ে।”
“মায়েদের কি দায়িত্বের সাথে রোমান্টিকতা আনুপাতিক হারে বাড়ে?”
অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “নাহ। বেবী হবার পর মেয়েরা আরো ডিপ্রেশনে চলে যায়।”
শিশির ল্যাপটপ বন্ধ করে পাশে রেখে শুয়ে পড়ল। অধরার গালে হাত রেখে বলল, “আমরা তো জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। ভবিষ্যতে আমাদের পরিস্থিতি কেমন থাকবে। আমি আসলে এখন কোনোকিছুরই অগ্রিম ধারণা করতে পারি না। আশাও করতে ভয় হয়। যত যাই হোক অধরা, তুমি ভালো থাকো এটাই চাই। যদি কখনো ডিপ্রেসড মনে হয়, আমার দিক থেকে কোনো অবহেলা হয়ে যায়, সরাসরি আমাকে বলো। আমি সমাধান করার চেষ্টা করব। মানুষ সবসময় নিজেকে জাজ করতে পারে না। কিছু বিষয় প্রিয় মানুষদের ধরিয়ে দিতে হয়।”
অধরা বলল, “তোমাকে এত কনফিডেন্ট লাগত এতদিন! এখন হঠাৎ আবার এসব বলছো কেন?”
শিশির সোজা হয়ে শুয়ে বলল, “বাবা হলে ছেলেদের নার্ভাসনেস বেড়ে যায়। তুমি বুঝবে না।”
অধরা হাসল। একটা কথা বলতে চেয়েও বলতে পারল না৷ মনে হলো বললে শিশির চিন্তা করবে শুধু শুধু।
*
অধরা চাকরিতে ঢোকার পরপরই রান্নার জন্য একটা মেয়ে রেখে দিয়েছিল। নদীর পাড়ে বাড়ি। চমৎকার রান্না করে মেয়েটি৷ দুপুরে এসে দুই বেলার রান্না আর সকালের রুটি বানিয়ে দিয়ে যায়। এমনিতে অধরা ছুটির দিনে বাড়িতে থাকলে নিজে রান্না করত, বা মাঝেমধ্যে মা৷ আজকাল সব মেয়েটার ওপরেই ছেড়ে দেয়া। অধরার রান্নাঘরে গেলে এটা ওটার গন্ধে অসুস্থ লাগে। বমি হয়। শরীরটাও অত ভালো যায় না।
ওর সারাদিন কাটে বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে। রোজ ডায়েরি লেখে সে। তার প্রেগনেন্সির দিনগুলোর কথা লেখে, মায়ামঞ্জরীর রোজ রূপবদলের গল্প লিপিবদ্ধ হয় তাতে।
কিছুদিন হলো প্রচন্ড গরম পড়েছে। গাছপালায় ঢাকা নিবিড় মায়ামঞ্জরী এমনিতে তুলনামূলক ঠান্ডা থাকলেও বৈশ্বিক এই গরমের প্রভাব এখানেও পড়েছে। দুপুর হতেই অধরার মনে হচ্ছিল শরীর জ্বলে যাচ্ছে। আর অস্থিরতা শুধু বাড়ছিল।
দিনের বেলা সাধারণত দোতলায় একা অধরা বাদে আর কেউ থাকে না। শিশির কয়েকদিন ধরেই চাইছিল ওদের ঘরটা কিছুদিনের জন্য নিচতলায় শিফট করতে। তাহলে মা বাবা আর অধরা সবাই সবাইকে দেখে রাখতে পারবে। কেউই তো তেমন সুস্থ নয়। কিন্তু সময়ের অভাবে কাজটা হচ্ছিল না।
একদিন দুপুরে প্রবল গরম পড়ল। অধরা যা খেল পুরোটা বমি হয়ে গেল। বিকেলের দিকে একটা হাতপাখা নিয়ে বারান্দায় বসল অধরা। আজ বাতাস নেই। ঘরের ভেতর ফ্যান আছে, তবুও গুমোট লাগে।
বসে বসেই মনে হলো গাছগুলোতে পানি দেয়া দরকার। ওদেরও তো গরম লাগছে!
গাছে পানি দিতে দিতেই হঠাৎ চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গেল অধরার। মনে হলো শরীরটা হালকা হয়ে গেছে। চোখের সামনের সব রঙ গুলিয়ে গেছে একে অপরের সাথে।
*
অধরার জ্ঞান ফিরল কয়েক সেকেন্ড পর। নিজেকে আবিষ্কার করল মেঝেতে পড়া অবস্থায়। বারান্দার রেলিং ধরে কোনোরকম উঠে বসল সে। অনাগত সন্তানের চিন্তায় আরো বেশি অসুস্থ লাগতে লাগল তার। শাওলীর ঘটনার পর মনে এমনিতেই ভয় ঢুকে গেছে। সে দ্রুত শিশিরকে কল করল।
এর মধ্যে রুনু খালা ওপরে উঠলে অধরাকে বারান্দার মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে এলেন। ওকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলেন।
শিশির যত দ্রুত পারে ফিরল। তারপর অধরাকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালে।
ডাক্তারেরা পরীক্ষা নীরিক্ষা করে জানালেন তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি৷ গরমের কারনে এমন হয়েছে।
পরদিন শিশির বাড়িতে এসি লাগিয়ে ফেলল। একদিনের মধ্যে নিচতলার একটা ঘর সাফ করে তাতে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো এনে এসি লাগিয়ে সেট করে ফেলল।
এসি মা বাবার ঘরেও লাগানো হলো।
মায়ামঞ্জরীর প্রাচীন শ্যাওলা ধরা চমৎকার দেয়ালের গায়ে বাগানবিলাসের পাশে এয়ার কন্ডিশনের বাইরের অংশটা বড্ড বেমানান মনে হলো অধরার কাছে।
*********
এক রাতে ডিনার খেতে খেতে ইভা বলল, “ডেভিড! আমরা কাল ভোরে ক্যাম্পিংয়ের জন্য বিগ বিয়ার লেক যাচ্ছি। রাতের মধ্যে প্যাকিং করে ফেলবে। খুব ভোরে রওনা হবো আমরা।”
ডেভিড অবাক হয়ে বলল, “সেকি! কবে ঠিক হলো এটা?”
“আজই। আমাদের দু’জনের শরীর এখন যথেষ্ট সুস্থ৷ তাই ট্র্যাকিং করতে অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না।”
“ওকে বস!”
“তুমি কখনো গেছ সেখানে?”
“না।”
“আমিও যাইনি। দারুণ মজা হবে!”
উত্তেজনায় সারারাত ঘুম হলো না ইভার। সে যদিও ডেভিডকে বলে রেখেছিল তাকে ডাকতে, কারন সে এলার্ম শুনে সবসময় উঠতে পারে না, কিন্তু ঘুম না হবার কারনে সে নিজেই ডেভিডকে ডেকে ওঠাল। প্যাকিং করাই ছিল। দ্রুত কিছু স্যান্ডউইচ বানিয়ে সেগুলো প্যাক করে নিয়ে চলল সকালের নাস্তার জন্য।
সূর্য ওঠার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ল ওরা। গাড়িতে চড়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় দশটা বেজে গেল।
বিগ বিয়ারে পৌঁছে গ্রসারি শপ থেকে ক্যাম্পিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নিল। তারপর হেঁটে রওনা দিল গাছপালায় ছাওয়া বুনো পথের মধ্যে দিয়ে।
ক্যাম্পসাইটে পৌঁছে পছন্দমতো একটা জায়গা বেছে নিয়ে তাবু খাটিয়ে ফেলল ওরা।
এখন ফল চলছে। এই সময়ে বেশ ভালোই ভিড় থাকে পর্যটকদের। কিন্তু আজ উইকডে বলে বেশ নিরিবিলি পেল ওরা জায়গাটা। তাবু খাটানো শেষ হলে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করতে বসল। কুকিং এরিয়া সেট করে দুজন মিলে রানাবান্না সেরে ফেলল। লাঞ্চ শেষে একটু রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল লেকসাইড ভ্রমণের জন্য।
পাতাঝরার মরসুমে বিগ বিয়ারের বনের মধ্যে দিয়ে অজস্র ঝরাপাতা যেন নরম গালিচা তৈরি করেছে। ওক, মেপল গাছের হলুদ, কমলা, গাঢ় লাল রঙে চারদিক অসম্ভব সুন্দর লাগছে। শীত নেই। একটু গরমই লাগছে। তবুও আবহাওয়া সহনীয়। লেকের দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস আসছে মাঝেমধ্যে।
লেকের স্বচ্ছ নীল পানির দিকে চাইলে আপনাআপনি মন ভালো হয়ে যায়। অনেকখানি ঘুরে এসে একটা নিরিবিলি জায়গায় পাথরের ওপর বসল ওরা। এখান থেকে সূর্যাস্তটা সোজা দেখা যাবে।
আকাশের রঙবদল হতে লাগল আস্তে আস্তে। ঝকঝকে নীল আকাশে বেগুনী, কমলা আর লালের অপূর্ব এক সংমিশ্রণ তৈরি হলো। সেই রঙের ছায়া লেকের পানিতে আয়নার মতো প্রতিফলিত হয়ে দৃশ্যটাকে অপার্থিব সুন্দর করে তুলল।
ওরা একটু দূরে দূরে বসেছিল। এবার ডেভিডের কাছে এসে বসল ইভা। ওর একটা হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখল। দুজনেই জানে, এত সুন্দর সূর্যাস্ত ওরা এর আগে দেখেনি।
পুরোপুরি অন্ধকার হবার আগে ক্যাম্পে ফিরে এলো ওরা। আগুন জ্বালল। রাত হতেই চারদিকে হালকা কুয়াশার আস্তর পড়ে গেছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক, ঝরা পাতার গন্ধ, সব মিলিয়ে একটা চমৎকার আবহ তৈরি হয়েছে।
ডিনার তৈরি করে ফেলল ওরা। ডিনার শেষে কফি হাতে বসল গল্প করতে।
ওরা মন খুলে গল্প করল আজ। যেসব গল্প এতদিন করা হয়নি, হয়তো সংকোচ হয়েছিল, হয়তো কিছুটা দূরত্বের কারনে হয়নি, কিংবা সময় হয়ে ওঠেনি।
একটাই তাবু খাটিয়েছে ওরা। রাত বাড়লে একসময় ঘুমানোর জন্য তাবুতে ঢুকল দু’জন। ডেভিড ভেবে রেখেছিল হয়তো আজ তাদের কাছাকাছি আসা হবে। কিন্তু তেমন কোনো ইঙ্গিত ইভার কাছ থেকে পেল না। ইভা হাই তুলে বলল, “ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। আ’ম সো টায়ার্ড! গুড নাইট ডেভিড।”
তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। দ্রুতই ওর গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ আসতে লাগল। ডেভিডও শুয়ে পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
খুব ভোরে ডেভিডের ঘুম ভাঙল ইভার ডাকে। “ওঠো ওঠো, আমরা হিল ট্র্যাকিংয়ে যাব আজ।”
তখনো আলো ফোটেনি। সামান্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করে কফি খেয়ে নিয়ে আলো ফুটতেই রওনা দিয়ে দিল ওরা। ক্যাসল রক ট্রেইল ধরে উঠতে শুরু করল। পাহাড়টা কিছুটা খাঁড়া। অনেকদিন পরিশ্রম হয় না বলে দুজনেই উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে উঠল। কিন্তু ওপরে উঠে দু’জনেরই মন ফুরফুরে হয়ে গেল। ওপর থেকে লেকের পুরোটা দেখা যাচ্ছে। কী চমৎকার ভিউ!
ঘন পাইন বনের ভেতর বসে ব্রেকফাস্ট সারল ওরা। সূর্যের আলোটা পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে প্রবেশ করছে। চারদিকে একটা বুনো গন্ধ মাতাল করে দিচ্ছে যেন।
হঠাৎ ডেভিডের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল ইভা। তাকেও টেনে ওঠাল। লেকের দিকে মুখ করে চূড়ার একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়াল দু’জন। ডেভিডের হাতটা শক্ত করে ধরে ইভা বলল, “ডেভিড, তোমার কেমন লাগছে ঘুরতে?”
“দারুণ!”
“আমার সঙ্গ?”
“তোমার সঙ্গ আমার সবসময়ই ভালো লাগে!”
“আমার সারাজীবনের সঙ্গী হবে? আমাকে বিয়ে করবে ডেভিড?”
ডেভিড কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল। আচমকা ইভা সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেবে এটা তার কাছে অভাবনীয়। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, “অবশ্যই ইভা। আমি তোমাকে হাজারবার বিয়ে করতে চাই। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত তোমার সাথে কাটাতে চাই!”
কিন্তু সব কথা মুখ ফুটে বলা যায় না৷ ডেভিডও বলতে পারল না। বরং ইভার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে তাকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, “আই লাভ ইউ ইভা।”
ইভা ডেভিডের চোখে চোখ রেখে বলল, “আই লাভ ইউ টু!”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৫৪
ইভার পুরো জীবনটাই কেটেছে কষ্টে। এখন যখন সে ডেভিডের সাথে একটা নতুন জীবনের শুরু করেছে তখন তার কাছে এই জীবনটাকে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। বিয়ের আংটিটার দিকে তাকালে মনে হয় এটাই তার স্বপ্নিল জীবনের পরশপাথর। বিয়ের দিনটা তার সবচেয়ে প্রিয় দিন। যখন সে আর ডেভিড একে অপরকে প্রমিজ করেছিল, “Till death do us part.”
মৃত্যু ছাড়া কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।
বিয়ের পরপর সবকিছুই যেন চমৎকারভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ডেভিডের প্রমোশন হয়েছে। মূলত রকম্যানের পোস্টটা সে পেয়েছে। ইভা দারুণ একটা চাকরি পেয়েছে। বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায় সে। কী সুন্দর সময় কেটে যায়!
ইভার মনে হয় ডেভিডের মতো স্বামী লাখে একটা পাওয়া যাবে। এত ভালোবাসে তাকে! এত যত্ন করে! মনে হয় তার উচিত ছিল সেই শুরুতেই ডেভিডকে বিয়ে করে ফেলা। তাহলে এতগুলো দিন এত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো না।
বিয়েতে ওর খালা খালুর পক্ষ থেকে চমৎকার একটা হানিমুন প্যাকেজ উপহার পেয়েছে। ঘুরে এসেছে ইউরোপ থেকে। রোমান্টিক শহর প্যারিসের অলিগলিতে রাতের উজ্জ্বল আলোয় হাতে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেছে একে অপরের মাঝে।
একসাথে ঘরের কাজগুলো করে ওরা। ডেভিডের রান্নার হাত ভালো বলে সেই রান্না করে। ইভা ঘর গোছায়। তারপর একসাথে শাওয়ার নেয়। ইভার চুল আঁচড়ে দিতে দিতে কত এডভেঞ্চারের গল্প বলে ডেভিড!
মাঝেমধ্যে ঝগড়াও হয় ওদের। রাগ করে গাল ফুলিয়ে দু’জন দুই ঘরে শুয়ে পড়ে। তারপর মাঝরাতে হয় ডেভিড ইভার ঘরে টোকা দেয়, নয়তো ইভা ডেভিডের ঘরে। ঝগড়ার রাতগুলোতে প্রেম আরো গাঢ় হয়।
বিয়ের তেরো মাসের মাথায় ইভা এক সকালে আবিষ্কার করলো তার জীবনে একটা চমৎকার পরবর্তন ঘটে গেছে। তার হাতের প্রেগ্ন্যাসি কিট বলছে, সে মা হতে যাচ্ছে।
আচ্ছা, ডেভিডকে খবরটা জানালে কি সে পাগল হয়ে যাবে না?
আজ আকাশটা গুমোট। শীতকাল প্রায় চলে এসেছে৷ তবে তাপমাত্রা এখনো অত কমেনি। দিনটা কেমন যেন মন খারাপ করা। অথচ ইভার পুরো জগৎ ঝলমল করছে।
সে পুরো বাড়িতে আলো জ্বালিয়ে রাখল। ডেভিডের পছন্দের ব্ল্যাকফরেস্ট কেক বানালো। একটা চমৎকার কার্ডে লিখতে শুরু করল তার সুখবরটা।
লেখা শেষ হলো না, কলিংবেল বাজল। এখন ডেভিডের আসার কথা নয়। একটু অবাকই হলো ইভা। সে উঠে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে হা হয়ে গেল সে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “তুমি!”
**********
অধরার শরীর দিন দিন যেন খারাপই হতে থাকল। ডাক্তার ওকে বেড রেস্ট দিয়ে দিল। ওকে সবসময় দেখেশুনে রাখার জন্য শিশির রান্নার মেয়েটাকে সারাদিনের জন্য রেখে দিল, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে ফিরে আসে।
অধরা এর মধ্যে অনেকবার নিজের বাড়ি যেতে চাইল। ওর বাবা মা প্রায় জোরাজোরি শুরু করে দিলেন। কিন্তু শিশির কিছুতেই তাকে যেতে দিল না। অধরার কাছে ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়। সে কয়েকদিন রাগ করে রইল শিশিরের ওপর। কিন্তু লাভ হলো না। শিশির গলল না। সে অধরাকে যেতে দেবেই না। অগত্যা অধরাকেই হার মানতে হলো।
মা আর অদিতি এলেন অধরাকে দেখতে। মা দু’দিন থেকে চলে গেলেন৷ অদিতি রয়ে গেছে এক সপ্তাহের জন্য। এর মধ্যে অধরা প্রথম তার সিক্রেটটা অদিতির সাথে শেয়ার করল, যেটা সে কাউকে বলেনি।
অদিতি অবাক হয়ে বলল, “কেউ জানে না? শিশির ভাইয়াও না?”
“না। তুই খবরদার বলবি না। এটা সারপ্রাইজ থাকবে।”
অদিতি অবাক হয়ে ভাবে এত বড় একটা ব্যাপার কিভাবে সারপ্রাইজ রাখা যায়! তাও এতগুলো দিন ধরে!
অদিতি যে ক’দিন রইল, অধরার এত শান্তি শান্তি লাগল! কতদিন পর বোনের সাথে রইল সে! একা একা থেকে বোধহয় মনটা আরো মরে গেছিল। তাই শরীরটাও চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারছিল না। কিন্তু শিশিরকে এটা কে বোঝাবে? ছেলেরা কিছু ব্যাপারে এত জেদি হয় কেন কে জানে!
অদিতিকে নিতে বাবা এলেন। অধরা সেদিন অনেকক্ষণ বাবার কাঁধে মাথা রেখে বসে রইল। ইদানীং তার শুধু কান্না পায়। কেন কান্না পায় বুঝতে পারে না সে। খুব চিন্তা হয় তার। কিসের চিন্তা নিজেও ধরতে পারে না।
রাতে শিশিরের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে সে। নইলে ভয় ভয় লাগে। মনে হয় সে হারিয়ে যাবে। স্বপ্নে কোনো অন্ধকার জঙ্গল দেখতে পায় সে। ছুটছে, কিন্তু আলোর দেখা পাচ্ছে না। আবার দেখতে পায় কোথায় যেন বন্দি হয়ে আছে সে। অক্সিজেনের অভাবে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
আট মাস পেরিয়ে নয় মাসে পড়ল অধরার। একেবারে শেষ সময়। হাসপাতালে ভর্তির জন্য গোছগাছ করে রাখা হলো। এখন শুধু অপেক্ষা।
শীত আসছে৷ মায়ামঞ্জরীর গাছপালা রুক্ষ হয়ে উঠছে। সতেজতা কমে গেছে। বাগানে বেতের চেয়ারে বসে অধরা দিনের অনেকটা সময় কাটায়৷ বাবাও এসে বসেন এ সময়। টুকটাক গল্প হয় তাদের। ফুল, ফল আর কাঠবিড়ালিরা সঙ্গ দেয় তাদের। বাবা গরম চায়ে চুমুক দেন, অধরার হাতে থাকে চকোলেট দেয়া দুধ। বাবা একসময় ওঠেন৷ অধরা বসেই থাকে। প্রকৃতি দেখে। শিশির সারাদিনের জন্য ছুটি নিতে পারে না। রাতেই তার দেখা পাওয়া যায়। দিনটুকুতে অন্তত একদিনের জন্য তাকে কাছে পেতে তীব্র ইচ্ছে করে অধরার৷ কিন্তু মুখ ফুটে বলা হয় না৷ শিশির এতকিছু বোঝে, এটা কেন বোঝে না?
অধরা এক সকালে একটা লম্বা চিঠি লিখল। শিশিরের জন্যই লিখল। নিজের ভালোলাগা, ভালোবাসা, অভিযোগ, অভিমান সব লিখে খামে ভর্তি করে রেখে দিল যত্ন করে। কখনো ইচ্ছে হলে শিশিরকে দেখাবে। আর যদি দেখানোর সময়টা সে না পায় তাহলে শিশিরই একসময় পেয়ে যাবে ওটা।
শিশির আজকাল রোজ খেলনা হাতে ফেরে। সব ছেলেদের খেলনা। তার ধারণা তার ছেলেই হবে। কেন ছেলে চাই জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়, ছেলের সাথে সে বাস্কেটবল খেলবে। অধরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। শিশিরের তখন মনে হয়, একটা মেয়ে হলেও মন্দ হয় না। গাল ফুলিয়ে থাকবে, আর খিলখিল করে হেসে বাড়ি আলোয় ভরিয়ে রাখবে।
ডেলিভারি ডেটের দুই সপ্তাহ আগে এক মাঝরাতে অধরার পেইন শুরু হলো। তার চিৎকারের শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসল শিশির। সব ঠিকঠাক করে রাখার পরেও কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেল সে। কী করবে এখন?
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৫৫
অধরার অবস্থা থেকে শিশির বেশ ঘাবড়েই গেল। আগে অধরাকে সান্ত্বনা দেবে, নাকি উঠে গিয়ে গাড়ি বের করবে, নাকি অ্যাম্বুলেন্সে খবর দেবে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড সে হকচকিত অবস্থায় বসে রইল। অথচ হসপিটাল থেকে শুরু করে সবটা ঠিকই করা আছে। অধরার কাতরানি বাড়ছে। শিশির এবার উঠে এক দৌড়ে চলে গেল শাওনের ঘরে। দরজা ধাক্কা দিতেই শাওন খুলে দিল। জেগে ছিল সে। তাকে নিয়ে এসে অধরাকে নামানো হলো। তারপর নিজের গাড়িতে করেই রওনা হলো হাসপাতালের দিকে।
শিশির গাড়ি চালাচ্ছে, পাশে শাওন। পেছনে অধরাকে ধরে রেখেছে রুনু খালা। বাড়িতে মা বাবাকে একা রেখে আসতে হয়েছে। কী করবে কিছু বুঝতে পারছিল না ওরা। শিশিরের হাত কাঁপছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শাওন বলল, “আমি গাড়ি চালাচ্ছি। তুই পেছনে অধরার কাছে গিয়ে বোস।”
শিশির বলল, “নাহ, এখন সিট পাল্টাপাল্টি করতে আবার দেরি। যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছুতে হবে।”
কিন্তু দ্রুত গাড়ি চালিয়েও কাজ হলো না। এই মাঝরাতে রাস্তা ব্লক হয়ে আছে। সামনে কোথাও একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে একটু আগেই। রাস্তা ক্লিয়ার হতে কিছুটা সময় লাগবে।
শিশির আরও বেশি নার্ভাস হয়ে গেল এই পর্যায়ে এসে। শাওন বলল, “কাছের কোনো একটা হাসপাতালে যাই চল। অপেক্ষা করার মতো সময় হাতে নেই।”
কাছের হাসপাতালে নিতে কোনো ভরসা পাচ্ছিল না শিশির। এমন কোনো ভালো হাসপাতাল এদিকে নেই। তবুও নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো। এখন ব্যবস্থা না নিলে খারাপ কিছু হয়ে যায় যদি? শিশির গাড়ি ঘোরালো।
তার এখনো হাত কাঁপছে। শাওন তাকে আরেকবার বলল, “আমাকে দে শিশির, আমি চালিয়ে নিয়ে যাই।”
শিশির এবারো দিল না। তার ভাবটা এমন, তার বউকে সে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে এটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারবে না? পারতেই হবে।
মাঝরাতে রাস্তা প্রায় ফাঁকা। হাইওয়ে ধরে দু’একটা গাড়ি যাচ্ছে।
অধরা কাঁদছে। ক্ষণে ক্ষণে চেঁচিয়ে উঠছে। শিশির একবার তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য পেছনে ফিরল। তক্ষুনি কোথা থেকে প্রবল গতিতে একটা ট্রাক চলে এলো সামনে।
শাওন ক্ষিপ্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে সংঘর্ষ এড়ালেও দুর্ঘটনা পুরোপুরি এড়াতে পারল না৷ গাড়িটা গিয়ে ধাক্কা খেল রাস্তার পাশের একটা গাছের সাথে। উইন্ডশিল্ড ফেটে চৌচির হয়ে গেল। আর প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগল গাড়িতে। শিশির আর শাওন পেছনে চেয়ে দেখল অধরা জ্ঞান হারিয়েছে।
শাওন অধরার পালস চেক করে বলল, “খুব দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু এই গাড়ি চালিয়ে কিভাবে সম্ভব?”
সৌভাগ্যবশত যে ট্রাকটার সাথে সংঘর্ষ হতে যাচ্ছিল সেটাই থেমে দাঁড়াল কিছুদূর গিয়ে। ড্রাইভার খুব অমায়িক লোক। সে নেমে এসে ওদের অবস্থা দেখে নিজে থেকেই লিফট দিতে চাইল।
ট্রাকটা খালি ছিল। শুধু ড্রাইভার ছিল তাতে। অধরাকে ধরাধরি করে বহু কষ্টে ট্রাকের পেছনে তোলা হলো। বাকিরাও উঠে পড়ল। ট্রাক চলতে শুরু করল।
শাওন লক্ষ্য করল শিশির নিঃশব্দে কাঁদছে। অধরার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে সে।
********
ডিপ নেক টপ, জিন্স আর স্নিকার্স পরনে, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, চোখে সানগ্লাস আঁটা, চুলগুলো চূড়ো করে বাঁধা। মেয়েটাকে চিনতে দেরি হয়নি ইভার। জেন! রকম্যানের সেই গার্লফ্রেন্ড যে সেদিন পালিয়ে গিয়েছিল। বহু চেষ্টাতেও যার কোনো ট্রেস পায়নি পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থা।
মেয়েটা মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, “ঢুকতে দেবে না?”
“তুমি এখানে কেন এসেছ?” ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করল ইভা।
জেন হাসল। ইভাকে একপ্রকার ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। চারদিকে ভালো করে নজর বোলালো সে। “বাহ! তোমার বাসাটা তো দারুণ সুন্দর!”
“তুমি কী চাও?”
উত্তর না দিয়ে ইভার বানানো কেকটার দিকে এগিয়ে গেল সে। মন্তব্য করল, “ওয়াও!” তারপর কেকের একটা টুকরো কেটে মুখে দিয়ে বলল, “দারুণ হয়েছে! তুমি বানিয়েছ নিশ্চয়ই! তুমি একটা বেকারি খু্লতে পারো। চমৎকার চলবে।”
জেনের কোমরে রিভলবার ঝুলছে। ইভা সতর্ক হয়ে গেল। বুঝতে পারছে না কী করবে। ডেভিডের এই সময়ে আসার কোনো সম্ভবনা নেই। তার ফোনটা কিচেনে রাখা। সেখানে গিয়ে নিয়ে আসার সময়টুকু পাবে কি সে? এই মেয়েটা কী চায়?
সে প্রশ্ন করল, “তুমি বলবে কেন এসেছ? এত হেয়ালি করছো কেন?”
জেন সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসল। বলল, “তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছি সেদিন আমার খুব ভালো লেগেছিল। তুমি নিজের বয়ফ্রেন্ডকে বাঁচাতে একেবারে বাঘের গুহায় ঢুকে পড়েছিলে। মায়া হচ্ছিল। তাই লেইজিকে বলেছিলাম তোমাকে কিছু না করতে। তোমার বয়ফ্রেন্ডকেও বাঁচার একটা চান্স দিয়েছিলাম।” বলতে বলতে এবার সামনের দিকে ঝুঁকে এলো সে। পাথরের মতো দৃষ্টিতে শীতল গলায় বলল, “আর তোমরা কী করেছ? একটা মিনিমাম সুযোগও আমাদের দাওনি। আমাকে সেদিন ফিরতে হয়েছে একা। তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমার কাছে দামী, আমার বয়ফ্রেন্ড আমার কাছে কিছু না?”
“যে অপরাধ করে তাকে শাস্তি পেতেই হয়।”
হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল জেন। কোমর থেকে মুহূর্তের মধ্যে রিভলবারটা বের করে ইভার দিকে তাক করে বলল, “এক্স্যাক্টলি ডার্লিং! তোমার অপরাধের শাস্তিই আজ দিতে এসেছি। আগে তুমি মরবে, তারপর তোমার প্রিয় বয়.. ওহ হো, তোমরা তো বিয়ে করে নিয়েছ৷ তোমার প্রিয় হাজবেন্ড মরবে।”
জেন সাথে সাথেই গুলি চালালো। গুলিটা লাগল না ইভার। সে ডাইভ দিয়ে পড়েছে পাশে। এখন না করলেও খেলাধুলা অনেক করেছে সে জীবনে। একসময় কারাতেও শিখেছিল। এত সহজে সে হার মানবে না। গড়িয়ে সোফার আড়ালে চলে গেল সে। তার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। অস্ত্রের মুখে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে সে জানে না।
জেনের আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই। শিকারকে খেলিয়ে মারার মজাই আলাদা। ইভা যে সোফার পেছনে লুকিয়েছে সেটায় ধীরেসুস্থে গিয়ে বসল সে। তারপর পেছনে উঁকি দিল। তৎক্ষনাৎ একটা ফুলদানি এসে লাগল তার কপালে। কপাল কেটে গেল। ইভা কৌশলে ফুলদানিটা হাতে নিয়ে সুযোগের অপেক্ষাতেই বসেছিল।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে থামিয়ে দিতে পারল জেনকে। ততক্ষণে দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে। নিচতলা কোনো ঘর নেই, থাকলে ঢুকে দরজা আটকে দেয়া যেত। সে ছুটল বেসমেন্টের সিঁড়ির দিকে।
বেসমেন্ট অজস্র জিনিসে ঠাঁসা। সেগুলোর পেছনেই আড়াল নিল ইভা। জেন প্রায় সাথে সাথেই ছুটে এসে ঢুকল। ইভার পায়ের শব্দ পেয়ে একটা গুলি ছুঁড়ল। তার রাগ হচ্ছে ভীষণ। একটা নিরস্ত্র মেয়েকে মারতে এতগুলো গুলি খরচ করতে হবে ভাবেনি সে। সহজ টার্গেট ছিল ইভা। রিভলবার উঁচিয়ে কপালে একটা ফুটো করে দেয়ার মতো সহজ। এখন মেজাজ গরম হচ্ছে তার।
ইভার শব্দে আবার গুলি ছুঁড়ল সে। গুলি লাগল না, কিন্তু একটা জং ধরা লোহার পাত কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল তার কাঁধের ওপর। ভালোই ব্যথা পেল সে। এবার সহ্যের সীমা অতিক্রম হতে থাকল তার। দ্রুত শব্দের দিকে ছুটে গেল সে।
*********
আজকের কাজটা বাড়ির পাশেই ছিল। একজন সোর্সের সাথে দেখা করার কথা ছিল। সাক্ষাৎ শেষে অফিসের দিকে যাবার পথে ডেভিডের মনে হলো একবার ইভাকে দেখে গেলে হয়। তাকে অসময়ে দেখে নিশ্চয়ই দারুণ একটা সারপ্রাইজ পাবে!
সে ইভার জন্য একটা চমৎকার ফুলের তোড়া কিনে নিল। তারপর গান গাইতে গাইতে বাড়ির দিকে চলল।
বাড়িতে পা দিয়েই তার মনে হলো কিছু একটা অস্বাভাবিক। তার সিক্সথ সেন্স বলছে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে এখানে। দরজাটা হাট করে খোলা। সে ডাক দিল, “ইভা! ইভা!”
কোনো সাড়া এলো না। ভেতরে ঢুকল সে। একটা ফুলদানি ভেঙে পড়ে আছে সোফার কাছে। ডাইনিং টেবিলে কার্ড, একটুখানি কাটা কেক, সব এলোমেলো হয়ে আছে। সোফাগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই তার হৃদপিণ্ড এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। দেয়ালে একটা স্পষ্ট গুলির দাগ। এতক্ষণে মনে হলো বাড়িতে পা দিয়ে যেটা অস্বাভাবিক লেগেছিল সেটা ছিল মৃদু বারুদের গন্ধ।
বাড়িটা জড়বৎ হয়ে আছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে গেছে চারপাশ।
সে দ্রুত পায়ে ওপরে উঠল। প্রতিটা ঘর খুঁজল। কোথাও ইভা নেই। আবার নিচে নামল। পাগলের মতো খুঁজতে থাকল চারপাশ। তারপর হঠাৎ একটা মৃদু শব্দ শুনল। তার পরপরই গুলির শব্দ! বেসমেন্ট থেকে এসেছে শব্দটা। দৌড়ে সেদিকে গেল সে।
সিঁড়িতে পা দিয়েই থমকে গেল। সিঁড়ির নিচের ধাপে পড়ে আছে একটা সদ্য মৃত দেহ। কপালের ঠিক মাঝ বরাবর গুলি লেগেছে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু