মায়ামঞ্জরী পর্ব-৫৬

0
6

#মায়ামঞ্জরী
পর্ব-৫৬

ডেভিড বেশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল মৃতদেহটার দিকে। যে পড়ে আছে সে আর কেউ নয়, রকম্যানের প্রেমিকা জেন স্মিথ, যাকে তারা এতদিন ধরে বহু চেষ্টাতেও খুঁজে পায়নি। তার বিষ্ময় কপালে উঠল যখন সামনে তাকিয়ে দেখতে পেল তারই মতো হতবাক হয়ে মৃতদেহটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইভা। ইভার হাতে একটা রিভলবার। কপালে একটা ক্ষত, চেহারায় বিধ্বস্ত, চোখে অবিশ্বাস।

ডেভিড জেনের শরীর পেরিয়ে ইভার কাছে চলে গেল। জড়িয়ে ধরল ইভাকে। ইভা পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে আছে। যে ধাক্কাটা ওর লেগেছে সেটা সামলে উঠতে পারছে না।

ডেভিড ইভাকে নিয়ে ওপরে উঠে এলো। প্রথমে পুলিশে খবর দিল, তারপর ইভার কাছে এসে বসল। ইভা কাঁপছে অল্প অল্প। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল ডেভিড। আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, “পুলিশকে বলতে হবে কী হয়েছে। প্লিজ বলো। আমি জানি ও তোমাকে মারতে এসেছিল। তোমার কিচ্ছু হবে না সুইটহার্ট। প্লিজ একটু খুলে বলো কীভাবে কী হয়েছিল।”

ইভার গলা কাঁপছে। কথা বলতে পারছে না। ডেভিড চট করে দুধ গরম করে নিয়ে এলো ওর জন্য। ততক্ষণে পুলিশ ফোর্স চলে এসেছে। সে লাশটা দেখিয়ে দিয়ে এসে আবার ইভার কাছে বসল। ইভাকে দুধ খাইয়ে আস্তে আস্তে সবটা জানতে পারল সে।

বেসমেন্টে জেন ইভাকে মারার জন্য একেবারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। ইভা কায়দা করে ওর পেছনে গিয়ে ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল একটা পুরানো টেবিলের ওপর৷ সে সময়ই জেনের হাত থেকে রিভলবারটা ছিটকে যায়। ইভা তক্ষুণি ঝাপিয়ে পড়ে জেনের ওপর। দু’জনের হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়। জেনের সাথে পারছিল না ইভা। জেনের ঘুষি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। টেবিলের চোখা কোণা লেগে ওর কপাল কেটে যায়৷ এরপরই ও দেখতে পায় জেনের রিভলবারটা ওর হাতের কাছেই আছে। সেটা উঠিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জেনের দিকে তাক করে সে। জেন পিছিয়ে যেতে থাকে। ইভার ইচ্ছে ছিল রিভলবারটা দেখিয়েই ওকে জিম্মি করে ওপরে উঠিয়ে পুলিশে খবর দেবার। কিন্তু সেই সুযোগ হয়নি। জেন ক্রমাগত অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিয়ে যাচ্ছিল তাকে আর ডেভিডকে উদ্দেশ্য করে। রাগে কখন সে ট্রিগার চেপে ফেলেছে আর গুলি সোজা জেনের কপালে গিয়ে লেগেছে সে বুঝতেই পারেনি। পুরো ব্যাপারটা খুব অল্প সময়ের মধ্যে হয়েছে।

ইভা আর ডেভিডকে পুলিশের সাথে থানায় যেতে হলো। তারপর ইভাকে আদালতে তার বয়ান দিতে হলো। ওদের বাড়িতে সিসিটিভি ফুটেজ ছিল। বেসমেন্টে না থাকলেও বাকি অংশের ফুটেজে যা দেখা গেছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জেন আসলে ইভাকে মারতে এসেছিল। নিজেকে বাঁচাতে ইভা ওকে খুন করতে বাধ্য হয়েছে। সে শুধু নিজেকে ডিফেন্ড করছিল।

ইভা পুলিশি ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু একটা মানুষের জীবন নিজ হাতে শেষ করে দেবার যে ট্রমা সেটা তাকে ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে যেতে থাকল বারবার। কোনোভাবেই সে স্বাভাবিক হতে পারল না। ডেভিড অনেক চেষ্টা করল ওকে আদর যত্ন করে, বুঝিয়ে স্বাভাবিক করার। কিন্তু তেমন একটা কাজ হলো না।

শেষ পর্যন্ত একজন সাইকোলজিস্টের সাথে কনসাল্ট করল ডেভিড। ইভাকে নিয়ে গেল তার কাছে। তিনি কয়েকদিন সময় নিয়ে ইভার কাউন্সেলিং করলেন। খানিকটা ইম্প্রুভমেন্টও হলো।

একদিন তিনি ডেভিডকে বললেন, ইভাকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতে। ওই বাড়িটাতে থাকতে থাকতে ওর আরও বেশি মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। ওখানে বসে চারদিকে চাইলেই ওর সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। তাই ওকে যতই কাউন্সেলিং করা হোক, আবারও সেই একই লুপের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে ইভা।

আপাতত কোথাও ঘুরে এলে, আর তারপর বাড়িটা সুবিধামতো বদলে ফেললে ইভা একসময় সুস্থ হয়ে উঠবে।

ডেভিড সেদিনই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কাছাকাছি একটা দ্বীপে কয়েকদিন ছুটি কাটাবার ব্যবস্থা করে ফেলল। দ্বীপটা ছোটো এবং মোটামুটি নির্জন। আর এখন অফ সিজন বলে লোকজনও থাকবে কম। নিজেদের মতো ছোটো একটা কটেজে থাকতে পারবে তারা। বিচে দাপাদাপি করবে, ঘাসের ওপর শুয়ে রাতের আকাশ দেখবে, দারুণ হবে। দ্বীপের ছবি দেখিয়ে ইভাকে রাজি করিয়ে ফেলল ডেভিড। তারপর একটা চমৎকার রৌদ্রজ্বল সকালে রওনা হয়ে গেল দু’জন।

**********

ট্রাকটা চলছে। অধরার ধারণা তার জ্ঞান একবার ফিরছে, একবার হারিয়ে যাচ্ছে। যখন জ্ঞান ফিরছে তখন প্রবল ব্যথায় মনে হচ্ছে কেউ যেন তার তলপেটে ছুটি বসিয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। প্রচন্ড ব্যথায় পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ট্রাকের ওপর থেকে পথের ঝাঁকুনিতে মনে হচ্ছে শরীরটা ছিঁড়ে যাবে মাঝখান থেকে। চিৎকার করতে না চেয়েও গলা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আর্তনাদ। তার এক হাত ধরে রেখেছে শিশির, আরেক হাত ধরে রেখেছে রুনু খালা।

হঠাৎ রুনু খালা বললেন, “রক্ত!”

শিশির দেখল ব্লিডিং হচ্ছে। অধরার শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সে চিৎকার করে ড্রাইভারকে বলল, “একটু তাড়াতাড়ি চালাবেন প্লিজ!”

ট্রাক ড্রাইভার যত দ্রুত সম্ভব তাদের হাসপাতালে পৌঁছে দিল। শিশির ধারণা ছিল হাসপাতালটা ভালো নয়। কিন্তু দেখা গেল ভালো ফ্যাসিলিটিজ আছে। তার ওপর শাওনের পরিচিত একজন বেশ ভালো গাইনোকলজিস্ট আছেন এখানে৷ শাওন নিজেও আসার আগে সেটা জানত না। ডাক্তার অধরাকে দেখলেন৷ তার তলপেটে চোট লেগেছে এক্সিডেন্টের সময়৷ ব্লিডিং হচ্ছে, শরীর দুর্বল হয়ে গেছে, বিপি একেবারো লো হয়ে গেছে। এক্ষুনি সি সেকশন করাতে হবে। ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো অধরাকে।

কিছুক্ষণ পর জানা গেল রক্ত দিতে হবে। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে, এবং হচ্ছে। অধরার রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ। এখানকার কারো রক্তের গ্রুপই এ পজিটিভ নয়। ডেলিভারির সময় হাসপাতালে ভর্তি হলে রক্ত দেবার জন্য ডোনারও ঠিক করা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন জটিল হয়ে গেছে যে এখন এই শেষ রাতে ওরা কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।

অধরাদের বাড়ির প্রত্যেকের রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ। অধরার মা বাবাকে আগেই খবর দেয়া হয়েছিল। তাদের ফোন করা হলে তারা জানালেন আসতে আরেকটু সময় লাগবে। সেই এক্সিডেন্টের কারনে বন্ধ রাস্তা খুলেছে, তবে এখনো জ্যাম লেগে আছে।

এদিকে রক্ত দিতে দেরি হওয়ায় অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

শিশির আর শাওন সম্ভাব্য সব জায়গায় যোগাযোগ করল। অনেকেই রক্ত দিতে পারবে, কিন্তু কেউই এক্ষুনি পৌঁছাতে পারবে না।

শিশির মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। কাঁদছে সে বাচ্চাদের মতো করে। শাওন ওর কাঁধে হাত রেখে পাশে বসল। শিশির শাওনের একটা হাত শক্ত করে ধরে রাখল। তার ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি দিয়ে তার হৃদপিণ্ডে আঘাত করছে প্রবলভাবে। আজ যদি অধরা বা বাচ্চার কিছু হয় তাহলে সে কোনোদিনই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। মরে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকবে না।

প্রতিটা সেকেন্ড মনে হচ্ছে একেকটা ঘন্টার মতো। রুনু খালা সেখানে বসেই মুনাজাতে কেঁদে কেঁদে দোয়া করে যাচ্ছেন।

বোধহয় কয়েক বছর সময় পার হয়ে যাবার পর অধরার মা বাবা আর বোন হাসপাতালে পৌঁছুল। তারা পৌঁছুনোর পরপরই শাওনের দু’জন বন্ধুও এসে পৌঁছাল। সবাই রক্ত দিতে পারবেন। দ্রুত রক্ত ম্যাচ করিয়ে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করা হলো। অধরার বাবার পর শাওনের বন্ধুদের রক্ত নেয়া হলো।

অদিতি এক কোণায় বসে কাঁদতে থাকল। এদিকে অধরার মা-ও নিঃশব্দে কাঁদছেন। মেয়ের চিন্তায় তার নিজেরই ব্লাড প্রেশার কমে গেছে। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চারদিকে তাকালে মনে হচ্ছে এটা হাসপাতাল নয়, কোনো কবরস্থান।

একসময় অপারেশন শেষ হলো। ডাক্তার তাদের জানালেন, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়েছে। ছেলে-মেয়ে দু’জনেরই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে তাদের জরুরি ভিত্তিতে এনআসিইউ রাখা হয়েছে। আর মা প্রচন্ড দুর্বল আর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে বলে তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

শিশির প্রথমে বুঝতেই পারল না কী হয়েছে। সে অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, “ছেলে-মেয়ে?”

ডাক্তার বললেন, “আপনি টুইন বেবির কথা জানতেন না?”

শিশির হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারছে না। ভয় আর বিষ্ময় দুটো একসাথে চেপে ধরেছে তাকে।

শাওন ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “চিন্তা করিস না। ঠিক হয়ে যাবে সব।”

শিশির শাওনের দিকে চেয়ে বলল, “আমি ওদের দেখব।”

“এখন বাচ্চাদের দেখতে দেবে না।”

“আর অধরাকে?”

“অধরার জ্ঞান ফিরলে দেখা করতে দেবে।”

শিশির ধপ করে বসে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। বুঝতে পারছে না তার করণীয় কী। সে শাওনকে জিজ্ঞেস করল, “ওদের আর কোনে রিস্ক নেই তো?”

শাওন জোর দিয়ে বলল, “না। সবাই ভালো হয়ে যাবে।”

শাওনের অত্যাধিক জোর দিয়ে বলার কারনেই শিশিরের মনে হলো, সব ঠিক হয়ে না-ও যেতে পারে!”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু