#পূর্ণিমায়_বিলীন_চন্দ্র
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_২৩
আজকে আকাশটা কেমন গুমোট ভাব ধরেছে। সূর্য মামার সাথে মনে হয় অভিমান করেই এই গুমোট ভাব ধরেছে। এই আবহাওয়ায় বারান্দায় বসে হাতে একটা বই নিয়ে সাথে এককাপ চা উফফফ অস্থির একটা ব্যাপার স্যাপার তবে পরীক্ষায় ব্যস্ত থাকা পুনম তা করতে না পেরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পাশেই মিহি পুনমের মনোভাব বুঝতে পেরে হাতে চিমটি কেটে বলল — থাক বান্ধুবী মন খারাপ করে না এইটু পরেই তো বাসায় চলে যাবি তখন নাহয়
— উহ হবে না বাসায় লোকজন ভর্তি,,,
— তাহলে আর কি বসে থাক,, আর এই তোর শিহাব ভাই কখন আসবে রে??
— জানিনা,,
বলেই আবার আশে পাশে তাকায় পুরো ক্যাম্পাস ভর্তি মানুষজন সবার সাথে তার বাবা অথবা মা আছে। পুনমের সাথেও এসেছে এবার তার আব্বু। পুনম ভাবতেও পারেনি তারও এমন ভাগ্য হবে তবে এস এসসির থেকেই প্রত্যেক পরীক্ষার সময় তার আব্বু তাকে দিয়ে আসত।।।
— পুনম ঐতো পুনম মামা,,
শিহাবের ডাক শুনে সেদিকে তাকায় পুনম মিহি। পারভেজ সাহেবের সাথে আসছে শিহাব ।। পরভেজ সাহেব সামনে এসেই মেয়ের সামনে একটা জ্যুসের বোতল ধরিয়ে ফাইল পত্র হাতে নেয়। আরেকটি বোতল মিহিকেও ধরিয়ে দেয়। মিহি চুপচাপ এই আদর টুকু নিয়ে নেয়।।
— কিরে এখানে বসে আছিলি ক্যান পুরো ক্যাম্পাস চষে বেড়িয়েছি তোর জন্য??
— সামনে অনেক ভীর বের হতে পারছিলাম না
আর কেউ কথা বাড়ায় না হাটতে শুরু করে পারভেজ সাহেবের হাত ধরে হাটছে পুনম। ভীর ঠেলে বাইরে আসতেই অটো ধরে পারভেজ সাহেব। শিহাব সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে। পিছনে মিহি পুনম ও পারভেজ সাহেব বসে। পৌনে একঘন্টা পর তারা নিজেদের বাসায় পৌছায়। ভিতরে ঢুকতেই দেখে ড্রয়িং রুমে আড্ডার আসর বসেছে। পারভেজ সাহেবের দুই বোন। বোন জামাই দুই ভাই। মেয়ের জামাই সবাই আলোচনায় ব্যস্ত। রোজিনা বেগম চাদনী বেগম নিপা বেগম সেখানে উপস্থিত নেই।
রোজিনা বেগম অবশ্য ঘরে মেয়ের জামাইয়ের সামনে লজ্জায় আসেনি। লিমনকে দেখে পারভেজ সাহেবও লজ্জা পায়। পুনম সবার সাথে কুশল বিনিময় করে নিজের ঘরে যায় মিহিকে নিয়ে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার মধ্যে ঠিক হয় আজ বিকালে বারবিকিউ পার্টি করবে ছাদে সাথে নিশাদেরও আসতে বলবে। পারভেজ সাহেব নিশাকে ফোন করলে সে সাফ জানিয়ে দেয় সে আসতে পারবে না। নিশারা এখন ঢাকাতেই থাকে। মন খারাপ করে পুনম ও পারভেজ সাহেব।
— মন খারাপ করিস না পূর্ণ দেখিস নিশা একদিন ঠিক ওর ভুল বুঝতে পারবে।
শেষে বিড়বিড় করে বলে — যেমন আমি বুঝতে পেরেছি। সৌন্দর্যই সব না জীবনে ভালো ভাবে বেচে থাকতে হলে মনটা সুন্দর থাকা সবচেয়ে জরুরি।
— কিছু বললা আপু
— হু,, নাহ
বলেই আবার লিমনের দিকে তাকায় এই লোকটাকে কবে এতো ভালোবেসে ফেলল রুপশা যে এখন এর অবহেলা সহ্য হয় না। মনে হয় সেই আগের ডমিনেট লিমনই ভালো ছিলো এখন স্বাধীনতা পেয়েও তার কাছে বন্দীর সমান।
_______________
খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই একটা ভাত ঘুম দিচ্ছে শুধু ঘুম নেই তিনজনের চোখে চন্দ্র পুনম ও চাদনী বেগম। চাদনী বেগম পাটি বিছিয়ে ফ্লোরে বসে পিঠা বানাচ্ছে। সবাই যখন এসেছে এই উছিলায় একটু পিঠা পুলি করার জন্যই বসেছে। পুনম না পারলেও নিজের সাধ্য মতো সাহায্য করছে।
চাদনী বেগমের পায়ে ঝিনঝিন ধরেতেই দুই পা মেলে দিল। ঠিক তখনই কোথা থেকে চন্দ্র ফ্লোরে চাদনী বেগমের কোলে শুয়ে পড়ল।
অবাক হয় চাদনী বেগম পুনম। — এই ফ্লোরে শুয়েছিস কেনো বাপ?? উঠঠ
— উহু ঘুম পাচ্ছে আম্মু ঘুমাব চুল গুলো টেনে দাও।
চাদনী বেগমের কোলে মুখ গুজে বলল।
— আমার হাতে আটা লেগে আছে বাবা উঠে যা হাত ধুয়ে আসি,,
— তোমার হাতে লেগে আছে অন্য কারো হাতে তো না সেই নাহয় দিক।
চাদনী বেগমের বুঝতে বাকী নেই কার কথা বলছে তবে যার কথা বলছে তার এই দিকে কোনো ধ্যান নেই সে। কাজের মেয়ে মিনু কখন আসবে সেই দিকে নজর দিচ্ছে।
— পুনম মা আমার চন্দ্রের চুল গুলো একটু টেনে দে না দেখ আমার হাতে আটা নাহলে আমিই দিতাম।
— আমিহহ
ঢোক গিলে বলল পুনম সে মুক্তির কাছে শুনেছে চন্দ্র নিজের শরীরে তার আম্মু ব্যতীত কারো স্পর্শ মানতে নাড়াজ। তবে চাদনী বেগম বলছে এমন করে মুখের উপর না করাও যাচ্ছে না।
— হ্যা তুই কিরে দে আমার হাতে আটা দেখিস না।
পুনম চাদনী বেগমের ডান দিকে এগিয়ে যায় । তার কাপা কাপা হাতটা চন্দ্রের মাথায় রাখে নরম সিল্কি চুল গুলো পুনমের ছোট্ট হাতে মুঠোয় চলে আসে। ধীর হাতে টেনে দিতে আরামে চোখ মুদে আসে চন্দ্রের। চন্দ্রের মনে হচ্ছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ এবং সুখী পাশাপাপাশি বসা এই দুই নারী তার সুখের কারণ।
একজনের কোলে শুয়ে আরেকজনের নরম হাতে আদুরে টানে মিনিটের মধ্যে গভীর ঘুমে চলে যায় চন্দ্র।।
চন্দ্রের যখন ঘুম ভাঙ্গে ঘড়িতে তখন বিকাল পাচঁটা বাজে। তখনও সে চাদনী বেগমের কোলে শায়িত। আড়মোরা ভাঙ্গে সে বহুদিন পর তার এমন শান্তির ঘুম হয়েছে। উঠে দেখে চাদনী বেগম সেভাবে বসেই মিনুকে মুরগি কাটার নির্দেশনা দিচ্ছে। চন্দ্রকে উঠতে দেখে বলল — উঠে পরেছিস বাপ এখন যানা একটু কয়লার ব্যবস্থা কর।
চন্দ্র মাথা নাড়িয়ে চারিদিকে তাকায়। চাদনী বেগম পুত্রের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল — তোর চাচীর কাছে গেছে পুনম
চন্দ্র মুচকি হেসে মায়ের কপালে চুমু দিয়ে চলে যায়। চাদনী বেগম অনেকদিন পর ছেলের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে প্রানটা জুড়িয়ে যায়। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল তার ছেলের এই হাসি যেনো বহাল থাকে চিরকাল।
ছাদে প্রবেশ করে চন্দ্র পিছন পিছন আসে রাব্বি হাতে একটা কয়লার বস্তা। তারা আসতেই লিমন বলল — ঐ তো আমাদের হিরো সাহেব এসে পরেছেন দেখবা একটু পরেই হিরোইনেরও আগমন ঘটবে।
তার পরপরই পুনম রুপশা মুক্তি একসাথে প্রবেশ করলে। সকলে ” হৌহৌ” বলে একটা চিৎকার দেয়।
মুক্তি বুঝতে পারলেও পুনম রুপশা বুঝতে পারে না কি হলো??
— সবাই এমন গরুর মতো হাম্বা করছ কেনো??
— তুই বুঝবিনা রুপশা এটা আমাদের টপ সিক্রেট বলা যাবে না ম্যান টু ম্যান। তাই না লিমন ভাই??
লিমন হেসে মাথা নাড়ায়। রুপশা সেদিকে একপল তাকিয়ে আবার বলল — এই তোমাদের কোনো বাজে মতলব নেই তো?? থাকলে বাদ দাও আমার জামাইকে এর ধারে কাছেও যেনো ঘেসতে না দেখী।
— রুপশারে কি কথা মনে করাইলি এখন দেহী তৃষ্ণা লাগছে।
শিহাবের কথা শুনে তখনই চন্দ্র গম্ভীর স্বরে বলল
— এক লাথিতে ছাদ থেকে ফালাই দিয়ে সব তৃষ্ণা মিটে যাবে।
চন্দ্রের কথা শুনে পুনম ভাবল যাক চন্দ্র ভাইটা এর বিপক্ষে তবে চন্দ্রের দ্বিতীয় কথা শুনেই তার মনোভাব পাল্টে গেলো
— যা হবার রাতে হবে এখন কচিকাচা বাচ্চারা আছে। পুনমের দিকে তাকিয়ে বলল। পুনম হতবাক দৃষ্টিতে তাকায় এই লোক আস্ত একটা হাড়ে বজ্জাত লোক ছিঃ,,,, মনে মনে ভেবে নজর অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়। পুনমকে নজর ঘুরাতে দেখে চন্দ্র চক্ষু হাসে। যা সবার নজরে পরে না চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে শুরু করা যাক বারবিকিউ পার্টি।
মুরগিতে মসলা মাখিয়ে শিকে ঢুকিয়ে। কয়লাতে আগুন জ্বালিয়ে তা পুরানো হয় আজকে এগুলো দিয়েই ডিনার হবে। চিকেন বারবিকিউ নান,, সাথে কয়েক রকমের পিঠা।
#চলবে
#পূর্ণিমায়_বিলীন_চন্দ্র
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_২৪
কাজীন দল আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া শ্রেষ্ঠ একটা উপহার এই কাজীনদের সাথে হাসি ঠাট্টায় যে কতটা আনন্দ মিশে আছে এটা যারা জানে তারাই বুঝে। মিহি সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল ওর এই পরিবারটাকে বেশ লাগে। পুনম মুক্তি ঝিনুক রিমি রুপশা মিহি একদিকে গল্প করছে অন্যদিকে ছেলেরা চিকেন গ্রিলড করছে।
লাষ্ট চিকেনটা প্লেটে রাখতেই ঝড় শুরু হলো সবাই দৌড়ে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকল। মূহুর্ত্তের মধ্যে বসন্তের বারিধারায় মিশ্রিত হলো ধরনী।
— উফফ আপু এই বৃষ্টিতে এককাপ চা হলে জমে যেতো তাইনা
ঝিনুকের কথায় রিশান চটকরে বলে ওঠে — এখানে কফি মেকার আছে তো পাকোড়া উইথ চা হবে নাকি,,,
রিশানের কথায় সবাই হইহই করে উঠল। মুক্তি রুপশা মিলে পাকোড়া মেরিনেট করে ডুবো তেলে ভাজা শুরু করে বাধাকপির পাকোড়া বানাচ্ছে তারা। শিহাব কফি মেকারে চা পাতা পানি দুধ সহ সব মিশ্রন দেয়।
— সমন্দি সাহেবরা এখানে সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা,, কফি মেকার ফ্রিজ কই পাইলা তাও আবার সবজি আছে।
— আমাদের চন্দ্রের কারসাজি লিমন ভাই ওর মাঝে মধ্যে এখানেই থাকে তাই মামি সব রেখে দিয়েছে এখানে। আজ ওর প্ল্যান ছিলো থাকার তাই মনে হয় মামিই সব রেখেছে।
লিমন মাথা নাড়িয়ে বলল — চন্দ্র তো দেখি রান্নাও পারে তো আমার শালিকা সাহেবা পারে নাকি??
পুনম মুচকি হেসে মাথা নাড়ায় সে পারে না রান্না করতে মুখ ফুটে বলে — এককাপ চা ছাড়া আর কিছুই পারি না আম্মু চাচীর সাথে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করলেও তারা রান্নার কোনো কাজে হাত দিতে দেয় না।
— তাহলে সেই হিসেবে আমাদের চন্দ্রের হবু বউ ভীষণ লাকি,,, তো একদিন চন্দ্রের রান্নার পার্টি হয়ে যাক,, কি বলো চন্দ্র??
— ইয়্যু আর অলোয়েজ ওয়েলকাম ভাই,,,
চন্দ্র মাথা নাড়িয়ে বলল। তাদের কথোপকথনের মাঝে মুক্তি রূপশা গরম গরম পাকোড়া এনে হাজির করে।
পাকোড়া মুখে দিতে দিতে শিহাব বলল — তবে আমাদের চন্দ্র মামার কিন্তু এই চিলেকোঠা নিয়ে বেশ রোমান্টিক প্ল্যান আছে,,
সকলে হইহই করে উঠল। রুপশা আগ্রহ স্বরে বলল — কি চন্দ্র ভাই এখানে সবাই জানে তোমার স্পেশাল মানুষের বিষয়ে শুধু আমিই জানি না। জানালায় বৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা পুনমের দিকে তাকিয়ে বলল — কিরে পুনম তুই কিছু জানিস নাকি??
— নাহ আপু
বলেই পুনম আবার বৃষ্টির দিকে নজর দেয় জানালার কিনারা ঘেষে দাড়ায়। বৃষ্টির ফোটাগুলো ছিটকে পুনমের মুখে এসে পরছে। যতবার বৃষ্টির ফোটা পুনমের মুখে পড়ছে পুনমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠছে। যাদের নিয়ে আলোচনা তাদেরই কোনো খেয়াল নেই একজন মজে আছে বৃষ্টিতে আরেকজন মজে আছে বৃষ্টিতে ভেজা আদল খানায়।
_সে কি জানে তার বৃষ্টি ভেজা
আদল খানায় বারিধারা বিন্দু
গুলো!!
কারো হৃদয়ের দোলাচল বাড়িয়ে দেয়
সেই ভেজা শ্যাম কন্যা কারো তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেয়,,,,,
বৃষ্টি দেখতে থাকা পুনমের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে চন্দ্র এ দেখার কোনো শেষ নেই। রুপশা চন্দ্রের দৃষ্টি খেয়াল করে মুক্তির দিকে তাকায়। মুক্তি দাত কপাটি বের করে হাসে। অবাক হয় রুপশা তবে খুশীও হয় যাক তার বোনকে কেউ এতো ভালোবাসে ভেবেও মনটা শান্তি পায়।
— এই পুনম ঐ দিকে কি করিস এখানে আয়,,,
বোনের ডাকে পুনম খাটে বসে এই ঘরে একটা সিঙ্গেল খাট ও একটা সিঙ্গেল সোফা আছে সেখানেই সবাই আটসাট বেধে বসেছে। পুনম এসে বসতেই চন্দ্রের নজরও ঘুরায় তাতেই আরো সিয়্যর হয় রুপশা তবে মনে মনে ভাবে কবে থেকে চন্দ্র পুনমকে পছন্দ করে। মুক্তির কাছে জিজ্ঞাসা করবে ভেবে চুপ থাকে।
— এই রুপশা আপু তুমি নাকি অনেক সুন্দর গান জানো আজ একটা গেয়ে শুনাও না,,,
রিমির কথায় রুপশা লিমনের দিকে তাকায়। যে এতোক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো রুপশাকে তাকাতে দেখে নজর ঝুকায়। রুপশা তার দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠল
_ যাও পাখি বলো হাওয়া ছলছল,,
আবছায়া জানালার কাচ..
আমি কি আমাকে হারিয়েছি বাকে,,
রুপকথা আনাচে কানাচ!!!
” আঙ্গুলের কলে জ্বলে জোনাকি
জলে হারিয়েছি কান শোনোকি
জানালার গল্পেরা কথা মেঘ __
যাও মেঘ চোখে রেখো এ আবেগ
–যাও পাখি বল হাওয়া ছলছল
আবছায়া জানালার কাচ
আমি কিইই আমাকে,,,,,
হুম হুম,,,
থামল রুপশা। সবাই একজোট হয়ে হাতে তালি দিল। লিমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি দেখে লজ্জা পেলো রুপশা। রুপশার লজ্জা পাওয়া দেখে হাসল লিমন।
এবার রিশান বলে উঠল — লিমন ভাই আপনি একটা গান,,,
— না ভাই তোমাদের বোনের মতো এতো সুন্দর গলা না আমার ঐ যাষ্ট গুন গুন পযর্ন্তই ঠিক আছে।
সবাই আর জোরাজুরি করল না। হাসি ঠাট্টায় কেটে গেলো সন্ধ্যাটা। রাতের ডিনারের আওয়াজ করলে সবাই নিচে নামে।
নেমে দেখে জম্পেশ আয়োজন করে ফেলেছে মায়েরা বৃষ্টির মধ্যে গরম গরম খিচুড়ি বেগুন ভাজা ইলিশ মাছ ভাজা গোশ ভুনা।।
কামরুল সাহেবের বুদ্ধিতে তিন ভাই মিলে টেবিলও সরিয়ে ফেলেছে। ছোটবেলার মতো শীতল পাটি বিছিয়ে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। এর মধে কারেন্ট চলে গেলে। কামরুল সাহেব বাচ্চাদের মতো হইচই শুরু করে দেয়।
— চাদনী দেখো তো ঘরে মোমবাতি আছে নাকি মোমবাতি থাকলে সোনায় সোহাগা।
তার বাচ্চামোতে সবাই একজোট হেসে উঠল। যাই হোক অনেক খুজেও মোমবাতি পাওয়া গেলো না। তখন টর্চলাইটের সাহায্যে সবাই হাসি ঠাট্টার মধ্যে খাওয়া শুরু করল।।
____________________
বৃষ্টি শেষে ভেজা মাটির ঘ্রাণে মুখোরিত ধরনী। পুনম নাক টেনে ছাদের দিকে পা বাড়ায় রাত বারোটা সবাই শুয়ে পরেছে। আজও চারবোন একসাথে ঘুমিয়েছে তবে তাদের সাথে এবারের সঙ্গী একজন বেড়েছে সে হলো মিহি। পুনম অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও দুই চোখের পাতায় ঘুম আনতে পারল না। তাই উঠে জানালার কাছে যায় লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ায়।
ধীর পায়ে ছাদে যেতেই ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে লাগে পুনমের মাথার ওড়না খসে পরে। আজ আর ওড়না টানার তাড়াহুড়া নেই রেলিংয়ের পাশে দাড়িয়ে আকাশ পানে তাকায়।
কখন যে চুলের খোপাটা খুলে যায় টের পায়না। পিছন থেকে খসখসে আওয়াজে সেদিকে তাকায়। চন্দ্রকে দেখে ভরকে যায় মনে পড়ে যায় সন্ধ্যার কথা আসলেই কি চন্দ্রের স্পেশাল কেউ আছে আর থাকলেই এতো লুকোচুরি কেনো??
— এখানে এমন পিচাশিনীর মতো দাড়িয়ে আছিস ক্যান??
পুনম মন খারাপ করল সে কালো বলে তাকে এমন উপহাস করল নিমিষেই চোখ জোড়া ছলছল করল। চন্দ্র ঠোট কামড়ে হাসল তার বোকা রানীর অভিমান হয়েছে। তখনই শুনতে পায় পুনম কর্কশ শব্দে বলল — আমার ইচ্ছা দাড়িয়ে আছি আপনার কি??
— আমারই তো সব ঐ এলো চুলে পশম যুক্ত ঘাড় পিঠময় ছড়ানো চুল আমার যে ঘোর লাগিয়ে দেয়। বিড়বিড় করে বলল,,,
— কি বললেন শুনতে পাইনি,,,
— শুনা লাগবে না
বলেই একহাত দূরত্ব রেখে রেলিংয়ে পিঠ দিয়ে দাড়ায় চন্দ্র। এখন পুনমের পূর্ণ আদলটাই চন্দ্রের সম্মুখে। পুনম চন্দ্রের দিকে একপল তাকিয়ে আবার আকাশে মনোনিবেশ করে। একজন আকাশ দেখতে ব্যস্ত আরেকজন তার নিজস্ব আকাশ দেখতে ব্যস্ত।
— আচ্ছা চন্দ্র ভাই সত্যিই কি আপনার জীবনে স্পেশাল কেউ আছে??
আবারও ঠোঁট কামড়ে হাসে। চন্দ্রের ঠোঁটের কোণে হাসিটা বিরল সহজে কেউ দেখে না। এইযে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সে যেনো একটু বেশীই হাসছে।
— আমার বিষয়ে তোর একটু বেশীই ইন্টারেস্ট দেখছি,,,
— উহু ভুল বললেন আপনার মতো গোমড়া মুখো গন্ডারের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেষ্ট নেই।
বলেই বড় বড় চোখ করে মুখে হাত দিয়ে মিলকা সিংয়ের মত একটা দৌড় দিয়ে ঘরে চলে গেলো।
সেদিকে তাকিয়ে চন্দ্র এবার শব্দ করে হাসল তার হাসির শব্দে শিহাব রিশান ট্যাংকির পিছন থেকে দৌড়ে আসল। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল প্রায় অনেক বছর পর চন্দ্রের মুখে এমন হাসি দেখল তারা। দুই ভাই ঝাপটে ধরে চন্দ্রকে। থেমে যায় চন্দ্রের হাসি রিশান শিহাবকে পেটে ঘুসি দিয়ে সরিয়ে বলে — আমার বউয়ের অধিকার হন্য করিস তোরা,,,
বলেই চন্দ্র চলে যায়। চন্দ্রের যাওয়ার দিকে দুইভাই হতবাক এই ভালো এই খারাপ এই ছেলেটা।।
#চলবে
#পূর্ণিমায়_বিলীন_চন্দ্র
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_২৫
পুনমের জাবির রেজাল্ট পরের দিনই দিয়ে দিয়েছে। সে চান্স পেয়েছে এখন সাবজেক্ট অ্যাপ্লিকেশন করবে। এইসব কাজ পারভেজ সাহেব চন্দ্রের উপর দিয়ে দিয়েছে চন্দ্রও বীনা বাক্যে মেনে নিয়েছে।
পুনমের এখন অবসর সময় কাটবে। রুপশা মুক্তির ও ইনকোর্স এক্সাম শেষ তাই পরের দিন যাওয়ার আগে লিমন সবাইকে দাওয়াত করে গেছে রিমি ঝিনুক মুক্তি পুনম ওদের সাথে করে নিয়ে গেছে। যদিও ঝিনুক ও পুনমের যাওয়া নিয়ে চন্দ্র ও রিশানের মত ছিলোনা তবুও লিমন তাদের রাজী করিয়ে দিয়েছে।
রুপশাদের বাড়িতে এসেও এই চারজনের ঘুমের নিয়ম ব্যঘাত হয়নি তারা এখানেই আড়াআড়ি ভাবে একসাথে শুয়েছে। রুপশা সকাল সকাল রান্নাঘরে ব্যস্ত আজকে তার চাচা শশুর ও আসবে তাদের ফ্যামিলি নিয়ে। রুপশার শশুর শাশুড়ি তার বিয়ের আগেই মারা গেছে। এই চাচা শশুরই তাদের বিয়ে করিয়েছে। লিমন ও তাকে বেশ মানে তিনি ছাড়া আর কারো সাথে লিমনের কোনো যোগাযোগ নেই। তার ছেলের ঢাকায় চাকরী হয়েছে ছেলের কাছেই বেড়াতে এসেছে তারা তাই লিমনকেও এই ফাকে দেখে যাবে দুপুরে এসে বিকালেই চলে যাবে।।
আটটায় পুনমের ঘুম ভাঙ্গে তাড়াহুড়ো করে উঠে। দেখে সবগুলো এখানে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে ঘুমাবে নাইবা কেনো কাল রাতে যে তারা অনেক দেরী করে ঘুমিয়েছে। ঝিনুক রিশশানের অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে দেরী করেছে আর তারা তিনজন ঝিনুকের খিল্লি উড়াতে উড়াতে দেরী করেছে।।
পুনম একেবারে ফ্রেশ হয়েই বের হয়। বের হয়ে দেখে লিমন সোফায় বসে কাদছে পুনম দৌড়ে আসে — কি হয়েছে ভাইয়া এভাবে কাদছেন কেনো আপা কই??
— বুঝলে পুনম তোমার আপা আমাকে একটুও ভালোবাসে না তার অভাবে আমার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা এমনিতে তো কান্না আসে না তাই পিয়াজ নিয়ে বসেছি পিয়াজও কাটা হলো মনে সুখে কান্নাও হলো,,
লিমনের কথা শুনে পুনম মুচকি হাসে। ততক্ষণে রনচন্ডি রুপ নিয়ে রুপশা খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এলো — কি বললে আমি তোমাকে ভালোবাসি না তো কে ভালোবাসে হ্যা সারাদিন তোমার ফর্মায়েশ কে পূরণ করে??
— তো তুমি বলতে চাইছ তুমি আমাকে ভালোবাসো??
— হ্যা অবশ্যই ভালোবাসি নিজের স্বামীকে ভালোবাসব না,,,
কথাটা শেষ করেই পুনমের দিকে তাকিয়ে রুপশা লজ্জা পায়। দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লিমন প্রাপ্তির হাসে পুনম মুচকি হেসে আপার পিছনে দাড়ায় ততক্ষণে বাকী তিনজন ও ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়।
— আরে আপা এতো তাড়াহুড়ো করছ কেনো??
— তাড়াহুড়ো করব না তো কি করব আজকেই খালাটা আসল না তার মেয়ের নাকি জ্বর। আবার আমার চাচা শশুর চাচী শাশুড়ি আসবে এই প্রথম আসবে তারা আপ্যায়ন না করলে হয়।
পুনম তাকায় তার আপার দিকে কথার ভাজে কেমন সংসারী সংসারী ভাব সারাদিন রুপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত আপা কেমন পুরো দস্তে সংসারী হয়ে উঠেছে।
তখনই মুক্তি বলল — আরে চিল কর চার বোন মিলে হাতে হাতে করলে কাজ এমনিতে শেষ হয়ে যাবে।
মুক্তির কথায় ধ্যান ভাঙে পুনমে। ড্রয়িং রুম থেকে লিমন চিল্লিয়ে বলল — তাহলে আগে সবাই ব্রেকফাস্টটা করে নাও শালীদের সাথে খাব হলে এখনো না খেয়ে বসে আছি।
— এইরে দেখেছিস এখানও ব্রেকফাস্ট দেইনি চলচল সবাই আগে ব্রেকফাস্ট করবি,,,,
সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করে হাতে হাতে কাজ ধরে পুনমের ঘর গোছানো সুন্দর তাই তাকে আর রিমিকে ঘর গুছিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দিয়েছে। লিমন বাজারে গেছে আবার।
বেলা একটা বাজে যোহরের আজান দিতে সবার কাজ শেষ হয়। লিমন গোসল করে মসজিদের দিকে রওয়ানা দিতে দিতে রুপশার উদ্দেশ্যে বলল
— গোসল করে নামাজ পরে একটা শাড়ি পরিও চাচা গ্রামের মানুষ তো বউদের শাড়িতেই পছন্দ করবেন।
রুপশা মাথা নাড়িয়ে গেট লাগায় আজ সে অনেক খুশী অনেক দিন পর লিমন তার সাথে স্বাভাবিক ব্যাবহার করছে। এবং আগের চাইতেও ভালো ব্যবহার।
গোসল করে নামাজ পরে বসতেই কলিং বেলের আওয়াজ আসল রুপশা গেট খুলে দেখে তার চাচা শশুর চাচী শাশুড়ি। বিয়ের দিন পরিচয় হয়েছিল। রুপশা তাকে সালাম দিলো তারাও সালামের জবাব নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল।
লিমন তাদের বসায়। রুপশা রান্নাঘর থেকে শরবত নিয়ে তাদের দেয়।
লিমনেরটা দিয়ে ট্রে রেখে লিমনের পাশে বসে।
— বউমা বাসাটা বেশ ভালোই সাজিয়েছো,, ভালোই আছো দুজনে
— জ্বি চাচী আলহামদুলিল্লাহ্ দোয়া করবেন।
— দোয়া তো অবশ্যই করি বউমা আমার বাবা মাহীন ভাইপোটা অনেক কষ্ট করেছে একসময়।
চাচা শশুরের কথা শুনে রুপশা লিমনের দিকে তাকায়। মুখে তার বিষাদের হাসি মনে মনে পণ করে এই লোকটাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখবে।
এর মধ্যে পুনমরা তাদের ঘর থেকে বের হয়ে সালাম দেয় তাদের।
— ওয়ালাইকুম আসসালাম,, বউমা ওরা কারা??
— ওরা আমার বোন চাচা ঐ জন আমার ছোট বোন আর এই জন বড় চাচার মেয়ে আর ওরা ছোট চাচার মেয়েরা,,,,, পুনমদের দেখিয়ে বলল।
চাচীর মুক্তিকে বেশ পছন্দ হয়েছে সে সবার সাথে কথা বলে মুক্তিকে পাশে টেনে সবায়। রিমি ঝিনুক পুনম একে অপরের দিকে তাকায়। তারা কিছু বুঝতে পারে না তবে রুপশা লিমন বুঝে গেছে।
আলাপচারিতার পর তারা খেতে বসেছে আজ রুপশাকে তাদের সাথে বসিয়ে চারবোন বেড়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে।
— হ্যা গো বউমার বড় চাচার মেয়েটাকে আমার ইহানের জন্য মনে ধরেছে,,,
— চুপ করো ফাতেমা তোমার ছেলেকে আগে বিয়ের জন্য রাজী করাও,,
— হ্যা সেটাই করাব এইবার ছেলে বিয়ে দিয়েই গ্রামে যাব আমি,,,,,
স্বামীর কাছে ফিসফিসিয়ে বলল ফাতেমা আক্তার। মনে মনে ভাবলেন ওমন মিষ্টি চেহারার মেয়েকে এবার আমার ছেলে ফিরাতেই পারবে না।
খাওয়া দাওয়া শেষে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে রুপশার চাচা শশুররা চলে গেলেন সবচেয়ে তাড়া ছিলো ফাতেমা আক্তারের। সে আজই বাসায় যেয়ে ছেলের সাথে কথা বলবেন।
— যাক বহুদিন পর একটা বিয়ে খাওয়া যাবে কি বলো??
— কার বিয়ে আপা তোমরা কি কোথাও বিয়ে খেতে যাবা??
পুনমের কথা শুনে রুপশা লিমন হাসে। লিমন বলল — সেটা কিছুদিন পর বুঝবে শালিকা তবে এটা সিয়্যর বাইরে কোথাও যাচ্ছি না বিয়ে খেতে। বলেই রুপশা লিমন একসাথে হেসে দেয়। আরো কিছুক্ষণ গল্প করে লিমন চলে গেলো রেষ্ট নিতে আর রুপশা চলে গেলো রান্নাঘরে। তার পিছন পিছন পুনমও যায়। মুক্তি লজ্জায় আর সেখানে থাকে না চলে যায় তাদের ঘরে।।
পরের দিন হঠাৎই রুপশাদের বাড়িতে আসে ফাতেমা আক্তার ও তার স্বামী শহিদুল। তখন বাড়িতে শুধু পাচঁ বোন ছিলো লিমন অফিসে ছিলো তাই তারা ভাবছিল শপিং এ যাবে তবে তারা যাওয়ার আগেই তারা আসে।
চাচা শশুর শাশুড়িকে দেখে রুপশা ব্যতিব্যস্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে তাকে আটকায় ফাতেমা আক্তার।
— বউমা যাওয়া লাগবে না আমরা এখনই বের হয়ে যাব শুধু তোমার সাথে কথা বলার জন্য এসেছি,,
রুপশা যদিও কাল বুঝেছে তবুও বলল — কি কথা চাচী আম্মা??
— তোমার ঐ বড় চাচার মেয়ে মুক্তি ওকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে আমার ইহানের জন্য। তুমি যদি বল তোমাদের বাড়িতে আমরা কথা আগাতে পারি,,
— চাচী আম্মা আপনি আমাদের বাসায় গিয়ে কথাটা রাখেন দেখেন তারা কি বলে এই বিষয়ে আমি এখনই কিছু বলতে পারছি না,,, ইস্তত করে বলল রূপশা।
রান্নাঘরে থেকে নাশতা রেডী করতে করতে মুক্তি সবই শুনে তাই লজ্জায় সেদিকে আর পা বাড়ায় না পুনম রিমি ঝিনুক মিলে নাশতা নিয়ে যায়।।
#চলবে