বাতাস বলে দেয় পর্ব-০১

0
1

সূচনা পর্ব
#বাতাস_বলে_দেয়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

স্বামীর উপর রাগ করে যেদিন আমাদের বিছানা আলাদা করলাম সেদিনই শাশুড়ি মা কথাটা বললেন। বললেন, “স্বামীর মন জয় করে চলতে না পারলে সংসার ছেড়ে চলে যাও। পৃথিবীতে মেয়ের অভাব পড়েনি। লাগলে আমার ছেলেকে আবার বিয়ে দেব।”

দুপুরের প্রহর শেষ। ঘরের সব কাজকর্ম সেরে সবে গোসলে ঢুকব। শরীর মন দুইটোই ভীষণ ক্লান্ত। তর্ক করতে ইচ্ছে করল না। সহজ গলায় বললাম, “ঠিক আছে। আপনার ছেলেকে আবার বিয়ে দেন। এতে অনন্ত আমি এই জা’হা’ন্না’ম থেকে মুক্তি পাব!”

শাশুড়ি মা নাকিসুরে বিলাপ করে উঠলেন। কান্নার ভংগিমার বললেন, “কেমন মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ! সংসার নাকি জা’হা’ন্না’ম? ঘরসংসারকে কি কেউ জা’হা’ন্না’ম বলে?”

শাশুড়ির কথায় ছোট ননদ তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মিনিট দুয়েক স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সরু গলায় বলল, “ভরদুপুরে এসব কি শুরু করছ মা?”

শাশুড়ি মা তেঁ তেঁ উঠলেন।
“আমি শুরু করেছি? তোরা তো সব সময় আমার দোষ দেখতে পাস। কাল রাতে তোর ভাই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সকালে দেখি- তানজিলা স্টোর রুম পরিষ্কার করে সেখানে বিছানা করছে। এসব কি ভালো কথা?”

“ভালো কথা না ঠিক। কিন্তু তুমি শুধু ভাবীকে জেরা করছ কেন? দু’জনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করতে পারতে।”

“সব দোষ আমার! সবই আমার দোষ! সংসারটা কিভাবে এক রাখা যায় সেই চিন্তা করছি তাতেও দোষ!”

হিমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বিরক্ত গলায় বলল, “মা তোমার সিরিয়াল দেখা বন্ধ করা উচিত। সারাদিন ওইসব কুকীর্তি দেখতে দেখতে মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”

শাশুড়ি মা আমার কথা ভুলে হিমির ওপর চড়াও হলেন। আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে শুনলাম শাশুড়ি মা হিমিকে ইচ্ছেমতো কথা শোনাচ্ছেন। সবকিছু ফেলে এখন হিমির মোবাইল চালানো নিয়ে কথা শুরু করেছেন। হিমি অবশ্য তার কথার জবাব দিচ্ছে না। কে জানে হয়তো তার কথাই শুনছে না!

একান্নবর্তী পরিবারের এই এক সমস্যা। না জেনেশুনেই সবাই নানান মন্তব্য শুরু করে দেয়।

গতকাল রাতের কথা,
খাওয়া শেষে শুতে যাব। ইনান খুব কাঁদছে। ঘুমাতে চাচ্ছে না, আমি তাকে কোলে নিয়ে ঘরে মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছি। এমন সময় আরিফ বলল, “বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এক ঘরে থাকা যায় না। সারাদিন কাজকর্ম করে দুদণ্ড বিশ্রাম নেব সে উপায়টুকুও নেই। কেমন মা তুমি? বাচ্চার কান্না থামাতে পারছ না?”

কথাটা আমার সহ্য হলো না। কর্কশ গলায় বললাম, “তুমি একাই সারাদিন কাজ করো না। আমাকেও কাজ করতে হয়। তাছাড়া বাচ্চারা এমন করে। এতে এতো বিরক্ত হওয়ার কি আছে?”

“রোদে পুড়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করতে হলে বুঝতে পারতে কেন এতো বিরক্ত হচ্ছি। সারাদিন বাড়িতে শুয়ে বসে থাকো, তাই এসব তুমি বুঝবে না।”

“বাড়িতে সারাদিন আমি শুয়ে বসে থাকি? ঘরের কাজ কে করে?”

“ঘরের কাজ! এমন অনেক মেয়ে আছে যারা ঘর সামলে বাইরে চাকরি বাকরি করে। তারা কিভাবে সবকিছু ম্যানেজ করে?”

“তারা কিভাবে সব সামলায় সে কথা আমার জানার দরকার নেই। দুই মিনিট অপেক্ষা করলেই ইনান ঘুমিয়ে পড়ত। সারাদিনে দু’টো মিনিট ছেলের জন্য সহ্য করতে পারলে না? কেমন বাবা তুমি?”

ঝগড়ার এক পর্যায়ে আরিফ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাতে কখন ফিরেছে জানি না। সেই রাগ থেকেই সকালে স্টোররুম পরিষ্কার করেছি। আজ থেকে মা ছেলে ওখানেই ঘুমব। থাকুক সে তার ঘর নিয়ে।

রাতে কথা মনে করতেই মেজাজটা আবার বিগড়ে গেল। ব্যস্ত হাতে গায়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগলাম। আরিফ ইদানিং সব ব্যাপারে একটু বেশিই রেগে যায়। যেন সবকিছুতেই তার বিরক্তি ধরে গেছে। অফিস থেকে ফিরে মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে। প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলে না। সামান্য কিছু হলে তেঁতো এবং তীক্ষ্ণ গলায় ঝগড়া শুরু করে। আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় সাড়ে চার বছর। বিয়ের প্রথম দিকে সে এমন ছিল না। শান্ত এবং কোমল স্বভাব, যে কোন কথাই খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলত। বেশ কিছুদিন ধরে তার মধ্যে এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করছি। দু-একবার জিজ্ঞেসও করেছি। জবাব দেয়নি। এড়িয়ে গেছে।

ইনান কাঁদছে। দুপুরের খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হয়তো উঠে গেছে। তড়িঘড়ি করে গোসল শেষ করলাম। মাথায় গামছা পেঁচিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি হিমি এসেছে। ইনানকে কোলে নিয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। মেয়েটা ভালো। এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়ে হয়েছে। তার ভেতর ননদ সূলভ আচরণ নেই। কথায় কথায় ভাইয়ের বউয়ের সাথে ঝগড়া না। মুখে মুখে তর্ক করে না। কখনো কোন কাজের ভুল ধরে না। বরং সে আমার কাজে অনেক সাহায্য করে।

ইনানের কান্না থেমে গেছে। হিমি বলল, “ভাবী, ভাইয়ার সাথে তোমার কি হয়েছে? প্রতিদিন এমন ঝগড়াঝাটি ভালো লাগে না।”

মুখ কালো করে ফেললাম। স্বাভাবিক গলায় বললাম, “কি আর হবে বলো! বউ পুরনো হয়ে গেলে সব সংসারেই অশান্তি লাগে।”

“এটা কেমন কথা? তোমাদের ব্যক্তিগত কোন সমস্যা থাকলে দু’জনে বসে কথাবার্তা বলে মিটিয়ে ফেলো। ইনান বড় হচ্ছে। ওর বেড়ে ওঠার জন্য একটা সুস্থ পরিবেশ দরকার। তোমরা এমন করতে ও কী শিখবে?”

তার কথার জবাব দিলাম না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, “ইনানকে আমার কাছে দাও। তুমি গিয়ে পড়তে বসো। আম্মা দেখলে রাগারাগি করবেন।”

“বিকেলে পড়তে ইচ্ছে করে না। ইনান আমার কাছেই থাকুক। তুমি খেয়ে নাও। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে চলল এখনো দুপুরের খাবার খেতে পারলে না।”

হঠাৎই চোখ দুটো কেমন জ্ব’লে উঠল। বোধহয় পানি আসবে। চোখে পানি আসার আগে এমন চোখ জ্বা’লা করে। রান্নাঘরে গিয়ে থালায় ভাত নিলাম। এক গ্রাস মুখে দিতে গিয়ে মনে পড়ল– সকালে আরিফ না খেয়ে বেরিয়ে গেছে। টিফিন নিয়ে যায়নি। সে বাইরের খাবার খেতে পারে না। ভাত রেখে ঘরে চলে এলাম। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরিফকে কল দিলাম। দু’বার রিং হওয়ার পর সে কল রিসিভ করল। খটখটে গলায় বলল, “কল দিয়েছ কেন? কি হয়েছে?”

“দুপুরে খেয়েছ?”

“খেয়েছি। আর কিছু বলবে?”

“কি খেয়েছ? তুমি তো বাইরের খাবার খেতে পারো না। তাহলে কি..”

আরিফ কল কেটে দিলো। ভাত মুখে দিতে দিয়ে খেয়াল করলাম– খেতে ইচ্ছে করছে না। খিদে ম’রে গেছে। অথচ এতক্ষণ এমন মনে হচ্ছিল খিদেয় পেটের নাড়িভুড়ি পর্যন্ত হজম হয়ে যাবে। হাত ধুয়ে ফেললাম। ইনান হিমির সাথে খেলছে। ওদেরকে আর বিরক্ত করতে গেলাম না। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম।

ঘুম ভাঙল ইনানের কান্নার শব্দে। হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি খেয়াল নেই। হিমির রুমে গিয়ে দেখি ইনান মেঝেতে বসে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে।

হিমি বলল, “আমার কথা শুনছে না। শুধু কাঁদছে।”

বুঝলাম ওর খিদে পেয়েছে। কোলে নিয়ে মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগলাম। শাশুড়ি মা বললেন, “মেয়ে মানুষের এত ঘুম থাকলে বাচ্চা মানুষ করা যায় না।”

“হয়, আমি তো সারাদিন ঘুমিয়ে থাকি। বাড়ির সব কাজ অন্য মানুষ করে দিয়ে যায়।”

“এসব কাজ আমরাও করেছি। তখন আরও এই গ্যাসের চুলা, ফ্রিজ, রাইস কুকার ছিল না। মাটির চুলায় রান্না করতে হতো। ঝুড়ি ভরা মাছ কু’টে ধুয়ে মশলা কসিয়ে জ্বাল দিয়ে রাখতাম। এখনের মেয়ে বউদের মতো এত আহ্লাদ ছিল না আমাদের।”

“ঠিক বলেছেন আম্মা। আমাদের অনেক আহ্লাদ। তা আপনাদের আমলে তো ফ্যান লাইটও ছিল না। তাহলে বরং একটা কাজ করি। আপনার ঘরের লাইট- ফ্যানের লাইনটা কে’টে দিই। বিদ্যুৎ বিল কম আসবে।”

শাশুড়ি মা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। তার দৃষ্টিকে গুরুত্ব না দিয়ে ঘরে চলে এলাম। ইনানকে খাইয়ে বোরকা হিজাব পরলাম। একটু বাইরে যেতে হবে। টুকটাক কেনাকাটা আছে। দু’দিন ধরে আরিফকে এনে দিতে বলেছি। দেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে আজ আমার বের হতে হলো।

বেলা পড়ে এসেছে। খানিকক্ষণ বাদে সন্ধ্যা নামবে। বাড়ির থেকে একটু সামনে একটা মুদির দোকান আছে। ওখানেই প্রয়োজনীয় জিনিস পেয়ে যাব। দোকানে গিয়ে দেখি সুমি দাঁড়িয়ে আছে। শ্যাম্পু সাবান এইসব কিনছে। সুমি আরিফের কলিগ। দু’জনে একই শিফটে চাকরি করে। সুমি আমাকে দেখে হাসল। ইনানের গাল টেনে দিয়ে বলল, “ভাবী, কেমন আছেন? বাচ্চার শরীর ভালো?”

হাসি মুখে বললাম, “এইতো ভালো আছি। আপনার কি খবর? অফিস শেষ?”

“অফিসের সময় শেষ হয়নি। আমার একটু কাজ আছে। তাই ছুটি নিয়ে চলে এসেছি।”

“ওহ আচ্ছা।”

সুমি হাসল। ইতস্তত করে বললাম, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলুন কি জানতে চান?”

“ইনানের বাবাকে দুপুরে খেতে দেখেছেন? আসলে ওর বাবা বাইরের খাবার খেতে পারে না। যাওয়ার সময় টিফিনটাও নিয়ে যায়নি। তাই জানতে চাইছি।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আরিফ ভাই খেয়েছে তো। আমাদের অফিস নতুন একজন স্টার্ফ এসেছে। সুরভি আপা, উনার টিফিন নিয়ে খেয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করেছি।”

“ওহ!”

“আচ্ছা আমি, আমি আসছি। দেরি করে যাচ্ছে।”

“ঠিক আছে।”

মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠল। ইনানকে শক্ত করে ধরে নিজেকে সামলে নিলাম। মনের ভেতর কিছু কুৎসিত চিন্তা উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। তবে আমি সেসবের কিছুই ভাবতে চাইছি না। চোখ বড় করে লম্বা শ্বাস নিলাম। রাস্তায় মধ্যে নিজেকে অপ্রস্তুত দেখাতে চাই না।

আরিফ বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার পর। ফিরিয়েই বাথরুমে ঢুকে গেল। লম্বা সময় ধরে গোসল করল। সন্ধ্যায় চা বানিয়েছিলাম। এক কাপ চা নিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলাম। নরম গলায় বললাম, “বাড়িতে ফিরে গোসল করলে যে?”

আরিফ বাঁকা চোখে তাকাল। বিরক্ত গলায় বলল, “গোসল কেন করেছি সেই কৈফিয়ত চাইছ? গোসল করতে হলেও কি তোমাকে বলে নিতে হবে?”

“তেমনটা কখন বললাম? শরীর খারাপ কি-না সেজন্যই জানতে চাইছি।”

“শরীর কি-না জানতে গোসল কেন করেছি সে কথা জিজ্ঞেস করতে হবে? আমাকে কি তোমার বোকা মনে হয়?”

কথা বাড়ালাম না। শুকনো কাপড় ভাজ করতে শুরু করলাম। ঠিক তখন-ই শাশুড়ি মা আমাদের ঘরে এলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “আরিফ তোমার বউকে আমার সাথে ঠিকঠাক করে কথা বলতে বলবে। এই বাড়িতে আমি তোমার কামাই খাই না।”

আরিফ আমার দিকে তাকাল। স্বাভাবিক গলায় বলল, “মা’কে কি বলেছ?”

“তোমার জন্য মেয়ে খুঁজতে বলেছি।”

“এ কথার মানে?”

শাশুড়ি মা কিছু বলতে যাবেন তার আগে শ্বশুর আব্বু এলেন। শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আরিফের মা, ঘরে এসো। তোমার সাথে কথা আছে।”

শাশুড়ি মা কটমট দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তারপর শশুরের পেছন পেছন বেরিয়ে গেল। আরিফ বলল, “তোমাকে একটা কথা বলি। সারাদিন কাজ করে বাড়িতে ফিরে এসব বিচারব্যবস্থা করতে পারব না। হয় মায়ের সাথে মানিয়ে চলবে নয়তো।”

“নয়তো কি?”

সে কথার জবাব দিলো না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রাত বাড়ছে। বাইরে বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। আগামীকাল পহেলা বৈশাখ। ঝড় হবে নাকি? জানালা দিকে আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদ তারা নেই। বোধহয় কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। ঠিক আমার জীবনে মতো!

হঠাৎই ঝুম বৃষ্টি নামাল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই সাথে বাতাস। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। ইনান কাঁদছে। আমার জীবনের সাথে প্রকৃতির কি অদ্ভুত মিল! যেন তারা একে-অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।

চলবে