বাতাস বলে দেয় পর্ব-০৩

0
1

#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

৩.
আরিফ বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার পর। তার চোখ-মুখে ফোলা ফোলা ভাব যেন অনেকক্ষণ কেঁদেছে। হিমি ইনানের সাথে খেলছিল। আরিফকে দেখে বলল, “ভাইয়া সারাদিন কোথায় ছিলে? কল রিসিভ করছিলে না কেন?”

আরিফ তার প্রশ্নের জবাব দিলো না। বিরক্ত গলায় বলল, “তোর ঘরে যা। আমি একটু ঘুমাব।”

হিমি ইনানকে কোলে নিয়ে উঠে গেল। আরিফ বলল, “তানজিলা বাতি নিভিয়ে দাও। আলো চোখে লাগছে।”

একটা মানুষ এভাবে বদলে যেতে পারে ওকে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতে পারতাম না। কয়েক মাস আগেও বাড়ি ফিরে প্রথমে ইনানকে কোলে নিয়ে শাশুড়ি মায়ের ঘরে যেত। তার সাথে দেখা করে এসে চা বানিয়ে দিতে বলত। সারাদিন কোথায় কি করেছে সেসব বর্ননা করত। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হতাম। মাঝেমধ্যে বেশ ভালোই লাগত।
অথচ এখন! সে আর আগের মতো নেই। প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলে না। আজ
সারাদিনে হাজারবারের উপরে কল দিয়েছি। রিসিভ করেনি। এখনও ভালো-মন্দ কিছু বলছে না। কি অদ্ভুত!

বাতি নিভিয়ে চলে যাচ্ছিলাম হঠাৎই আরিফ আমাকে তার কাছে ডাকল। হালকা গলায় বলল, “এক কাপ চা বানিয়ে দেবে? তোমার হাতের চা না পেলে চায়ের তেষ্টা মেটে না।”

খুশি হব নাকি অভিযোগ জানাব বুঝতে পারলাম না। তাই আর কোন কথাও বললাম না। চুপচাপ রান্নাঘরে চলে গেলাম। চা বানিয়ে নিয়ে এসে দেখি আরিফ ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে আর বিরক্ত করলাম না। শাশুড়ি মা বললেন, “আরিফের কি হয়েছে? সারাদিন কোথায় ছিল?”

“জানি না আম্মা। আমায় কিছু বলেনি।”

কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলাম না। নিজের কাজে চলে গেলাম। কারণ আমি জানি এরপর শাশুড়ি মা যেসব কথা বলবে না সেসব কথা আমার সহ্য হবে না। মন খারাপের দিনে ঝগড়া করতে চাই না। আজকে শুধু আমার মন খারাপ-ই নয় বরং আমি নিজের ওপর অনেক বেশি বিরক্ত। একটা মানুষ আমায় দেখেও দেখছে না, কথা বলতে চাইছে না অথচ আমার হৃদয় সারাক্ষণ শুধু তার কথা ভাবছে। তাকে নিয়ে চিন্তা করছে। তাকে হারানোর ভয় পাচ্ছে। ভালোবাসায় এই অনুভূতিটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর এবং কষ্টের।

সারাদিনের কাজ পর শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়। বাচ্চা সামলে সংসার কাজ শেষ করে রাতে বিছানায় পিঠ দিতেই ঘুমিয়ে পড়ি। তবে আজ কেন যেন ঘুম আসছে না৷ মন বলছে আমার সংসারে খারাপ কিছু হচ্ছে। এতটাই খারাপ কিছু– যা কোন নারী দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না। মনের সাথে অভিনয় করলাম না। সত্য স্বীকার করে নিলাম। সুরভিকে আমার ভালো লাগছে না। মন বলছে ওর সাথে আরিফের নিশ্চয়ই কোন না কোন সম্পর্ক আছে। খুব ভালো বন্ধুত্ব অথবা অ’বৈ’ধ প্রেমের সম্পর্ক। সুমির কথা অনুযায়ী সুরভি নামের মেয়েটা অফিসে জয়েন হওয়ার পর থেকে আরিফের ব্যবহার বদলে গেছে। তেমন কিছু হলে আমি আরিফকে ক্ষমা করতে পারব না। কখনোই পারব না। ওকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাব। কিন্তু ইনান? ইনানের কি হবে? এই বয়সেই বাবার ভালোবাসা হারাবে?

আর কিছু ভাবতে পারলাম না। ঠিক করলাম কাল আরিফের অফিসে যাব। ব্যাপারটা খোলাসা হওয়া জরুরি। তেমন কিছু হলে সরাসরি ওদের সাথে কথা বলব।
রাত বাড়ছে। ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টি নামবে নাকি?

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়ে হিমির ঘরে গেলাম। নিচু গলায় বললাম, “আজকের দিনটা বাড়িতে থাকতে পারবে?”

হিমি সবে ঘুম থেকে উঠেছে। আড়মোড়া ভেঙে লম্বা হাই তুলল। জড়ানো গলায় বলল, “কোন কাজ আছে নাকি?”

“একটা কাজ আছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তোমার সাহায্য চাই।”

“কি করতে হবে বলো। সকালের নাস্তায় নুডলস রান্না করে দিলে যে কোন কাজ করতে রাজি।”

“আমি তোমার ভাইয়ের অফিসে যাব। তোমাকে ইনানের খেয়াল রাখতে হবে।”

হিমি একটু জোরেই বলল, “ভাইয়ার অফিসে যাবে? কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি?”

তড়িঘড়ি করে ওর মুখ চে’পে ধরলাম। ফিসফিসিয়ে বললাম, “আরে চিৎকার করো না। না জানিয়ে যাব। দুপুরে বিরিয়ানি রাঁধব। ওটাই দিতে যাব।”

হিমি একটু সুর টেনে বলল, “ও হো! সারপ্রাইজ? কাজ হয়ে যাবে ম্যাডাম। তবে কিছু পারিশ্রমিক দিতে হবে। এই যেমন সন্ধ্যায় আদা লেবু চায়ের সাথে কুড়মুড়ে পাপড় ভাজা অথবা বিকেল বিকেল ঝাল ঝাল ফুচকা।”

“ঠিক আছে। হয়ে যাবে।”

হিমি হাসল। ব্রাশে টুথপেষ্ট মাখাতে মাখাতে বাথরুমে ঢুকল। এই মুহূর্তে ওকে সত্যি কথাটা বললাম না। বললে হয়তো বিশ্বাসও করত না। শত হলেও আরিফ ওর আপন ভাই। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম।

দুপুর হয়ে এসেছে। রান্না প্রায় শেষ। আরিফ আজকেও টিফিন নিয়ে যায়নি। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেছে। বেরিয়েছে ওই সুরভির কল পেয়ে। হঠাৎই চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে কাজে মন দিলাম। আর মাত্র কিছু সময়। তারপরই সবটা খোলাসা হয়ে যাবে।

আরিফ অফিস বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় আবার অনেক কাছেও না। মাঝামাঝি দূরত্ব। রিকশায় যেতে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। ঝাঁঝাঁ রোদের মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। একটা রিকশাও নেই। দুপুরে এদিকে তেমন কেউ আসে না। মিনিট দশেক দাঁড়ানোর পর রিকশার দেখা পেলাম। ভাড়া ঠিক না করেই রিকশায় উঠে বসলাম। রোদের মধ্যে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। শরীর ঘেমে গেছে। তেষ্টা পাচ্ছে।

অফিসে ঢুকতেই সুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ভাবী আপনি? আরিফ ভাইকে ডেকে দেব নাকি?”

তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। নরম গলায় বললাম, “তাকে কোথায় পাব বলেন। নিজে গিয়ে দেখা করে নিচ্ছি।”

“ইমম! আরিফ ভাই, সুরভি আপা সবাই ক্যান্টিনের দিকে গিয়েছে। আমিও যাচ্ছিলাম।”

“ঠিক আছে। আমি আপনার সাথে আসছি।”

সুমি হাসি-হাসি মুখ করে উঠে এলো। ক্যান্টিনের পরিবেশ ভালো। ছিমছাম ধরনের গোছগাছ। একটা টেবিলে আরিফ এবং বেশ কয়েকজন ছেলে বসে আছে। ওদের থেকে একটু দূরের একটা টেবিলে একজন ভদ্রমহিলা বসা। সুমি ভদ্রমহিলার সামনের চেয়ারে বসল। ঝলমলে গলায় বলল, “সুরভি আপা, আরিফ ভাইয়ের ভাগ্য দেখেছেন! বাইরের খাবার খেতে পারে না বিধায় ভাবী উনার জন্য টিফিন নিয়ে এসেছে।”

আরিফ চমকে পেছনে ফিরল। উঠে এসে বলল, “তানজিলা! তুমি আবার আসতে গেলে কেন? আমি কিছু একটা খেয়ে নিতাম।”

আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। যদিও মুখে হাসি ধরে রেখেছি তবু বিস্মিত ভাবটা চাপা দিতে পারছি না। যেমনটা ভেবেছিলাম সুরভি তেমন নয়। বেশ বয়স্ক একজন মহিলা। কম করে হলেও পঞ্চান্ন ছাপান্ন বছর বয়স, মোটা থলথলে শরীর, মুখের চামড়ায় ভাজ পড়ে গেছে। আরিফ কখনো এই মহিলার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়বে না।

সুমি বলল, “ভাবী, কি নিয়ে এত চিন্তা করছেন? আমাদের সাথে এসে বসুন।”

সুরভি বলল, “আরিফ, একা খেলে খাবার হজম করতে পারবে না। বিরিয়ানির গন্ধে খিদেটা আরও বেড়ে গেল। আমাদেরকেও একটু ভাগ দাও।”

আরিফ টিফিনবক্স এগিয়ে দিলো। আমি বললাম, “আচ্ছা তাহলে আপনারা খাওয়া-দাওয়া করেন। আমি যাই। ইনানকে রেখে এসেছি।”

সুমি যেতে দিলো না। হাত ধরে ওদের পাশে বসালো। জোর গলায় বলল, “আরে একটু সময় বসলে এমন কোন ক্ষতি হবে না। তাছাড়া খাওয়ার সময় কাউকে খালি মুখে পাঠাতে নেই।”

“আমি খেয়ে এসেছি। খিদে নেই।”

সুরভি বলল, “ভাত না খেলেও চা পান করতে হবে। এখানের চা খুব ভালো।”

সুমি আর জোর করল না। মিনিট দশেক বসে সবার খাওয়া দেখতে লাগলাম। সুরভি বেশ আয়েশ করে মুরগির রান চিবুচ্ছে। আরিফের সাথে বসা ছেলেগুলো একে একে বেরিয়ে গেল। তাদের খাওয়া শেষ। আরিফ বলল, “চলো, তোমাকে রিকশা ঠিক দিচ্ছি।”

সুরভি বলল, “আহ! মেয়েটার সাথে একটু ভালো করে কথাও বলতে পারলাম না। যে মেয়ে এমন সুন্দর বিরিয়ানি রান্না করে তার সাথে দুদণ্ড গল্প না করলে খুবই খারাপ দেখায়। তুমি যাও। ও কিছুক্ষণ পর যাবে।”

আরিফ এক পলক আমার দিকে তাকাল। তারপর মুখ গোমড়া করে বেরিয়ে গেল। সুমি বলল, “আরিফ ভাই বোধহয় রেগে গেলেন।”

সুরভি তার কথায় পাত্তা দিলো না। বিরিয়ানির প্রশংসা করতে লাগল। আমি বললাম, “আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”

সুরভি খুব মাথা দোলাল। বলল, “নিশ্চয়ই পারো। তবে দু’টো কথা হলে আরও একদিন বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াতে হবে। হা হা হা!”

“এই বয়সে আপনি চাকরি করছেন? না মানে সুমি আপু বলেছিলেন– আপনি অফিসে নতুন। তাই কৌতুহল হচ্ছে।”

সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হতাশ গলায় বলল, “কি আর করব বলো! ছেলে মেয়ে নেই, স্বামী সংসার নেই। খেয়ে-পরে বাঁচতে গেলে কাজ তো করতেই হবে।”

“ওহ আচ্ছা! আপনি বিয়ে করেননি?”

“বিয়ে! হ্যাঁ বিয়ে করেছিলাম। সে অনেক কথা। লিখতে বসলে উপন্যাস হয়ে যাবে।”

সুমি বলল, “ভালো কথা মনে পড়েছে। সুরভি আপা, আপনি কখনো আপনার স্বামীর ব্যাপারে বলেননি। আজকে একটু বলেন। সত্যিই কি আপনার বিয়ে হয়েছিল?”

“হয়েছিল। আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগের আমার বিয়ে হয়েছিল। আট বছর সংসার করার পর উনি মা’রা যান। তারপরে আর বিয়ে করিনি।”

কৌতূহলী গলায় বললাম, “কেন? আর বিয়ে করেননি কেন?”

সুরভি আয়েশ করে বসল। ঝলমলে গলায় বলল, “বারো বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়েছে। আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা, অজপাড়া গ্রাম। বারো বছর মানে অনেক বয়স। খুব দুরন্ত স্বভাবের ছিলাম। সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতাম। মা বাবা ধরে বেঁধে এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। উনি তখন ঢাকায় থাকতেন। সরকারি চাকরি করতেন। বিয়ের পর আমাকেও ঢাকায় নিয়ে গেলেন। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বললেন– আমার মতে মেয়েদের পড়াশোনা করা জরুরি। তোমাকে আমি শেষ পর্যন্ত পড়াব।
জানো? আমাদের খুব সুখের সংসার ছিল।
বিয়ে নিয়ে ভয় যা পেয়েছিলাম দু-দিনেই সব ভয় কে’টে গেল। মানুষটা আমার এতটাই আপন হয়ে উঠেছিল যে সে কথা আর কি বলব! দিনে উনি অফিসে থাকতেন। ফিরতেন বিকেল মিলিয়ে গেলে। ফেরার পথে হাতে করে নানান সব খাবার নিয়ে আসতেন। সন্ধ্যায় চা নাস্তা সেরে আমাকে পড়াতে বসতেন। খুব কড়া মাস্টার। গুনে গুনে দু’ঘন্টা বই পড়িয়ে তবেই ছাড়তেন।
মানুষটা খুব যত্নশীল এবং ভালো মনের ছিল। মেয়েরা এমন চরিত্রকে নিজেদের কল্পনায় পুষে রাখে। ভাগ্য করে আমি তাকে পেয়েছিলাম।
ছুটির দিনগুলোতে উনি আমাকে রান্না করে খাওয়াতেন। উনার রান্নার হাত খুব ভালো ছিল। কাঁচা পেঁপে দিয়ে এমন একটা তরকারি রাঁধত, ঐ এক পদ দিয়েই দু’প্লেট ভাত খাওয়া যেত।
কিন্তু কি বলো তো? কথায় বলে না সুখের ভাত বেশিদিন সহ্য হয় না। আমার সাথে ঠিক তা-ই হয়েছে। বিয়ের আট বছরের মাথায় উনি মা’রা গেলেন। সুস্থ মানুষ অফিসে গিয়েছে। হঠাৎই দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে বলল– ‘সুরভি আমার কাছে একটু বসো। তোমার হাতটা আমার বুকের উপর রাখো।’
ব্যস্ত হয়ে তার কাছে গেলাম। গায়ে মাথায় হাত দিয়ে বললাম– ‘কি হয়েছে? এমন করছ কেন?’
উনি বললেন– ‘শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। তুমি কাছে থাকলে ভালো লাগে। তাই বাড়িতে চলে এলাম।
ছেলেমানুষি করত অনেক। আমার কাছ থেকে বেশ কয়েকবার কথা নিয়েছে উনি ছাড়া অন্য কোন পুরুষকে আমার জীবনে ঠাঁই দেব না।”

এতটুকু বলার পর সে থামল। চোখের পানি মুছে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আমি বললাম, “তারপর? তারপর কি হলো?”

“তারপর! ওদিনই উনি মা’রা যান। আমার হাতটা উনার বুকের ওপরে ছিল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শক্ত করে ধরে রেখেছিল। বুঝতে পারিনি ওটাই শেষবার। সারাজীবনই এই আফসোসটা রয়ে যাবে। সেদিন যদি উনাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারতাম।”

“তারপর আর বিয়েসাদী করেননি? মানে আপনার মা বাবা আত্মীয় স্বজনের চেষ্টা করেনি?”

“বিয়ে জীবনে একবারই হয়। আর কাকেই বা বিয়ে করব! উনার মতো করে কাউকে মনে ধরে না। এসব নিয়ে ভাবতে গেলে উনি আমার স্বপ্নে আসেন।”

কি বলব বুঝতে পারলাম না। আমার চোখ দুটোও কেমন ভিজে উঠেছে। সুমির চোখেও পানি। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, “স্বামী সরকারি চাকরি করলে তো আপনার অবস্থা ভালোই থাকার কথা। পেনশন পান না?”

“না রে! পেনশন পাই না। তখন বিক্রি করে দিয়েছিলাম। টাকাগুলো ব্যাংকে রাখা ছিল। বছর দুয়েক আগে সব টাকা ভাইয়ের ব্যবসায় দিয়েছি। আর ফেরত দেয় না। বাধ্য হয়ে চাকরিতে যোগ দিতে হলো। কাজ জানতাম। আগে বেশ কয়েক বছর চাকরি করেছি। অভিজ্ঞতা আছে তা-ই এখানে নিয়েছে।”

“ওহ আচ্ছা। আপনাদের দাওয়াত রইল। একদিন আমাদের বাড়িতে আসবেন। আসলে আমাকে এখন যেতে হবে। ইনান মানে আমার ছেলে বাড়িতে রয়েছে। বাচ্চা মানুষ। বুঝতেই তো পারছেন।”

সুরভি বলল, “ঠিক আছে। যাও তুমি। তোমার সময় নষ্ট করলাম।”

অল্প হাসলাম। বেরিয়ে দেখি আরিফ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে একটা রিকশা দাঁড়ানো। আমাকে দেখে ইশারায় তার কাছে ডাকল। কোমল গলায় বলল, “রিকশায় ওঠো।”

“তুমিও কি যাবে নাকি?”

“হ্যাঁ যাব। চিন্তা করতে হবে না। ছুটি নিয়ে নিয়েছি।”

রিকশায় উঠে বসলাম। বেশ অনেকদিন পর আরিফের সাথে রিকশায় বসেছি। হালকা বাতাস লাগছে গায়ে। মন অনেকটা ভালো হয়েছে। পরিস্থিতি যা দেখলাম সুরভির সাথে ওর কোন ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব না। হয়তো অফিসের কোন কাজ ছিল। আনমনে বসে নানান কথা ভাবতে লাগলাম। হঠাৎই খেয়াল হলো– রিকশা বাড়ির পথে যাচ্ছে না। নির্জন রাস্তায় চলে এসেছে। আরিফের দিকে তাকালাম। আরিফ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ-মুখ শান্ত। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পলক ফেলছে না। তার চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছে না।

কেমন যেন ভয়ভয় করতে লাগল। তরল গলায় বললাম, “রিকশা এদিকে কোথায় যাচ্ছে? এটা তো বাড়ির পথ নয়।”

আরিফ মুচকি হাসল। বরফ শীতল গলায় বলল, “এই পথের শেষে খুব সুন্দর একটা জায়গা আছে। ওখানে গেলে তোমার মনের কষ্ট, হতাশা, দুশ্চিন্তা সবকিছু দূর হয়ে যাবে। সব ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে।”

“তার মানে? কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“অপেক্ষা করো। ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়।”

রিকশা আগের থেকে দ্রুত চলছে। বাতাসের জোর বেড়েছে। আরিফের চুল উড়ছে। দূরে কোথাও ঘুঘুপাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘুঘুটা খুব করুণ সুরে ডাকছে।

চলবে