বাতাস বলে দেয় পর্ব-০৯

0
16

#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

৯.
আরিফ ফিরল সন্ধ্যার পর। ততক্ষণে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশে তারা ফুটে উঠেছে। একফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। সে হাত-মুখ ধুয়ে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসল।

হামজা বলল, “ভাইজানের অফিস কেমন চলে? সবাই ঠিকঠাক আসে তো?”

আরিফ ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সরু গলায় বলল, “সবাই ঠিকঠাক আসে মানে?”

“মানে আপনার অফিসে যারা কাজ করে, তারা সবাই অফিসে আসে কি-না তাই।”

“হ্যাঁ আসে। হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“ওই সুরভির বাসায় তো আপনাদের অফিসের প্রায় সবারই যাওয়া-আসা ছিল। বাড়ির দারোয়ান বলল– একটা মেয়েও নাকি আসত।”

“যেতে পারে। আমি ঠিক জানি না।”

“আপনি কখনো যাননি?”

“না, আমি কখনো যাইনি। হিমির সাথে দেখা করেছিলে শুনলাম। তোমাকে কিছু বলেছে?”

“না আমাকে তেমন কিছু বলেনি। ওর কথার ধরন অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু লুকাতে চাইছে।”

“এ কথার মানে কি? কিছু লুকাতে চাইছে বলতে কি বোঝালে? হিমি কি লুকাবে?”

“জানি না। তদন্তের ব্যাপারে সবাইকে সন্দেহ হয়।”

“যাকে বাঁচাতে তদন্ত করবে তাকেও সন্দেহ হয়?”

হামজা অত্যন্ত সহজ গলায় বলল, “আমার কাজ সত্যের খোঁজ করা। আসল অ’প’রা’ধীকে সবার সামনে নিয়ে আসা। এর বাইরে আর কিছুই নয়। অ’প’রা’ধী হলে আমি তাকে বাঁচানোর জন্য বিন্দুমাত্র চেষ্টা করি না।”

“সত্যের কতটুকু উদ্ধার করতে পারলে?”

“এক ফোঁটাও না। তবে আমার বেশ কয়েকজনকে সন্দেহ হয়। বিশেষ করে ওই বাড়ির মালিক– মকবুল সাহেবকে।”

“তাকে সন্দেহের কারণ?”

“জানি না। কথার ধরন ভালো লাগেনি।”

আরিফ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। হামজা বলল, “আপনারা আর কিছু জানলে আমাকে বলুন। খুব গোপন কিছু থাকলেও বলুন। সবটা না জানতে তদন্ত করা কঠিন।”

আমি তাকে শার্টের ব্যাপারটা বলতে গিয়েও বললাম না। শাশুড়ি মা ডাকছেন। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যদি খুব বেশি রাত হয়নি। সবে সাড়ে সাতটা বাজে।

আরিফ বলল, “এতো তাড়াতাড়ি খেতে ডাকছ কেন?”

শাশুড়ি মা মলিন গলায় বললেন, “গরুর গোশত রান্না করেছি। তেল জমে গেলে খেতে পারবি না। তাছাড়া হামজা গ্রামের থাকে। ওদিকে সবাই সন্ধ্যা সন্ধ্যা খাবার খায়।”

কথাগুলো বলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অস্পষ্ট ভেজা গলায় বললেন, “হিমিটা গরুর গোশত পছন্দ করে।”

তার কন্ঠের আদ্রতা এতটাই বেশি ছিল যে আমার চোখ দু’টোও কেমন যেন ভিজে উঠল। আহা! একজন মা কি কখনো তার সন্তানকে রেখে ভালো মন্দ খেতে পারে? সন্তানের পছন্দের খাবার দেখে নিজেকে সামলাতে পারে– যখন তার সন্তান বিপদে থাকে। মায়ের এই অনুভূতি বোধহয় একজন মা’ই বুঝতে পারে।

আরিফ খুব বেশি খেতে পারল না। দুই গ্রাস মুখে দিয়ে ঘরে চলে গেল। যেতে যেতে ক্লান্ত গলায় বলল, “তানজিলা, ঘরে এসো।”

শাশুড়ি মা বললেন, “কেন ডাকছে শুনে এসো। এসে তুমিও খেয়ে নাও। ইনান তোমার শশুরের কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম ভাঙলে আমি ওকে দিয়ে আসব।”

আরিফ বিছানায় বসে আছে। তার চোখ-মুখে ক্লান্তির ছাপ। আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। গায়ে হাত রেখে বললাম, “তোমায় এমন বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন? কিছু কি হয়েছে?”

সে হতাশ গলায় বলল, “নতুন আর কি হবে বলো! আজ ব্যাংকে গিয়েছিলাম। টাকা পরিশোধ করার জন্য কতদিন সময় পাব জিজ্ঞেস করলাম। ওরা নিধারিত সময়ের চেয়ে সামান্য কয়েকদিন বেশি দেওয়ার কথা বলল।”

“টাকা তো সবাই দিয়েছ। সবার কি খবর?”

“খবর আর কি? সুরভি থাকলে হয়তো কিছু করা যেত।”

আরিফের চোখ-মুখ আরও বিষন্ন হয়ে উঠল। প্রসঙ্গ ঘোরাতে বললাম, “হিমি আমাকে একটা কথা বলেছে।”

“কি কথা বলেছে?”

“ওই যে মেয়ের কথা বলেছিলাম না। আমাকে ছি’ন’তা’ইকারীর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। মেয়েটা নাইমার সহপাঠী। বেশ বুদ্ধিমতী। এসব তদন্তও ভালো বোঝে। হিমি গোয়েন্দা হিসাবে ওকেই চাইছে।”

“তোমার কি ধারণা মেয়েটা রাজি হবে? তাছাড়া আমরা তাকে কোথায় পাব?”

“ওদের কলেজে গেলে পেতে পারি। তাছাড়া হিমি ওদের এলাকার নাম বলেছে। নাইমার বাবা ভাইয়ের নামও বলেছে।”

আরিফ ঘড়ির দিকে তাকাল। আলমারি থেকে শার্ট বের করে পরতে পরতে বলল, “তৈরি হও। নাইমাদের বাড়িতে যাব।”

“রাতেই? কাল সকালে গেলে ভালো হতো না?”

“হাতে সময় নেই তানজিলা। কোর্টের তারিখ পনেরো দিন পিছিয়ে গিয়েছি। সন্ধ্যায় কল দিয়েছিলাম। উকিল বলল– কোর্ট না বসলে সে কিছু করতে পারবে না।”

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলাম। তৈরি হয়ে শাশুড়ি মা’কে ডেকে সবটা বুঝিয়ে বললাম। তিনি বললেন, “রাত-বিরেতে ইনানকে সাথে নেওয়ার দরকার নেই। আমার কাছে থাকুক। জেগে উঠলে দুধ গরম করে খাইয়ে দেব।”

অল্প হেসে আরিফের সাথে বেরিয়ে গেলাম। শাশুড়ি মা আমায় খুব একটা সহ্য করতে না পারলেও ইনানকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। উনার কাছে রেখে যেতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

রাতের আকাশ পরিষ্কার। মেঘ নেই। বেশ গরম পড়েছে। শরীর ঘেমে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে এটা বৈশাখ মাস। আরিফ বলল, “ওদিকে হাঁটছ কেন? এদিকে এসো। এসে আমার হাত ধরো।”

“রাস্তার মধ্যে হাত ধরব?”

“সমস্যা থাকলে থাকুক। ধরতে হবে না। তবে এবার কারো খপ্পরে পড়লে নাইমা আসবে না। আমিও কোন ধরনের সাহায্য করব না।”

এগিয়ে এসে ওর হাত ধরলাম। জায়গাটা বেশ ফাঁকা। লোকজন নেই বললেই চলে। দুটো নেড়ি কুকুর রাস্তা পাহারা দিচ্ছে।

অনেক কাঠ-খড় পু’ড়ি’য়ে নাইমাদের বাড়ির খোঁজ পেলাম। বাড়িটা বেশ সুন্দর। ছিমছাম করে গোছানো। উঠানের একপাশে প্রকাণ্ড এক বসরাই গোলাপের ঝাড়। অসংখ্য ফুল ফুটে আছে। বাতাসে হালকা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করার পর একজন যুবক এসে সদর দরজা খুলে দিয়েছে। আমরা দু’জন তাকে অনুসরণ করে বাড়ির বারান্দায় এসে বসলাম। ভদ্রলোক বেশ সুদর্শন। শক্ত-পোক্ত চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। কথাবার্তার ধরণও খুব গোছানো। সে আমাদের সামনের চেয়ারে বসল। বিনয়ের সাথে বলল, “আমার নাম হাবিব। বলুন, আপনাদের কিভাবে সাহায্য করতে পারি?

আরিফ তাকে সবকিছু খুলে বলল। সব শুনে হাবিব ভ্রু কুঁচকে ফেলল। গম্ভীর গলায় বলল, “এসব কাজ খুবই ঝু’কি’পূ’র্ণ। তাছাড়া নাইমাও বেশ ছোট। জেনে-বুঝে আমি আমার বোনকে এমন বিপদের মধ্যে যেতে দিতে চাই না। আপনাদের অন্য কোন সাহায্য লাগলে বলুন।”

“মিস্টার হাবিব, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। দায়িত্ববান ভাই কখনো চাইবে না তার বোনের গায়ে বি’প’দের আঁচ লাগুক। কিন্তু আমিও আমার বোনের জন্য এসেছি। ওর কথাতেই এসেছি। আমরা একজন গোয়েন্দাও ঠিক করেছি। কিন্তু হিমি ওর বান্ধবীকে চাচ্ছে। আমার বোনটা ব’ন্দী। যদি একটু ভেবে দেখতেন।”

“আপনার কথা বুঝতে পারছি এবং আপনাকেও ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। আপনার বোন ব’ন্দী, অপরাধ না করলে সেখানে সে বেশ নিরাপদে আছে। কিন্তু নাইমা বাইরে থাকবে। যে কেউ ওর ক্ষ’তি করতে পারে।”

“আপনি যদি একটু নাইমার মতামত নিতেন, তাহলে খুব ভালল হতো। সে হিমিকে দেখতেও গিয়েছিল।”

হাবিব চুপ করে গেল। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, “আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমি নাইমাকে ডেকে নিয়ে আসছি।”

সে উঠে দাঁড়াল। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ঘরের ভেতর ঢুকল। মিনিট পাঁচেক পর নাইমা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। সালাম দিয়ে শান্ত গলায় বলল, “হিমির ব্যাপারটা আমার অজানা নয়। ভাইয়া আপনাদের কথাও বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে আমার একটু সময় লাগবে। পরিবারের সবার সাথে আলোচনা করে আপনাদের জানাব।”

হাবিবের কথায় প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এখন খানিকটা আশা পাচ্ছি। আরিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হাত জোড় করে বলল, “নাইমা তদন্ত করে সবকিছু সলভ করে ফেলবে এমনটা আশা করছি না। শুধু আমার বোনের মন রাখতে চাইছি। আশা করি বুঝবেন।”

হাবিব তার হাত ধরে ফেলল। লজ্জিত গলায় বলল, “এমন করবেন না। ইনশাআল্লাহ কাল সকালের মধ্যে আপনাদের উত্তর জানিয়ে দেব। রাত হয়ে গেছে। আপনারা জানিয়ে আসেননি। সামান্য ডাল-ভাত যা আছে, মুখে দিয়ে গেলে খুশি হব।”

তার কথায় এতটাই আন্তরিকতা মিশে ছিল যে দু’জনের কেউই না করতে পারলাম না। মুখ-হাত ধুয়ে খেতে বসলাম। আয়োজন ভালো। সরু চালের সাদা ভাত, কাঁচা আম দিয়ে টক ডাল, মলা-ঢেলা মাছের ঝোল, বেগুন ভর্তা, সঙ্গে ডিম ভাজা। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের উপলক্ষে ডিম ভাজা হয়েছে। খাবারের প্রতিটা পদই খুব সুস্বাদু। আরিফ বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। আমারও বেশ ভালো লাগছে খেতে। বহুদিন বাদে এমন মজা করে খাবার খাচ্ছি।

খাওয়া শেষে হাবিব আমাদের বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। কথার এক ফাঁকে বলল– গোলাপ ফুলের গাছ নিলে অন্য একদিন আসবেন।”

সামান্য হাসলাম। দু’জনে রিকশায় বসে আছি। ল্যামপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আরিফের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। হালকা গলায় বললাম, “কি মনে হয় তোমার? নাইমা কি রাজি হবে?”

“জানি না। বুঝতে পারছি না।”

হঠাৎই আকাশের তারা ম’রে গেছে। মেঘ জমতে শুরু করছে। বোধহয় বৃষ্টি নামবে।

হামজা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে। দু’কাপ চা একটা মগে ঢেলে নিয়েছে। বিছানায় বসে ছোট ছোট চুমুকে চা পান করছে। তার সামনে কাগজপত্র ছড়ানো। আরিফ তার পাশে গিয়ে বসল। স্বাভাবিক গলায় বলল, “এসব কি করছ তুমি?”

“কিছু হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছি। সে কথা না থাক, নাইমা নামের মেয়েটা রাজি হয়েছে? সে কী তদন্ত করতে আগ্রহী?”

আমি ভীষণ অবাক হলাম। বিস্মিত গলায় বললাম, “নাইমার ব্যাপারে আপনি জানলেন কিভাবে?”

“চোখ-কান খোলা রাখলে এমন অনেক কিছুই জানা যায়। এতে অবশ্য আমার কোন সমস্যা বা আপত্তি নেই। সে কি আসবে?”

“নিশ্চিতভাবে কিছু বলেনি। সকালে জানাবে বলেছিল।”

আরিফ কিছু বলবে ঠিক সেই মুহূর্তে তার ফোন বেজে উঠল। আরিফ বলল, “হাবিব কল দিয়েছে।”

সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কল রিসিভ করল। চার-পাঁচবার আচ্ছা বলার পর কল কেটে দিলো। উজ্জ্বল গলায় বলল, “নাইমা রাজি হয়েছে। আমাদেরকে দেখা করতে বলেছে।”

হামজা বলল, “কোথায় দেখা করতে বলেছে?”

“কলেজের ডান পাশের ক্যাফেতে। জায়গাটা নাকি বেশ নিরিবিলি। এগারোটার দিকে যেতে বলল।”

“কে কে যাচ্ছেন?”

“তুমি আমি আর তানজিলা। আব্বা মা’কে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তানজিলা, হাতের কাজ শেষ করো। ইনানকেও নিয়ে যাবে।”

আমি হেসে মাথা দোলালাম। তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করে তিনজনে রওনা দিলাম। তিনজন বললে ভুল হবে, চারজন। ইনানও আমাদের সাথে আছে। উৎসুক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাচ্ছে।

হাবিব ঠিক বলেছিল। ক্যাফেটা বেশ নিরিবিলি। খোলা মাঠের ভেতর চেয়ার টেবিল পাতানো। রোদ থেকে বাঁচতে মাথার উপর ছাতার ব্যবস্থা আছে। আমরা সদরের দিকে একটা টেবিলে বসলাম। যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। ঠিক এগারোটায় ক্যাফের সামনে একটা বাইক দাঁড়াল। নাইমা আগেরদিনের মতোই কালো বোরকা পরে আছে। হুবহু একই বেশ। হাবিবের পরনে সাদা শার্ট, হাতে ঘড়ি, শার্টের গলার কাছে একটা বোতাম খোলা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সে নাইমাকে নামিয়ে দিয়ে হাতের ইশারায় আমাদের দেখাল। দু’জনে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলার পর হাবিব চলে গেল। নাইমা সহজ ভঙ্গিতে এসে একটা চেয়ারে বসল। সালাম দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, “আপনি ভালো আছেন?”

“ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? শেষ পর্যন্ত রাজি হলে তাহলে।”

“জ্বি, পরিবারের সবার মতামত না নিয়ে আমি কোন কাজ করতে চাই না।”

“বেশ ভালো।”

আরিফ বলল, “হিমির বয়সী তাই তোমাকে তুমি করেই বললাম। কে’সের ব্যাপারে কিছু জানো?”

“কিছুটা জানি। হিমি বলেছে।”

“কি মনে হয় তোমার? হিমির কথা সত্যি?”

“ওর কথা পঁচানব্বই ভাগ বিশ্বাসযোগ্য। তবে পাশে বসে সে কিছু দেখেনি এটা মানতে পারছি না।”

“তদন্ত শুরু করবে কিভাবে?”

“প্রথমে ভদ্রমহিলার বাসায় যেতে হবে। সেখানের সবকিছু দেখে কিভাবে কি করব সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারব।”

“বাসায় যাবে কিভাবে? পুলিশ সেখানে বাইরে কাউকে ঢুকতে দেবে বলে মনে হয় না।”

“তার বাসায় যেতে না পারলেও বাড়িতে যেতে পারব। আমাকে ওই বাড়ির ঠিকানা দেন। এবং আপনারা যা-কিছু জানেন, সবকিছু বলুন।”

আরিফ আমার দিকে তাকাল। হামজা চুপচাপ বসে আছে। কথা বলছে না। আমি নাইমাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। আরিফের শার্টের ব্যাপারটাও বললাম।

নাইমা বলল, “যিনি খু’ন হয়েছেন– সুরভি তার সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?”

অল্প হেসে বললাম, “কয়েকদিনের পরিচয়।”

সে আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর আপনার সাথে?”

আরিফ বলল, “অফিসে জয়েন হওয়ার পর থেকে।”

“আপনার শার্টের মতো হুবহু একই শার্ট উনার বাথরুমে পাওয়ার তিনটে কারণ হতে পারে–
১. আপনি ওই বাসায় গিয়েছিলেন। শার্টটা পছন্দ বিধায় একই রকম শার্ট আরও একটা কিনেছেন।

২. পুরো ঘটনাই কাকতালীয়। হয়তো অন্যকেউ উনার বাসায় এসেছিল। ভুলে অথবা ইচ্ছে করে শার্ট ফেলে রেখে গিয়েছে। পারফিউমের ব্যাপারটাও কাকতালীয়।

৩. কেউ জেনে বুঝে আপনাকে ফাঁসানোর জন্য এমন কাজ করেছে। সে জানত– তানজিলা আপু সেদিন ওই বাসায় যাবে।”

“আমায় ফাঁ’সা’বে মানে? কোন ব্যাপার নিয়ে ফাঁ’সা’বে?”

নাইমা বলল, “আমি ঠিক জানি না। আচ্ছা আপু, সুরভি কি আপনাকে এমন কিছু বলেছিল যাতে আপনার মনে আরিফ ভাইকে নিয়ে স’ন্দে’হ জাগে? প’র’কী’য়া বা অন্যকিছু?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, সুরভি এমন কিছু কথা বলেছিল। ইনানের ব্যাপার ধরে বলেছিল।”

“হতে পারে সে আপনাকে বোঝাতে চেয়েছিল– তার সাথে আরিফ ভাইয়ের সম্পর্ক আছে।”

আরিফ বলল, “বুঝতে পারছি কিন্তু সুরভি আপা এমন কেন করবে? তার সাথে তো আমার কোন শ’ত্রু’তা নেই।”

“জানি না। তবে এমন হলে শার্টটা উনি কিনেছেন। এই শহর থেকেই কিনেছেন।”

এতক্ষণে হামজার মুখ খুলল। সে বেশ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “হতে পারে অন্য কেউ কিনে দিয়েছে। পরিকল্পনার সাথে অন্যকেউও জড়িত থাকতে পারে।”

“এমন হলে আমাদের মার্কেটে যেতে হবে। ওই শার্ট দেখিয়ে প্রতিটা দোকানে জিজ্ঞেস করতে হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে কিছু জানতেও পারি।”

“এসবই অনুমান। প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া কোন কথার ভিত্তি নেই।”

নাইমা বরফ শীতল গলায় বলল, “তদন্ত অনুমান নির্ভর। এখানে প্রতিটা পদক্ষেপই অনুমান।”

হামজা কথার জবাব দিলো না, হাসল।

আরিফ বলল, “শার্টের ব্যাপারে আমি খোঁজ নেব।”

নাইমা উঠে দাঁড়াল। বিদায় জানিয়ে বলল, “আমাকে এখন যেতে হবে।”

সে আর দাঁড়াল না। হামজা গলার স্বর অনেকখানি নিচু করে বলল, “মেয়েটা বেশ সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী।”

“আপনি কিভাবে বুঝতে পারলেন?”

“তার হাতের আঙুলগুলো বেশ সাদা। কথা বলার ধরনও চমৎকার।”

“সাদা মানেই যে সুন্দর এ কথা আপনাকে কে বলেছে?”

“কেউ বলেনি। চয়েস ভালো দেখে মনে হয়েছে।”

“বুঝতে পারলাম না।”

“যে ছেলের বাইকে এসেছিল সে বেশ সুদর্শন। যুবকটা তার প্রেমিক নাকি স্বামী?”

তার কথা আমার কাছে ভালো লাগল না। কঠিন মুখে বললাম, “পৃথিবীতে এর বাইরে কোন সম্পর্ক নেই নাকি? দু’জন ছেলে-মেয়েকে একসাথে দেখলেই তাদের প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা স্বামী স্ত্রী বানিয়ে দেন কেন? কি সমস্যা আপনাদের? আপনাদের মতো কিছু লোকের জন্য চলাফেরা দায় হয়ে গিয়েছে। ভাইরা বোনদের নিয়ে বের হতে চায় না। ভদ্রলোকের নাম হাবিব, সে নাইমার ভাই। যেন-তেন ভাই না। একই বাবা মায়ের দুই সন্তান।”

হামজা মুখ চেপে হাসল। যেন সে আমায় ইচ্ছে করে রাগিয়েছে। তার হাসি দেখতে ভালো লাগল না। হঠাৎই মনটা বি’ষি’য়ে উঠেছে। কতদিন হয়ে গেল সুরভি খু’ন হয়েছে। হিমির কে’সের ব্যাপারটা এতটুকুও এগোয়নি। এক জায়গায় আটকে গিয়েছে। রোদের তাপ তীব্র হচ্ছে। গরম বাড়ছে। ইনান কাঁদতে শুরু করেছে। বোধহয় খিদে পেয়েছে। ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।

চলবে