#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল
১১.
বাড়ি ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ততক্ষণে রোদ পড়ে গিয়েছে। হামজা বাড়ি ফিরেই হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছে। তাকে ভাত তরকারি বেড়ে দিয়ে ঘরে এসে বসলাম। আমার খিদে ম’রে গেছে। খেতে ইচ্ছে করছে না। বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেব ঠিক তখনই শাশুড়ি মা এলেন। বেশ বিরক্ত গলায় বললেন, “এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
“নাইমার সাথে ছিলাম। কথাবার্তা বলেছি, সুরভির বাসায় গিয়েছি।”
“ওহ আচ্ছা! মেয়েটা কি বলল? কিছু কি খুঁজে পেয়েছে?”
“তেমন কিছু বলেনি। চেষ্টা করছে।”
তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। খুব ক্লান্ত এবং অসহায় গলায় বললেন, “আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। সব কেমন এক জায়গায় দলা পাকিয়ে গেছে। রোজই যাচ্ছ-আসছ! কোন ফয়দা হচ্ছে না। পুলিশেও তেমন কিছু বলছে না। মেয়েটা ওখানে কেমন আছে কি করছে আল্লাহই ভালো জানেন!”
“বুঝতে পারছি না আম্মা। আমারও আর ভালো লাগছে না। কোর্টের তারিখ পড়লে হয়তো কিছু করা যেত। উকিলকে দিয়ে জামিনের চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন কি করব বুঝতে পারছি না।”
“আরিফ কোথায়? সে আসেনি?”
“আরিফ আমাদের সাথে যায়নি। অফিসে গিয়েছে।”
“ওহ আচ্ছা!”
শাশুড়ি মা আর কিছু বললেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় দরজা টেনে দিয়ে গেলেন। ইনানের চোখে ঘুম। ঢলে ঢলে পড়ছে। ওকে শুইয়ে দিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম। গা কুটকুট করছে। গরমে ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছি। গায়ে পানি ঢালতেই শরীর জুড়িয়ে গেল। বেশ ঠান্ডা পানি৷ সময় নিয়ে গোসল সেরে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে আরিফকে কল দিলাম। মানুষটা কোথায় কি করছে কে জানে! দুপুরে খেয়েছে কি-না। কল কে’টে গেল, রিসিভ করল না। বেশ কয়েকবার কল দিলাম। প্রতিবারই একই অবস্থা। রিং হচ্ছে কল রিসিভ করছে না। বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিলাম। ব্যাপারটা নতুন নয়। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলে সে কখনো কল রিসিভ করে না।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাতের রান্না বাকি। চাল ধুয়ে ভাত বসিয়ে দিলাম। একবারে রান্না শেষে ঘুমাব। এখন শুলে আর উঠতে পারব না। এমনিতে মন-মেজাজ ভালো না। নতুন করে আর কোন অশান্তি করতে চাইছি না।
রাতের রান্না শেষ হতে হতে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। এরমধ্যে আরিফ একবারের জন্যও কল দেয়নি। চিন্তা হচ্ছিল, তাই আবার কল দিলাম। এবার মোবাইল বন্ধ। মেয়েলি কন্ঠে জানান দিচ্ছে আপনি যে নম্বরে কল দিচ্ছে সেটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। দয়া করে আবার চেষ্টা করুন।
সুমির নম্বর ছিল৷ ইতস্তত না করে তাকে কল দিলাম। সুমি কল রিসিভ করে সালাম দিলো। সরল গলায় বলল, “কেমন আছেন ভাবী? শরীর ভালো?”
“এইতো চলছে। আপনি কেমন আছেন? অফিসে নাকি?”
“এইতো। কেন আপনি কিছু বলবেন?”
“আচ্ছা সুমি, আরিফ কোথায়? কল দিচ্ছি কিন্তু ওর মোবাইল বন্ধ। সারাদিনে কোন খোঁজ পাইনি।”
“আরিফ ভাই তো আজ অফিসে আসেনি। বস বেশ কয়েকবার তার খোঁজ করেছে৷ কলও দিয়েছি। সে রিসিভ করেনি।”
“অফিসে যায়নি?”
“না ভাবী। আসেনি। আমি এখনও অফিসে, এখানে থাকলে তো আমার চোখে পড়ত।”
ফোন রেখে দৌড়ে শাশুড়ি মায়ের ঘরে গেলাম। তিনি তখন বিছানায় বসে পান চিবুচ্ছেন। আমায় ছুটে আসতে হকচকিয়ে গেলেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “কি হয়েছে? তুমি এমন করছ কেন?”
“আম্মা আরিফ! আরিফের সাথে আপনার কথা হয়েছে? সারাদিনে একবারও কল দিয়েছিল?”
“না তো, কেন কি হয়েছে?”
“আরিফ অফিসে যায়নি। সারাদিন আমার সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।”
“দুশ্চিন্তা করো না। হয়তো অন্য কাজে গিয়েছে। চলে আসবে।”
কথার ধরনের বুঝলাম তিনি আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন। ভেতরে ভেতরে তার দুশ্চিন্তাও কিছু কম নয়। সারারাত জেগে বসে রইলাম। অনিশ্চিত অপেক্ষা প্রহর ভীষণ তিক্ত!
রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে গেল। আরিফ ফিরল না। আত্মীয় স্বজন যেখানে যে ছিল সবার কাছে কল দিয়েছি। কেউ কিছু জানে না। কোন উপায় না পেয়ে থানায় আসলাম। মন বলছে ওর কোন বিপদ হয়েছে। এর আগে কখনো আরিফ এমন করেনি।
°
এতটুকু বলে সে চোখের পানি মুছল। ভেজা গলায় বলল, “আমি যা জানি, যেখান থেকে ঘটনা শুরু হয়েছে– সবকিছু আপনাকে খুলে বলেছি। দয়া করে আমার স্বামীকে খুঁজে দেন। তাকে ছাড়া আমাদের পরিবারটা ভেসে যাবে।
এতক্ষণ দারোগা সাহেব চুপচাপ শুনছিলেন। তিনি বেশ সহজ গলায় বললেন, “প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের এভাবে হারিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। কেউ কিছু জানে না এটাও বেশ অবিশ্বাস্য।”
তানজিলা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “কি বলতে চাইছেন?”
“আমি কিছুই বলতে চাইছি না। শুধু ভাবছি।”
“কারো নিখোঁজ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে থানায় গিয়ে জি’ডি করতে পারি। পুলিশ আইনগতভাবে পুলিশ তা গ্রহণ করতে বাধ্য।”
“উত্তেজিত হবেন না। আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
“আপনারা শুধু মুখে মুখে এসব কথা বলেন। হিমির ব্যাপারে কী এখনও কিছু করতে পেয়েছেন? নিরপরাধ মেয়েটা ব’ন্দী জীবন কাটাচ্ছে।”
“তদন্তের ব্যাপারে বাইরে লোকদের জানানো হয় না। যাইহোক, এমনও তো হতে আরিফ নিজের ইচ্ছায় কোথাও চলে গিয়েছে।”
“না, আরিফ কখনো এমন কাজ করতে পারে না। এখানে ওর সবকিছু আছে। মা, বাবা, বোন, স্ত্রী সন্তান। সবাই আছে। এদেরকে রেখে ও চলে পারে না।”
“ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলো কখনোই রেখে যাওয়া মানুষদের পরিস্থিতি ভেবে দেখে না। তাদের কি হবে না হবে সে-সব কিছুও ভাবে না। ভাবলে কখনোই তারা চলে যেতে পারত না।”
“আরিফ নিজে থেকে হারিয়ে যায়নি। আমার মন বলছে ওর কোন বিপদ হয়েছে। আপনারা তদন্ত শুরু করুন।”
“আরিফ বাড়ির দলিলপত্র জমা রেখে লোন নিয়েছে– এ কথা আপনার শ্বশুর শাশুড়ি জানে?”
“না, উনারা এসব জানেন না।”
“এমনও হতে পারে এই টাকার চিন্তায়, বাবা মা’কে কি জবাব দেবে, কি করবে, এসব কথা ভেবে আরিফ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।”
“সবই অনুমান।”
“তদন্ত অনুমানের ওপর নির্ভর করে এগিয়ে যায়। আপনি এখন যেতে পারেন। প্রয়োজনে আপনাকে আবার ডাকা হবে।”
“জ্বি আচ্ছা।”
তানজিলা উঠে দাঁড়াল। ইনানকে বুকে সাথে চেপে ধরে থানা থেকে বেরিয়ে গেল। হামজা বলল, “পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। যেন রাতের আঁধার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে।”
তানজিলা তার কথার জবাব দিলো না। উদাসীন ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল। হামজা বলল, “গোড়া থেকে তদন্ত শুরু করতে হবে। আমার মন বলছে এতসব কিছু কাকতালীয় হতে পারে না।”
“যা মনে হয় করতে পারেন। তবে আমি আর কিছু করতে পারছি না। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এবার একটু বিশ্রাম নিতে চাই।”
“মোহন নামের ওই লোকটা আমার বেশ স’ন্দে’হ হয়। হতে সে-ও এসবের মধ্যে জড়িত আছে।”
“শুধু মোহন নয়, সুমি, সবুজ, তমাল এরাও জড়িত থাকতে পারে।”
“চিন্তা করবেন না। আল্লাহ চাইলে সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আরিফ ভাইয়ের কিছু হবে না, সে নিরাপদে ফিরে আসবে।”
তানজিলা চোখ বন্ধ করে বলল, “তাই যেন হয়।”
তার কপল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
রেশমা বেগম ছেলে-মেয়ে দু-জনকেই হারিয়ে একদম নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছেন। বিছানার কোণে বসে তসবি জপছেন। তানজিলা তার পাশে গিয়ে বসল। দ্বিধা দন্ত কাটিয়ে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। রেশমা বেগম বললেন, “পুলিশ কি বলল?”
“কে’স লিখেছে। এর বাইরে আর কিছু বলেনি।”
“আমাদের সুখের সংসারের কার নজর পড়ল বলো তো?”
“জানি না আম্মা। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“হামজার সাথে কথা বলো। সে না পারলে তোমার শ্বশুরকে বলে অন্য গোয়েন্দা ঠিক করব। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না।”
“আব্বা কোথায়?”
“জানি না। সকালে কিছু না খেয়েই বেরিয়ে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করলেও কোন জবাব দেয়নি।”
তানজিলা আর কোন কথা বলল না। খানিকক্ষণ শাশুড়ির পাশে বসে নিজের ঘরে চলে এলো। হঠাৎই তার ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে। এই পৃথিবীতে থাকার মানে কী? দুঃখকষ্ট ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই।
আজকের মতো নাইমার সব ক্লাস শেষ। সে বেশ তড়িঘড়ি করে কলেজ থেকে বের হলো। আকাশ কালো হয়ে গেছে। মেঘ ডাকছে। যে-কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। তার কাছে ছাতা নেই। দেরি করলে ভিজতে হতে পারে। এই সময়ে বৃষ্টিতে ভেজা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। জ্বর-টর চলে আসতে পারে। নাইমা দ্রুত পা চালাতে লাগল। খানিকটা পথ যেতেই হঠাৎ একটা ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়াল। ছেলেটার পরনে কালো শার্ট, মাথায় কালো কাপড় বাঁধা। নাইমা তাকে এড়িয়ে চলে যেতে চাইলে সে তার পথ আগলে দাঁড়াল। বিরক্ত গলায় বলল, “চলে যাচ্ছ কেন? তোমার সাথে কথা বলতে চাই।”
নাইমা শান্ত গলায় বলল, “কে আপনি? আমার সাথে কি কথা বলতে চান?”
“দু’দিন আগেই আমাকে পে’টা’লে আর এখন বলছ আমি কে! এর মধ্যেই ভুলে গেলে? চমৎকার!”
“পি’টি’য়ে ছিলাম বিধায় বদলা নিতে এসেছেন?”
ছেলেটা শব্দ করে হাসল। ঝলমলে গলায় বলল, “সুন্দরী মেয়েদের কাছ থেকে বদলা নেওয়া রোহানের প্রোফাইলের সাথে যায় না।”
“অযথা বিরক্ত করছেন কেন?”
রোহান সামনে থেকে সরে গেল। নাইমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “সবসময়ই এমন রেগে থাক? হাসতে জানো না?”
নাইমা জবাব দিলো না। বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত পা চালাতে লাগল। রোহান তার পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে বলল, “তোমার কাজে সাহায্য করতে চাই।”
“কোন কাজে সাহায্য করতে চান? তাছাড়া আমার কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”
রোহান কিছু বলবে তার আগে একটা বাইক তাদের সামনে দাঁড়াল। নাইমা গিয়ে বাইকে উঠল। শান্ত গলায় বলল, “চলো ভাইয়া। বৃষ্টি নামতে পারে।”
রোহান শূন্য দৃষ্টিতে নাইমার চলে যাওয়া দেখল। ফ্যাকাসে মুখে বলল, “আমি এখানে কেন এসেছি! আমার তো আরও কাজ আছে।”
বলেই হাঁটতে লাগল। তার চোখ জ্বলছে। চোখে পানি আসার আগে এমন করে চোখ জ্বালা করে।
হাবিব বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বাইক চালাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। গায়ে লাগলে শীত শীত করে। নাইমা বলল, “ভাইয়া, আমার মাথায় কাজ করছে না।”
“কি হয়েছে?”
“হিমির ভাই, যে আমাদের বাড়িতে এসেছিল– তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“পাওয়া যাচ্ছে না মানে? কোথায় গিয়েছে?”
“কেউ কিছু জানে না ভাইয়া। না বলে কোথাও চলে গিয়েছি।”
“এই কে’সটা নিয়ে এত ভাবছিস কেন? তোকে তো শুধুমাত্র হিমির মন রক্ষার জন্য নিযুক্ত করেছে।”
নাইমা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করল। হাবিব বলল, “দুশ্চিন্তা করিস না। পুলিশেরা নিশ্চয়ই কিছু করবে। লাগলে বলিস, আমি হেল্প করে দেব।”
“তোমাকে কয়েকজনের ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর করে দিতে হবে।”
“নাম ঠিকানা দিয়ে রাখিস, কাল পরশুর মধ্যে জানাব।”
নাইমার মন খুশি হয়ে গেল। হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “আমাকে এখানে নামিয়ে দাও। এতটুকু হেঁটে চলে যাব।”
হাবিব অল্প হাসল। নাইমা বোরকা উঁচু করে ধরে ঘরের ভেতর ঢুকল। আঁড়চোখে দেখল– নববী হাবিবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দু’জনের চোখ জ্বলজ্বল করছে। নববী এগিয়ে গিয়ে হাবিবের হাত ধরল। কোমল গলায় বলল, “আজকে এত তাড়াতাড়ি? কাজ শেষ?”
হাবিব তার কথার জবাব না দিলো না, হাসল।
চলবে