বাতাস বলে দেয় পর্ব-১২

0
19

#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল

১২.
রাত প্রায় শেষ। চাঁদ ম’রে এসেছে। হালকা বাতাসে গাছের পাতায় সড়সড় শব্দ হয়৷ হামজা বেশ নিশ্চিতে ঘুমচ্ছিল। হঠাৎই চিৎকার দিয়ে বিছানায় উঠে বসল। বালিশের পাশা রাখা পানির বোতল খুলে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি পান করল। ভয়ে তার শরীর ঘেমে গিয়েছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। সে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলো।

দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। হামজা মুখ হাত মুছে দরজা খুলে দিলো। শান্ত গলায় বলল, “তেমন কিছু হয়নি। দুঃস্বপ্ন দেখেছি।”

আকরাম সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ওহ আচ্ছা! খুব বেশি ভয় পেয়েছ নাকি? জমজম কূপের পানি এনে দেব। খাবে?”

হামজা মাথা দোলালো। যার অর্থ হ্যাঁ হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। রেশমা বেগম বললেন, “আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ যেভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলে!”

“দুঃখিত! আমি আপনাদের এ পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইনি। স্বপ্নটা ভ’য়ং’ক’র ছিল তাই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না।”

রেশমা বেগম অত্যন্ত কোমল গলায় বললেন, “এভাবে বলো না। ওজু করে নামাজ পড়ে নাও। ফজরের আজান দিচ্ছে।”

হামজা দরজা ভেজিয়ে দিলো। সে শুনেছে ভোররাতে স্বপ্ন সত্যি হয়। কিন্তু এই স্বপ্নের মানে কি? জায়গাটা তার পরিচিত নয়। গাছপালায় ঘেরা, শুনশান পরিবেশ। ভাঙাচোরা একটা ঘরের সামনে মাটির চুলা। চুলার পাশে বিশাল এক সাপ ফনা তুলে আছে। একটু দূরে নাইমা দাঁড়িয়ে, সে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। পারছে না। হঠাৎই সাপটা নাইমার শরীর পেঁচিয়ে ধরল। ঘাড়ের কাছে ছো’ব’ল দিতে যাবে তখনই তার ঘুম ভেঙে গেছে।

হামজা মাথা দুলিয়ে সমস্ত দুশ্চিন্তা ছেড়ে ফেলে দিতে চাইল। আঁজলা ভরে চোখ-মুখে পানি ছড়ালো। সুবহে সাদেক হয়ে গেছে। খানিকক্ষণের মধ্যেই দিনের আলো ফুটতে শুরু করবে। সে যখন জায়নামাজে বসল খেয়াল করল তখনও তার গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে আছে।

তানজিলা অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারেনি। ইনানকে কোলে নিয়ে হাটাহাটি করেছে। ছেলেটা গা গরম হয়েছে। থার্মোমিটারে জ্বর ধরা পড়ছে না। অনেক চেষ্টার পর শেষ রাতের দিকে চোখ বুজেছে। তানজিলাও তার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার ঘুম ভাঙল শাশুড়ির ডাকে। রেশমা বেগম নীচু গলায় তার নাম ধরে ডাকছে। সে হকচকিয়ে বিছানায় উঠে বসল। চোখ কচলে ঘড়ির দিকে তাকালো। নয়টা বত্রিশ বাজে। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, “এত বেলা হয়ে গেছে! আগে ডাকলেন না কেন?”

রেশমা বেগম ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। অন্যদিন হলে তিনি ভীষণ রেগে যেতেন, তবে আজ রাগলেন না। শান্ত গলায় বললেন, “হাত-মুখ ধুয়ে সকালের নাস্তা করে নাও। থানায় যেতে হবে। দারোগা সাহেব কল দিয়েছিলেন। সবাইকে যেতে বলেছেন।”

তানজিলা মাথা দোলালো।

“ইনান গায়ে বেশ জ্বর। ফেরার পথে ডাক্তার দেখিয়ে আনবো। দেরি করো না। তোমার শ্বশুর থানা থেকে ফিরে আবার কাজে যাবে।”

“ঠিক আছে আম্মা। আমার খুব বেশি সময় লাগবে না। দশ মিনিটে হয়ে যাবে।”

রেশমা বেগম চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই তানজিলা তাকে পেছন ডাকল। নরম গলায় বলল, “আম্মা আপনার ছেলে এসেছে নাকি?”

“আরিফ! না সে আসেনি।”

“ওহ! মনে হলো এসেছে। ওর গায়ের গন্ধ নাকে লাগছে।”

“চলে আসবে। তুমি চিন্তা করো না। দারোগা সাহেব হয়তো ওর কথা বলতেই ডেকেছে। হয়তো খোঁজ পেয়েছে।”

সে আর কথা বাড়াল না। ব্রাশে টুথপেষ্ট মাখাতে মাখাতে বাথরুমে ঢুকে গেল। তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। যেন মাঝ সমুদ্রে নিজের সবটুকু শক্তি হারিয়ে স্রোতে গা এলিয়ে দিয়েছে।

তানজিলা বেশ দ্রুতই ফ্রেশ হলো। মুখ-হাত মুছে খাবার টেবিলে বসল। রুটি, ডিম পোঁচ আর আলুভাজি। খাবারের দিকে তাকিয়ে তার চোখে পানি এসে গেল। এইতো ক’দিন আগে এইসব খাবার খাওয়ার সময় আরিফ তার পাশে বসে ছিল। মানুষটা আজ নিখোঁজ। কোথায় হারিয়ে গিয়েছে কেউ জানে না।
সে খাবার গিলতে পারল না। এক গ্লাস পানি পান করে উঠে দাঁড়াল।

হামজা বলল, “দু’মিনিট সময় দিতে পারবেন? আপনার সাথে আমার কথা আছে।”

“কি বলবেন আমাকে? জরুরি কিছু?”

“তেমন জরুরি নয়, তবে আমার এই কাজটা আপনিই করতে পারবেন।”

“কি কাজ করতে হবে? ইতস্তত না করে বলুন। সাধ্যের মধ্যে হলে আমি করার চেষ্টা করব।”

“নাইমা! ওই মেয়েটার সাথে একবার দেখা করতে চাই। ওর মোবাইল নম্বরটা আমায় দিতে পারবেন?”

“নাইমা নিজস্ব মোবাইল আছে কি-না জানা নেই। সে সবসময় তার ভাইয়ের নম্বর দিয়ে কথা বলে। আপনি চাইলে ওর ভাইয়ের নম্বর নিতে পারেন।”

“ভাইয়ের নম্বর! না থাক। লাগবে না। আপনি ওকে একটু আপনার সাথে দেখা করতে বলেন। আমি আপনার সাথে থাকব।”

“কি হয়েছে? আপনি এমন করছেন কেন?”

“আমি খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি। নাইমাকে নিয়েই দেখেছি। তাই ওর সাথে দেখা করতে চাই।”

তানজিলা হয়তো কিছু বুঝল। সরল গলায় বলল, “ঠিক আছে। আমি কথা বলে আপনাকে জানাব।”

হামজা মাথা দোলালো। তানজিলা বলল, “আম্মা বললেন থানায় যেতে হবে। সবাইকে যেতে বলেছে। আপনি যাচ্ছেন?”

“জ্বি আমি যাব। তৈরি হয়ে আসছি। আপনি খাবার খেলেন না কেন?”

তানজিলা কথার জবাব দিলো না। নিজের ঘরে চলে এলো। কোমল ভঙ্গিতে ইনানের গায়ে হাত রাখল। গা বেশ গরম। সে নিচু হয়ে ছেলের কপালে চুমু খেলো। গালে নাকে ঠোঁট ছোঁয়াল। ভেজা গলায় বলল, “তোর ভাগ্যে কি আছে আমি জানি না। কিভাবে বড় হবি, কোথায় থাকবি, কি খাবি কিছুই জানি না। তবে তোকে আমি একটা কথা দিচ্ছি– যতদিন আমার শরীরের র’ক্তচলাচল করবে, নিঃশ্বাস নিতে পারব, ততদিন আমি তোর সাথেই থাকব।”

তার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বুক চি’রে দীর্ঘশ্বাস বের করে দিলো। বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাইমাকে কল দিলো। দু’বার রিং হওয়ার পর নাইমা কল রিসিভ করল। সালাম দিয়ে বলল, “জ্বি আপু, বলেন। আমি নাইমা।”

তানজিলা শুকনো গলায় বলল, “তুমি কি কিছু জানতে পারলে?”

“না আপু, এখনও কিছু জানতে পারিনি। তবে চেষ্টা করছি।”

“আজকে একটু আমার সাথে দেখা করতে পারবে?”

“আপনার সময়মতো?”

“তুমি কখন দেখা করতে পারবে বলো।”

“একটার দিকে আমার কলেজ শেষ হবে। তখন ওই ক্যাফেতে দেখা করতে পারি।”

“ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করব।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

“নাইমা শোনো।”

“জ্বি, বলেন।”

“এটা কি তোমার নম্বর? মানে তোমার ব্যক্তিগত ফোন?”

“আমার কাছেই থাকে। তবে সবাইকে বলি ভাইয়ার নম্বর।”

“ঠিক আছে। সাবধানে থাকবে।”

তানজিলা কল কেটে দিলো। বেশ কয়েকবার আরিফের নম্বরে চেষ্টা করল। তার নম্বরে কল ঢুকছে না। মোবাইল বন্ধ বলছে।

দারোগা সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তানজিলাকে দেখছেন।

তানজিলা বলল, “আমাকে কিছু বলতে চান?”

“অবশ্যই! বলব বলেই তো এখানে ডেকেছি।”

“আপনার যা বলার বলুন। আমার ছেলে অসুস্থ, ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”

দারোগা সাহেব ইনানের অসুস্থতা নিয়ে কোন আগ্রহ দেখালেন না। সমবেদনা অথবা ভদ্রতা দেখিয়েও দু’একটা শব্দ বললেন না। বরং বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, “সুরভির বাসায় আপনি আরিফের শার্ট পেয়েছিলেন– এ কথা আমাদের থেকে লুকিয়েছিলেন কেন?”

তানজিলা শুকনো ঢোক গিলল। নরম গলায় বলল, “শার্টটা আরিফের নয়, অন্যকারো। তাই বলার প্রয়োজন মনে করিনি।”

“আরিফের কলিগ মোহনের নাকি?”

“খোঁজ নিয়ে তেমনটাই জেনেছি।”

“সুরভির পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে এসেছে। ছু’রির আ’ঘা’তে তার মৃ’ত্যু হয়েছে। আপনি কি জানেন ছু’রি কে চালিয়েছে?”

তানজিলা বেশ শক্ত গলায় বলল, “না আমি জানি না।”

“এমনও হতে পারে যে, আরিফের সাথে সুরভির অবৈধ সম্পর্ক ছিল। আর আপনি এই ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিলেন। তাই ওদের দু’জনকেই সরিয়ে দিয়েছেন।”

“আমি এমন কিছুই করিনি। তাছাড়া বিনা প্রমাণে আপনি আমায় দোষারোপ করতে পারেন না। আমার ওই বাসায় যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না। এমনকি আমি এ ব্যাপারে কিছু জানতামও না। আপনি চাইলে আম্মা- আব্বা কিংবা হিমির কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

“আগেই জিজ্ঞেস করেছি।”

“তাহলে আমায় এসব কথা বলার মানে কি?”

“আরিফ সুরভিকে টাকা দিয়েছিল– এ কথাটা আপনি জানতেন?”

“জানতাম। আরিফ আমায় বলেছিল।”

আকরাম সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, “আরিফ সুরভিকে টাকা দিয়েছিল মানে? কি টাকা দিয়েছিল?”

দারোগা সাহেব তাকে সব ঘটনা খুলে বললেন। সব শুনে তিনি সত্যিকার অর্থে নিভে গেলেন। মিইয়ে যাওয়া গলায় বললেন, “আরিফ এসব করেছে?”

রেশমা বেগম ততক্ষণে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করেছেন।

দারোগা সাহেব বললেন, “হ্যাঁ। আপনার ছেলেই এসব করেছে। শুধু আপনার ছেলে নয়, তার অফিসের বেশিরভাগ লোক সুরভির কথায় জমিজমা বন্ধক রেখে লোন নিয়েছে। লোনের সব টাকা লোক এক লোকের কাছে ব্যবসার জন্য দিয়েছে। সেই লোক এখন পলাতক। টাকা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।”

আকরাম সাহেব বললেন, “সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু সুরভিকে কে খু’ন করেছে তার খোঁজ পেয়েছেন?”

“পেয়েছি। আপনাদের কিছু জানানো হয়নি বিধায় হয়তো ভেবেছেন আমরা কোন কাজ করছি না। কিন্তু আমরা আমাদের কাজে অবহেলা করি না।”

“সুরভিকে কে মে’রে’ছে? আর সে এখন কোথায়?”

“সুরভির খু’ন আপনার ছেলে আরিফ করেছে। সে কোথায় এই ব্যাপারে আমরা এখনও কিছু জানি না। তবে খুব শীগ্রই জানতে পারব।”

তানজিলা অবিশ্বাস্য গলায় বলল, “না, আরিফ কিছু করেনি। সে এসবের কিছু জানে না।”

দারোগা সাহেব তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “তাহলে কি আপনি করেছেন?”

তানজিলা চুপ করে গেল। রেশমা বেগম বললেন, “আরিফ সেদিন ওই বাসায় যায়নি। হিমি আর তানজিলা গিয়েছিল। তাহলে আরিফ কিভাবে খু’নি হতে পারে?”

“ভালো প্রশ্ন করেছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় পনেরো থেকে বিশ ফুট দূর থেকে ছু’রি চালানো হয়েছে।”

আকরাম সাহেব বললেন, “পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সরাসরি এধরণের কথা বলা থাকে না। আপনি আমাদের ভুল তথ্য দিচ্ছেন কেন?”

দারোগা সাহেব হাসলেন। শান্ত গলায় বললেন, “পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সরাসরি বলা সম্ভব হয় না ঠিক কতদূর থেকে ছু’রি ছোঁড়া হয়েছে, তবে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ধারণা করা যায় ছু’রিটি কাছ থেকে মা’রা হয়েছে, নাকি দূর থেকে ছোঁড়া হয়েছে। তবে কাছ থেকে মা’রা ছুরির আ’ঘা’ত সাধারণত নিয়ন্ত্রিত ও গভীর হয়। দূর থেকে ছুঁড়ে মা’রা হলে তা অপ্রতিসম, অসম গভীরতা ও ক্ষতিতে প্রকাশ পায়।”

“সাধারণ কারো পক্ষে এমন করা অসম্ভব। আরিফ কখনো এই কাজ করতে পারবে না।”

“আকরাম সাহেব! আপনি বেশ বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী। তবে আমরাও বোকা নই। মাঝারি দূরত্ব অর্থাৎ পনেরো থেকে বিশ ফুটের জন্য
এক থেকে তিনমাসের অভ্যাস লাগে সঠিক ভারসাম্য ও নিশানা বুঝতে।”

“ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এই কাজের জন্য আপনি আরিফকে কিভাবে দোষারোপ করছেন? তাছাড়া হিমিকে আটকে রেখেছেন। আপনারা ঠিক কি চাইছেন?”

“অপরাধীকে ধরতে চাইছি। কষ্ট করে একটু মনে করে দেখবেন বছরখানেক আগে আরিফের অফিসে একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল।”

“না, আমার এমন কিছু মনে পড়ছে না।”

“মস্তিষ্কের উপর চাপ দিতে হবে না। আমিই বলছি– ‘Knife Throwing’, আর বাংলায় বলা যায় ‘ছু’রি নিক্ষেপ’ বা ‘ছু’রি ছোঁড়া খেলা’। এটি একটি প্রাচীন ও রোমাঞ্চকর ক্রীড়া। যেখানে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে একটি লক্ষ্যবস্তুতে (সাধারণত কাঠের বোর্ড বা মানব আকৃতির ডামি) ছু’রি ছুঁড়ে মা’র’তে হয়। আরিফ সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল।”

তানজিলা বলল, “সেটা অনেক আগের কথা। আরিফ তখন নিয়মিত প্রাকটিস করত। তাছাড়া ওই প্রতিযোগিতায় জিতলে পুরষ্কার হিসাবে বিশ হাজার টাকা পাওয়া যেত। মূলত পুরষ্কারের টাকার জন্যই আরিফ নিয়মিত প্রাকটিস করত। এখানে দোষের কি আছে?”

“পুরষ্কার জিততে চাওয়া দোষের কিছু নয়। তবে মানুষ খু’ন করা অনেক বড় দোষ।”

“আরিফ এমন করেনি। ও এসব করতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি না।”

“বাড়ির দলিলপত্র জমা রেখে লোন নিতে পারে– এ কথা ভাবতে পেরেছিলেন?”

তানজিলা চুপ করে গেল। দারোগা সাহেব বললেন, “গোটা ব্যাপারটাই আয়নার মতো পরিষ্কার। আরিফই সুরভির খু’ন করেছে। আর ধরা পড়ার ভয়ে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”

রেশমা বেগম বললেন, “আরিফ কেন ওই মেয়েটাকে মা’র’তে যাবে?”

তমা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বেশ বিরক্ত গলায় বলল, “সমস্যা কি আপনাদের? ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন করছেন কেন?”

দারোগা সাহেব তাকে থামিয়ে দিলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, “রাগ করো না। পুলিশের চাকরি করে এতো অধৈর্য হওয়া ঠিক না।”

“সরি স্যার।”

দারোগা সাহেব তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সহজ গলায় বললেন, “টাকা ব্যাপারটা নিয়েই আরিফের সাথে সুরভির কথা কাটাকাটি হয়েছিল। সুরভি বলেছিল– টাকা ফেরত পাবে কি-না সেই ব্যাপারে সে কোন দায়বদ্ধতা নিতে পারবে না। এদিকে টাকা না পেলে আরিফ সব হারিয়ে পথে বসত। খু’ন করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।”

থানার পরিবেশ থমথমে। আকরাম সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। রেশমা বেগম ক্রমাগত চোখের পানি মুছচ্ছেন।

হামজা বলল, “আরিফ ভাই দোষী হলে হিমি নির্দোষ। ওকে ছেড়ে দিবেন না?”

দারোগা সাহেব হাসলেন।

“যদি কাউকে শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে আটক করা হয়, এবং তদন্তে দেখা যায় সে নিরপরাধ, তাহলে পুলিশ নিজ উদ্যোগে তাকে ছেড়ে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি প্রয়োজন হয় না। কিন্তু হিমির মামলাটি আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আদালত সেই মামলার শুনানির দিন নির্ধারণ করেছে। এখন আর পুলিশ নিজে থেকে কাউকে ছেড়ে দিতে পারে না। এমনকি যদি সেই ব্যক্তি নিরপরাধ প্রমাণিত হয়। তবে আমরা খুব দ্রুত ওর জামিনের ব্যবস্থা করে দেব।”

হামজা আর কোন প্রশ্ন করল না। দুপুর হয়ে গিয়েছে। মসজিদের মাইক থেকে জোহরের আজান শোনা যাচ্ছে। তারা আর অপেক্ষা করল না। থানা থেকে বেরিয়ে গেল। রেশমা বেগম আকরাম সাহেবের হাত ধরে আছেন৷ তাদের দু’জনকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে।

তানজিলা বলল, “আম্মা আপনি আব্বাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যান। আমি আর হামজা ভাই ইনানকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। রোদের মধ্যে সবাই মিলে ঘোরাঘুরি করার কোন মানে হয় না।”

আকরাম সাহেব ম’রা গলায় আচ্ছা বললেন। হামজা দু’টো অটোরিকশা দাঁড় করালো।

নাইমা ক্যাফেতে বসে আছে। পরপর দু’টো ফালুদা অর্ডার করে ফেলেছে। তবুও কারোর দেখা নেই। সে বেশ কয়েকবার তানজিলার নম্বরে কল দিয়েছে। তানজিলা কল ধরেনি। নাইমা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করল। মোবাইল বের করে শেষবারের মতো তানজিলার নম্বরে ডায়াল করল। মনে মনে ঠিক করল– এবার কল রিসিভ না করলে সে বাড়িতে চলে যাবে।

একবার রিং হতেই তানজিলা কল রিসিভ করল। ব্যস্ত গলায় বলল, “এইতো আমরা ক্যাফের সামনে। এক মিনিটে আসছি।”

হামজা বলল, “নাইমা! আপনি ভালো আছেন?”

তার গলার স্বর একটু অন্যরকম শোনালো। নাইমা চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো নেই। পুলিশ আরিফ ভাইকে সন্দেহ করছে।”

তারা দু’জন নাইমাকে সবকিছু খুলে বলল। সব শুনে নাইমা বলল, “আমার কী বলা উচিত বুঝতে পারছি না। তবে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। আমরা আরিফ ভাইয়ের নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ খুঁজতে পারি।”

তানজিলা বেশ দৃঢ় গলায় বলল, “আরিফ খু’ন করেনি। আমার মন বলছে ওর কোন বিপদ হয়েছে। আমাদের ওকে খুঁজতে হবে।”

হামজা তার কথায় সায় দিয়ে বলল, “আমারও তাই মনে হয়। আমাদের আরও যত্নশীল হতে হবে।”

তারা বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলল। কথা শেষে হামজা তানজিলা আর ইনানকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ইনান গা ঠান্ডা। জ্বর নেই। তবুও বাচ্চা মানুষ ডাক্তার দেখিয়ে রাখা ভালো।

ঝাঁ-ঝাঁ রোদের মধ্যে রোহান রাস্তা নেমেছে। একমনে হাঁটছে এবং বিড়বিড় করছে। কয়েকদিন ধরে তার দিন ভালো যাচ্ছে না। হঠাৎই হঠাৎই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। সে নিজের এই অবস্থাকে সে অসুস্থতা দাবি করছে আবার করছে না। বারবার করে তার ওই নাইমা মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। মেয়েটার কথা মনে পড়লেই তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। সে এই অনুভূতির ব্যাখ্যা পাচ্ছে না। সহ্যও করতে পারছে না। সে এসব উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে রোদের মধ্যে হাঁটছে। খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাবে। তখন আর কোন সমস্যা হবে না।

চলবে