#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল
১৩.
তানজিলা ভাত বসিয়েছে। মোড়া এনে বসে আছে চুলার পাশে। তার শরীরে এতটুকু বল অবশিষ্ট নেই। আরিফের চিন্তায় পা’গ’ল পা’গ’ল অবস্থা। তবুও জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। শরীরের নিয়ম আবেগের বেড়াজাল মানে না। ক্ষুধা লাগে, পিপাসা পায়, জোর করে হলেও নিঃশ্বাস নিতে হয়। সে তার মা’কে কল দিয়েছিল। দু’দিনের জন্য আসতে বলেছে। তিনি আসবেন বলে কথা দিয়েছেন, তবে ঠিক কখন আসবেন তা বলেননি। শুধু বলেছেন আসবেন। তানজিলা সময় জানতেও চায়নি। সে জানে তার মা কখনো মিথ্যা কথা বলে না। যখন বলেছে আসবে, তখন আসবেই।
সে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রাতের রান্না শেষ করল। খুব বেশিকিছু রাঁধেনি। ভাত, আলু সেদ্ধ, পাতলা ডালের সাথে বেগুন ভাজা। এতটুকু রাঁধতেই বেলা পেরিয়ে গেছে। রান্না সময় ক্রমাগত সে আরিফের নম্বরে কল দিয়েছে। তার মোবাইল বন্ধ। ছেলেটা কোথায় কি করছে কে জানে! কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। যেন হঠাৎই কোথাও উবে গিয়েছে।
সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার পরপরই সুমি তাদের বাড়িতে এলো। একাই এসেছে। ঘরে ঢুকে নরম গলায় বলল, “শুনলাম আরিফ ভাই এখনও বাড়িতে ফেরেনি। কোথায় গিয়েছে কিছু জানতে পারলেন?”
রেশমা বেগম মাথা দোলালেন। করুণ গলায় বললেন, “না রে মা, আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এ পরীক্ষার শেষ কোথায় আল্লাহই ভালো জানেন!”
“চিন্তা করবেন না কাকিমা। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। হয়তো আরিফ ভাই ভালোই আছেন। আমরা অহেতুক দুশ্চিন্তা করে ম’র’ছি।”
হামজা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বিরক্ত গলায় বলল, “এখানে ভালোর কি পেলেন? আমি তো এখানে ভালো কিছুই দেখছি না।”
সুমি মুচকি হাসল। বলল, “সবার দেখার চোখ থাকে না। বোঝার মস্তিষ্ক থাকে না। আপনি বোধহয় সেই রাজার গল্পটা শোনেননি।”
হামজা বিরক্তি নিঃশ্বাস ফেলল। রেশমা বেগম বললেন, “তা মা, তুমি কেন এসেছ? কিছু বলবে?”
“না কাকিমা, কিছু বলব না। আপনারা কেমন কি আছেন তা-ই দেখতে এলাম। যে বিপদ যাচ্ছে! আপনাদের অবস্থা বুঝতে পারছি।”
“দোয়া করো মা, এই ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।”
“ভাবীকে দেখছি না যে, সে কোথায়?”
“তানজিলা ওর ঘরে। বোধহয় ইনানকে খাওয়াচ্ছে।”
“ঘরটা?”
রেশমা বেগম ঘর দেখিয়ে দিলেন। হিসহিসিয়ে বললেন, “যা হয় ভালোর জন্য হয়!”
তানজিলা সবে একটু শুয়েছিল। সুমিকে দেখে বিছানায় উঠে বসল। ব্যস্ত গলায় বলল, “আপনি! আরিফ এসেছে?”
সুমি বলল, “না ভাবী৷ আরিফ ভাই আসেননি। আমি এসেছি। আপনাদের অবস্থা দেখতে এলাম। গোটা অফিসে আপনাদের আলাপ হয়। কেমন কি আছেন না আছেন।”
“আছি। সবকিছু মিলিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। খাটের ওপরই বসুন। ইনান ঘরের সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। মন মাথা ভালো না বিধায় আমি অতো গোছগাছ করতে যাইনি।”
“সমস্যা নেই, আমি বসছি।”
সুমি বিছানায় এক কোণায় বসল। হালকা গলায় বলল, “কিছু মনে না করলে এক গ্লাস পানি পেতে পারি? আসলে গলাটা একটু শুকিয়ে গেছে।”
তানজিলা হাত বাড়িয়ে পাশে টেবিলে রাখা জগ ধরল। জগে পানি নেই। সে একটু লজ্জিত গলায় বলল, “আপনি বসেন। আমি পানি নিয়ে আসছি।”
সুমি হাসল। তানজিলা উঠে চলে গেল। পানি নিয়ে এসে দেখল সুমি তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিলো। এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি শেষ করে বলল, “আমি আর বসব না। রাত হয়ে যাচ্ছে। মা চিন্তা করবে।”
তানজিলা মাথা কাত করে তাকে বিদায় জানালো। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল, “সাবধানে যাবেন। হামজা ভাইকে বলব? সে এগিয়ে দিয়ে আসত।”
“প্রয়োজন নেই। আমি চলে যেতে পারব।”
তানজিলা দরজা লাগিয়ে দিলো। তার শরীর ভেঙে আসছে। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকল। ইনানের গায়ে কাঁথা টেনে দিতে দিতে খেয়াল করল বিছানার ওপর সাদা একটা খাম পড়ে আছে। সে খুব দ্রুত হাতে খামটা তুলে নিলো। বেশ হালকা ধরনের। খাম খুলে দেখল– ভেতরে একটা চিঠি। তানজিলা চিঠি পড়তে আরম্ভ করল। এই হাতের লেখাটা তার পরিচিত। ভীষণ পরিচিত।
প্রিয় তানজিলা ,
জানি তুমি ভালো নেই। তোমার বিরহে আমিও কখনো ভালো থাকতে পারিনি। আজও পারছি না। বারবার তোমার ওই মায়াময়ী মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। ইনানের চঞ্চলতা, আধফোটা বুলি সবকিছুই খুব বেশি মনে পড়ছে। তোমাকে ছাড়া ভালো থাকা সম্ভব না। জানি পারব না। তাই চেষ্টাও করছি না। তোমার গায়ের গন্ধ না পেলে রাতে আমার ঘুম আসে না। ওই কণ্ঠস্বর না শুনলে মনে হয় আমি বধির হয়ে গিয়েছি। তোমায় না দেখলে চারপাশের সুন্দর নয়নাভিরাম দৃশ্যকেও ফিকে মনে হয়। বৈশাখের তপ্ত দুপুরের কড়া রোদও যেন মেঘে ঢেকে বিলীন হয়ে যায়। তুমি কি আমার এই অনুভূতি বুঝতে পারছ? আমার হৃৎস্পন্দনের শব্দ কি তোমার কানে পৌঁছাচ্ছে?
দূরে আছি বিধায় কষ্ট নিও না। দুশ্চিন্তা করো না। চোখ বন্ধ করে তোমার বুকে হাত রাখো, আমার সবটুকুই অনুভব করতে পারবে।
জানো? তোমার জন্য একটা উপহার কিনেছিলাম। পরিস্থিতির কারণে দিতে পারিনি। উপহারটা ছাঁদের এক কোণায় রাখা আছে। টবের ভেতরে। সময় করে নিয়ে নিও। ভালোবাসা রইল।
বিশ্বাস করো তোমাদের থেকে দূরে সরে গিয়ে আমি ভালো নেই। পরিস্থিতি বাধ্য করছে। আমি খুব দ্রুতই ফিরে আসব।
ইতি তোমার আরিফ।
চিঠি পড়ে তার শরীর কাঁপতে লাগল। বুক ধুকপুক করতে লাগল। মনে হলো যেন সে শূন্যে ভাসছে। তবুও সে প্রায় দশ বারের মতো চিঠিটা পড়ল। বুকে জড়িয়ে নিলো। ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমু খেলো। চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে টর্চ লাইট হাতে ছাঁদে উঠে গেল। তার দৃষ্টি ঝাপসা। চোখ থেকে ক্রমাগত পানি পড়ছে। সে বারবার করে চোখের পানি মুছচ্ছে।
ছাঁদের এক কোণায় একটা ফুলের টব আছে। মাসখানেক আগে আরিফই এই টবটা হাতে করে নিয়ে এসেছিল। টবে ছোট্ট দু’টো গোলাপের চারা ছিল। বিনা যত্নে চারা দু’টো শুঁকিয়ে গিয়েছে। তানজিলা সেদিকে খেয়াল দিলো না। ব্যস্ত হাতে টবের মাটি সরাতে লাগল। লাঠি দিয়ে মাঠি সরাতে গিয়ে বারবার তার হাতে খোঁচা লাগছে। বেশ ব্যথা পাচ্ছে তবে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
সে প্রায় মিনিট দশেক সময় নিয়ে মাটি সরালো। মাটি সরিয়ে মোটা পলিথিনে পেঁচানো একটা বান্ডিল পেল। খুলে দেখল– তাতে অনেকগুলো একশ টাকার নোট এবং একটা আংটি। রাস্তার পাশে কিনতে পাওয়া যায় এমন সস্তা ধরনের আংটি। তবে দেখতে বেশ সুন্দর। এসবের সাথে ছোট একটা চিরকুটও আছে।
চিরকুটে লেখা– ভালোবাসি তোমাকে। ঠিক আছি। চিন্তা করো না। ফিরে আসব। তোমায় এত সহজে ছেড়ে যাব না। আমার দেওয়া কষ্টের হাত থেকে এত সহজে তোমার মুক্তি নেই।
তানজিলা অস্ফুটস্বরে কেঁদে উঠল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। মেঘে আকাশ ঢাকা। চাঁদ তারা নেই। থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সে দু’হাত মেলে দাঁড়াল বৃষ্টির অপেক্ষায়। যেন বৃষ্টির পানি তার সব সমস্ত দুঃখ ধুয়ে দেবে। তার এ অপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। রেশমা বেগমের তীক্ষ্ণ চিৎকারে তড়িঘড়ি নিচে নেমে এলো।
ইনান সমানে বমি করছে। তানজিলা বলল, “কি হয়েছে ওর? হঠাৎ বমি করছে কেন?”
রেশমা বেগম বললেন, “ঘুম থেকে উঠে আমার কাছে এসেছে। সুমি মিষ্টি নিয়ে এসেছিল তাই খেতে দিয়েছি। মিষ্টি খাওয়ার পর থেকেই বমি করছে।”
হামজা তানজিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? হাতে এসব কি?”
তানজিলা যেন ধ্যানে ফিরল। হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “ইনানের বাবার দেওয়া উপহার। ছাঁদে রেখেছিল তাই আনতে গিয়েছিলাম।”
“আরিফ ভাই এসেছে?”
“না সে তো আসেনি। বিছানার উপর একটা চিঠি পেয়েছি। আরিফের চিঠি। ওরই হাতের লেখা। সেই চিঠিতে…”
হামজা চিৎকার করে উঠল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “কি হয়েছে আপনার? আরিফ ভাইয়ের চিঠি পেয়েছেন মানে? তার চিঠি বিছানার উপরে আসবে কি করে? কে রাখবে?”
রেশমা বেগম কিছু বলবে তার আগে সে পুনরায় চিৎকার করে উঠল।
“বুঝতে পেরেছি। খালা! সময় নষ্ট করা যাবে না। এক্ষুনি ইনানকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। আমার মন বলছে মিষ্টিতে কোন ঝামেলা আছে। ওই মেয়েকে দেখেই সুবিধার মনে হয়নি।”
রেশমা বেগম ভীতু চোখে তাকালেন। ইনান শরীর নেতিয়ে আসছে। তানজিলা সেই অবস্থায় ছেলেকে কোলে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। হামজাও তার আগে আগে ছুটল। উঁচু গলায় বলল, “খালা, আপনি বাড়িতে থাকেন। খালুকে কল দেন। আমি যাচ্ছি।”
সে খুব দ্রুত ছুটল। গাড়ি ডেকে সদর হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। তানজিলা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। নিজের উপর তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। কেন কিছু বুঝল না? কেন চিঠি পেয়েই সব সত্যি মনে করল? কেন ভাবল না আরিফের চিঠি বিছানায় কি করে আসবে?
হামজা ইনানের গায়ে হাত রাখল। ভরসা দিয়ে বলল, “ভয় পাবেন না। চলে এসেছি। ইনশাআল্লাহ ওর কিছু হবে না।”
তানজিলা তার কথার জবাব দিলো না। ঢোক গিলে চোখ বুজল। তার চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
নাইমা বই নিয়ে বসেছে। পড়ায় মনযোগ দিতে পারছে না। কে’সের ব্যাপারে ভাবছে। আরিফের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা তার কাছে ভাল ঠেকছে না। যদি সে-ই খু’ন করে থাকে তাহলে হিমিকে বাঁচাতে গোয়েন্দা নিযুক্ত করবে কেন?
তাছাড়া! হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতো তার কিছু মনে পড়ল।
সে চমকে উঠল। আরিফ সেদিন তানজিলাকে দাওয়াতে যেতে নিষেধ করেছিল। অর্থাৎ সে জানত– ওই বাসায় এমন কিছু হবে। ওখানে গেলে ওরা ফেঁসে যেতে পারে তাই আগে থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছিল৷ তানজিলা আর হিমি আরিফের কথা না শুনে ওই বাড়িতে যায়। আর হিমি সুরভির খু’নের দায়ে ফেঁসে যায়। আরিফ ছোট বোনের এই অবস্থা মেনে নিতে পারেনি। তাই নিজেই গোয়েন্দা ঠিক করে ওকে বের করতে চায়। এতে সে নিজেও নিরাপদ থাকত। তার নিযুক্ত গোয়েন্দা তাকে সন্দেহ করবে না।
নাইমা আর ভাবতে পারল না। ডান হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরল। হাবিব বলল, “মাথায় হাত দিয়ে বসে আছিস কেন? মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে নাকি?”
“না ভাইয়া, ভাবছি। কেন যেন মনে হচ্ছে আরিফ ভাই এই খু’ন করেছে আর এখন শা’স্তির ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”
“এ কথা মনে হওয়ার কারণ?”
নাইমা তাকে সব খুলে বলল। সব শুনে হাবিব ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সরু গলায় বলল, “আরিফের অফিসের সবার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। ওদের অফিসটা আমার পরিচিত। বছরখানেক আগে একবার ওই অফিসের সাথে আমাদের অফিসের একটা ডিল হয়েছিল।”
“কি জানতে পারলে? ওদের কেউ এ কাজ করতে পারে?”
“সবার কাছে একই কারণ ছিল। টাকা মা’র গেলে কারো মাথা ঠিক থাকে না। চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে সবাই একসাথে কেন এই কাজ করবে? তারপর আবার বাড়ির জমিজমা বন্দক রেখে।”
“নফসের কাছে আমরা সবাই কমবেশি পরাজিত হই। সেখানে টাকার লোভ ঢুকলে তো আর কোন কথাই নেই। যাইহোক তুমি আর কি জানতে পারলে?”
“সুরভির ব্যাপারেও খোঁজ খবর নিয়েছি। এর আগে কোথায় ছিল জানার চেষ্টা করছি। আমার এক বন্ধুকে বলেছি, সে খোঁজ নিয়ে জানাবে বলেছে।”
“পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।”
“আস্তে আস্তে সব জট খুলে যাবে। রহস্য ভেদ করতে এত তাড়াহুড়ো চলে না।”
নাইমা কিছু বলবে তার আগে তার মোবাইল বেজে উঠল। সে কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে কেউ কথা বলল না। নাইমা হ্যালো হ্যালো করতে করতে কল কেটে গেল।
হাবিব বলল, “হয়তো ভুলে কল চলে এসেছে। যাইহোক রাত হয়ে গেছে। খেয়ে শুয়ে পড়। আরিফের অফিসের সবার ডিটেইলস লিখে রেখেছি। তোকে পাঠিয়ে দেব।”
নাইমা মাথা দোলালো। হঠাৎই তার কেমন ভয়ভয় করছে। ফোনের ওপাশ থেকে কেমন একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ গোঙাচ্ছে।
চলবে