#বাতাস_বলে_দেয়
#ফারহানা_কবীর_মানাল
১৯.
রাতের আঁধার ম’রে গেছে প্রায়। চাঁদের গা গলে জোছনা চুইয়ে পড়ছে। থেমে থেমে ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। শুনশান রাস্তায় পাঁচটি প্রাণ নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের নিঃশ্বাসের ধরন আলাদা। হামজা বলল, “এই শালাকে নিয়ে কি করব? ইচ্ছে করছে আরও কয়েক ঘা লাগিয়ে দিই।”
নাইমা বলল, “আপাতত একে থানায় নিয়ে যেতে হবে। তারপর যা বলার ওখানেই বলবে।”
রোহান এগিয়ে গিয়ে লোকটার হাত ধরল। হিসহিসিয়ে বলল, “জে’লে ঢোকার আগে আমার হাজার টাকা ফেরত দিয়ে যাবেন। রোজগার করতে কষ্ট হয়।”
মকবুল সাহেব তেঁ তেঁ উঠলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “আমাকে ধরে তোরা ভালো করলি না। এর ফল তোদের পেতেই হবে।”
“উহু সোনাপাখি! ফল যা পাওয়ার তা তো তুমি পাবে। থানায় চলো তারপর তোমাকে বোঝাচ্ছি। আমার টাকা হজম করা এত সহজ নয়।”
নাইমা রোহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কিভাবে এখানে এলেন? তা-ও ঠিক সময়ে।”
রোহান কথার জবাব দিলো না, শুধু হাসল। হাবিব বলল, “এখানে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। যত দ্রুত সম্ভব থানায় যেতে হবে।”
হামজা এবং রোহান দু’জনে মকবুল সাহেবকে টানতে টানতে থানায় নিয়ে গেল। দারোগা সাহেব তাকে দেখে ভীষণ অবাক হলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, “উনাকে ধরে এনেছেন কেন?”
হামজা বলল, “পথে আমার উপর আ’ক্র’ম’ণ করেছিল। সাথে আরও একজন ছিল। কিন্তু সে পালিয়ে গিয়েছে।”
“ভিডিও ক্লিপ এনেছেন?”
“সত্যি বলতে আমার কাছে কোন ভিডিও ক্লিপ নেই। ওটা শুধুমাত্র আসল অপরাধীকে ধরার জন্য বলেছিলাম।”
“বেশ ভালো। তা মকবুল সাহেব আপনাকে কেন আ’ক্র’ম’ণ করবে? এই কেসের সাথে তার কি সম্পর্ক?”
হামজা বলল, “কি সম্পর্ক সে কথা তাকেই জিজ্ঞেস করেন। আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবে।”
দারোগা সাহেব মকবুল সাহেবের দিকে তাকালেন। বরফ শীতল কণ্ঠে বললেন, “কে আপনাকে হামজার কথা বলেছে? কার সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন?”
মকবুক সাহেব আমতাআমতা করতে লাগলেন। নাইমা বলল, “খবরটা এখান থেকেই গিয়েছে। এখানকার সবার মোবাইল চেক করলে আসল দো’ষীকে পাওয়া যাবে৷ যেহেতু আরিফ ভাই পুলিশের হেফাজতে আছেন, তাই সে হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।”
সুমি বলল, “আমার কাছেও কোন মোবাইল নেই। এখানে আসার আগেই পুলিশ ওটা নিয়ে নিয়েছে।”
দারোগা সাহেব কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। কনস্টেবল সবার মোবাইল চেক করতে লাগল। সবার মোবাইল খাটাখাটি করে দেখার পর সে ফ্যাকাসে মুখে মাথা দোলালো। মিইয়ে যাওয়ায় গলায় বলল, “কারো ফোনে কিছু পাওয়া যায়নি।”
দারোগা সাহেব বললেন, “এটা কি করে হতে পারে? কারোর ফোনে থেকে কোন সূত্র পাওয়া যায়নি? তাহলে খবর বাইরে গেল কিভাবে?”
রোহান বলল, “এটা হতে পারে না। আমি উনার সাথে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎই জিজ্ঞেস করলেন– আমার বাড়ির পাশের মাঠে কি কোন ক্যামেরা লাগানো হয়েছে?
আমি বললাম– হ্যাঁ, বেশ কয়েকদিন আগে দেখছি ক’জন ছেলে ক্যামেরা লাগিয়ে কিসব ভিডিও করেছে। আমার কথা শোনার পরপরই উনি লাফিয়ে উঠলেন। ব্যস্ত পায়ে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে বললেন– পরে আছিস। তোর সাথে পরে কথা বলব।”
“মোবাইলে কানে ছিল?”
“না তবে ব্লুটুথ লাগানো ছিল। ওয়াজ শুনছিলেন।”
নাইমা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। হামজা বলল, “এভাবে প্রশ্নোত্তর পর্ব না চালিয়ে দু’ঘা ক’ষি’য়ে দেন। সব সত্যি গড়গড় করে বলে দেবে।”
দারোগা সাহেব মকবুলের দিকে তাকালেন। হঠাৎই মকবুল সাহেব মেঝেতে বসে পড়লেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “স্যার এরা আমায় ফাঁসাচ্ছে। আমি কিছু জানি না। দুপুরে খাওয়ার পর ভাতঘুম দিচ্ছিলাম। হঠাৎই এই চেংড়া ছেলেটা গিয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। বলল– কাজের জিনিস দেখাবে। আমার বাড়ির সামনে নাকি খুব দামী একটা বুনোগাছ ফুটেছে। ওটাই নিতে চায়। আমি ওর কথা শুনে বাইরে আসতেই এই তিনটে ছেলে আর একটা মেয়ে মিলে আমাকে তুলে এসেছে। যা মা’র মে’রে’ছে না। দেখেন স্যার সারা গায়ে দাগ বসিয়ে দিয়েছে।”
দারোগা সাহেব ভড়কে গেলেন। এক হাতে কপাল চেপে ধরে অন্য হাতে পানির গ্লাস নিয়ে পানি পান করতে লাগলেন।
নাইমা বলল, “সুমির ফোন কোথায়? ওই ফোনটা একবার চেক করুন।”
এক পুলিশ কনস্টেবল গিয়ে সুমির মোবাইল চেক করল। উত্তেজিত গলায় বলল, “স্যার এই মোবাইল তো বন্ধ হয়ে গিয়েছি।”
দারোগা সাহেব ইশারা করলেন। সুমির মোবাইল চার্জে লাগানো হলো। আরিফ বলল, “আমি তো আমার অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছি। তাহলে এসব করে সময় নষ্ট করার মানে কী?”
তানজিলা অস্ফুট স্বরে বলল, “তুমি কেন সব দোষ তোমার নিজের ঘাড়ে নিতে চাইছ? কাকে বাঁচানোর জন্য এমন করছ?”
আরিফ এক পলক তার দিকে তাকাল। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমি কাউকে বাঁচাতে চাইছি না। যা সত্যি তাই বলছি।”
হামজা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করল। বিরক্ত গলায় বলল, “আপনার যা বলার বলেছেন। এখন একটু চুপ থাকেন৷ এই যে মকবুল সাহেব এক পা তো ক’ব’রে চলে গিয়েছে এখনও ভণ্ডামি করছেন?”
মকবুল সাহেব কড়া চোখে তার দিকে তাকালেন। কর্কশ গলায় বললেন, “তোরা ভণ্ডামি করছিস। আমাকে ধরে এনে নাটক সাজাচ্ছিস। এই কে’সের কোন কিছু আমার জানা নেই৷ আমি সাত পাঁচ কোথাও নেই।”
দারোগা সাহেব অল্প হেসে বললেন, “আপনি সাতেপাঁচে আছেন কি-না একটু পরেই প্রমানিত হয়ে যাবে। তীর্থ, সুমির ফোনে চার্জ হয়েছে?”
“হ্যাঁ স্যার। তবে এই ফোনেও তেমন কিছু পাইনি।
দারোগা সাহেব সিমার দিকে তাকালেন। হালকা গলায় বললেন, “শুনেছি সুরভির চাকরির ব্যাপারে আপনি সুপারিশ করে দিয়েছিলেন৷ আগে থেকে চিনতেন নাকি?”
সিমা বলল, “সুরভি আপা আমার দুঃসম্পর্কের আত্মীয় হয়। স্বামী মা’রা যাওয়ার পর বেশ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। আমি শুধু উনাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। উনি যেহেতু কাজ জানতেন তাই। তাছাড়া বসের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল। এসব খু’নের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। সুরভি আপার কথায় আমিও টাকা দিয়েছি।”
নাইমা বলল, “আপনি যখন জানতেনই সুরভি অসহায় তাহলে তার কথার টাকা কেন দিয়েছেন?”
“লোভে পড়ে দিয়েছি। ইনভেস্ট করার পর বাকিরা অনেক টাকা লাভ পেয়েছিল। তাই আমিও। এমন হবে জানলে কখনো এসবে জড়াতাম না।”
দারোগা সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। থানার ঘর গিজগিজ করছে। সবার মুখে অন্য রকমের উদ্বেগের ছাপ। শুরু রেশমা বেগমকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তিনি একপাশের চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে আছেন। দারোগা সাহেব শান্ত চোখে সবার মুখে দিকে তাকালেন৷ অত্যন্ত কঠিন মুখে বললেন, “আপনাদের সবাইকে অনেক সুযোগ দিয়ে ফেলেছি। চাইলে প্রথমেই সত্য স্বীকার করে নিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সবাই মিলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। মনে হয় এবার আর ভালো ব্যবহার করা উচিত হবে না। মকবুল সাহেব, রিমান্ডের আপ্যায়ন নিবেন নাকি সত্যি বলবেন?”
মকবুল সাহেব তবুও কিছু বললেন না। দারোগা সাহেব স্বাভাবিক পায়ে হেঁটে ময়লার ঝুড়ি থেকে একটি মোড়ানো কাগজ বের করল। কাগজ সোজা করতেই তার ভেতর থেকে একটি ছোট ব্ল্যাক বক্স বা USB ফ্ল্যাশ ড্রাইভের মতো একটা জিনিস বের হয়ে এলো। দারোগা সাহেব বললেন, “এই জিনিসটা কেউ চেনেন?”
নাইমা বলল, “স্পাই বাগ ডিভাইস। একটি ছোট আকারের গুপ্তচর ডিভাইস, যা দেখতে সাধারণ জিনিসের মতো। এটি একটি সিমকার্ড-ভিত্তিক ডিভাইস, যা মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আশেপাশের শব্দ শুনতে সাহায্য করে। কিন্তু এটা এখানে কে রেখেছে?”
দারোগা সাহেব হেঁটে সিমার কাছাকাছি দাঁড়ালেন৷ রহস্যময় গলায় বললেন, “কে রেখেছে এটা?”
সিমা বলল, “আমি এসবের কিছু জানি না৷ এই জিনিসটাকে প্রথম দেখছি।”
“ভালোই নাটক করতে পারেন। অভিনয়ে নাম লেখাতে পারতেন। যাইহোক, মনে পড়ে থানায় ঢোকার পরপরই আপনি এই ঝুড়িতে ময়লা ফেলেছিলেন? এই কাগজটাই তো ফেলেছিলেন নাকি?”
“না আমি। আমি এই কাগজ ফেলেনি।”
“আপনারা বড্ড খাটান৷ এটা থানা৷ এখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। এই মুহূর্তে প্রমান হয়ে যাবে কাগজটা আপনি ফেলেছিলেন কি-না।”
সুমি জড়ানো গলায় বলল, “ওই কাগজ আমাকে মোহন ভাই দিয়েছে। হ্যাঁ, থানায় ঢোকার সময় উনি ওটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন ফেলে দিতে। তখন কাগজ মোড়ানোই ছিল।”
মোহন অস্বীকার করল না। দারোগা সাহেব শক্ত হাতে মকবুল সাহেবের চোয়াল চে’পে ধরলেন। কড়া গলায় বললেন, “এতক্ষণ অনেক নাটক করেছেন। এবার বলেন। এসবের সাথে কে জড়িত?”
মকবুল সাহেব ব্যাথায় কুঁকড়ে যাওয়া গলায় বলল, “ওই মোহন ছেলেটা। ওই আমাকে বলেছিল থানায় যে-সব কথা হবে সে-সব শুনে পদক্ষেপ নিতে। আমি শুধু ওর কথা শুনেছি।”
“কেন শুনেছেন? আপনার কি উচিত ছিল না এমন কথা পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া।”
“টাকার জন্য করেছি। ও আমাকে বলেছিল এই কাজটা করে দিলে সত্তর হাজার টাকা দেবে। টাকার জন্য করেছি।”
“মাত্র সত্তর হাজার টাকার জন্য আপনি অপরাধীকে সঙ্গ দিবেন।”
রোহান বেশ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “ছেড়ে দেন। যে লোক এক হাজার টাকার লোভ সামলাতে পারে না। সে কি করে সত্তর হাজার টাকার শুনে নিজেকে সামলে রাখবে।”
দারোগা সাহেব মোহনের দিকে তাকালেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “এসবের পেছনে তাহলে আপনি?”
মোহন মাথা নিচু করে ফেলল। নরম গলায় বলল, “হ্যাঁ আমি। সুরভির কথায় আমার সব টাকা শেষ হয়ে গিয়েছে। সারাদিন বাড়িতে অশান্তি হয়। সত্যি বলতে ম’রে গিয়ে বেঁচে আছি। এরপর হঠাৎই একদিন জানতে পারি সুরভি এসব ইচ্ছে করে করেছে। টাকা মা’র হবার পেছনে তারও হাত আছে। সে লাভের অংশ পাবে। কথাটা শুনে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি৷ ঠান্ডা মাথায় খু’নের পরিকল্পনা সাজাই। ঠিক করি সবকিছুর জন্য আরিফ ভাইকে ফাঁসিয়ে দেব। অফিসের ছু’রি ছোড়ার প্রতিযোগিতায় আরিফ ভাই চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল তাই এটাকেই খু’নের অ’স্ত্র হিসাবে ব্যবহার করি। টাকা দিয়ে একজন লোক ভাড়া করি যে খুব ভালো নিশানা লাগাতে পারবে। বাড়ির মালিক মকবুল সাহেবকেও টাকা দিয়ে হাত করি যেন উনি ওই লোকটাকে সাহায্য করেন।
আরিফ ভাইয়ের মতো শার্ট এবং পারফিউম কিনে সুরভির বাথরুমে রাখি।”
তানজিলা বলল, “ওই শার্ট কে রেখেছিল?”
“মকবুল সাহেব রেখেছিল। সে প্রথম থেকেই আমায় সঙ্গ দিয়েছে।”
মোহন চুপ করে গেল। হামজা বলল, “তাহলে আরিফ ভাই কেন সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়েছে?”
“সেদিন অফিসে যাওয়ার পথে আরিফকে কি’ড’ন্যা’প করে একটা ঘরে আটকে রেখেছিলাম। তারপর ওকে মৃ’ত্যুর ভয় দেখিয়ে সব দোষ স্বীকার করতে বলি। এর মধ্যে আবার সুমিকে দিয়ে আরিফের বাড়িতে বি’ষা’ক্ত মিষ্টি পাঠাই। ইনান অসুস্থ হয়ে যায়। এতে করে আরিফের মনে ভয় ঢুকে গেছে। তাই সে আমার কথামতো সুমিকে ওই চিঠি লিখে দেয়। আর যা কিছু হয়েছে সবকিছুই আমার জন্য হয়েছে। আরিফ নির্দোষ, সুমিও নির্দোষ। ওদেরকে আমি ব্যবহার করেছি।”
রাত বাড়ছে। আরিফের পরিবারের সবার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। নাইমা বলল, “ভাইয়া, আমাদের এখন বাড়ি ফেরা উচিত। বেশি রাত করলে মা রাগ করবে।”
চলবে