ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-১২

0
1

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১২
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা নিজের জন্য বরাদ্দ রুমে এসে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে শুরু করে। তার চোখের সামনে বারংবার মান্যতা ও জাবিরের ঘনিষ্ঠ দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছিল৷ দৃঢ়তা বলে ওঠে,
“কেন আল্লাহ কেন? আমার ভাগ্যে এত কষ্ট কেন লিখে রাখলে তুমি? আমি যে আর পারছি না সহ্য করতে। তুমি আমাকে আরো ধৈর্য দাও আল্লাহ৷”

এমন সময় হঠাৎ করে মনোয়ারা বেগম দৃঢ়তার রুমে চলে আসেন৷ তিনি এসে দৃঢ়তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ঘাবড়ে গেলেন। তার চোখেও জল এলো। তিনি ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,
“দৃঢ়তা…”

দৃঢ়তা মনোয়ারা বেগমের কন্ঠস্বর শুনে উঠে বসলো। চোখের জল মুছে বললো,
“চাচি তুমি..”

মনোয়ারা বেগম এগিয়ে এসে দৃঢ়তাকে জড়িয়ে ধরেন৷ বলেন,
“আমার থেকে তোকে কিছু লুকাতে হবে না। আমি বুঝতে পারছি তোর কষ্টটা। কেন এই অন্যায় মেনে নিচ্ছিস দৃঢ়তা? তুই না চাইলে কিন্তু মান্যতা জাবিরকে বিয়ে করতে পারবে না।”

“কিন্তু আমি চাই যে, এই বিয়েটা হোক।”

“এসব কি তুই মন থেকে বলছিস? তোর চোখ কিন্তু অন্য কথা বলছে।”

দৃঢ়তা মেকি হেসে বলে,
“আমার মনের খবর কি কেউ করে চাচি? মান্যতা আপু, মিস্টার জাবির ওনারা তো শুধু নিজের সুখের খোঁজ করছেন। আমি নাহয় তাদের সেই সুখের পথকে সুগম করে দিলাম।”

“কিন্তু এসব করে তুই তো কোন লাভ পাবি না৷ বরং তোকে আরো দুঃখ পেতে হবে।”

“জোর করে এই সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রেখেও আমি কোন লাভ পাব না চাচি। মিস্টার জাবির আমাকে কখনো ভালোবাসবে না। উনি মান্যতা আপুকে ভালোবাসেন। আর তাই আমি ওনাদের সুখী দেখতে চাই।”

“আর তোর সুখের কি হবে?”

“সুখ! আমার জীবনে যদি আল্লাহ সুখ লিখে রাখেন তাহলে একদিন আমি ঠিকই সেই সুখের দেখা পাব।”

এমন সময় আনিকা চৌধুরী এসে বলেন,
“আমি দৃঢ়তার সাথে একমত।”

“চাচি!”

“হ্যাঁ, দৃঢ়তা। শুরুতে যখন তুমি জাবিরের সাথে মান্যতার বিয়েটা মেনে নিয়েছিলে তখন আমি ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম তোমার উপর। তোমার বোকামি আর ভালোমানুষি দেখে আমি ভীষণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলাম৷ কিন্তু তারপর যখন ঠান্ডা মাথায় সব ভাবলাম, তখন মনে হলো তোমার সিদ্ধান্ত ভুল নয়। কারণ তুমি যদি এই বিয়েতে মত না দিতে তাহলে জাবিরসহ এই বাড়ির সবাই তোমার উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতো। তুমি কখনো একটা স্বাভাবিক লাইফ পেতে না। তাছাড়া জাবির যে-ধরনের ছেলে ও হয়তো মান্যতাকে…বাদ দাও সেসব, তুমি ঠিকপথেই হাটছ। জাবির তোমার যোগ্য নয় আর নাতো এই পরিবার। তুমি একটা ভালো লাইফ ডিজার্ভ করো যা এখানে কখনোই পাবে না।”

মনোয়ারা বেগম বলেন,
“কিন্তু ও আবার কিভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে বেয়ান? এই সমাজ একজন ডিভোর্সি মেয়েকে কতটা নীচ নজরে দেখে সেটা তো আপনি জানেন।”

“একটা কথা কি জানেন, রাত যত গভীর হয় প্রভাত ততো নিকটে আসে। আমাদের হয়তো এখন পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে দৃঢ়তার জীবনে গভীর আধার নেমেছে কিন্তু এমনটা হতে পারে যে, এই আধারের শেষেই ও নিজের জীবনে আলোর দেখা পাবে।”

মনোয়ারা বেগম দৃঢ়তার মাথায় হাত রেখে বলেন,
“তাই যেন হয়। আমার মেয়ে আর স্বামীর জন্য দৃঢ়তার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। এরপর ও একটা স্বাভাবিক জীবন না পেলে যে আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। কারণ, ওর মায়ের মৃত্যুর আগে আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম ওকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখব। কিন্তু…”

দৃঢ়তা বলে,
“তুমি সেই দায়িত্ব পালনে একদম সফল চাচি। আর যার প্রতিই আমার অভিযোগ থাকুক, তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। একমাত্র তুমি ছিলেই বলে আমি মায়ের অভাব কখনো বোধ করিনি।”

আনিকা চৌধুরীও বলেন,
“হ্যাঁ, আমি দৃঢতার কাছে আপনার ব্যাপারে অনেক শুনেছি। আপনি যেভাবে ওকে আগলে রেখেছে সেটা আজকালকার যুগে কজনই বা করে। ওকে নিয়ে আর চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো, আমার নিজের জীবন এই চৌধুরী পরিবারের জন্য তছনছ হয়ে গেছে কিন্তু দৃঢ়তার জীবন আমি তছনছ হতে দেবো না। ওর জীবন সাজিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার।”

★★
গোটা চৌধুরী বাড়ি সেজে উঠেছে বর্ণীল সাজে। জাবির ও মান্যতার বিয়ে উপলক্ষে বিরাট আয়োজন করা হয়েছে। যদিও আগামীকাল তাদের বিয়ে তবে এখন থেকেই উৎসবের আমেজ লেগেছে। যদিওবা এই বিয়ে নিয়ে অনেক হাসি-তামাশাও হচ্ছে। কারণ কিছুদিন আগেই জাবিরের বিয়ে হয়েছে। এখন সেই বিয়ের মাস না ঘুরতেই বউয়ের চাচাতো বোনের সাথে বিয়ে—ব্যাপারটা বেশ হাস্যরস তৈরি করেছে। একইসাথে অনেকে দৃঢ়তার জন্য দুঃখপোষণ করেছে। তেমনি বিয়েবাড়িতে আসা এক অতিথি বলছিলেন,
“শুনেছেন আপনারা..কিছুদিন আগেই তো এই মেয়েটার সাথে জাবিরের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটা বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যায়। তারপর তো ওর চাচাতো বোনের সাথে বিয়েটা হয়। এখন আবার ঐ মেয়েটা ফিরে আসায় ওর সাথে বিয়ে হচ্ছে। কি কেচ্ছা কি কেচ্ছা।”

আরেকজন বলেন,
“ওমা কি বলছেন আপনি? আর ঐ মেয়েরই বা কেমন রুচি? পালিয়েই যখন গিয়েছিলি তখন আবার নিজের বোনের সংসার নষ্ট করতে ফিরে এলি কেন?”

মান্যতা দূর থেকে এসব কথা শুনে ফেলে। তার ভীষণ অস্বস্তি হয় এসব শুনে। সে রেগে সামনের দিকে এগোতে থাকে। একটু দূরে গিয়েই দৃঢ়তার মুখোমুখি হয়। দৃঢ়তা হাসিমুখেই বিয়ের সব আয়োজনে অংশ নিচ্ছিল। মান্যতা দৃঢ়তার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আচ্ছা দৃঢ়তা আমি কি তোর সংসার নষ্ট করছি? তোরও কি এটা মনে হয়? মনে হলে বল আমায় আমি এই বিয়েটা ভেঙে দিয়ে চলে যাব। তবুও মানুষের কথা শুনতে পারব না।”

দৃঢ়তা বলে,
“অন্যের কথায় এত গুরুত্ব দিও না আপু। তুমি যা করছ নিজের সুখের জন্য করছ।”

“মানে তুইও আমায় ঘুরেফিরে স্বার্থপরই বলছিস?”

“না,আমি সেটা বলছি না। দেখো, যদি তুমি একতরফাভাবে মিস্টার জাবিরকে বিয়ে করতে চাইতে তাহলে তো এই বিয়েটা হতো না। তোমরা দুইজনই চেয়েছ বলেই হচ্ছে। তাই দোষটা তো তোমার নয়। এই বিয়েটায় তোমরা দুজনেই সুখী হবে। আর জোর করে আর যাইহোক সংসার হয়না। মিস্টার জাবির কেবলমাত্র তোমার সাথেই সংসার করতে চান।”

“তুই কি মন থেকে এই বিয়েটা মেনে নিয়েছিস?”

“আমার কথা বাদ দাও তো, আমার মানা না মানায় কি এসে যায়। তোমরা সুখী থাকলেই হয়।”

মান্যতা আর কিছু বলবে এমন সময় জাবির সেখানে চলে আসে। এসেই মান্যতার হাত ধরে বলে,
‘তুমি এখানে, আর আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার বন্ধুরা তোমার সাথে দেখা কর‍তে চাইছে।’

বলেই মান্যতাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। দৃঢ়তা তাদের যাওয়ার পানে তাকায়। জাবির আজ একটা বাদামী কালারের পাঞ্জাবি পড়েছে। ভীষণ মানিয়েছে তাকে পাঞ্জাবিটা। লাল শাড়ি পড়া মান্যতাকেও তার পাশে দারুণ লাগছে।

জাবির হাসিমুখে নিজের সব বন্ধুদের সাথে মান্যতার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এসব দেখে দৃঢ়তার চোখে জল আসে। সে জলটুকু মুছে নিয়ে জাবিরের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনাকে ভালোবেসেছি নিজের মনের গোপনে..কিন্তু সেই ভালোবাসা আপনি উপলব্ধি করতে পারেন নি। তবুও আমি সবসময় চাইবো, যাকে ভালোবেসে আপনি নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছেন তার সাথে সুখী হন। আমি নাহয় দূরেই রইলাম নিজের গোপন অনুভূতি নিয়ে।”

দৃঢ়তার ভাবনার মাঝেই আনিকা চৌধুরী এসে তার কাধে হাত রেখে বলেন,
“জানো, একসময় আমার শাশুড়ী আমার সংসারও এভাবে ভাঙতে চেয়েছিলেন। আমার স্বামীকে অন্য একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলেন৷ কিন্তু তিনি সেই সময় সেই বিয়েটা ভেঙে দেয় এবং নিজের মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় আপন করে নেয়। কিন্তু জাবির..”

“সব মানুষ তো একরকম হয়না। এই নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই। সবাইকে নিজের মতোই বাঁচতে দেওয়া উচিত।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨