ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-১৩

0
2

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১৩
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল৷ মান্যতা ও জাবিরের বিয়ে উপলক্ষ্যে এখানে আসা অনেক মানুষই তার দিকে ত্যাড়া চোখে তাকাচ্ছিল। যা বুঝতে পেরে দৃঢ়তার ভীষণ অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে মান্যতা এসে দৃঢ়তার হাত ধরে টেনে বলে,
“দৃঢ়তা একটু আমার সাথে এদিকে আয়৷ জাবিরের সব বন্ধুরা আছে ওখানে। আমার সবার মধ্যে ভীষণ আনকমফর্টেবল ফিল হচ্ছে। তাছাড়া ওরা আমার বাড়ির লোকের ব্যাপারেও জানতে চাচ্ছে।”

“না, আপু। আমি এখানেই ঠিক আছি।”

“একটু বোঝার চেষ্টা কর বোন। এমনিতেই বিয়েটা এভাবে হচ্ছে যে, আমাদের কোন আত্মীয়-স্বজনকে সেভাবে জানানো হয়নি। এখানে তুই ছাড়া আর কেউ আমার পরিচিত নেই। আমার অবস্থাটা একটু বোঝ।”

“আচ্ছা, চলো। আমি যাচ্ছি তোমার সাথে।”

মান্যতা খুশি মনে দৃঢ়তাকে সাথে নিয়ে সবার সামনে আসে। জাবিরের কিছু বন্ধু দৃঢ়তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“আরে ইনি কে?”

মান্যতা বলে,
“ও হলো আমার বোন দৃঢ়তা।”

“বাহ, তার মানে আমাদের জাবিরের শালী। শালী মানে তো আধি ঘরওয়ালী।”

এসবের মধ্যে জাবিরের এক বন্ধু ছিল আয়ুশ, যে দৃঢ়তা ও জাবিরের বিয়ের ব্যাপারে সবটাই জানে। সে হঠাৎ করে বলে ওঠে,
“কিন্তু এই শালী তো ফুল ঘরওয়ালী।”

কথাটা শুনেই জাবির, মান্যতা ও দৃঢ়তা তিনজনেরই কেমন জানি লাগে। দৃঢ়তার তো চরম অস্বস্তি হতে থাকে। এরইমধ্যে জাবিরের বন্ধুদের মধ্যে একজন বলে,
“তা বেয়াইন, আপনি গানটান জানেন তো নাকি? নিজের বোনের বিয়ে উপলক্ষে একটা গান তো শোনাতেই পারেন।”

দৃঢ়তা বলে,
“নাহ, আমি গান গাইতে পারি না।”

দৃঢ়তার কথা শুনে মান্যতা বলে ওঠে,
“মিথ্যা কেন বলছিস রে? তুই তো খুব সুন্দর গান গাইতে পারিস। ওরা যখন শুনতে চাচ্ছে একটু শোনা।”

জাবিরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলে ওঠে,
“হ্যাঁ, দৃঢতা। আমি তো এর আগেও তোমার গান শুনেছি। বেশ ভালো গাও তুমি৷ একটা গান শোনাও সবাইকে।”

দৃঢ়তা জাবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বেশ।”

অতঃপর সে জাবিরের দিকে তাকিয়ে সুর টেনে বলতে শুরু করে,
❝ওরা মনের গোপন চেনে না..
ওরা হৃদয়ের রং জানে না…
প্রজাপতি ডানা ছুঁলো বিবাহ বাসরে
কেন সারারাত জেগে বাড়ি ফিরি ভোরে
ওরা মনের গোপন চেনে না..
ওরা হৃদয়ের রং জানে না..❞

গান বলতে বলতে দৃঢ়তার চোখে জল চলে সে। সবার অলক্ষ্যে সে সেই জলটুকু মুছে নিয়ে আবারো গেয়ে ওঠে,

❝তুমি চিরদিন..ভিষণ কঠিন
তোমার ঘর ভেসে যায়
ওরা মুখ দেখে বুঝতে পারে না
ওরা এ মন কেমন বোঝে না..❞

এবার আর দৃঢ়তা নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। তার চোখ দিয়ে বৃষ্টির ধারার মতো জল পড়তে লাগল। জাবির লক্ষ্য করলো সেই অশ্রুকণা। তার বুকে কেন জানি চিনচিনে ব্যথা অনুভব হতে লাগল৷ দৃঢ়তার সাথে কাটানো মুহুর্ত, তার করা সেবাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। দৃঢ়তা নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে দৌড়ে পালিয়ে গেল।

জাবিরের বন্ধুরা নিজেদের মধ্যেই কথাবার্তা চালাতে লাগল। মান্যতা পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করল। সে জাবিরের দিকে তাকিয়ে তার অস্থির ভাব দেখে বলে উঠল,”শুনুন..”

জাবির বলে ওঠে,
“দৃঢ়তার দিকে খেয়াল করেছ তুমি? ওকে দেখে কেন জানি ভীষণ দুঃখী দুঃখী লাগছিল৷ ও কি আমাদের এই বিয়ে নিয়ে সুখী নয়।”

মান্যতা বলে,
“সুখী হবে না কেন? ও তো নিজেই আমাদের এই বিয়ের আয়োজনটা করেছে। হয়তো আমার বিয়ে হয়ে যাবে তাই একটু ইমোশনাল হয়ে গেছে।”

জাবির নিজের ভাবনায় হারিয়ে যায়। অধঃপতনের কিছু না বলেই স্থানত্যাগ করে। মান্যতা জাবিরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। জাবির যাওয়ার পর আয়ুশ এগিয়ে এসে মান্যতাকে বলে,
“আমি জাবিরের অনেক পুরানো বন্ধু। তাই ওর ব্যবহার দেখেই ওর ব্যাপারে অনেক কিছু বলে দেখতে পারি। আমি আপনাদের ব্যাপারে সবটাই জানি৷ কিভাবে জাবিরের সাথে আপনার বিয়ের দিন আপনি পালিয়ে গেছিলেন তারপর আপনার বোনের সাথে..”

মান্যতা বলে,
“ওটা তো জাস্ট একটা ভুল ছিল। দৃঢ়তা বা জাবির কেউ এই বিয়েতে সুখী ছিল না৷ কারণ জাবির আমাকে ভালোবাসে।”

আয়ুশ হেসে বলে,
“বাংলায় একটা প্রবাদ আছে জানেন তো, আগুন আর ঘি পাশাপাশি থাকলে যেকোন সময় বড় একটা বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। বাকিটা আপনিই বুঝে নিন,আপনাকে দেখে তো বুদ্ধিমতী মহিলাই মনে হয়।”

বলেই আয়ুশ মান্যতার কাছ থেকে সরে আসে। মান্যতা মনে মনে বলে,
“নাহ, আমি এটা কিছুতেই হতে দেব না। একবার আমি নিজের ভালোবাসাকে হারিয়েছি। আবির ভাই, যাকে আমি নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসতাম সে আমায় ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় বার আমি একই কষ্ট সহ্য করতে পারব না। জাবিরকে আমি নিজের করে নেবোই।”

এদিকে আয়ুশ শরবতে চুমুক দিয়ে মনে মনে বলে,
“আমি এখনো ভুলিনি জাবির কিভাবে কলেজ টাইমে তোর জন্য আমার সাথে আমার প্রেমিকার বিচ্ছেদ হয়েছিল। হ্যাঁ আমি প্লেবয় ছিলাম তবে ঐ মেয়েটাকে আমি সত্যিকারের ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু তুই ওর সামনে আমার অতীত নিয়ে এসে ওকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলি৷ এখন দেখ, আমি কিভাবে তোর জীবনেও ঝড় তুলি। তুইও এবার উপলব্ধি করবি ভালোবাসা হারালে কেমন লাগে।”

★★
দৃঢ়তা একটা রুমে ঢুকে নিজের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলছিল। তার চোখের জল যেন কোন বাঁধ মানতে চায় না। দৃঢ়তা এভাবে কাঁদছিলই কি এমন সময় মান্যতা সেখানে চলে এসে বলে,
“দৃঢ়তা..”

দৃঢ়তা নিজের চোখের জল মুছে বলে,
“আপু তুমি। এসো..”

“আমাকে দেখে তোকে আর নিজের চোখের জল মুছতে হবে না৷ আমিই তো তোর এই চোখের জলের কারণ, তাইনা?”

“না আপু। তুমি ভুল ভাবছ।”

“না, আমি একদম ঠিক ভাবছি৷ সত্যিই তো, আমার জন্যই তোর আজ এই অবস্থা। আমার জন্য তোকে জাবিরকে বিয়ে করতে হয়েছে আর এখন আমার জন্যই এই সংসারটা ভাঙতে বসেছে।”

“না, আপু। মোটেই এমন না। মিস্টার জাবির তো তোমাকে ভালোবাসে।”

“ভালোবাসে..কিন্তু জানিস, আজ যখন তুই গান বলতে বলতে কাঁদছিলি তখন আমি ওনার চোখে তোর জন্য মায়া দেখেছি। এই মায়াও যেকোন সময় ভালোবাসায় পরিণত হবে।”

“না, এমনটা হবে না। আমি ওনাকে ডিভোর্স দিয়ে তোমাদের জীবন থেকে চলে যাব।”

“না, তোকে এমনটা করতে হবে না দৃঢ়তা। আমি একটা কাজ করি, জাবিরের সাথে নিজের বিয়েটা ভেঙে দেই। তারপর তুই জাবিরের সাথে সুখে সংসার কর। আমার আর কি, আবির ভাই তো আমায় ধোকা দিয়েছে বাকিটা জীবন নাহয় তার স্মৃতি নিয়েই কাটিয়ে দেব। সমাজ আমায় ছি ছি করবে, মা-বাবার চোখেও একসময় বিষ হয়ে উঠব। সবাই আমায় নোংরা কথায় বিদ্ধ করবে। তারপর নাহয় একদিন গলায় ফাঁ/স দিয়ে..”

দৃঢ়তা মান্যতার মুখে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“আপু..এসব কি আবোলতাবোল বলছ তুমি? এমন কিচ্ছু হবে না। তুমি মিস্টার জাবিরকে বিয়ে করবে। ওনার সাথে সুখে সংসার করবে, বুঝেছ?”

“কিন্তু তোর সাথে ওনার ডিভোর্সের তো আরো ৬ মাস আছে। এই ৬ মাসে যদি উনি তোর প্রতি দূর্বল হয়ে যায় আর..”

“এমন কিছু হবে না।”

“তাহলে তো এই ৬ মাস তোকে ওনার থেকে দূরে কোথাও থাকতে হবে।”

“বেশ, আমি তোমাদের বিয়ের পরই ৬ মাসের জন্য তোমাদের জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাব।”

মান্যতা দৃঢ়তাকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলে,
“এটাই তো আমি চাইছিলাম। আমি জানতাম, এভাবে ব্ল্যাকমেইল করলেই এই বোকা দৃঢ়তা গলে যাবে..এবার আমার আর জাবিরের এক হওয়া আর কেউ আটকাতে পারবে না।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨