ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-১৬

0
2

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১৬
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে পৌঁছে ট্রেন থেকে নামে। এই শহর তার কাছে বড্ড অচেনা৷ সে জানেও না এখন কোথাও যাবে৷ তবুও অক্লান্ত মুসাফিরের মতো পথ চলতে শুরু করল। সময় তখন মাঝরাত। এত রাতে চলাফেরা একটা মেয়ের জন্য নিরাপদ না। দৃঢ়তারও একটু ভয় করছে এখন। কিন্তু এখন আপাতত তার অন্য কোন উপায়ও নেই। একটু দূরে গিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে সেখানে উঠে পড়লো দৃঢ়তা। তবে সিএনজিতে ওঠার পর থেকেই লক্ষ্য করল যে সিএনজি চালক তার দিকে কিরকম অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছিল৷ ব্যাপারটা তার খটকা লাগে৷ তবুও সে বলে,
“ভাইয়া আমাকে একটু হালিশহরের দিকে নিয়ে চলুন।”

সিএনজি চালক হঠাৎ বলে উঠল,
“আপনি কি এই শহরে নতুন ম্যাডাম?”

“হ্যাঁ..মানে..ঐ আরকি।”

দৃঢ়তা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল৷ কিন্তু তার ভীষণ ভয়ও করছিল। দৃঢ়তা চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে,
“হে আল্লাহ,একবার শুধু আমার সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে হালিশহরে পৌঁছে দাও, ওখানে গিয়ে কোন ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে হবে৷ আপাতত যা জমানো টাকা আছে সেসব দিয়েই চলতে হবে। তারপর দেখা যাক, কোন কাজের জোগাড় করতে পারি যদি।”

দৃঢ়তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে সিএনজি চালক সিএনজিটা ঘুরিয়ে একটা অন্ধকার পথে নিয়ে যেতে থাকে। দৃঢ়তা বলে ওঠে,
“ভাইয়া এটা কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন? দেখে তো মনে হচ্ছে এটা জঙ্গলময় একটা পথ।”

“এটা একটা শর্টকার্ট পথ ম্যাম, আপনি তো এই শহরে নতুন তাই জানেন না।”

সিএনজি চালকের কথায় কেন জানি দৃঢ়তা একটুও ভরসা পায় না৷ তার মনে একটা খটকা লাগে। তাই সে নিজের ফোন বের করে গুগল ম্যাপে সার্চ দেয়। অতঃপর যখন দেখে এই রাস্তা হালিশহরের দিকে নয় বরং বান্দরবানের দিকে যাচ্ছে তখন সে বলে ওঠে,
“ভাইয়া..গাড়ি থামান। এটা আপনি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? এটা তো হালিশহরের পথ না।”

কিন্তু সিএনজি চালক তার কথা শোনে না। স্ব আরো জোরে সিএনজি চালাতে শুরু করে। দৃঢ়তা এবার ভয়ে ভয়ে ফোন বের করে ৯৯৯ এ কল করতে চায় এমন সময় সিএনজি চালক গাড়ি থামিয়ে তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে তার গলায় একটা চাকু ধরে বলে,
“চুপ..একদম চালাকি করার চেষ্টা করবি না। নাহলে জানে মেরে দেব।”

দৃঢ়তা ভয়ে গুটিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে বলে,
“হায় আল্লাহ! এ তুমি আমায় কোন বিপদে ফেললে। তাহলে কি আজই এই পৃথিবীতে আমার শেষ দিন?”

★★
জাবির নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দৃঢ়তার লেখা চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছে। বারবার করে সে চিঠিতে লেখা হৃদয়বিদারক কথাগুলো পড়ছে,
❝মিস্টার জাবির, আপনাকে দেয়া এটাই হয়তো আমার প্রথম এবং শেষ চিঠি। প্রথমেই আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানাই। আশা করি, যাকে ভালোবেসে আপনি নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন তার সাথে অনেক সুখী হবেন। মান্যতা আপু আর আপনি হয়তো একে অপরের জন্য তৈরি। আমিই হয়তো তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে আপনাদের মাঝে চলে এসেছিলাম। তবে যাইহোক, এতকিছুর পরে যে আপনারা এক হতে চলেছেন এটাই অনেক। আপনাদের মাঝে আর আমি দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে চাই না। তাই আপনাদের দৃশ্যসীমার বাইরে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তবে কোন চিন্তা করবেন না, ৬ মাস পর আমি ঠিকই ফিরে আসব। ফিরে এসে আপনাকে এই মিথ্যা সম্পর্ক থেকে মুক্তি দেব। ততদিন পর্যন্ত নিজের খেয়াল রাখবেন এবং মান্যতা আপুরও। আবারো আপনাদের জন্য শুভকামনা জানিয়ে চিঠিটা এখানেই শেষ করছি।❞

চিঠিটা পড়ে জাবির ভীষণ অস্থির বোধ করছিল। আচমকা সে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছিল। জাবির দেয়ালে আঘাত করতে করতে নিজের হাতের রক্ত বের করে ফেলে। তবুও এযন্ত্রণা যেন তার হৃদয়ের অসীম যন্ত্রণার কাছে কিছুই না। জাবির বলে,
“আমি ভুল ছিলাম দৃঢ়তা। তাই তোমার মতো একটা ভালো মেয়েকে আমি এত কষ্ট দিয়েছি..হিরে ফেলে কাঁচের পেছনে ছুটেছি। তবে এবার আর না। এবার আমি নিজের সব ভুল শুধরে নেব। তোমাকে আবার আমি নিজের করে নেব।”

বলেই জাবির ঘর থেকে বের হয়। অতঃপর ড্রয়িংরুমে যেতেই ললিতা চৌধুরী তার পথ আটকে বলেন,
“এত রাতে তুমি কোথায় যাচ্ছ জাবির?”

“আমাকে আজ আটকিও না, আম্মু। আমি যা ভুল করেছি এবার তা সংশোধন করতে হবে।”

“মানে কি বলছ তুমি?”

“আমি দৃঢ়তাকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি।”

এমন সময় আমিনা চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন,
“ঐ মেয়ে আর এই বাড়িতে ফিরবে না। আমি সেটা বরদাস্ত করবো না।”

“দাদি! এত কিছু ঘটে যাবার পরেও তুমি এই কথা বলবে?”

“হ্যাঁ, বলব। আমি তোমার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করছি। চৌধুরী পরিবারের এত খারাপ দিন আসেনি যে দৃঢ়তার মতো মেয়েকে মাথায় তুলে ফিরিয়ে আনতে হবে। ও যেখানে গেছে যাক। এমনিতেই ওর বোন আমাদের কম অপমান করেনি।”

“তোমরা যাই বলো, আমি আর তোমাদের কোন কথা শুনব না। তোমাদের কথা শুনে আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি কিন্তু আর না। এবার সব শোধরানোর পালা।”

আনিকা চৌধুরী সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলেন,
“কিন্তু জাবির, কিছু ভুল এমন আছে যা সময়মত শোধরাতে না পারলে আর কখনো শোধরানো যায় না। দৃঢ়তার সাথে তুমি যতটা অন্যায় করেছ তারপর ওকে আর নিজের জীবনে ফিরে পাওয়ার আশাও করো না। আর কে কি করবে জানি না। কিন্তু আমি দৃঢ়তাকে তোমার জীবনে ফিরতে দেব না।”

“চাচি তুমি এই কথা বলছ? কিন্তু তুমিই তো চেয়েছিলে যে আমি দৃঢ়তার সাথে সংসার করি।”

“চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর চাই না। কারণ দৃঢ়তা একটা খাটি সোনা। আর খাটি সোনা সবার গায়ে মানায় না।”

বলেই তিনি আমিনা চৌধুরীর দিকে রাগী চোখে তাকান। জাবির বলে ওঠে,
“তোমরা যা খুশি বলো কিন্তু আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই করবো৷ দৃঢ়তাকে ফিরিয়ে আনবোই..”

বলেই জাবির বেরিয়ে যায়। ললিতা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“জাবির, শোনো আমার কথা এভাবে যেও না..”

কিন্তু জাবির দাঁড়ায় না। ললিতা চৌধুরী এবার সব রাগ আনিকা চৌধুরীর উপর উগড়ে দিয়ে বলেন,
“তুমি আমার ছেলেকে উস্কে দিয়েছ তাই না? আমার ছেলেটার সাথে তুমি সবসময় এমন শত্রুতা করো৷ নিজে তো মা হতে পারো নি, সেই রাগ আমার ছেলের উপর মেটাও।”

“ছোট,মুখ সামলে কথা বল। নাহলে..”

আমিনা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“কেন মুখ সামলাবে ও? ভুল কিছু বলেছে কি? যা সত্য তাই বলেছে।”

আনিকা চৌধুরী এবার দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বললেন,
“আসল সত্য কি আম্মা? সেটা কি আপনি আমায় বলবেন কখনো? জানেন কি,আমার কেন জানি আজো বিশ্বাস হয়না যে আমি একটা মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছিলাম। কারণ আমার সন্তান জন্মানোর পর আমি তার কান্নার আওয়াজ শুনেছিলাম। কিন্তু তারপর..হঠাৎ করেই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আর জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারি আমি মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছি। আচ্ছা, এমন নয় তো যে আপনারাই চক্তান্ত করে আমার সন্তানকে আমার থেকে আলাদা করে দিয়েছেন?”

কথাটা শোনামাত্রই ললিতা চৌধুরী ভয়ার্ত চোখে আমিনা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ঢোক গেলেন। তবে আমিনা চৌধুরী ইশারা করে তাকে স্থির থাকতে বলেন। তবুও ললিতা চৌধুরী তোতলাতে তোতলাতে বলেন,
“মানে..কি বলতে চাইছে আপনি আপা?”

আমিনা চৌধুরী স্পষ্ট বলে দেন,
“তোমার সন্তান মারা গেছে আর এটাই চরম সত্য৷ বাস্তবতা মেনে নাও।”

বলেই তিনি চলে যান।

★★
দৃঢ়তা সুযোগ বুঝে সিএনজি থেকে নেমে প্রাণপনে দৌড় দেয়। সিএনজি চালক তার পিছু ছুটছিল৷ এভাবে দৌড়ানোর দৃঢ়তা কোন কিছু খেয়াল করতে পারে না। হঠাৎ করে তার সামনে একটি গাড়ি চলে আসে এবং সে গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে৷ কিছু সময় পর একটা যুবক গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে৷ অতঃপর নিজের চশমা খুলে বলে,
“হোয়াট দা হেল..”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨