সুগন্ধি ফুল পর্ব-৫২

0
3

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৫২
#জান্নাত_সুলতানা

-“আবরাজ উঠুন। আবরাজ?”

আবরাজ ফিজার হাত টেনে বুকে আগলে ধরে আরও। ঘুমঘুম স্বরে বলে,

-“উম।”

-“কি উম? উঠুন। সাব্বির সাহেব কল করে যাচ্ছে সেই কখন থেকে।”

আবরাজ এবার চোখ মেলে চাইলো। খুব দ্রুত শোয়া থেকে ওঠে বসলো। ফিজার ডান হাতে রয়েছে ফোন। আবরাজ বললো,

-“রেডি হয়ে নাও সুগন্ধি ফুল। আমরা বেরিয়ে পড়বো এখন।”

আবরাজ গায়ে শার্ট জড়িয়ে ওয়াশ রুম চলে গেলো। ফিজা রুম থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে এলো। মোহিতা বেগম নাশতা বানাচ্ছে। ফিজা মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“আম্মু উনি রেডি হতে বলেছেন।”

-“আমার হাতের কাজ শেষ। তুই গিয়ে বোস। আমি নাশতা নিয়ে আসছি।”

ফিজা দেখলো কাজের মেয়ে টা নাশতা নিয়ে যাচ্ছে। সে রান্না ঘর ফাঁকা পেতে বললো,

-“আম্মু তুমি আমাদের সাথে চলো না।”

-“এ হয় না রে মা।”

মোহিতা বেগম মৃদু হেঁসে বললো। মোহিতা বেগম এর কথায় খুব ভালো করে বোঝা যাচ্ছে তিনি যাবে না। ফিজা তা-ও জোরাজুরি করলো। কিন্তু তবুও মোহিতা বেগম রাজি হলো না। অগত্যা নাশতা শেষ ফিজা আবরাজ রওনা দিলো খান বাড়ির উদ্দেশ্যে।

——

আবরাজ ফিজা খান বাড়িতে এসে পৌঁছাল সকাল তখন সাড়ে ন’টা। বাড়িতে তেমন কেউ থাকার কথা নয়। তবুও ফিজা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কোনো পুরুষের কণ্ঠে শুনে অনুমান করলো কেউ একজন আছে। তারা বাড়ির ভেতর এসে দেখলো লিভিং রুমে মিস্টার জি। সাথে ইলা বেগম, আব্রাহাম, মিষ্টি, মেহরিন। ওদের দেখে মিস্টার জি এগিয়ে এলো।

-“হেই ইয়াং ম্যান।”

আবরাজের মুখ গম্ভীর। মিস্টার জি হাত বাড়িয়ে রেখেছেন। আবরাজ নিজের হাত প্যান্টের পকেটে গোঁজে রেখেছে। মিস্টার জি নিজের দুই হাত এক সাথে কচলাতে কচলাতে হেঁসে হেঁসে বললো,

-“নেভার মাইন্ড। তোমার ওয়াইফ কোথায়? মেয়ে টার সাথে আমার এখনো ভালো করে কথা হয় নি। দেখি দেখি।”

বলতে বলতে ফিজার কাছে এগিয়ে এলো। ফিজা মুখের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। সে মৃদু হাসলো। মিস্টার জি বেশ মধুর কথা জানেন। ফিজা কে তিনি একটা রিং দিলো। মেহরিন কেও দিলো। ফিজার হাতে তিনি নিজেই রিং টা পরিয়ে দিলেন। ডায়মন্ডের রিং টা চকচক করছে ফিজার হাতে। ইলা বেগমের মুখে হাসি। মিস্টার জি মুখে হাসি ঝুলিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

-“তারপর কি ডিসিশন নিলে?”

-“নাথিং।”

-“ইভেন আফটার নোয়িং এভরিথিং?”

-“ইয়াহ।”

ফিজাও ফিসফিস করে মুখে হাসি ঝুলিয়ে জবাব দিলো। মিস্টার জি এর মুখের রং পরিবর্তন হয় মূহুর্তে। পরপরই ফিজা হেঁসে হেঁসে আবার বলে,

-“নাইস রিং। থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার মামা।”

মিস্টার জি এর চেহারা টা কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। চোখ দু’টো যেনো শয়তানি হাসে। আবরাজের জহুরির নজর। সে হঠাৎ করে মা’কে বলে উঠলো,

-“আম্মু আমরা রুমে যাই। ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

আবরাজ বলতে বলতে একটু পিছে এসে নিজে থেকে ফিজার হাত টেনে ধরলো। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার আগেই কল করে দিলো সাব্বির কে। করিডোরে গিয়ে কল রিসিভ হলো। আবরাজ বললো,

-“কাম হোম কুইকলি।”

ফোন টা কেটেই ফিজার দিকে তাকালো। কেমন নিস্তেজ দেখাচ্ছে মেয়ে টাকে। আবরাজ হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো রিং পড়ানো তর্জনী আঙুল টা নীলচে রং ধারণ করেছে। আবরাজ এর ধারণা কি তবে সঠিক হলো? আবরাজের দুনিয়ায় উতালপাতাল শুরু হলো। ফিজার হাত থেকে রিং টা রুমাল দিয়ে খুলে সেখানে পেঁচিয়ে রাখলো। কোলে তুলে দ্রুত রুমে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলো। একজন মেইড কে কল করে গরম পানি চাইলো। পানি নিয়ে আসার আগেই আবরাজ বেশ কয়েকবার সাবান দিয়ে হাত টা ধুয়ে নিলো। মেইড পানি দিয়ে যাওয়ার পর আবরাজ সেটা কুসুম গরম পানি করে বউয়ের হাত ভালো করে ধুয়ে দিলো। ফিজা তখনও বুঝতে পারছে না আবরাজ এমন কেনো করছে। সে শুধু এটুকু বুঝে গিয়েছিল শরীর টা কেমন দুর্বল লাগছে। যখন মেহরিন আব্রাহাম সহ রুমে এলো আবরাজ তখন বললো,

-“গাড়ি বের কর। ইমেডিয়েটলি। সাব্বির হসপিটাল কল করো। কথা বলো ডক্টরের সাথে।”

সাব্বির ব্যাস্ত হয়ে তাই করে। আব্রাহাম বেরিয়ে যায়। মেহরিন ততক্ষণে কেঁদে ফেলেছে। যদিও ফিজা এখন বিপদমুক্ত। তবুও তার কান্না পাচ্ছে। আবরাজ যখন ফিজা কে কোলে তুলে গাড়িতে বসালো। গ্যারেজে তখন অনেক মানুষের ছায়া দেখলো। চোয়াল শক্ত করে শুধু সেদিকে তাকিয়ে দেখলো একবার। ইলা বেগম মেহরিন ও তাদের সাথে যাচ্ছে।

—–

ফিজার কন্ডিশন এখন অনেক টা বেটার। হসপিটাল থেকে বাড়ি চলছে এসছে সন্ধ্যায়। ইলা বেগম ফিজার সাথে সাথে আছে। মেহরিন ও বোনের সাথে রয়েছে সেই সকাল থেকে। আবরাজ সুযোগ বুঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। যখন নিজের গন্তব্যে এসে পৌঁছাল তখন রাত হয়েছে। অন্ধকার চারদিকে। অন্ধকার ঘরে একটা বাল্বের নিচে চেয়ারে বাঁধা এক মানব মূর্তি। চারদিক থেকে গার্ড। ঘিরে আছে সেই মানুষ কে। একজন গার্ড একটা চেয়ার এনে দিতে আবরাজ সেটাতে বসলো। শান্ত চোখে চেয়ে আছে সামনের পুরুষ টার দিকে। শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে বললো,

-“আমার ক্যারিয়ার। আমার জীবন থেকে কয়েকটি বছর। আমার সংসার আমার সন্তান। এখন আমার ভালোবাসা। এই মেয়ে টার কী দোষ? বলতে পারবেন আপনি?”

মিস্টার জি মাথা টা উঁচু করে আবরাজের দিকে তাকালো। তিনি অসুস্থ। হসপিটাল থেকে পালিয়ে তিনি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজ এখানে এসে পৌঁছে ছিলো। কিন্তু শেষ মূহুর্তে এসে কোনো লাভ হলো না। তিনি কম্পিত কণ্ঠে বললেন,

-“তোমার জীবনে পদার্পণ। এটাই ওর জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল। আজ এখানে আমার মেয়ে থাকার কথা ছিলো।”

-“ইউ আর টোটালি রং। এটা কোনো দিন হওয়ার ছিলো না। আপনি খুব ভালো করে জানতেন।”

মিস্টার জি তৎক্ষনাৎ রেগে গেলেন। গর্জে ওঠে তিনি। মেয়ের মানসিক সমস্যার জন্য নিজেও মানসিক ভাবে অসুস্থ তিনি। একমাত্র মেয়ে আজ পৃথিবীতে নেই। ভাবলেই দুমড়েমুচড়ে যায় বুকের ভেতর। আবরাজ সাব্বির কে বললো,

-“উনার ডক্টরের সাথে যোগাযোগ করো। আর জার্মানিতে পাঠাও।”

আবরাজ চেয়ার ছেড়ে ওঠে যায়। পেছনে রয়ে যায় মেয়ের শোকে এক পাগলপ্রায় বাবা। চেঁচাতে থাকে। কিন্তু আবরাজ ফিরেও তাকায় না। পাপের শাস্তি সবাই পায়। সে-ও কি পেয়েছে? না-কি এখনো বাকি?

——

ফিজার তেমন সমস্যা হয় নি। তবে হতে পারতো। যদি না আবরাজ সময় মতো রিং টা খুলে ফেলতো। তারপর ও ফিজা আগেও পয়জন এর শিকার হয়েছে। তাই একটু তো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শরীর টা আরও দুর্বল হচ্ছে। অথচ মেয়ে টা জানেই না তার ভেতরে বেড়ে ওঠতে থাকা প্রাণ টাকে কিভাবে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জানলে নিশ্চয়ই আরও ভেঙে পড়তো। আবরাজ বউয়ের শরীর টা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ফিজা দুর্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে স্বামী কে। আজকের ঘটনা সে স্বচক্ষে দেখেছে। আবরাজের গালের ওপর একটা হাত রেখে বলে উঠলো ,

-“মিস্টার জি কোথায় আবরাজ? মেরে ফেলেছেন?”

আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরলো। বেশ চমকেছে পুরুষ টা। তবে আজকের ঘটনা ফিজা দেখেছে। মেয়ে টা অতোটা বোকা নয়। এখনো নিশ্চয়ই বোঝার বাকি নেই মিস্টার জি ওর সাথে কি করেছে। আবরাজের বড়োই মায়া হয়। তার সাথে জড়িয়েছে পর মেয়ে টা একটু সুখের দেখা পায় নি।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

-“সিচুয়েশন টা একটু ডিফারেন্ট হলেই পারতো। বাট মাই ব্যাড লাক, সুগন্ধি ফুল, তোমার কোশ্চেনের আনসার টা পজিটিভ হলো না।”

আবরাজের ঘুরি ফিরিয়ে উত্তর বুঝতে একটু সময় লাগলো বটে। তবে যখন বুঝতে সক্ষম হলো তখন স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। আবরাজ বউয়ের কপালে গভীর চুম্বন করলো। সে পর্দার আড়াল দেখাতে চায় না বউ কে। যতোটা সামনে এসছে ততটা তাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য মেয়ে টার কাছে যথেষ্ট ছিলো।

#চলবে….