আবছা_আলো ৩য় পর্ব
Nazmul Huda
মেনে নিলাম তুবা একটা দুশ্চরিত্রা।কিন্তু আমাকে তো কিছু বলতে পারতো আমার বাবা মা।মানুষে তো নানান কথা বলবে।কিন্তু কিছুই যাচাই-বাছাই না করে তুবাকে এভাবে তাড়িয়ে দিবে?আমি তুবার স্বামী কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নিলে আমিই নিবো।তুবাকে ছেড়ে দেওয়া বা আমার কাছে রাখা সম্পুর্ন আমার ব্যপার।
অথচ বাবা মা আমাকে এমন অপশন দিলেন যে আমি কোনোটাই বেছে নিতে পারবো না।পারবো না কাউকে ছেড়ে দিতে। সব কিছুর রহস্য আমার খুঁজে বের করতে হবেই।কিন্তু আমি যে একটা পঙ্গু।এই মুহুর্তে আমি কি করে সব কিছুর রহস্য বের করবো।না পারছি চলাফেরা করতে না পারছি কোথাও যেতে।
অন্যদিকে তুবা আমার সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।আমার তো কোনো অন্যায় ছিলো না।আমি তো তুবাকে কিছুই বলিনি।কখনো একটা শক্ত কথা আমি বলিনি।আমরা তো একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম।আমাদের ভালোবাসায় তো কোনো খাদ ছিলো না।তাহলে এমন করলো কেনো।
তুবা কোথায় আছে কি করছে আমি কিছুই জানি না।তুবা কি আমাকে মিস করে না?আমার কথা কি একটা বারের জন্যেও মনে উঠে না।আমি অসুস্থ কিভাবে আছি কেমন আছি সেই খবরটুকু রাখার প্রয়োজন নাই?
ইদানীং আমার পরিবারের সবাই আমাকে এড়িয়ে চলছে।কেউই আমার ধার ঘেষতেছে না।বাবা না হয় ব্যস্ত আছেন।কিন্তু আমার মা তো সব সময় বাসায়ই থাকেন।কিন্তু একটা লোক আমার কাছে আসে না।
সন্ধ্যা বেলা থেকে শরীরটা বেশ খারাপ লাগতেছে।না পারছি কিছু করতে না পারছি কাউকে কিছু বলতে।রাতের বেলা আমার মা একবার আমার রুমে এসে খাবার খেতে ডেকে গেলেন।খাবার খেয়ে ঔষধ খেতে যাবো হঠাৎ করেই মনে হলো ঔষধ তো গতকালই শেষ হয়ে গেছে।
এলবাম থেকে আমার আর তুবার ছবিগুলো দেখছি।কি সুন্দর হাসি মেখে আছে ওর মুখে।একটা ছবি দেখেই আমার চোখ আটকে গেলো।ছবিটা আমাদের প্রথম দিকের একটা ছবি।সেই দিনই আমাদের প্রথম মিট হয়েছিলো।
সারাটাদিন কি পরিমানে বৃষ্টি। রিক্সায় চড়ে কিছু দূর যাওয়ার পরেই ঝুম বৃষ্টি।দুজনেই ভিজে গেলাম পুরোপুরি। ঠান্ডা লেগে তুবার ঠোঁট কাপতেছে।আমি আড় চোখে দেখে ফিক করে হেসে দিলাম।আমার হাসি দেখে তুবা অনেকটা লজ্জা পেলো।ব্লেজারটা খুলে দিয়ে তুবাকে দিলাম।প্রথমে ইতস্ততভাবে না নিতে চেয়েও নিলো।খুব অনায়াসেই ব্লেজারটা তুবা গায়ে দিলো।রাস্তার লোকজনে হা করে আমাদের তাকিয়ে দেখছে।
তুবার চুল গুলো ভিজে ওকে অন্যরকম লাগছে।মেয়েদের ভেজা চুলে যে অসম্ভব সুন্দর লাগে তা আমি সেদিনই অনুভব করেছিলাম।চোখের সামনে থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে আমি ওর মুখটা ছুঁয়ে দিয়েছিলাম।ওহহো দিনটি ছিলো শুক্রবার।ছুটির একটা দিন।সন্ধ্যা পর্যন্ত দুজনে রিক্সায় চলেছিলাম।আমার কাধের উপরে তুবা মাথা গুজলো।সেই মুহুর্তে আমরা একটা সেল্ফি তুলে ছিলাম।ওর ভেজা চুল গুলো আমার মুখের উপরে দোল খেতে লাগলো।
যখন আমার কাছ থেকে তুবা ওর হোস্টেলে ফিরে যায় তখন তুবা আমার হাতটি ধরে বলেছিলো;”সারাটি জীবন এই হাতটা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই”।
আমি শুধু মাথা নেড়ে হ্যা বলেছিলাম।যাবার বেলায় তুবা আমার ব্লেজারটা সাথে করেই নিয়ে গেছিলো।যখন আমার কথা মিস করবে তখনই ব্লেজারটা গায়ে দিবে।আমি নাকি ব্লেজারের সাথে মিশে আছি ব্লেজারের পারফিউম টা নাকি তুবাকে আমার কাছে টেনে নিয়ে আসবে।তুবার কথা গুলো শুনে অনেক ভালো লাগলো।নির্দ্ধিধায় কথা গুলো কত সুন্দর করেই না বলে ছিলো।
অথচ তুবা এখন অনেক দূরে। দুইটা দিন তুবার সাথে কোনো কথাই হয় না।তুবার কথা ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে পানি টপটপ করে এলবামের উপরে পরতে লাগল।
ব্লেজারের কথা মনে পরতেই ওয়ারড্রব খুলে দেখলাম ব্লেজারটা নিচে পরে আছে।অথচ এই নীল রঙের ব্লেজারটা কত যত্ন করেই রেখে দিতো।
চারটা মাস ছাদে যাওয়া হয় না।আগে প্রত্যেক দিন আমি আর তুবা ছাদে যেতাম। আমার কাধে মাথা রেখে তুবা চাঁদ দেখতো।তুবা অনেক সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারতো।আমার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে গান গাইতো।দোলনাটা বড্ড একা হয়ে ছাদে পরে আছে।
অনেক ইচ্ছা করছিলো ছাদে যাই।কিন্তু আমার দু পায়ে যে ভর রাখতে পারছি না।শোয়া অবস্থায় উঠে বসলাম।বিছানা থেকে পা নামাতে গিয়েই ফ্লরে পরে গেলাম।হাতের কনুইয়ে বেশ আঘাত পেলাম।বেশ খানি কেটে গেছে।
চিৎকার দিয়ে শুধু মাকে একবার ডাক দিয়েছিলাম।সে ঘুম থেকে উঠে আমার রুমে এসে দেখে এই অবস্থা।হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে আমার পাশে বসে আছে।মনে হচ্ছে সে কিছু একটা আমাকে বলবে।কিন্তু বলতে গিয়েও বলছে না।রাত বেশ হয়েছে।আমি মাকে বললাম আমার মাথায় একটু পানি দিয়ে দিতে।আমার মাথায় হাত দিয়ে দেখলেন আমার জ্বর এসেছে।
মাথায় পানি দিতে দিতে বললেন..
-মিহির দেখছো তোমার বউ তোমায় কেমন ভালোবাসে?আমি না হয় বকেছিলাম কিন্তু তোমার কথা ভেবে চলে না যেতেও পারতো?
আমি চুপচাপ ভাবে শুনছি।কিন্তু কিছুই বলছি না।মা আবার বললো…
-তুমি সুস্থ হয়ে গেলে আমরা তোমাকে আবার বিয়ে দিবো।সব কিছুই ভুলে যাও তুমি।তুমি তো আমাদের সন্তান তোমার ভালো কিছুই তো আমরা চাবো তাই না?
-তুবার অপরাধ কি?
-তোমার বাবার কাছে বারবার রিপোর্ট আসে তুবার নামে।তুবা নাকি ওর কলিগের সাথে ঘোরাফেরা করে।এবং সেদিন তুবাকে তোমার বাবা জিজ্ঞেস করেছিলো।কিন্তু তুবা কোনো এন্সার দিতে পারে নি।
-এটাই কি তুবার অপরাধ?নাকি তুবা তোমাদের চাহিদা মিটাতে পারে নাই?তোমাদের ইচ্ছা ছিলো আমাকে বিয়ে দিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে অর্থ সম্পদ আনবা।অর্থ সম্পদ না তো যাকে বলে যৌতুক। সেই তুবার পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক নাই আমদের।সেই জন্য নাতো?
-সে জন্য থাকলেই বা কি?তুমি কোন পরিবেশের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছো?যার মায়ের নামে নানা বাজে কথা রটে আছে?
-এসব বাদ দাও তোমরা।আমার ভালো করেই জানা আছে তোমরা কি চাও?
আমার কথায় আর আগাতে না পেরে মা চুপ হয়ে গেলেন।মাথায় জল পট্টি দিয়ে আমার পাশে মা বসে আছেন।আমার চোখ বেয়ে পানি পরতেছে মায়ের চোখ থেকে তা লুকাতে পারলাম না।তিনি শুধু চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন।”সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে যেনো স্বাভাবিক থাকি”।
মা চলে গেলেন আমার রুম থেকে। কোনো ভাবেই ঘুমাতে পারলাম না।ইদানীং স্লিপিং পিল খেয়েই ঘুমানো লাগে।তাও ডাবল ডোস।পাশের বালিশটা ফেলে রাখা।আমার পাশে আর তুবা ঘুমায় না।বুকের উপরে মাথে রেখে আর বলে নো”চিন্তা করো না তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।আবার আগের মত চলতে পারবে”।
তুবা একদিন ফিক করে হেসে দিয়ে বললো।
-আমাদের একটা ছেলে হবে তুমি সেই ছেলের হাত ধরে হাটবে।শোনো আমার ছেলেকে কিন্তু অনেক আদর করবা।সেই সুযোগে যেনো আবার আমার প্রতি ভালোবাসা কমে না যায়;তাহলে কিন্তু একেবারে মেরে ফেলবো বলে দিলাম।
আমিও হাসির ছলে বলেছিলাম;
-একটা না পাঁচটা ছেলে থাকবে আমাদের।যেদিকে যাবো সেদিকেই আমার ছেলেরা থাকবে।হাহা
-তুমিও না!
এই সব কিছুই কি একে বারে ভুলে গেলো তুবা?জানি না তুবাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো কিনা।তবে আমিও ছেড়ে দিবো এই পরিবার।আমি একা হয়েই থাকবো।
প্রচন্ড ভাবে শরীর ব্যাথা করতেছে।পায়ের গিটে গিটে ব্যথা অনুভব করলাম।সেই চার মাস থেকেই আমার দুইটা পা অবশ হয়ে ধরে আছে।পায়ের মধ্যে কি চলতেছে কিছুই বুঝতে পারিনা আমি।
ভোর বেলার দিকে আমার ফোনে তুবার নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ আসলো;
-“আমি যেখানে আছি যেভাবে আছি অনেক ভালো আছি।আমাকে তোমার খুঁজতে হবে না।আমি তোমাকে দূর থেকেই দেখে যাবো।আমার জন্য নিজের ক্ষতি করবে না।সময় মত ঔষধ খেয়ে নিবে।আর হ্যা তোমার বাবা মায়ের কথা মত চলবে তাহলেই খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে তুমি।আবার আগের মত হাটতে পারবে।
আমাকে খুঁজে তোমার আর লাভ হবে না।যার কাছে আছি যেখানে আছি বেশ আছি।”
এই ছোট্ট ম্যাসেজ এসেছিলো আমার ফোনে।ম্যাসেজটা দেখার পরে আমি তুবাকে কল দিয়েছিলাম।কিন্তু ফোন আবার অফ করে রেখেছে।
তাহলে কি তুবার সাথে আতিফ স্যারের সাথে সম্পর্ক রয়েছে?সেই আতিফ স্যারের কাছেই কি তুবা আছে।অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে দেখলাম আতিফ স্যার নাকি চাকরি থেকে রিজেইন নিয়েছে।যদি তুবা মনে করে অন্যকে ভালোবেসে বা অন্যের কাছে গিয়ে ভালো থাকবে?তাহলে ভুল ভাবছে একদম ভুল।খুন করে দিবো তুবাকে আর সেই সাথে সেই লোকটাকে।
তার আগে জানতে হবে তুবা কোন বান্ধবীর মাধ্যমে স্কুলে জবটা নিয়েছিলো?কে সেই?তাকে খুঁজে বের করলেই সব কিছু আমি জানতে পারবো।
এতটা সহজে আমি কাউকেই ছেড়ে দিচ্ছি না!সব কিছুই আমার জানতে হবে…..
.
.
[চলবে……..]