আবছা_আলো(৬ষ্ঠ পর্ব)
. Nazmul Huda
এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলাম তুবার জন্য কিন্তু যাবার বেলায় আসেনি তুবা।
মূলত দেশের বাহিরে আমার চিকিৎসা করার জন্য আমার বাবা ভালো একটা সাপোর্ট পেয়েছিলেন। কারন আমার বাবার বন্ধু দেশের বাহিরে একটা ভালো মেডিকেলের ডাক্তার।তিনি সেখানে অনেক বছর যাবত আছেন। তো অনেক আগেই আমার বাবাকে তার বন্ধু বলেছিল যে আমাকে চিকিৎসার জন্য তার ওখানে নিয়ে যেতে। কিন্তু টাকা পয়সার দিক থেকে আমরা প্রথম পর্যায় আগাতে পারি নাই। যার কারণে সেই শুরুর দিকে নিয়ে যায় নি বাবা। আর আমিও দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য নারাজ ছিলাম।
বাবার বন্ধুর বাসায় যাবার দুইদিন পরে আমাকে সে মেডিকেলে নিয়ে যান। চিকিৎসার করে সমস্ত রিপোর্ট দেখার পরে জানিয়ে দিলেন যে সেখানে আমাদের একমাসের বেশি থাকতে হবে।
আমি যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন আমার কোমর এবং দুইটা পা সম্পূর্ণভাবে ব্যান্ডেজ করা ছিল দেশের বাইরে আসার পরে আমার ব্যান্ডেজ গুলো ডাক্তার খুলে ফেলতে বলে আর একেবারে সিম্পল ভাবে থাকতে বলে। ডক্টর বলেছেন আমাকে হুইল চেয়ার ব্যবহার করতে এবং তিনি যেভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন ঠিক সেভাবে আমাকে চিকিৎসা নিতে বলতেছেন। তো আমাকে তারা এক সপ্তাহের মত তাদের মেডিকেলে রেখেছিলেন তখন আমার প্রচুর পরিমাণে কষ্ট হয়েছে আমি হাটতে পারি না অথচ সেখানে আমাকে দুজনে ধরে মেডিকেলের মধ্যে হাটাতো। আমার মূলত কোমরে ব্যথা ছিল। আমি আমার কোমরে ভর করতে পারি নাই আর তাছাড়া পা নাড়াচাড়া করতে পারিনি।
আমরা আবার দেশে ফিরে আসলাম এখন দু এক পা খুব কষ্ট করে আমি হাটতে পারি প্রায় দুইটা মাসের মত আমি দেশের বাহিরে ছিলাম কিন্তু তুবার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি আমি তুবার সাথে কোন কথা বলতে পারিনি।
এই দুইটা মাস তুবাকে যে কতটা মিস করেছি সেটা আমি আসলে কাউকে বুঝাতে পারবো না। প্রত্যেকটা মুহূর্ত তুবাকে মিস করছি। অনায়াসে চোখ থেকে পানি বের হয়ে গেছে তুবাকে ভাবতে ভাবতে। ফোনের গ্যালারি থেকে আমাদের শত শত তোলা পিক দেখতে ছিলাম। অথচ তুবার কাছ থেকে আমি এখন অনেক দূরে। সে আমার সাথে থাকতে পারবে না আমাদের সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে দিতে হবে।
সমস্ত অভিমান ভেঙে যদি তুবা আমার কাছে একটা বার ফিরে আসত তাহলে আমার চাইতে হয়তো আর কেউ সুখি হতো না। ভীষণ একা হয়ে গেছি আমি। কোনভাবে সময় পার করতে পারতেছিনা।
বিদেশ থেকে ফিরে আসার ঠিক ছয় দিন পরে তুবা আমাদের বাসায় আসে। সাথে নিয়ে আসে আতিফ স্যারকে।আমি তুবা আর আতিফ স্যার ড্রইং রুমের সোফায় বসে আছি। মাথা নত করে আমাদের সামনে বসে আছে তুবা। আমাদের সমস্ত ভাবনা দূর করে হঠাৎ করে আমাদের মাঝে বলে উঠল..
– আমি আমার সমস্ত কিছু নিতে এসেছি। মিহির এখানে ডিভোর্স লেটার রয়েছে।তুমি সময় মত সই করে দিবে।আর হ্যা তুমি আমাকে যে গয়না গুলো দিয়েছো সেগুলা আমি বিক্রি করে দিয়েছি।
-মানে?কি সব বলতেছো?
-কি বলি বুঝোনা? আমিতো তোমাকে আগেই বলে দিয়েছি তোমার সাথে আমার সংসার করা কখনো সম্ভব না।
– ছেড়ে দিবে তাই তো? ঠিক আছে! আজ আমি অসুস্থ আমি ঠিকমত চলতে পারি না। সেজন্য আস্তে আস্তে সবাই আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। জানো যখন তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম, তখন আমি ভেবেছিলাম আমার যাই হোক না কেন তুমি আমার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিবে। কিন্তু আমার সমস্ত ভাবনা ভুল ছিল। কোন একটা সময় আসবে যে তুমি আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত মিস করবে আর আমি যখন থাকবো না তখন ঠিকই বুঝতে পারবে যে আমি তোমাকে কতটা ভালবাসতাম। একটা কথা কি বলবে?
– হ্যাঁ বল আমি শুনছি।
– জানিনা আমার ভুলটা কোথায়? কেন তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে? আর এখন আমি চাইলেও তোমাকে আটকাতে পারব না। কিন্তু যাবার আগে আমাকে বলে দাও আমি কি করেছি? আমার বাবা-মা না হয় তোমাকে অনেক কথা বলেছে তোমাকে বাসা থেকে বের করে দিছে। কিন্তু তুমি তো সারাজীবন আমার বুকে স্থান করে রয়েছো। দাও তোমার ডিভোর্স লেটার দাও। আমি সই করে দিচ্ছি। আর আমার বাসায় যা কিছু রয়েছে সবকিছু নিয়ে এখনই বের হয়ে যাবে আর কখনো আমার সামনে আসবে না। তুমি যদি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারো তাহলে আমি কেন পারবো না? আমারও পারতে হবে?
– এইযে আতিফকে দেখছ না? ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমিও হঠাৎ করে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। আগামী মাসেই আমি আতিফকে বিয়ে করবো। আর যদি কখনো তোমার বাবা-মা তোমাকে বিয়ে করিয়ে দেয় তাহলে তাদের পছন্দমতো বিয়ে করবে। আর দেশের বাহির থেকে যেহেতু চিকিৎসা করে এসেছো সেহেতু সুস্থ হয়ে যাবে। আমরা চলে যাচ্ছি আর কখনো তুমি আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করবে না।
কথাগুলো কত সুন্দর করে তুবা বলে গেলো, কোন প্রকার কষ্ট অনুভব হয়নি। আতিফ চুপচাপ করে বসে আছে। তুবা চলে যাওয়ার সময় একটা বার পিছনে তাকিয়ে দেখল না আমি কি করছি। একটাবার বুঝতে চাইল না আমার কি কষ্ট হয় না? এক হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছি আর এক হাত দিয়ে টেবিলের উপরে ভর করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। দেয়াল ঘেঁষে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম। ততক্ষণে তুবা তো অনেক দূরে চলে। আমার চোখের আড়াল হয়ে গেলো তুবা।
আজকে আমার বাবা মা বাসায় নাই যার কারণে তুবা আমাদের বাসায় এসে অনেক কথা বলে গেল। যদি আজকে বাবা-মা বাসায় থাকতো তাহলে হয়তো তুবার অনেক কথা শুনে নামতে হতো আমাদের বাসা থেকে। কিন্তু আজকে যে বাবা-মা বাসায় নেই এটা তুবা জানলো কিভাবে?
আসলে আমার বাবা-মা যেটাই বলছে তাদের ধারণাটা ঠিক ছিল। তুবার কখনো আমাকে ভালোবাসে নি। যদি আমাকে ভালবাসতো তাহলে হয়তো আমাকে ছেড়ে চলে যেত না আর আমি আজকে বুঝতে পারলাম যে আসলে বাবা মা কখনো তার সন্তানদের খারাপ চায়। না আমি ভুল বুঝেছিলাম। ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে তাদের ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।
যদি কখনো আমি সুস্থ হয়ে ভালোমতো ফিরতে পারি। তাহলে আমিও তুবাকে দেখিয়ে দেবো যে তুবাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারি। যখন ডিভোর্স পেপারে সই করি তখন খুব আনন্দের সহিত মিট মিটিয়ে হাসতেছিল।ওদের সামনে থেকে আমার চোখের পানি আড়াল করতে পারিনি।
রাতেরবেলা আমার বাবা-মা বাসায় ফেরার পরে আমি সমস্ত কিছু বলি।যে তুবা আমার বাসায় এসেছিল। আমার মাথায় হাত দিয়ে মা বলল…
– চিন্তা করিস না বাবা যা হয় ভালোর জন্য হয়। হয়তো তোকে আমরা বুঝিয়েছি কিন্তু তুই বুঝতে চাসনি। কিন্তু আজ তুই নিজে থেকে সবকিছু বুঝলি। এবং তুবার কথা শুনলি,এখন বল আমাদের অপরাধ ছিলো নাকি তুবার।
কষ্টগুলো সামলাতে না পেরে বাবা মায়ের সামনেই আমি কেঁদে দিলাম। আমি কি করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। শুধু বাবাকে বলেছিলাম..
-আমি সুস্থ হতে পারব তো?
– মিহির তুই চিন্তা করিস না।সব সময় তোর জন্য আল্লাহের কাছে দোয়া করি এবং যতটা সম্ভব তোর জন্য আমরা চেষ্টা করবো তোকে সুস্থ করার।
সবার সামনে থেকে নিজের রুমে চলে গেলাম। অ্যালবামে তুবার কয়েকটা ছবি ছিলো সমস্ত ছবিগুলো পুড়িয়ে দিয়েছি। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ছেলেদের নাকি কান্না করতে নেই। আজ থেকে আমি আর কাঁদবো না। রাতের বেলা খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে আছি। আর ভাবছি হঠাৎ করে তুবা এমন পরিবর্তন হলো কিভাবে?আর যাই হোক এটা মেনে নেয়া যায় না।
কিন্তু আতিফ আমাকে ফোন দিয়ে যেটা বলল আমি তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।তুবা নাকি….
[চলবে…..]