আবছা আলো পর্ব-০৭

0
1

আবছা_আলো(৭ম পর্ব)
. Nazmul Huda

আতিফ স্যারের কল দেখে চমকে উঠলাম। তিনি এই সময়ে আমাকে কল দিবেন কেন? হয়ত তুবার ব্যাপারে কিছু বলবে৷ তাই কল পিক করলাম। কিন্তু কল রিসিভ করার পরে সমস্ত শরীর জমে গেল।
– মিস্টার মিহির, তুবা খুব অসুস্থ্য। ও আপনাকে দেখতে চাচ্ছে। হয়ত আর কোনদিন……

এটুকু বলেই কল কেটে দিলেন। কিছু সময়ের জন্য আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল। সবকিছু কেমন ব্ল্যাঙ্ক লাগছে৷ আশ্চর্য, কি বলছে লোকটা! কোনমতে নিজেকে সামলে আবার কল দিলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ। মাত্রই তো কথা বললো৷ তাও অসম্পূর্ণ। এইটুকু সময়ের মধ্যে ফোন অফ করে দিল। আমার সাথে কোন মজা করছে না তো? নাকি এটা তুবার কোন চাল?

কিচ্ছু বুঝতে পারছি না৷ বারান্দায় গিয়ে আবারো কল করলাম। হাত পা কাঁপছে এখনো। সত্যি বলতে ব্যাপার কতটুকু সত্যি আমি জানিনা। কিন্তু আমি এমন একটা খবর কোনভাবেই নিতে পারিনি। খানিক বাদে মনে হলো আমি তো বিছানায় ছিলাম। তাহলে বারান্দায় এলাম কি করে?

নিজের অজান্তেই হেটে চলে আসিনি তো? আমি তো ঠিকভাবে হাটতেই পারিনা। সন্দেহ দূর করতে একটু হাটার চেস্টা করলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না!
আমি হাটতে পারছি তাও কোনরকম সমস্যা ছাড়াই। একদম সেই আগের মত। খুশিতে চোখের কোণে জল জমা হলো। এখন যদি তুবা থাকত তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি সে-ই হত।

কিন্তু তুবা কোথায়? আসলেই কি ও কোন বিপদে পড়েছে? নাকি মিত্থ্যে বলছে? যদি সত্যি বিপদে পড়ে থাকে তো আমার ওকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু ওকে এখন কোথায় পাব? জানিনা কোথায় পাব কিন্তু আমার ওকে খুঁজতেই হবে।

বাসায় কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তুবাকে খুঁজতে৷ এখন রাত ১১ টা। বাবা মা ডিনার শেষে নিজেদের ঘরে চলে গেছেন। এই সুযোগে গাড়ি নিয়ে বের হলাম। প্রথমে চলে গেলাম তুবার বাবার বাসায়। কিন্তু সেখানে কেউই নেই। আশ্চর্য, এত রাতে সবাই কোথায় চলে গেল?

রাতে গাড়ি নিয়ে শহরের অনেক জায়গায় খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। ভোর চারটার দিকে বাসায় এসে শুয়ে পড়লাম। ভাবছি কোথায় কোথায় যেতে পারে। সকালে সবার আগে তুবার স্কুলে যেতে হবে। সেখানে গেলেই আতিফ স্যারের ঠিকানা পাব। হুম এখান থেকেই আমাকে শুরু করতে হবে।

সে রাতে আর ঘুমালাম না। সকাল হতেই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। অনেক সময় ধরে লম্বা এক শাওয়ার নিলাম। তারপর ছাদে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে নিচে এলাম। মা ততক্ষণে টেবিলে নাশতা দিয়েছেন। আমাকে হেটে হেটে আসতে দেখে অনেকটা অবাক হয়ে দৌড়ে আসলেন।

– মিহির, বাবা তুই ঠিকভাবে হাটতে পারছিস?

– হ্যাঁ মা। আমি সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে গেছি।

মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। বাবাও খুব খুশি হয়েছে। কিন্তু আমি খুশি হতে পারছিনা। তুবার শূন্যতা অনুভব করছি সব জায়গায়। সব জায়গায় তুবার ডাক শুনতে পাচ্ছি৷ আমার সবখানে তুবা আছে অথচ যেন কোথাও নেই। মা বাবার সাথে নাস্তা করে বেড়িয়ে পড়লাম। মা জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় যাচ্ছি কিন্তু কিছুই বলিনি।

তুবার স্কুলে গিয়ে স্যারদের অফিস রুমে চলে গেলাম। হেড টিচার এখনো আসেনি। তাই এক সহকারী শিক্ষক কে তুবার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম।

– এক্সকিউজ মি,

– জ্বী বলুন।

– আচ্ছা এখানে তুবা নামে কেউ জব করত?

– আমি তো এখানে এসেছি মাত্র ৬ মাস হয়েছে। সো আগের কথা জানিনা।

– না না রিসেন্টলি। গত তিনমাস আগে তুবা নামে কেউ জব করত না?

– জ্বী নাহ। গত ৬ মাসে আমি ছাড়া এখানে নতুন কেউই আসেনি।

– আপনি কি নিশ্চিত?

– জ্বী হ্যাঁ।

এবার অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলাম। তুবা এখানে জব করত না তাহলে কোথায় জব করত? ও কি আমাকে মিত্থ্যে বলেছে? বুঝলাম ও আমাকে মিথ্যে বলছে। কিন্তু ওর হেড স্যার? তিনি কেন মিথ্যে বলবেন? সব গুলিয়ে যাচ্ছি। এসব কি হচ্ছে?
– আচ্ছা আমাকে আরেক টা কথা বলুন, এখানে আতিফ স্যার নামে কেউ ছিলেন?

– জ্বী হ্যাঁ । উনি দুই মাস আগে জব ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন।

– কোথায় গেছেন বলতে পারবেন? ওনার বাসার ঠিকানা দিতে পারবেন? আমার একটু দরকার ছিল।

– দুঃখিত। ওনার বাসার ঠিকানা আমি জানিনা। আর তাছাড়া উনি এখন কোথায় আছেন সেটাও জানিনা।

এবারেও হতাশ হলাম। তুবার কাছে পৌছানোর একটাই রাস্তা ছিল। আতিফ স্যার। কিন্তু উনি কোথায় আছেন সেটাই যদি না জানি তো তুবার ব্যাপারে কিভাবে জানব? এখন শেষ ভরসা হলো হেড টিচার। উনি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। হয়ত উনি কিছুই জানে। হয়ত না, আমি নিশ্চিত যে এই গোলকধাঁধা সম্পর্কে উনি জানেন। বুঝতে পারছি না সবাই মিলে আমার সাথে কেমন খেলা খেলছে?

একের পর এক শক খাচ্ছি৷ তুবা এ কদিনে আমার সাথে একের পর এক মিত্থ্যে বলে গেছে। আর বাকিরাও ওর সঙ্গ দিয়েছে৷ তবে কি মা বাবা সত্যি বলছেন? আমি ভুল না তো?

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হেড টিচার আসলেন।
– আসসালামু আলাইকুম স্যার।

– ওয়ালাইকুম আসসালাম। মিহির সাহেব যে? কি খবর আপনার?

– এই তো আলহামদুলিল্লাহ। স্যার আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।

– জ্বী বলুন।

– তুবা কি এই স্কুলে জব করত? আর ও এখন কোথায়?

– দেখুন আমি আপনাকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।

– কেন পারবেন না? আপনি বলেছিলেন তুবা আপনার স্কুলে জব করে অথচ তুবা এখানে জব করত না। আপনি কেন আমাকে মিথ্যে বলেছেন? কেন আমার পরিবারের সবার কাছে মিথ্যে বলেছেন?

– দেখুন আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আমি সত্যিই আপনাকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।

– দেখুন সবকিছু আমার কাছে ঘোলাটে লাগছে। এতগুলো প্রশ্ন অথচ একটার ও উত্তর নেই। প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন। আমি আপনার পায়ে পড়ছি।

– আরে আরে কি করছেন এটা? উঠুন?

– আপনি দয়া করে আমাকে সবটা খুলে বলুন। আসল রহস্য টা বলুন আমায়।

– বেশ। বলুন কি জানতে চান?

– তুবা এখন কোথায় আছে?

– জানিনা। আমার সাথে গত সপ্তাহে শেষ কথা হয়েছিল। তখন ওর মায়ের কাছে ছিল। এখন কোথায় আছে ঠিক বলতে পারব না।

– মানে? তুবার মা তো তুবাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এমনকি তুবাও জানেনা ওর মা কোথায়। তাহলে ওর মায়ের কাছে কিভাবে?

– আপনারা ভুল জানেন। তুবার মা কখনোই তুবাদের ছেড়ে যায়নি। বরং তুবার বাবা ই তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এবং অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করেছিল। তিনি অনেকবার তুবার সাথে যোগাযোগ করার চেস্টা করেছেন। কিন্তু তুবার বাবা করতে দেন নি। আপনাদের বিয়ের পরেই তুবার মা তুবার সাথে যোগাযোগ করেন এবং সবকিছু খুলে বলেন।

– কিন্তু তুবা এসব কিছু আমাকে জানায় নি কেন?

– সেটা তো তুবাই বলতে পারবে।

– আচ্ছা তুবার সাথে কি আতিফ স্যারের কোন সম্পর্ক আছে? ও স্কুলে আসার নাম করে কি আতিফ স্যারের সাথে সময় কাটাতো?

এইবারে একটু মুচকি হাসলেন ভদ্রলোক।

– নাহ৷ তুবা আতিফ কে ভাইয়ের মত জানে। আতিফ এর স্ত্রী শীমু কে তুবার মা ছোটবেলা থেকে দেখাশোনা করত৷ শীমু হলো তুবার মায়ের বোনের মেয়ে। ছোটবেলায় তার মা মারা যাওয়াতে তুবার মায়ের কাছে বড় হয়। সেই থেকে আতিফ স্যারের সাথে পরিচয়।

– তাহলে তুবা কি করত সেই সময়ে?

– ওর মায়ের সাথে দেখা করতে যেত।

– তাহলে আপনি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছিলেন?

– তুবার অনুরোধে। সে খুব করে অনুরোধ করেছিল। আর আপনাকে এসব যেন কখনো না বলি তার জন্যও অনুরোধ করেছিল। কিন্তু আপনি যেভাবে বললেন আমি সত্যিটা বলতে বাধ্য হয়েছি।

– ওহ আচ্ছা। আপনি কি আর কিছু জানেন তুবার ব্যাপারে? যাতে আমি ওকে খুঁজে পেতে পারি?

– সর‍্যি৷ এর থেকে বেশি কিছু আমি জানিনা।

– আতিফ স্যার কোথায় আছে বলতে পারবেন? ওনার ঠিকানা আছে আপনার কাছে?

– হ্যাঁ আছে। একটু অপেক্ষা করুন।

– অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার! আমার অনেক বড় উপকার করলেন।

– ইট’স ওকে। আবার আসবেন।

হাসিমুখে বিদায় দিলেন। স্কুল থেকে বেড়িয়ে আতিফ স্যারের বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। এখনো সবকিছু পরিষ্কার হয় নি আমার কাছে। যদি তুবা জব না করত তবে ও আমার খরচ বহন করত কি করে? আর যদি আতিফ স্যারের সাথে সম্পর্ক না-ই থাকে তাহলে কেন বললো যে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে তাকে বিয়ে করতে চায়?

আমাকে কেন ডিভোর্স দিলো? আমার সাথে সংসার করতে চায় না তাহলে আমার জন্য এতকিছু কেন করলো? উফফ ভাবতে পারছি না আমি। তুবা কি আমার বাবা মায়ের জন্য আমাকে ছেড়ে গেল? নাকি আতিফ স্যারকে ভালোবাসে বলে? নাকি অন্য কোন কারণ আছে?…..

[চলবে…]