আবছা_আলো(৮ম পর্ব/শেষ পর্ব)
. Nazmul Huda
আতিফ স্যারের বাসায় পৌঁছে গেলাম। কিন্তু বাসায় কেউ নেই৷ ঘর তালা দেওয়া। উফফস এসব কি হচ্ছে? কেন পাচ্ছিনা তুবাকে? কেন?
গাড়িতে এসে বসলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে। আমি এখনও বাসায় যাইনি। মা বাবা হয়ত চিন্তা করছে৷ করুক, তুবার চলে যাওয়ার পেছনে তারাও দায়ী। তারা নিজেদের সন্তানের ভালো টা বুঝতে পারলো না। কেমন মা বাবা? মা বাবা তো সবসময় সন্তানের ভালো টাই চায়। তবে আমার বেলায় কেন উল্টো হলো? কেন আমার মা বাবা আমার ভালো থাকার কারণ টা দূরে সরিয়ে দিলো?
গাড়ি স্টার্ট করে পকেট থেকে ফোন টা বের করলাম। এটা আবার অফ। অফ হওয়ার আর সময় পায়না। বিরক্তি নিয়ে ফোন অন করে গাড়ি চালানোতে মনযোগ দিলাম। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি তুবার বাবা। এক মূহুর্ত দেরী না করে পিক করলাম।
– হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। বাবা মিহির, তুমি কি একটু আসতে পারবে? তুবা খুব অসুস্থ্য। বারবার তোমার নাম নিচ্ছে। হয়ত তোমাকে দেখতে চায়।
– আপনি ঠিকানা বলুন আমি এখনি আসছি।
গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছি। এতে আমার বিপদ হতে পারে সেদিকে একটুও খেয়াল নেই। আমার সমস্ত ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু এখন তুবা। তুবা এতটা অসুস্থ্য অথচ আমাকে কেউ কিছু জানালো না। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।
হস্পিটাল পৌঁছাতে দেড় ঘন্টা লেগে গেল। তুবার কেবিনের সামনে ওর বাবা, আতিফ স্যার, আর দুজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আমি দৌড়ে গেলাম তুবার বাবার কাছে।
– তুবা কোথায়? কি হয়ছে আমার তুবার? ও এখানে কেন?
তুবার বাবা নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে প্রচন্ড কষ্ট চেপে রেখেছেন। আমি আরেকবার জিজ্ঞেস করলাম তুবার কি হয়েছে। এবার তিনি আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। চোখদুটো লাল, পানি ছলছল করছে। কোন কিছু হারানোর তীব্র কষ্ট আর হতাশা দুচোখের দৃষ্টিতে।
– তু, তুবার ব্লাড ক্যান্সার। লাস্ট স্টেইজে আছে। বাঁচার সম্ভাবনা একদমই নেই। খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।
তুবার বাবার এমন কথা শুনে ছিটকে পিছনে সরে গেলাম।হাত পা জমে বরফ হয়ে গেছে। নড়ার শক্তি টুকুও পাচ্ছিনা। নার্ভ সিস্টেম কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে৷ বুঝতে পারলাম আমি নিচে পড়ে যাচ্ছি কিন্তু কেউ একজন আমাকে ধরে ফেলল।
তুবার বাবা আমাকে ধরে বসালো। আমি ঝিম মেরে বসে রইলাম। কারো মুখে কোন কথা নেই৷ তুবার বাবার চোখ মুছছে বারবার। পাশে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা কেঁদেই চলছেন। তার পাশে বসে শান্ত্বনা দিচ্ছেন আরেকটা মেয়ে। আতিফ স্যারের চোখে মুখে একরাশ ব্যর্থতার চিহ্ন। সবার অলক্ষে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া দুফোটা জল মুছে ফেললেন। কিন্তু আমি কাঁদতে পারছিনা। আমার বুকের ভেতরটা জমে গেছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি। কিন্তু পারছি না।
কিছুক্ষণ পরে মা বাবা আসলেন। মা এসে আমার পাশে বসলেন। বাবা গেলেন ডক্টর এর সাথে কথা বলতে। আমি মায়ের দিকে মুখ তুলে তাকালাম।
– এমন কেন হলো মা?
মা দুচোখের পানি ছেড়ে দিলেন।
– আমরা আরো আগে থেকেই সব জানি। কিন্তু তুবার অনুরোধ ছিল যেন তোকে কিছুই না বলি।
উত্তরে শুধু মায়ের দিকে তাকালাম। কিছু বলার ভাষা নেই আমার। সবাই সব জানততো অথচ আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আরো আগে জানলে হয়তো চিকিৎসা করাতে পারতাম। মা আবার বলা শুরু করলেন।
– তুবা ৪ মাস আগে জানতে পেরেছিল যে তার ব্লাড ক্যান্সার। এবং লাস্ট স্টেইজে আছে। চিকিৎসা করেও কোন লাভ হবে না। বেশি হলে ৩-৪ মাস বাঁচতে পারে। ও প্রথম যখন কথাটা আমাকে জানায় আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। একদিকে তুই অসুস্থ আর এইদিকে তুবা। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু তুবা যথেষ্ট শক্ত ছিল। ও শেষবারের মত আমার কাছে কঠিন এক আবদার করে বসে। আমি ফেলতে পারিনি ওর কথা। এজন্য তোকে শুনিয়ে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম। যেটা তুবা আমার কাছে মেয়ে হিসেবে চেয়েছিল। ও বলেছিল আমি যেন ওর শেষ ইচ্ছেটা অপূর্ণ না রাখি! আমি কি করতাম বল?
মা আবার ও কান্না শুরু করলো। একটু থেমে আবারো বলতে শুরু করলেন,
– তুবা কোন স্কুলে জব করত না সেটা আমি জানতাম। তুই যে টাকাগুলো বেহিসেবী ভাবে উড়াতি ও সেগুলো থেকে কিছু টাকা রেখে দিত সবসময়। আর এটা শুধু আমি জানতাম। তুবাই বলেছিল। আর তুবার মায়ের ব্যাপারেও সব বলেছে আমাকে। ওই যে তুবার মা।
– ছিঃ মা। একটা অসুস্থ মেয়ে দিনের পরে দিন একা একা এতটা লড়াই করে গেছে আর তুমি সব জেনেও কিছু করতে পারো নি? উল্টে আমাকে বলেছো তুবাকে ডিভোর্স দিতে? মা কি এমন হয়? তুমি তো ওর মায়েরই মত।
– আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু তুবা কখনো চায়নি তুই ওর জন্য কষ্ট পেয়ে নিজেকে শেষ করে দিস।
– ও না থাকলে শেষ তো আমি এমনিতেই হব। কেন বলো নি আমাকে আরো আগে? কেন?
– কারণ তুই যদি আরো আগে জানতি তাহলে তুই তুবাকে রেখে কখনোই বিদেশ যেতে চাইতি না। আর সুস্থ্যও হতে পারতি না। তুবা জানত যে সে এমনিতেই বাঁঁচবে না। তুবা শুধুমাত্র তোর জন্যই সব করেছে। যাতে তুই সুস্থ্য হয়ে যাস আর ওকে ঘৃনা করতে পারিস। এতে তোর জন্য নতুন জীবন শুরু করা আরো সহজ হবে।
– সবাই আমার সাথে মিথ্যে বলেছে, সবাই। তোমরা সবাই আমার তুবার সাথে অন্যায় করেছো। আমি তোমাদের কাউকে ছাড়ব না।
এবার আতিফ স্যার এগিয়ে আসলেন।
– শান্ত হোন মিহির সাহেব। কেউ আপনাকে ঠকায় নি। বরং আপনার ভালোর জন্যই তুবা এতবড় একটা ত্যাগ করল। একটা মেয়ে তার সমস্ত খারাপ মুহূর্তে, তার অসুস্থতায় এমনকি তার জীবনের শেষ সময়েও তার স্বামী কে পাশে চায়। অথচ মেয়েটার ভাগ্য দেখুন আপনাকে ভালো রাখতে গিয়ে ও আপনার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হলো। ডিভোর্স দিয়ে দিল যাতে ওকে ঘৃণা করে নতুন করে শুরু করতে পারেন।
– কে বলেছে ওকে এত মহৎ হতে? কে বলেছে আমার ভালোর জন্য আমাকে একা করে দিতে?
– আপনি প্লিজ শান্ত হোন। তুবা আপনাকে জানাতে মানা করা সত্বেও আমি কাল আপনাকে কল করেছিলাম। কিন্তু কথা শেষ করার আগেই ছিনতাইকারী আমার ফোন টা নিয়ে যায়।
এরই মধ্যে তুবার বাবা জোরে কান্না করে দিলেন।
– এসব আমার ভুল। আমার পাপের শাস্তি আমার মেয়েটা পাচ্ছে। আমি আমার স্ত্রী কে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছি আর তাই আজ আমার নিজের মেয়েকে হারাতে হচ্ছে।
তিনি দৌড়ে গেলেন তুবার মায়ের কাছে। তার পা ধরে বসে পড়লেন। ক্ষমা চাইলেন। আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমার তুবাকে চাই।
হঠাৎ নার্স এসে বললো যে তুবার জ্ঞান ফিরেছে। যে কোন একজন তার সাথে দেখা করতে পারে। আমি দৌঁড়ে গেলাম। চুবা অল্প করে চোখ খুলে তাকালো। আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল৷ চোখের জল আড়াল করতে চাইছে। আস্তে করে বললো,
– কেন এসেছো এখানে? তোমার সাথে তো আমার কোন সম…
– কিসের এত রাগ তোর আমার ওপরে হ্যা? কিসের জন্য আমার থেকে দূরে যেতে হলো?
– আমি তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাইনা। চলে যাও প্লিজ।
খুব কষ্টে বললো কথাগুলো। আমি তুবার পাশে বসে তুবার মুখটা আমার দিকে ঘুরালাম।
– এত ঘৃণা করো আমায়? তাহলে এই জলগুলো কিসের? আমি তোমার চোখে উপচে পড়া ভালোবাসা দেখেছি, আমাকে হারানোর ভয় দেখেছি। মুখে মুখে কেন দূরে সরিয়ে দিচ্ছো? কেন বৃথা চেস্টা করছো আমার থেকে লুকানোর?
তুবা এইবার হাউমাউ করে কেঁদে দিলো৷ একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো৷ আমি খুব শক্ত করে ওর হাত টা ধরলাম।
– তুমি তো চেয়েছিলে আমি সুস্থ্য হয়ে যাই। এই দেখো আমি একেবারে সুস্থ্য হয়ে গেছি। আমি পুরোপুরি হাটতে পারি পাখি৷ একদম আগের মত৷ প্লিজ তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে যাও। আমরা আবার পাশাপাশি হাটব। প্লিজ তুমি ঠিক হয়ে যাও।
– আমাকে একটু বুকে নিবে?
আমি এক মুহূর্ত দেরী না করে তুবাকে বুকে টেনে নিলাম। দুজনের চোখের পানিতে একাকার হয়ে যাচ্ছি। তুবা কাঁদছে, আমিও কাঁদছি। তুবা শক্ত করে ধরে আছে আমাকে। আমিও কিসের এক আতঙ্কে তুবাকে ছাড়ছি না। মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই তুবা হারিয়ে যাবে।
– আমাদের পথটা শেষ হওয়ার আগেই থেমে গেল কেন মিহির? অনেকটাই তো বাকি ছিল। এমন কেন হলো?
– চুপ করো তুমি। কিচ্ছু হবে না তোমার। আমি, আমি কিছু হতে দিব না তোমার। কিচ্ছু হবেনা।
– খুব ভালোবাসি তোমায় মিহির খুব ভালোবাসি।
– আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি।
তুবাকে কতক্ষণ জড়িয়ে রেখেছি মনে নেই। হঠাৎ মনে হলো তুবা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। কাঁদছেও নাহ। বেশ শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। আমি বিরক্ত করলাম না৷ একটু পরে একজন নার্স আসলো। এসে দেখলো হার্টবিট ড্রপ করে গেছে। নিশ্বাস চলছে না। পার্লস ও চেক করলো। তারপরে ডক্টর সহ সবাইকে ডেকে আনলো।
সবাই এসে কান্না শুরু করে দিলো। তুবার মা সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। আশ্চর্য আমার তুবা আমার বুকে ঘুমুচ্ছে তাতে এদের এত কি সমস্যা? তুবা এখনো আমার হাতটা ধরে আছে। আর এরা বলছে তুবা আর নেই। পাগল হয়ে গেছে সবাই।
আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। সবাই বলে তুবা চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার চলার শক্তি আর কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে। কিন্তু এরা জানেই না আমি তুবার সাথে রোজ কথা বলি। একসাথে হাত ধরে হাটি সারারাত। কেউ জানে না শুধু আমি আর তুবা জানি!তুবা আমার মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে।কত সুন্দর করে খিলখিল করে হাসছে।চোখের দিকে তাকালে ওর কাছে টেনে নিয়ে যায়।এই তো আছে তুবা আমার সাথে।
হাহা,সবাই আমাকে পাগল ভাবছে।ভাবলে ভাবুক,তুবা আমার পাশে আবছা আলো হয়ে মিশে আছে।
সমাপ্ত