রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব ৪
গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব মজিদ ব্যাপারীর ঘরটা দূর থেকেই দৃষ্টি আকর্ষন করে। বলে না টাকা দিয়ে রুচি কেনা যায় না!সব কিছুতে রুচির বড় অভাব। দো-তলা বিল্ডিং টা নানা রঙে সজ্জিত যেন। এটাই শেষ না চারিদিকে ইটের গাথুনি দেওয়া, দো-চালা টিনের দুইটা ঘর ও আছে। উঁচু পাঁচিল তুলে আলাদা রাজত্ব বানিয়ে রেখেছে পুরো বসত বাড়ি সে। পাঁচিলের ভেতর কি নেই? পুকুর, গাছ, হাস-মুরগি গরু…. সব, এলাহি অবস্থা।
নীচতলার বৈঠক ঘরের ভেতরে ঢুকলেই প্রথম চোখে পড়ে শোভার জন্য রাখা দামি সোফা, যার গায়ে প্লাস্টিকের কাভার এখনো তোলা হয়নি, লোকটা যেন দাম দেখাতে চায়। দেয়ালে ঝুলে আছে সস্তা সোনালি ফ্রেমে নিজের একচেটিয়া ছবি, হাত তুলে সালাম দিচ্ছেন, এরকম ছবি বহু জায়গায়, যেন এই গ্রাম তার একক জমিদারি।
বৈঠক ঘরের এক কোণে কাঠের সিন্দুক, যেটা সে কখনো কাউকে ছুঁতেও দেয় না। কথিত আছে, সেখানেই তার সুদের খাতাগুলো লুকানো। লোকটা চরিত্রহীন, মাতাল ভীষণ লোভী তবে অসম্ভব চতুর বটে, হবেই নইলে কিভাবে মনসদ টিকিয়ে রাখবে?
চেয়ারম্যান বাড়ি শুধু একটা বসতবাড়ি নয়, এটা তার ক্ষমতার প্রতীক,যেখানে মাটির গন্ধ কম, আর হিসেব-নিকেশের গন্ধ অনেক বেশি। আর বিভিন্ন কান্নার আর মানুষের জুলুমের হাহাকার বাতাসে আর অট্টহাসি যেন তার কুটিল বুদ্ধির।
উঠানে বড় আম গাছটার নীচে রাজকীয় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছে মজিদ ব্যাপারী।পান চিবোচ্ছে, আর ধোঁয়া ছুঁড়ছে মাটির হুক্কা থেকে। হুক্কার গুঁড়ির পাশে বসে আছে তার বুড়ো চাকর, যদু। যত্ন করে পিকদানি ধরে আছে। একে চেয়ারম্যান হুজুর গালমন্দ করে আবার ভালো ও বাসে।
“হুক্কা ভালো টানতাছি না রে যদু ! কয়দিন হইল তামাক ঠিকমতো বানাইতে পারোস না,” কষে এক ধমক দেয় মজিদ। শুদ্ধ বলার আপ্রান চেষ্টা, তবে টান লুকাতে পারেন না।
যদু মাথা নিচু করে বলে, “মাফ কইরেন গো হুজুর, আগতবার খাঁস তামাক লইয়া আমু হাটত থেইকা।”
মজিদ ব্যাপারি মুখে কিছু না বললেও চোখের কোণ কুঁচকে যায়, যেন ভেতরের আগুনটা বাইরে বের হবার পথ খুঁজছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে মেঘ জমেছে, বাতাস বইছে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। কিন্তু তার ভিতরের রাগের আগুনে যেন এই বাতাসও ঘি ঢালছে। কাল যেই তান্ডব বয়ে গেল। বড় রাস্তায় গাছ ভেঙে পরে বিশ্রি অবস্থা। পুকুরে অনেক মাছ ভেসে উঠছে।বাড়ির মেয়েরা রান্না ব্যাস্ত৷
“আজ ডাক্তারকে দুপুরে খানার দাওয়াত দিস।”
যদু চোখ তুলে তাকায়, “ “ইর লাইগ্যা আপনের এত কিসের দরদ বুঝি না হুজুর।”
“তুই বুঝবি না রে, দরদ না, ই হইলো ঘেন্না আর ফাঁদ।”
এই ডাক্তার না থাকলে সেই মেয়েটা এখন আমার ঘরের মানুষ হইতো-মনে মনে গজগজ করল সে। বছর এক আগের ঘটনা মনে পরে যায়, গরিব এক ফারুক মোল্লা,হাটে ছোটখাটো মালামাল বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালাতো। তার কাছে সুদে কিছু টাকা নেয় দিন গড়ায়, মাস পেরোয়,কিন্তু টাকা ফেরত আসে না, ব্যাবসায় বিরাট লস করে বসে। ততদিনে সূদে আসলে প্রায় লক্ষ খানেক টাকায় দাঁড়ায়।এই সুযোগে মজিদ চেয়ারম্যান টাকার বিনিময়ে তার পনেরো বছরের মেয়েকে দাবী করে। আর ফারুক মোল্লাও নিরুপায়, শেষমেশ, টাকার বদলে লোকটা নিজের পনেরো বছর বয়সী মেয়েটাকে তুলে দিতে রাজী হয়।
এমন সুযোগ মজিদ ব্যাপারি কখনো ছাড়ে না, তবে আইনের মারপ্যাঁচ আছে, একসাথে চার বউয়ের বেশি রাখা যায় না। তাই আগের এক বউকে তালাক দিয়ে জায়গা খালি করে। তবে বিয়ে না করেই অনেক মেয়েকেই সে নিজের বিছানায় নিয়েছে, বাবা বা স্বামীর দেনার দায়ে।
কিন্তু সেবার বাধ সাধে ডাক্তার। একে মেয়ে নাবালিকা তার উপর বিনা দোষে একজন স্ত্রীকে তালাক দেওয়া! সে মজিদ ব্যাপারিকে বুঝায়,
“এইটা অন্যায়, জঘন্য অপরাধ,” বলে বারবার বোঝাতে থাকে। “ বাবার দেনার দায়ে এভাবে কন্যা বিক্রি হতে পারে না।”
“বিক্রি কে বললি? আমি তো উপকার করতে চাচ্ছিলাম।”
রুবায়েত উনার দিকে তাকায় সে দৃষ্টিতে ঘৃনা ছিল কিন্তু কন্ঠে প্রকাশ পায় নমনীয়তা। জলে নেমে কুমিরের সাথে পারবে না এটা জানে রুবায়েত। মজিদ ব্যাপারি ওর চোখের ভাষা বেশ বুঝতে পারেন।
সেদিন,সেই মেয়েটার বাপের সমস্ত ঋন শোধ করে দেয় ডাক্তার। গ্রামের লোকজনও জানে ঘটনাটা, তাই মজিদ তখন কিছু বলে না, মান-সম্মানের প্রশ্ন। “এ ডাক্তারটা ভাবছে কী? সব সময় যেন ভালো মানুষি করে বেড়ায়। এবার এমন শিখ দিব, চোখে অন্ধকার দেখবো,” দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে সে।
“হ হুজুর, মাইরে ডুবাই দিলেই হইতো না? এত ফিকির কিসের? হুজুরের জিনিস কেড়ে নিবে! তা নিয়া ঠ্যালা পুহাবি না?” যদু হাত কচলে বলে উঠে।
“এরে মারবো তবে অন্যভাবে ইজ্জতে হাত দিব, মুখে কালি লেপে যদি গ্রামে উদোম করে না ঘুরিয়েছি আমার নাম মজিদ ব্যাপারি না।” জোরে জোরে হুক্কায় টান দিতে থাকে। এদিকে এক চালা রান্নাঘরে তখন দুপুরের খাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
_________________
ঘুম ঘুম চোখেই রুবায়েত রিমঝিমের গান… চোখে চোখে কথা বল, মুখে কিছু বলনা….
মন নিয়ে খেলা করো, এ কি ছলনা….আর চুড়ির শব্দ শুনছে রুটি বানাচ্ছে সম্ভবত। উঠে পরা উচিৎ কিন্তু ইচ্ছে করছে না৷ পরিবেশটা ঠান্ডা তার উপর সারা ঘরময় যেন রিমঝিমের উপস্থিতি। মুখে হাসি ধরে রেখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়, বিয়ের পর রুবায়েত যখন আবিষ্কার করে রিমঝিমের গানের গলা বেশ,এরপর যখন তখন গানের আবদার করতো। কপট রাগ দেখালেও রিমঝিম খুশি লুকিয়ে রাখতে পারতো না একদম,মুখ ঝলমল করত।
রুবায়েত বেশি কথা বলার মানুষ না তবে বিয়ের পরপর এই স্পষ্টভাষী, অস্থির মেয়েটাকে ওর খুব ভালো লেগে যায়। ও সব সময় একা সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বই পড়া,কিছু নিয়ে চিন্তা করা বা ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকতেই ওর পছন্দ ছিল। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করে রিমঝিমের সাথে সিনেমা দেখতেও ওর ভালো লাগছে, বা সারাদিন কি হল এসব গল্প শুনতে। দিনগুলো ভালো যাচ্ছিলো কিন্তু একদিন রুবায়েতের সামনে রিমঝিমের চরিত্রের একটা দিক প্রকাশ পায়।
দিনটা ছিল শুক্রবার, রুবায়েত বিসিএস এর পড়া পড়ছিল খাটে বসে সামনে টেবিল। টেবিলটা এমন ভাবে রাখা, যেন খাটে বসেও পড়া যায়। আর রিমঝিম ওর পিঠে, পিঠ লাগিয়ে মোবাইল দেখছিল, গুন গুন গান তো আছেই। রুবায়েতের লতা আর আশা ভোঁসলে এই দুইজনের বাংলা গান খুব পছন্দ এটা জানার পর রিমঝিম কিছু গান আয়ত্ত করে নেয়। রুবায়েত মুখে কিছু না বললেও কি যে পুলকিত হয় বিষয়টা তে।
হঠাৎ খেয়াল করে রিমঝিম খুব হাসছে।
“কি হল?”
“এই জোকসটা শোন–
ক্যাবলা প্রশ্ন করলো
“প্রথম প্রেম কি ভোলা যায়?”
পাশ থেকে ভ্যাবলা উত্তর দিল, “ বাসে করে না গেলেও লঞ্চে করে নিশ্চিত যায়।”…. হা হা হা ভুলে যাওয়া কে আরেকজন ভাবছে ভোলা জেলা। ওরে আল্লাহ।
রুবায়েত ঘুরে বসলো, অবাক হয়ে হাসিতে ভেঙে পরা রিমঝিম কে দেখলো খানিক। “কিন্তু এটা সত্যি প্রথম প্রেম ভুলা যায়, যেমন আমি গিয়েছি।”
মুহূর্তে রিমঝিম এর চেহারা বদলে গেল, “তুমি প্রেম করতা?” প্রশ্ন একটা তাতে ঝরে পড়েছিল শত অনুযোগ,অভিমান, রাগ আর ঘৃণা।
রুবায়েত বুঝে উঠতে পারে না কি বলবে আর এত প্রতিক্রিয়াই বা কেন?
“নাস্তা হয়ে গেছে, হাত মুখ ধুয়ে নাও।” দরজার কাছে রিমঝিমের কন্ঠ, ওকে অতীত ভ্রমণ থেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনলো।
নাস্তা খেতে খেতে রিমঝিম বললো, “ শুন কচির বাবা সকাল, সকাল অনেক গুলো পাঁচ মিশানো মাছ দিয়ে গেছে। চচ্চড়ি করব ভাবছি। তুমি উনাকে টাকা দিয়ে দিও।”
“হু!”
এত রাগ লাগলো রিমঝিমের, ছড়া কাটতে ইচ্ছে করল, “ তোর মুখে গু!” মাথা নাড়লো পেটে বোমা মারলেও কোন কথা বলে না। আর এদিকে ডায়েরি লিখে ভরে ফেলেছে। কি মনে হতে, “ আর শুন কাল একটা সাপের জন্য এত মায়া দেখালা, বারান্দার গাছগুলোর কথা ভেবেছিলে চলে আসার আগে? ওদের বুঝি বাঁচার অধিকার নেই? ওরা বুঝি পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় না?”
রুবায়েত চোখ তুলে তাকালো, “ তুমি তো আস্ত মানুষের কথাই ভাবো নি বাড়ি ছেড়ে যাবার সময়! আর গাছ গুলো তুমি যখন বাড়ি ছেড়েছিলে, তখন সাথে করে নিয়েই যেতে।”
রিমঝিম উত্তর দেয় না। চুপচাপ খেতে খেতে মনে পরে যায়, বিয়ের পরপর গাছের বায়না করে ও, এত সুন্দর একটা দক্ষিণ মুখি বারান্দা গাছ না থাকলে চলে? রুবায়েত ওকে সাথে নিয়েই নার্সারিতে যায়। অনেক গাছ কিনে দেয়। তবে রিমঝিম লক্ষ্য করে গাছে ফুল আসলে রুবায়েত বারান্দায় যায় কম, বিশেষ করে গাঁদা আর গোলাপ। এ নিয়ে কত গোপন অভিমান ছিল ওর। কিন্তু ডায়েরি পড়ে জানতে পারে ফুলের রেনুতে রুবায়েতের এলার্জি। এই কথাটা ওর ডাক্তারকে বললে উনি আগে কতক্ষণ হেসেছেন পরে বলেছেন, “ আপনার হাসব্যান্ড এর ও কাউন্সিলিং দরকার।”
“একা একা হাসছো যে!” রুবায়েত না চাইতেও বলে ফেলে।
“তোমার ও কাউন্সিলিং দরকার এটা ভেবে।” বলেই বোকা বনে যায়।
“কি!!”
“জ্বি! “ বলে রিমঝিম হাসিতে ভেঙে পরে।
সেই হাসি দেখে রুবায়েতের মনে হয় যেন বয়ে চলা কোন ঝর্না, এই মেয়ের ভেতরেই যেন চলে ছয় ঋতুর খেলা। কখনো বৃষ্টি কখনো রোদ আবার কখনো কালবৈশাখীর তান্ডব।
গিট্টুর মা গলা নীচু করে রিমঝিমের সাথে কি সব বলছে ডাক্তার সাব…খচ্চর…বিপদে…এসব টুকরো শব্দ রুবাইয়াতের কানে আসছে। তবে পাত্তা দিচ্ছে না, মহিলা মানুষের খালি গল্প আর গল্প। মোবাইলে ডাউনলোড করা কিছু বই পড়ছে, ডাক্তারদের তো সারা জীবন পড়াশোনা। এখানে এ ছাড়া কোন কাজ নেই, তবুও খানিক বাদে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়বে কালকে ঝড় বৃষ্টির পর অবস্থা দেখতে। শুনেছে বড় রাস্তার উপর গাছ পড়েছে, ভালো হলো। রিমঝিম বুঝবে এজন্যই তাকে যেতে দিচ্ছে না।
“তোমাকে কে যেন ডাকছে।” রিমঝিমের গলা শুনে ফিরে তাকালো।
যদু উঠানে দাঁড়িয়ে আছে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে, রুবায়েতের গা জ্বলে গেল। আস্ত শয়তান এটা উস্তাদের মত। অথচ কি ভাব ধরেছে।
“সালাম ডাক্তার সাব,চেয়ারম্যান সাব কইছে, দোপুড়ত খাইতে আইছেন, ভাবিরে লইয়া আইছেন।
আর পোলাপাইনরেও একবার দেইখা দিতেন, রোগ বালাইয়ের কি অভাব আছে।”
রুবায়েত কিছু বলে না, জানে যেতে হবে। এসব হচ্ছে চেয়ারম্যানের নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের উপায়। শুধু রুবায়েত না আরো অনেক মানুষকেই বলবে। উনার বাচ্চাদের দেখার বিষয়টা একটা আলগা আদিখ্যেতা, গত পরশুই দেখে এসেছে। সাথে দেখে এসেছে, নতুন ফ্রিজ। চট করে ঘরের দিকে তাকিয়ে পুকুর পাড়ে চলে গেল, গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো, বিয়ের আগে খেত অল্প। বিয়ের পর পুরাই বন্ধ রিমঝিমের জন্য। তবে এখানে এসে আবার ধরে ফেলেছে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলো রিমঝিমকে নেওয়া যাবে না,চেয়ারম্যানের নজর ভালো না।
জানলায় দাঁড়িয়ে সমস্তটা শুনলো রিমঝিম, আজ সকালে গিট্টুর নানী চেয়ারম্যানের সাথে রুবায়েতের ঠান্ডা লড়াইয়ের কথাটা বলেছে। শুধু তাই নয়,ভদ্রমহিলা মুখ সরু করে সাবধান করে দিয়েছে। তার ধারণা চেয়ারম্যান একটা প্রতিশোধ নিবেই নিবে। সব সময় সেধেই এই ব্যাটার কেন বিপদে পরা লাগে? আর এদিকে রুবায়েত গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। আস্ত একটা বেঈমান, মীরজাফর! কথা দিয়ে কথা রাখে নাই।রুবায়েত যদি নিজের কথা না রাখে রিমঝিমের কোন ঠেকা নাই।
গোছল করে তৈরি হয়ে নিল রুবায়েত, রাগ লাগছে। তবু কিছু করার নেই৷
“এই যে শুনেন…”
অবাক হয়ে ফিরে তাকালো, “ হুম বল!” একটা বাসন্তী সালোয়ার পরেছে রিমঝিম, রুবায়েতের বলতে ইচ্ছে হলো, শাড়ি লাগবে তোমার? এনে দিব?
“না গেলে হয় না, আপনি উনার সাথে একটা ঠান্ডা লড়াইয়ে আছেন…! রিমঝিমের সমস্ত চেহারায় চিন্তার ছাপ।
রুবায়েত বিরক্ত হল, “এসব কথা কি গিট্টুর নানী বলেছে?” মনে,মনে ভাবলো, এমনিতেই টেনশনের রোগী। এখন সারাক্ষণ এই কথাই ভাবতে থাকবে।
“মিথ্যে তো বলে নাই? ঢাকাতেও আপনি সেবার আরেকজনের ঝামেলায় নাক গলিয়ে মাথাটা ফাটিয়ে ছিলেন, এখন…”
রুবায়েত মৃদু হাসলো, “ আমার জন্য এত চিন্তা না করলেও চলবে…দুইটা কথা রাখার অনুরোধ করেছিলাম। দুইটাই আজ ভাঙলে!”
রুবায়েত যখন স্যান্ডেল পায়ে গলাচ্ছে, রিমঝিম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে “আপনিও তো ওয়াদার খেলাফ করেছেন। সব দায় বুঝি একা আমার?”
রুবায়েতের হঠাৎ ডিভোর্স লেটারের কথা মনে পরে গেল, হাসি পাচ্ছিলো। “ কোন ওয়াদা? তোমার দায় অবশ্যই সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত তুমিই তো নিয়েছ।”
রিমঝিম কিছু বলে না, মনে মনে তুই আজ বাসায় ফেরত আয় আগে। নিজের মনেই হেসে ফেলে আপনি, তুমি আর তুই কি দারুন বিষয়টা।
চলবে………
রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব ৫
আজকের দিনটা রৌদ্রোজ্জ্বল। সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে চারিদিকের প্রকৃতি রুবায়েতকে খুব টানে। ভিড় বা সামাজিক জমায়েতে ওর পছন্দ না, ক্লান্ত লাগে।মানসিক শান্তি পায় না, অনেক মানুষ বা বড় জমায়েত ওর মত মানুষের জন্য একটা মানসিক অত্যাচার। কিন্তু একটা ক্যাচাল যেহেতু হয়েছে চেয়ারম্যান এর সাথে আর কোন দ্বন্দে জড়াতে চায় না।
অথচ রিমঝিম বলল, ও নাকি শুধু শুধু বিপদে নাক গলায়। সেবার রিমঝিম খুব রাগ রুবায়েতের উপর, ওই যে প্রথম প্রেম সেটা জানার পর। সে সময় একদিন, রুবায়েতদের হাসপাতালে একটা রোগী অসুস্থ হয়ে মারা যায়। দোষ ডাক্তারের না, তবুও রোগীর আত্মীয়-স্বজন, ডাক্তারের উপর চড়াও হয়। তাকে বাঁচাতে গিয়ে রুবায়েত সহ আরো কয়েকজন আহত হয়। সেদিন বাসায় মাথায় সেলাই হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে যাবার পরে, রিমঝিম রাগ ভুলে যায় আর ওর খুব সেবা করেও। কান্নাকাটি তো আছেই, তখন ওর কাছে মনে হয় একটু মার খেয়ে ভালোই হয়েছে। এমনিতেই কিছু প্রকাশ করতে পারেনা, রিমঝিম এর মান অভিমান ভাঙাতে পারছিল না।
মজিদ ব্যাপারির বিশাল দোতলা বাড়ির আঙিনায় খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। চেয়ার টেবিল পাতা হয়েছে উপরে ছামিয়ানা টানানো। সাইকেল নিয়ে প্রবেশ করেই মন তিতা হয়ে গেল রুবায়েতের। এই গ্রামে কত মানুষ দারিদ্র্যতার সাথে লড়াইয়ে ব্যাস্ত আর উনি…সরকারের সাহায্য, ত্রান সব এর পেটেই যায় আর সুদের ব্যাবসা তো আছেই।
চেয়ারম্যান মজিদ ব্যাপারি সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে, অতিথিদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। পাশেই ইউনিয়নের মেম্বার, হেডমাস্টার স্যার, মসজিদের ইমাম,বাজার কমিটির সভাপতি, থানা থেকে আসা এক অফিসার—সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় চলছে। রুবায়েতকেও সবাই সাদরে গ্রহণ করলো। সবাই ওকে ডাক্তার সাব বলেই সম্বোধন করে।
“তা ডাক্তার যাচ্ছ কবে?”প্রশ্ন করলো হেডমাস্টার সাহেব খুব সজ্জন ব্যাক্তি।
“এই মাস পরেই।” হেসেই জবাব দেয় রুবায়েত।
এদিকে মজিদ ব্যাপারি মুখে হাসি ঝুলিয়ে, “যেতে দিলে তবে তো যাবি?”
রুবায়েতের মনে হয় হাসিতে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি লুকিয়ে আছে। তবে এগুলোতে ও পাত্তা দেয় না।
আজ বেশিরভাগ মাছের আইটেম, চেয়ারম্যান সাহেবের পুকুরের মাছ। খাসির মাংস ও রান্না করা হয়েছে সাথে মুরগির ঝাল মাংস।
খাবার শেষ করে রুবায়েত বৈঠক ঘরে গেল। বাচ্চাদের দেখতে। চেয়ারম্যানের বড় দুই ছেলে বিয়ে করেছে, দুই ছেলের ঘরে দুইটা নাতি আর একটা নাতনী। আর উনার নিজের আরও পাঁচটা মেয়ে আছে যারা স্কুলে যায় মোটামুটি বড়। আর তিনটা ছেলে ছোট স্কুলে যায় না। সবচেয়ে ছোট বউ এর আবার বাচ্চা হবে, বয়স বেশি না। রুবায়েত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো কি একটা অবস্থা। বাচ্চাদের জিভ দেখছে হাত পা টেনে কুতুকুতু দিচ্ছে। হঠাৎ চেয়ারম্যান এর বড় নাতি বলে উঠলো,
“আমার মাকেও দেখে দিবা?”
রুবায়েত জিজ্ঞেস করে, “কেন?” অন্দরমহলে এই বাড়ির মেয়েরা থাকে। দুই একবার রুবায়েত সেখানে গিয়েছে মহিলা রুগি দেখতে। সাথে মুরুব্বি দুইজন মহিলাও ছিল।
“বাবা কাল মাকে অনেক মারছি!” এরপর ওর বোন টা ফুঁপিয়ে উঠে। এদের ভাষা মোটামুটি শুদ্ধ আঞ্চলিক টান আছে একটু।
“আহ! ভেতরি যাও এহন।” বাচ্চাদের ধমক দেয় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা চেয়ারম্যানের খাস লোক লোকমান। “পুরুষ মানুষ হইলে বউ না পিটাইলে কিসের পুরুষ?!”
তারপর রুবায়েতের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসি দিয়ে,
“সব পুরুষই বউরে মারে, কন ভুল কইলাম? এ জাতটার এমন, না মারলে ঠেকতেও জানে না।”
রুবায়েত কড়া উত্তর দিতে গিয়েও পারে না৷ কারন একটা দৃশ্য মনের আয়নায় ভেসে উঠে, যেদিন রুবায়েত রিমঝিমের গায়ে হাত তুলেছিল। রিমঝিমের চোখের সেই দৃষ্টি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কোথায় নিজেকে নামিয়ে ফেলেছে। এখন এই অসভ্য লোকগুলোর কথার উত্তর দিতেও পারছে না, বিবেকে লাগছে।
এখন আকাশে হালকা মেঘ করেছে, রুবায়েত লেকের পাড়ে সটান শুয়ে আছে। রুবায়েত এত মিশতে পারে না। তবে ও সম্পর্ক করে স্বল্প কিন্তু গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। অনেক বন্ধু হয়ত নেই কিন্তু যে অল্প কয়েকজন আছে তাদের সাথে গভীর সম্পর্ক ওর। অথচ রিমঝিমের সাথেই সম্পর্ক টা সহজ হচ্ছে না। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে, চিন্তায় ডুবে গেল। আত্মবিশ্লেষণ প্রবণ ছেলে রুবায়েত । নিজের সংসার নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলো, নিজের ভুলগুলো বিশ্লেষণ করতে লাগলো। প্রথম থেকেই নিজের ভাবনা গুলো প্রকাশ না করা একটা ভুল ছিল। সেই ভুল এখনো করে চলেছে রুবায়েত৷ রিমঝিমকে অনেক ভালোবাসে, আর যে কারনে ওদের মনমালিন্য সেটা সম্পর্ক বিচ্ছেদের মত না। কিন্তু সমস্যা হল ও ভালো বক্তা না, লিখতে পারে বেশ। হঠাৎ দূরে একটা কদম গাছে চোখ গেল। উঠে বসলো।
________________________
আজ সারাদিন দারুণ রোদ ছিল। উঠোন জুড়ে রোদের খেলা, গাছের ফাঁকে আলোছায়া কাঁপছিল। রান্না শেষ করে, খেয়ে, রিমঝিম এখন ঘরের দুই কপাটের দরজায় ঠেস দিয়ে রুবায়েতের ডায়েরি পড়ছে। দরজার সাথেই একটা বকুল গাছ, রোদ আসছে পাতার ফাঁক গলে। গন্ধও আসে হালকা হালকা বকুল, হাস্নাহেনা…আরো কত ফুলের।
ডায়েরিটা প্রথম থেকে আবার পড়া শুরু করল। পাশে একটা বাটিতে তেতুল মাখা, ময়নার মা দিয়ে গেছে খানিক আগে। ভেজা চুল এলিয়ে, ডায়েরি চোখের সামনে ধরে নিজেকে খুব সুখী মনে হয় রিমঝিমের।
ডায়েরিতে ওদের প্রথম দেখাদেখির তারিখ দেওয়া, সময়টা ডিসেম্বর।
১৫.১২.২০২৪
আজ যে মেয়েটাকে দেখতে গেলাম, অনেক অন্যরকম। এর আগেও আমি চারজন মেয়ে দেখেছি। এদের সাথে একা কথা বলার অভিজ্ঞতা সুখকর নয় বলেই এবার আর কিছু বলতে আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু আজ বেশ অবাক হলাম। দারুণ স্পষ্ট কথা বলে মেয়েটা, নামটাও সুন্দর। হৃদয়ে যেন টুপটাপ বৃষ্টি ঝরছিল। তবে ম্যাডামের নাকি ডাক্তার পাত্র পছন্দ নয়। জান কয়লা করে পড়ে, তারপর ডাক্তার হয়ে এগুলো শুনতে ভালো লাগে? বাসায় এসেও ঘোর কাটছে না। আল্লাহর কাছে দু’আও করে ফেলেছি, যেন ডাক্তার এই অপরাধে বিয়েটা ভেঙে না যায়।
১.১.২০২৫
আলহামদুলিল্লাহ, রিমঝিম নামের দারুণ মিষ্টি মেয়েটা এখন আমার স্ত্রী। আজ বিয়ের পর “কবুল” বলার সময়, এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল আমার। জানি না এর নাম কী! এত ভিড় আর ছবি তোলার প্রতিযোগিতার মাঝে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছি তার দিকে..যে এখন আমার। কিন্তু সে তাকায়ইনি।
ডাক্তার হয়ে কি এমন অপরাধ করলাম? তবে আয়নায় দেখাদেখির সময় খুব কিউট করে বলেছে, “ডাক্তার দেখছি।”
এতটুকু পড়ে, রিমঝিম তেতুল তুলে মুখে দেয়। বিয়ের দিন সে আসলে চিন্তিত ছিল খুব। নতুন একটা বাসায় যাবে, কার কেমন মন—ওর চুল কে ছাড়িয়ে দেবে? আর খিদে পেলে? ও বাড়ির রান্না কেমন? তার উপর একটা পুরুষের সাথে একত্রে থাকা! ভাবলেই গা শিউরে উঠছিল। সালামটা কেমন করে করবে, ঠিক জানত না।
আর রুবায়েত ডায়েরিতে লিখে রেখেছে, তার দিকে তাকায়নি! তাকাবার পরিস্থিতি ছিল নাকি! তবে আয়নায় দেখেছিলো, মুখে একটা হালকা হাসি এসেছিলো। রুবায়েত বলেছিল, “বৃষ্টি দেখছি, স্নিগ্ধ সুন্দর।” আর রিমঝিম বলেছিল, “ডাক্তার দেখছি।” খুব অন্যরকম একটা শিহরণ খেলে গিয়েছিল তনু-মনে।
পুনরায় পড়তে শুরু করে—
…
বিয়ের প্রথম রাত নিয়ে অনেক গল্প-কবিতা থাকলেও, বাস্তবতা হলো, খুব ভয়াবহ একটা অনুভূতি হচ্ছিল। তার মধ্যে কী প্রচণ্ড ঝড়! রুমে ঢুকে দেখি, সে বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে, ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে। বাহ! কিন্তু আমার পা চলছে না। যাই হোক, তাকে বললাম উঠে ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে নিতে। সে উঠে দাঁড়ালো স্বাভাবিকভাবেই, আর ঠিক তখনই বাজ পড়লো! ভাগ্যিস… আমি তাকে আমার বুকের ওপর আবিষ্কার করলাম। সমস্ত শরীরে এক অদ্ভুত অনুভূতি! ইতস্তত করে আমিও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, বাজের শব্দে ভয় পায় কিনা। আর কি কি ভয় পায়? আর কী বুদ্ধিমানের মতো উত্তর দিল, “সম্পর্ক হারাতে ভয় পাই।”
আমার তখন গান গাইতে ইচ্ছে করছিল—”তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো, ছেড়ে দিব না…”। কিন্তু আমার গলায় সেই সুর নেই। পরে যদি বউ অজ্ঞান হয়ে যায় প্রথম রাতেই!
অল্প গল্পের পর সে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি শুধু আফসোস করছিলাম—আর একবার বাজ পরলে কি এমন ক্ষতি হতো? বুকটা শূন্যই থেকে গেল।
রিমঝিম ডায়েরি বন্ধ করে চোখ মুদে হাসলো। কী রকম বদ একটা মানুষ! ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরার নাম করে আসলে কী ইচ্ছেটাই না ছিল তার! এরপর তো কতবার নিজেই জড়িয়ে ধরেছে—কাজ থেকে ফিরে, কারণে-অকারণে। অথচ এখানে আসার পর, একবারও নিজের ইচ্ছেতে না… এখনো কি সে দু’আ করে, যেন বাজ পড়ে?
১.২০.২০২৫
রিমঝিম যে গান গাইতে পারে, সেটা কিছুদিন আগেই আবিষ্কার করলাম। হঠাৎ জ্বর এল আমার। অবশ্য আমার জ্বর এরকমই, হঠাৎ আসে, হঠাৎ যায়। আমি অভ্যস্ত। কিন্তু রিমঝিম খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। নিজেকেই দোষ দিতে লাগল।
“আপনি কাল ফিরে শাওয়ার নিলেন, আমার উচিত ছিল মানা করা, তাই না? আমারই ভুল… মা কতবার বলে গেলেন, আপনার খেয়াল রাখতে।”
আমি ওর হাত চেপে ধরলাম, “চুপ করো প্লিজ, এগুলো কোনো কথা না! হাসপাতাল থেকে ফিরে শাওয়ার নেওয়া নিয়ম। আমার এরকম জ্বর খুব স্বাভাবিক। তুমি শুধু পাশে বসে থাকো।”
এরপর মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে সে গান শুরু করল। আমি অবাক! আমার প্রিয় শিল্পী লতা মঙ্গেশকর আর আশা ভোঁসলে, বিষয়টা জানার পর সে চেষ্টা করে করে ওদের গান আয়ত্ত করে ফেলল! বিষয়টা ছোট না, না খুব বড় জানি না, তবে আমার কাছে এই মেয়েটার জন্য সমস্ত হৃদয়ে ভালোবাসা জন্মাল।
আমি আমার বউকে ভালোবাসি! এর চেয়ে সুন্দর অনুভূতি আর হয় না।
আমার দিনগুলো রঙিন হয়ে গেল। রিমঝিম চা বানায় চুড়ি নাড়িয়ে, আর গান করে। এখন আমাকে “তুমি” বলে আর বাসায় শাড়ি পরে। আমার দুইটা ছোট্ট আবদার ছিল তার কাছে, বা বলা যায় একে-অপরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি। এই ঘটনাটা মজার, লিখে রাখতে হবে সময় করে। ম্যাডামকে লুকিয়ে ডায়েরি লিখি!
যাই হোক, আমি ঘরে বসে বিসিএস প্রস্তুতি নেই, আর ওর গান শুনি। এখন গাইছে—
“আমি তোমাকেই ভালোবাসি…
যাতে আরও কাছে সরে আসি…”
আমি তোমাকেই ভালোবাসি…
আলহামদুলিল্লাহ! জীবন এর চেয়ে সুন্দর কীভাবে হয়?
রিমঝিমের চোখ দিয়ে এখন জল গড়াচ্ছে। কী সম্পর্ক, কী হয়ে গেল! এখন কি রুবায়েত আর ভালোবাসে না তাকে?
দোষ যার থাকুক, রুবায়েত কি একবারও সরি বলবে না? বুঝবে না, কী কারণে এতদূর ছুটে এসেছে রিমঝিম?
_____________________
সন্ধ্যা নেমেছে পাহাড়ের গায়ে, অপূর্ব দৃশ্য। দূরে কোথাও আজান হচ্ছে। বাতাসে একটা পবিত্রতা ভেসে আসে। আজ রুবায়েত গিয়েছিল মৎস্যপল্লীতে। সেখানে ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে দেখে এসেছে, যাদের অনেকেরই পায়ে ঘা হয়েছে। আপাতত ওষুধ দিয়ে এসেছে, কাল আরও ওষুধের অর্ডার দেবে।
এই গ্রামটা কেমন করে যেন মন ছুঁয়ে গেছে রুবায়েতের। ভালোবেসে ফেলেছে… ঠিক যেমন ভালোবেসেছে রিমঝিমকে। কিন্তু জানে, এই গ্রামেও থাকা হবে না ওর। তবে রিমঝিমকে… ধরে রাখতেই হবে।
সাইকেলের পেছনে পলিথিনে মুড়িয়ে অনেকগুলো কদমফুল এনেছে সে। রিমঝিমের ফুলের প্রতি অদ্ভুত এক দুর্বলতা। তাই রুবায়েত নিজের ফুলের রেনুতে ওর অ্যালার্জির কথাটা লুকিয়ে গেছে। নাহ, রিমঝিম যদি জানত, তবে গাছগুলো বোধহয় রাখত না।এত শখের গাছ ওর।
কিন্তু যতই বাড়ির দিকে এগোচ্ছে, রুবায়েতের গলা তত শুকিয়ে যাচ্ছে। আজ সকালেই ঝড়বৃষ্টির আভাস পেয়েছিল সে। জানে, আজকের রাতে কিছু একটা বদলে যাবে।
নামাজ শেষ করে, আগেরটার মতো আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিল। পা দিয়ে একটা ছোট ইটকে লাথি মারলো। ও জানে এটা ঠিক হচ্ছে না। কথা দিয়েছিল রিমঝিমকে সিগারেট খাবে না। এখন নিজেকেই মনে হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক, একেবারে বেঈমান।
রুবায়েত যখন বাড়িতে পৌঁছলো, তখন রাত নেমে গেছে। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে জোনাকিপোকার আলো জ্বলছে নিভছে। রিমঝিম ডায়েরিটা লুকিয়ে রেখেছে, ওর চোখে পড়েনি।
রুবায়েত হাত-মুখ ধুয়ে বেতের সোফায় এসে বসলো। কী বলবে ভাবছে। ভেতরে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে চায়ের গন্ধ। রিমঝিম চা বানাচ্ছে, পরনে একটা লাল সালোয়ার কামিজ। এখন একটা গান গাইছে, কার গান কে জানে?
“হারানো সেই দিনগুলি হায়…
আজও সুখের স্বপ্ন জাগায়…
হৃদয় সবই ভুলতে পারে,
স্মৃতির বেদন নাহি ভোলে।”
রিমঝিমের কণ্ঠে আজ এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা। যেন তার গলার ভিতরটায় কোন পুরনো বেদনার সুর বাসা বেঁধেছে। বুকের ভেতর মোচড় দিল রুবায়েতের।
চা আর মুড়ির বাটিটা শব্দ করে টেবিলের উপর রাখলো রিমঝিম।
“তুমিও বসো।”
“আপনি খান, আমি পরে খেয়ে নেবো।” রাগ রাগ কন্ঠ।
“আবার ‘আপনি’? “আপনি বলছো কেন? তুমি–”
রুবায়েতের কথা শেষ হওয়ার আগেই রিমঝিম ঝাঁঝিয়ে উঠলো, “আপনি যেভাবে সিগারেট খেয়েছেন, সেভাবেই আমি শাড়ি পড়া ছেড়েছি। আপনাকে ‘তুমি’ বলা ছেড়েছি। আপনি চুক্তি ভেঙেছেন। আমি কাল চলে যাচ্ছি, বাসে তুলে দিলেই হবে।”
রুবায়েত ধীরে উঠে দাঁড়ালো, “সরি।”
“কিসের জন্য?”
“সিগারেট খেয়েছি বলে। তুমি ছিলে না, খুব একা লাগতো…”
“সিগারেট কি আমার রিপ্লেসমেন্ট?” রিমঝিম পুরো ঝগড়ার মুডে, দুই হাত বুকের সামনে ভাঁজ করা।
ওর দিকে তাকিয়ে রুবায়েত হেসে ফেললো। “এবার তুমিও সরি বলো।”
“কেন?” রিমঝিম একেবারে হতবাক।
“আমাকে ‘আপনি’ বলছো, আর শাড়ি পড়া ছেড়েছো, তাই।”
রিমঝিম কিছু বললো না, মুখে রাগের ছায়া রেখেই ভেতরের ঘরে চলে গেল। মিনিট পাঁচেক পর ফুলগুলো আবিষ্কার করলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে। তার পাশে একটা চিরকুট—
“এই ফুলগুলোর কোনো দোষ নেই, আগেই বলে রাখছি। এরা কেবল দূতের কাজ করছে। আমি দুঃখিত তোমাকে মেরেছিলাম, তাই।”
রিমঝিম ভ্রু কুঁচকে লেখাটা পড়ে, ফুলগুলো হাতে নিয়ে সামনের রুমে এল–
“তোমার এইসব কবি মার্কা চিরকুটে কোনো লাভ নেই। এই বিশ দিন চুপ থাকাটা খুব ‘ইন্ট্রো’ ছিল, তাই না? একটা সরি বলতেও এত নাটক?”
রুবায়েত হেসে ফেললো,
“হ্যাঁ… আমি ‘ইন্ট্রো’। আমি জানি। তাই ‘সরি’ বলার স্ক্রিপ্ট খুঁজতেই বিশ দিন কেটে গেল।”
“তাই নাকি উপলব্ধি করতে?” চোখ সরু করলো রিমঝিম।
রুবায়েত দীর্ঘশ্বাস ফেললো, “হুম। উপলব্ধি করতে। কারণ তুমি সেদিন যা করছিলে… এরপর ডিভোর্স লেটার…!” সত্যিটাই বলে দিল।
রিমঝিম একটা নিঃশ্বাস ফেললো, “তবে আজ কী হল?”
“একজন জানোয়ারের আয়নায় উঁকি দিয়ে নিজেকে দেখলাম।” সরল স্বীকারোক্তি রুবায়েতের কণ্ঠে। “নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে যে কারণেই হোক গায়ে হাত তোলাটা নিতান্তই কাপুরুষতা। আমাকে যদি সম্ভব হয়, মাফ করে দিও। আর হ্যাঁ, কাল সকালেই বাসে তুলে দেব।”
রাতে বিছানায় শুয়ে রুবায়েত দেখলো, রিমঝিম পরেছে সেই হলুদ তাতের শাড়িটা, যেটা ওর পরনে দেখলেই রুবায়েতের বুকের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে ধীরে ধীরে।
হঠাৎ বললো, “শোনো, আমি কাল যাচ্ছি না। এই গ্রামটা তো এখনো ঠিকঠাক দেখা হয়নি।”
রুবায়েত হাসি চেপে পেছনে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লো। মুখটা ঝুঁকিয়ে বললো, “রিমঝিম, নড়ো না… একটা তেলাপোকা। আমি মারছি।”
রিমঝিমের কি এসব শোনার ফুরসত আছে? তেলাপোকা থাক বা না থাক, সে ঘুরে দাঁড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুবায়েতকে। বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, যেন এতদিন জমে থাকা সব কথা নিঃশ্বাসে ভেসে যাচ্ছে।
রুবায়েত ওর কোমরে হাত রেখে একটু ঝুঁকে কানে কানে বললো, “তুমি থাকো…নইলে সিগারেট আবার তোমার জায়গা নিয়ে নিবে।”
রিমঝিম রেগে মাথা তুলে কিছু বলতে যাবে..
“নড়ো না, তেলাপোকা এখনো আছে, জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাবে মনে হচ্ছে।”
“রিমঝিম কিছু বললো না আর, কেবল চোখ দুটো ভিজে উঠেছে, আর বুকের গভীরে জমে থাকা কষ্টটুকু একটু,একটু করে গলে যাচ্ছে এই লোকের আলিঙ্গনে।
এদিকে আয়নার দিকে তাকিয়ে রুবায়েত নিজের প্রতিবিম্বকে একচোখে মটকে দিল, মুখে একরাশ হাসি।
চলবে….
#রিমঝিম_বৃষ্টি
#কাজী_জেবুন্নেসা