অসময়ের শুকতারা পর্ব-০১

0
67

#অসময়ের_শুকতারা
#অনামিকা_আহমেদ
পর্ব:০১

– বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরপুরু*ষকে শরীর দেখানো শেষ হলে এক্ষুনি আমার রুমে এক কাপ কফি নিয়ে আয়।

এই বলে সাদাত কয়েক কদম পিছু হটলেও আবারো পূর্বের স্থানে ফিরে এসে কড়া কন্ঠে বলে,

– পাঁচ মিনিটের মধ্যে যেনো আমি তোকে আমার রুমে দেখি। আর যদি আমাকে আবারো তাগাদা দিতে আসতে হয় তাহলে তুই মনে রাখবি আজকেই তোর এই বাড়িতে শেষ দিন।

সাদাত এবার দ্রুত পা ফেলে ড্রয়িংরুম থেকে বের হয়ে যায়। সেই সময় সাদাতের মা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে মটরশুঁটির খোসা চারাচ্ছিলেন। তার বড় ছেলের আদেশ বানী শোনার পরও শীতলের কোনো নড়চড় না দেখে তার মনে মনে ভীষণ রাগ হয়। মেয়েটা কেনো এত অবুঝ তিনি বোঝেন না। সে তো জানে সাদাতের কথা না শুনলে তাকে আজ হয়তো তীব্র শীতের মাঝে ছাদে ঘুমাতে হবে। তাও মেয়েটা কেমন জিদ দেখিয়ে একমনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।

জয়া বেগম কোলের ওপর থেকে ঝুড়িটা নামিয়ে শীতল বলে একটা ডাক পারে। কিন্তু শীতল এর আসার কোনো নামগন্ধ নেই, পায়ের শব্দ না পেয়ে শেষমেষ জয়া কে উঠে দাঁড়াতে হয়। কিছুদিন আগেই তার মাজায় বড় ধরনের অপরেশন হয়েছে। ডাক্তার বলেছে যেনো বেশি নড়াচড়া, উঠাবসা না করে। কিন্তু না করে কি উপায় আছে? এই অবুঝ ছেলে মেয়ে দুটিকে এক হাতে মানুষ টা তো চারটি খানি ব্যাপার না।

জয়া বেঁটে মানুষ, বয়সের জন্য বোধহয় আরও খর্ব হচ্ছে তার উচ্চতা। যতটুকু সম্ভব শরীর নাড়িয়ে নাড়িয়ে সে বারান্দায় গিয়ে শীতল এর পাশে গিয়ে দাঁড়ান। মেয়েটার অর্ধেক মুখ দেখে তিনি ভালই আন্দাজ করতে পারছেন যে, কেঁদে কেটে একাকার তার চোখ মুখ। দুটো চোখের নিচ ফুলে গেছে। জয়া শীতল এর মাথায় হাত রাখলে শীতল ঘোর ভেঙে তাকায় তার দিকে। কি মায়াভরা চোখ যুগল, কি লাস্যময়ী তার চেহারা, শীতল এর দিকে তাকালে বরাবরই তার ছোট জা এর কথা মনে পড়ে যায়। দেবরের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখার দায়িত্ব তার ঘাড়ে পড়েছিল। অনেক খুঁজেও যখন মনের মত মেয়ে পাচ্ছিলেন না ঠিক সেই দিন তার নজরে পড়ে গ্রামের পুকুর পাড়ে বসে থালা বাসন মাজতে থাকা সতেরো বছর বয়সী এক সুন্দরী মেয়েকে। চড়া রোদেও তার দুধে আলতা গায়ের রং ক্ষয় হয় না, কোমর সমান চুলের সেই রূপসী নারীই ছিল শীতলের মা। মেয়েটাও দেখতে ঠিক মায়ের মতোই হয়েছে, কোনো অংশেই যেনো কম নয় সে।

– জানিস তো সাদাত একটু এমনই , যা না মা কফি টা বানিয়ে দিয়ে আয়। পাগ*লাটাকে আর ক্ষেপাস না।

শীতল নিশ্চুপ থেকে কিছুক্ষণ আর বড়চাচির দিকে চেয়ে রয়। কি অমায়িক মানুষটা। যখন বাড়ির সকলে মিলে শীতল এর ওপর অত্যাচা*র করতে বেস্ত ঠিক সেই সময় জয়া নিজের সর্বস্ব টুকু দিয়ে তাকে আগলে রাখে। কখনোই তাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি জয়া। ছোটবেলায় মা কে হারানোর দরুন মায়ের ক্ষীণ স্মৃতি ও মনে নেই শীতলের, তার কাছে মা মানের জয়া।

জয়া সযত্নে শীতলের চোখের পানি নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,

– রা*গ করিস না মা, মন খারাপ কাদের ওপর করছিস যারা তোকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না। মন কে শক্ত কর, অনেক পথ তোকে পাড়ি দিতে হবে। একাই সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে।

শীতল চুপচাপ শুনে যায় জয়ার কথা গুলো। বড়ই মিষ্টি তার এই পাতানো মায়ের কন্ঠ। শীতল কে আগলে রাখার জন্য তাকেও অনেক অপমা*নিত হতে হয়। এমনকি তার নিজ ছেলে মেয়ের কাছে মা চ*ক্ষুশূল এ পরিণত হয়েছে। জয়া আবারও বলেন,

– আমি ব্যর্থ মা, নিজের সন্তানকে ঠিক মতো মানুষ করতে পারি নি। আজ নাহলে এই দিন আমাকে দেখতে হতো না। তুই মনে কিছু নিস না মা। দেখিস একদিন তোর জীবনে এমন একজন মানুষ আসবে যে তোকে মানুষ হিসেবে সম্মান করবে। তোর ভালো লাগা মন্দ লাগাই তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি হবে। তোকে বিয়ে করে রাজরানীর মত রাখবে।

চাচীর কথা শুনে শীতল তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। মনে মনে নিজেকে বলে,

– আমার মত মেয়েকে কেও কেনো বিয়ে করবে।

শীতল আলতো করে জয়ার গালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে হাসিমুখে তার দিকে তাকায়। মেয়ের চেহারা আবারও প্রনোজ্জলতা ফিরে পাওয়ায় তিনি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচেন। শীতল এর দাঁড়িয়ে না থেকে রান্নাঘরে এসে সাদাতের জন্য কফি বানাতে থাকে।

কফি বানানো শেষ হলে ধোঁয়া ওঠা গরম কফি একটা কাপে ঢেলে নিয়ে যায় তার জন্য। কফি ঢালার সময় অসাবধানতায় তার হাতের কিছুটা অংশ পুড়িয়ে ফেলে, এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। অষ্টাদশীর হাতে এমন পোড়া ছেকার দাগ কম নেই।

দ্বিতীয় তলার প্রথম রুমটাই সাদাতের। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শীতল দরজায় টোকা দিলে ভিতর থেকে সাদাতের কন্ঠ ভেসে আসে।

– দরজা খোলে, ভিতরে আয়।

ভয়ে শীতল এর বুক কেঁপে উঠে। সাংঘাতিক লোক তার এই সাদাত ভাই। একবার বাড়ির ইলেক্ট্রিসিটি প্রবলেম হয়েছিল দেখে মেকানিক ডাকা হয়েছিল। সেই মেকানিককে চা খাওয়ানোর অপরাধে বেল্ট দিয়ে কি মারটাই না মেরেছিল সাদাত সেদিন রাতে। মা*রের চোটে শীতল এর মরমর অবস্থা। তারপর জয়ার সেবায় সেবারের মত বেঁচে উঠে শীতল। তারপর থেকেই সাদাত ভাইকে সে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।

আজ সকালেও তার আরেক চাচার ছেলে রাহুলের সাথে একসাথে নাস্তা করতে দেখে ফেলে সাদাত। ঠিক সেখানেই খাওয়ার মাঝ থেকে উঠিয়ে মেয়েটার গালে সজোরে দুটো চ*ড় মারে সাদাত। রাহুল শীতলের বড় হলেও সাদাতের চেয়ে চার বছরের ছোট। বলতে গেলে এই বাড়ির সবচেয়ে কনিষ্ঠ বংশধর শীতল।

শীতল ঘরের ভিতর প্রবেশ করে কোনো দিক না তাকিয়ে কফির মগ টা টেবিলের ওপর রেখে চলে যেতে নেয়। কিন্তু কোত্থেকে যেনো সাদাত এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। শীতল ভয়ে মাথা নিচু করে রাখে।

– আমার দিকে তাকাচ্ছিস না কেনো? ও রা*গ দেখাচ্ছিস, আমাকে রাগ দেখাচ্ছিস? কলিজা এত বড় হয়ে গেছে তোর, এসব কি ওই রাহুলের কুম*ন্ত্রণায় করছিস তাই না।

শীতল কোনো জবাব তো দেয়ই না এমনকি চোখ তুলে ও তাকায় না। লোকটাকে সে মনে প্রাণে ঘৃ*ণা করে। বাড়ির বাকিরা তাকে অপছন্দ করলেও তার মতো অহেতুক অপ*মান করে না।

শীতল এর এমন ঠান্ডা ব্যবহারে সাদাতের ভীষণ রাগ হয়। কিছু না ভেবেই শীতল এর চুলের মুঠি শক্ত করে টেনে ধরে তাকে নিজের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। ব্যথার চোটে শীতল এর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তাতেও সাদাতের রাগ একটুও খ্রান্ত হয়না। বরং নিজেকে সংবরণ না করতে পেরে একটা দাবাং চ*ড় বসায় শীতলের গালে। চড়ের বেগ সামলাতে না পেরে শীতল মাটিতে পড়ে যায়।

– আমার সামনে এলে তোর মুখ ভার হয়ে যায়, কই রাহুলের সাথে তো ঠিকই হেসে হেসে সময় কাটাস। আমার কাছে এলে তোর গায়ে এত জ্বালা ধরে কেনো ? রাহুলের কাছে এত মধু যে বারবার তার কাছেই ছুটে যাস?

শীতল দুই হাতে তার কান চেপে ধরে। নিজের সম্পর্কে এত খারাপ কথা সে সহ্য করতে পারে না। সাদাত সজোরে তার হাত টেনে ধরে। ব্য*থায় আবারো কুঁক*ড়ে উঠে শীতল।

– শোন শা*লি, আজকে বিকালে আমার কিছু বন্ধুরা বাসায় আসব। তুই বিকালের আগেই নিজ রুমের দরজা আটকে বসে থাকবি। আর যদি দেখি তুই রুম থেকে বের হয়ে আমার বন্ধুদের গায়ে ঢ*লাঢলি করছিস, তাহলে তোকে একশো টুকরা করে নদীতে ভাসিয়ে দিবো। আল্লাহ জবান দেয়নি তো কি হয়েছে, রূপ দিয়েছে। ছেলে পটানোর কৌশল তো তোর হাড়ে হাড়ে জানা। যা সর সামনে থেকে, দুর হয়ে যা আমার রুম থেকে, বোবা কোথাকার।

চলবে……………………