অনুভূতির খাঁচা পর্ব-৩+৪

0
21

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ছায়ামূর্তিটা উওর দেয় না। তবে তার নড়াচড়ার আভাস ঠিকই পায় সে। সে এগিয়ে আসে, তার দিকে।

ভয়ে সুরভির বুকের ভেতর থরথর কাঁপতে শুরু করে। জায়গাটা নির্জন। আশেপাশে তেমন কোনো বাড়ি নেই। বিশাল জায়গা ঘিরে কেমন এই মহলের তো শ্বেতভবনটি অবস্থিত। ভূত টূত আবার এলো না তো? না না কি ভাবছে সে? ভয়ে আবারও ঢোক গিলল। কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে তার। জান যেন গলায় আটকে গেছে। সে আবারও ভীত গলায় জিজ্ঞাসা করে, “কে সেখানে?”

আঁধার থেকে বের হয়ে এলো লম্বা চওড়া সে ছায়ামূর্তিটি। যার নাম অভ্র। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরা। হাতে একখানা গ্লাস। অর্ধগ্লাস ভরা পানীয়। তাকে দেখে শান্তির নিশ্বাস ফেললেও যখন বুঝতে পাড়ল তার হাতের গ্লাসে মদ্য আছে তখন তার চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। সে চিকন সুরে প্রশ্ন করে, “আপনি মদ্যপান করছেন? এত রাতে, তাও বাড়ির ভেতরে?”
“তাহলে কী রাস্তায় যেয়ে পান করব?”
“আর ভয়টয় লাগে না? কেউ দেখে ফেললে?”
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
“কেউ দেখলে যখন লাঠি দিয়ে পিটাবে তখন ডোন্ট কেয়ার বের হয়ে যাবে। রাখেন এইসব বাজে জিনিস।”
“ওহ, সাট আপ। আমাকে কারও কিছু বলার সাহস নেই। ইনফ্যাক্ট, কিছু বললে আমি বছরে যে এক দুইবার এখানে আসি তাও বন্ধ করে দিব। একথা তারা জানে।”
“বছরে এক দুইবার আসেন? থাকেন কীভাবে আপনার পরিবার ছাড়া।” অবিশ্বাস্য কন্ঠ সুরভির।
“ওয়েল, অভ্যাসটা তারাই ছুটিয়ে দিয়েছিল। নয়বছর হবার আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল অন্য দেশে। পড়ার জন্য। সো আমার একা থাকারই অভ্যাস আছে।”
কথাটা শুনে সুরভি চমকায়। আরও বেশি চমকাল এই কথাটা বলার সময় অভ্রর কন্ঠে কোনো কষ্টের আভাস না পেয়ে।

অভ্র বলে, “আমার কথা বাদ দেও। তোমার প্রেমিককে নিয়ে কথা বলছিলাম। তোমার প্রেমিক মিথ্যা বলছে না কিন্তু তার ভুলের জন্য তোমাকে গিলটি ফিল করাচ্ছে। ম্যানুপুলেট করছে।”
“সে আমার প্রেমিক না। হবু স্বামী। আর আপনি কীভাবে জানলেন সে মিথ্যা বলছে না।”
“মিটিং এর কথা বলে একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। তারপর তোমার মতো মেয়ের কাছে ধরা খেয়েছে। অফকোর্স বেশি চালাক তো হবে না। আর এত চালাক যেহেতু না, সেহেতু এত কনফিডেন্সের সাথে মিথ্যা বলতে পাড়বে না।”
“আমার মতো মেয়ে মানে?”
“তোমার মতো মেয়ে মানে যার আক্কেল নেই। আক্কেল থাকলে আমার সাথে এত তর্কাতর্কি করার সাহস পেতে না। তুমি জানো চাইলে আমি একদিনের মধ্যে তোমার সবকিছু বরবাদ করে দিতে পারি।”
“ভয় অন্যকাওকে দেখিয়েন। এসব ভয় পাওয়ার মানুষ আমি না।”
বাঁকা হাসে অভ্র। অন্যদিকে ফিরে তার গ্লাসে এক চুমুক দিতেই সুরভি উচ্চস্বরে বলে উঠে, “ওয়েট, আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ব্যক্তিগত কথা শুনলেন কেন?”
“একারণেই বলেছি তুমি যথেষ্ট বোকা। এক তো আমি এখানেই বসে ছিলাম। তুমি এসেছ এখানে। দ্বিতীয়ত একথা তুমি এতক্ষণ বাদে রিলাইজ করলে? রিপোর্টার কে বানাল তোমায়।”
“আমার প্রফেশনাল লাইফে যাবেন না বুঝলেন? এমনিতেই মাথা এলোমেলো তাই বুঝতে দেরি হলো। কাজের কথা বলেন। আপনি ইন্টারভিউর ব্যাপারে কী ভাবলেন?”
“বললাম তো দেখব।”
সুরভি ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকাল। আর বিড়বিড় করে বলল, “ইন্টারভিউর জন্য তো নিজেরও লাভ আছে। এখন কেবল ভাব দেখাচ্ছে।”
“যেখানে পাওয়ার থাকে সেখানে ভাবও থাকে।” অভ্র বলে তাচ্ছিল্য হাসে।
সুরভি তাকায় তার দিকে। হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে জবার দেয়, “ভাব তো তাহলে আমারও নেওয়া উচিত। আপনার বিরুদ্ধে নিউজ রিলিজ করার পাওয়ার আছে আমার কাছে। এতে আপনার রাজনৈতিক জীবনে অনেক ক্ষতি হতে পারে।”
বাঁকা হাসে অভ্র। এগিয়ে আসে সুরভির কাছে। তার চোখে চোখ রেখে রসিকতার সুরে বলে, “আর তোমাকে সে নিউজ চ্যানেল থেকে মুহূর্তে সরানোর পাওয়ার আমার আছে। তুমি আমার সামান্য ক্ষতি করতে পারবে আর আমি তোমার সম্পূর্ণ ক্যারিয়ার শেষ করতে পাড়বো। এটাকে বলে আসল পাওয়ার।”

সুরভি বাকরুদ্ধ হয়ে যায় কথাটি শুনে। সাথে খানিকটা ঘাবড়েও যায়। কিন্তু তা প্রকাশ করে না। সে যেয়ে বসে এক কোণে রাখা সোফায়। যেখানে ক্ষাণিক সময় পূর্বেও বসেছিল অভ্র। বলে, “সভ্য ভাইয়া ও ইনারা আগামীকাল সকালের জন্য ব্যাগ গুছাচ্ছিল। তাদের বিরক্ত করতে চাই না তাই এখানে এলাম। একটুপরই চলে যাব।” আর ফোন দেখতে থাকে।
অভ্র কিছু বলে না। সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক পর। তার হাতে একটি মলম। সে সুরভির পাশে মলমটি রেখে বলে, “পা’য়ে লাগিয়ে নিও।”
সুরভি ফোন চালাচ্ছিল। অভ্র’র কথা শুনে অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে, “আপনি কীভাবে… ”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই বলে অভ্র, “নিজেকে বিশেষ ভাবার প্রয়োজন নেই। সকলের খুঁটিনাটি সবকিছুই খেয়াল করি আমি, নাহয় মানুষের দুর্বলতা কীভাবে খুঁজে পাব।”
সুরভি বিরক্তিতে চোখ ঘুরায়। লোকটার সব কথায় পেঁচাল। সুন্দরভাবে কথা বলতে যেন তার বুকে তীর বিঁধে। সে অভ্রর কথা মাথা থেকে ঝেরে নিজের পা’য়ে মলম লাগাতে শুরু করে।

অভ্র তার পানীয় পান করার সময় তাকিয়ে ছিলো অন্যদিকে। হঠাৎ সুরভির দিকে তাকায় সে। চন্দ্রিমার নম্র জ্যোৎস্নার আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। শুভ্ররঙা একটি সাধারণ সেলোয়ার-কামিজ পরে আছে সে। তার ভেজা কৃষ্ণকেশ দুলে বেড়াচ্ছে তার কাঁধে। সে দেশ বিদেশে হাজারো সুন্দরী মেয়ে দেখেছে। কিন্তু এমন পবিত্রতা কারও মাঝে দেখে নি মনে হয়। হয়তো মদের কারণে নেশা হয়েছে তার।

সুরভি একপলক তাকায় সামনের দিকে। সাথে সাথে অভ্র চোখ সরিয়ে নেয়। জিজ্ঞেস করে, “আমার এক বন্ধু বলতো, মেয়েরা কাওকে পছন্দ করলে তাদের থেকে বিরক্ত হবার মিথ্যে ভান করে। এখন বুঝলাম তোমার আমার সাথে এত কীসের সমস্যা। ইনারা বলল আমার উপর তোমার বিরাট ক্রাশ ছিলো। তাইতো এত বিরক্ত হবার ভান করো। আমার থেকে এটেনশন পাবার জন্য।”
“এই’যে মিস্টার অভদ্র, এই ভুল ধারণায় থাকবেন না। কলেজে জ্ঞানবুদ্ধির অভাব ছিলো বলে আপনাকে পছন্দ করেছিলাম, নাহলে আপনার মধ্যে ভালো লাগার মতো কিছু নেই।”
অভ্র বাঁকা হাসে কথাটা শুনে। তার এলকোহলের গ্লাসটা ব্যালকনির বর্ডারে রেখে এগোয় সুরভির দিকে। তার সামনে যেয়ে ঝুঁকে দাঁড়ায়৷ তার কাছাকাছি চলে আসে। সুরভির পিছনের দেয়ালেই ছিলো বাতির সুইচ। তা জ্বলাতেই সারা বারান্দায় আলোর ঝিলমিল খেলে।

ঘাবড়ে যায় সুরভি। কী বিব্রতকর অবস্থা! সে পিছন দিকে ঝুঁকে যায়। ঘাবড়ানো স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কী করছেন আপনি?”
“ভালো করে দেখো তো, সত্যিই ভালো লাগার মতো কিছু নেই আমার মাঝে?”
অভ্রকে হঠাৎ এতটা কাছে দেখে এক মুহূর্তের জন্য তার নিশ্বাস আটকে আসে। সে ঢোক গিলে। অভ্র তার দিকে হাত এগোতেই সে ঘাবড়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। “ভালো…ভালো হচ্ছে না কিন্তু।” কাঁপানো সুরে বলে। পরক্ষণে সুইচের শব্দ পেয়ে ধীরে ধীরে চোখের পলক তুলে সে। তখনও তার ভীষণ কাছে। অভ্র আবারও বলে, “ভালো করে দেখো তো।”
সুরভির ভালো করেও দেখার প্রয়োজন পড়ে না। অভ্রর মতো সুদর্শন পুরুষের খবর যখন প্রথম নিউজপেপারে এসেছিল তখন কলেজের সকলেই তার ছবি দেখে প্রেমে পড়েছিল। সকলের একসময়ের ক্রাশ ছিলো সে। ফর্সা বর্ণা দেহের রঙ, বড় বড় চোখ, চেহেরার চমৎকার গড়ল এবং সুঠাম দেহ। কিন্তু তার প্রধান আকর্ষণ ছিলো তার ধূসর রঙা চোখ। খবরের কাগজে বা ম্যাগাজিনে তার চোখগুলো সুন্দর লাগলেও বাস্তবের তুলনায় সে ছবিগুলো ভীষণ তুচ্ছ। ছবির তুলনায় বাস্তবে হাজারোগুণ বেশি সুদর্শন লোকটা। তাকে এত কাছ থেকে দেখে সুরভি লজ্জা পেয়ে যায়। গাল দুটো লালচে হয়ে আসে। কিন্তু কিশোরী বয়সে চেহেরা দেখে পছন্দ করাটা নিছক বাচ্চামো ছিলো। সে নিজেকে সংযত করে অভ্রর কাঁধে হাত রেখে তাকে দূরে সরায়। বলে, “আমার কাছে আসবেন না, ওয়ার্নিং দিচ্ছি।”
“আচ্ছা, আসলে কী করবে শুনি?”
মৃদু হাওয়া ছুটে আসে। এসে ছুঁয়ে যায় তাদেরকে। সুরভির ভেজা চুলগুলো উড়ে বেড়ায়। আলতো করে ছুঁয়ে যায় অভ্রর মুখখানা। অদ্ভুত মিষ্টি এক সুবাসে ভরে যায় তার নিশ্বাস। সে খুশবুতে এক মাতোয়ারা ভাব আছে। যা এই রাত্রিকে মাতাল করে তুলে। নয়নে নয়ন মিলে। হয় নয়ন বন্ধন। এই মিষ্টি রাতের বাতাসে কিছু একটা ছিলো। অদ্ভুত কিছু।

আচমকায় সুরভি লাথি মারে অভ্রর পা’য়ে। অভ্রর ঘোর ভাঙে ভীষণ বাজেভাবে। সে চোখ বন্ধ করে ব্যাথা সহ্য করতে ঢোক গিলে। তারপর বড় এক নিশ্বাস ফেলে। সে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “ব্রেইনলেস মেয়ে এভাবে কেউ মারে? স্টুপিড।”
“আপনি স্টুপিড, ফাজিল, অভদ্র। এভাবে কেউ অচেনা মেয়ের কাছে আসে? নিলজ্জ!”
“নিজেকে বিশেষ ভাবার দরকার নেই। তোমার থেকে হাজারো সুন্দরী মেয়েরা আমাকে প্রাপোজ করেছে। আমি তো যাস্ট তোমাকে আমার চেহেরাটা ভালো করে দেখতে বললাম। আমার চেহেরায় না’কি ভালো লাগার মতো কিছু নেই। মেয়েরা মরে এই চেহেরায়।”
“তাদের রুচি এত খারাপ। আপনার বান্দরের মতো চেহেরার উপর মরে? আহারে তাদের রুচি এত খারাপ?” আফসোসের সুরে বলে সুরভী।
“ওহ প্লিজ তোমার কাকের মতো গলায় ক্যাঁক্যাঁ শোনার মোটেও ইচ্ছা নেই আমার।” অভ্র সবসময়ের মতো শান্ত সুরেই বলে। কিন্তু সুরভির স্বর উচ্চতর, “এই কথা মোটেও বলবেন না খবরদার।”

তাদের কন্ঠ শুনে ইনারা ও সভ্য উপস্থিত হয় সেখানে। তারা হতবাক দুইজনকে এভাবে ঝগড়া করতে দেখে। ইনারা সভ্যের দিকে ঝুঁকে বলে, “এভাবে তো ঝগড়া করার কোটা আমার। সুরভিকে কলেজে শিখিয়েছিলাম কিন্তু এতবছর পর এপ্লাই করবে, তাও আমার শশুড়বাড়িতেই বুঝি নি।”
সভ্য আড়চোখে তাকায় তার দিকে, “ওকে থামাও। অভ্র ভাইয়া শান্ত মাথার মানুষ। তার রাগ খুব কম। কিন্তু একবার রাগ উঠলে সামনের জনের জীবন শেষ করে দিতে পারে।”
“এটা কোন ধরনের কথা? আমার বান্ধবীর একটা ক্ষতি করলে আপনার ভাইকে আমি রেহাই দিব? বুঝিয়ে দিবেন আপনার ভাইকে।”
“ভাইয়াকে কেউ, কখনো, কোনোভাবেই বুঝাতে পারে না। সে যা করে নিজের মন অনুযায়ী করে। তার মাথা নষ্ট হলে আমারও কিছু করার ক্ষমতা নেই। সে শান্ত মাথায় কি করতে পারে তার ধারণা তোমার আছে। তো তার মেজাজ খারাপ হলে সে কি করবে বুঝে নেও।”
একথা শুনে খানিকটা ঘাবড়ায় ইনারা। দ্রুত যায় সুরভির কাছে। তাকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় রুমে। সুরভি বলতে থাকে, “তুই আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছিস? নিজের ভাসুরকে কিছু বল। আমার কন্ঠ না-কি কাকের মতো। সাহস কত বড়। কলেজে যেমন কেউ আমাকে কিছু বললে তাকে মাইর দিতি উনাকেও দিয়ে শিক্ষা দে।”
ইনারা তার কথার তোয়াক্কা না করে টানতে টানতে নিয়ে যায় সুরভিকে সেখান থেকে।

সভ্য তার ভাইয়ের পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। বলে, “ভাইয়া মাইন্ড করো না। আমার বউয়ের সাথে থাকার সঙ্গদোষ। এমনি তোমরা একসাথে এইখানে কী করছ?”
“আমি ড্রিংক করছিলাম। ওই এলো।”
“ড্রিংক করছিলে?” সভ্য হতবাক সুরে বলে, “দাদাজান দেখে নিলে।”
“আই ডোন্ট কেয়ার।” সে আবারও ব্যালকনির বর্ডারের কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। হাতে গ্লাসটি নিয়ে একচুমুক দেয়। সভ্য আবারও তার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়, “ভাইয়া তুমি তো সবসময়ের মতোই কুল। ভাইয়া শুনো না, আমি একটা সিপ নিয়ে দেখব?”
অভ্র তার দিকে তাকায়। হেসে বলে, “ট্রাই করবি?”
সভ্য মাথা নাড়ায় আর অভ্র তার মাথায় টোকা মারে জোরে, “লজ্জা লাগে না খাবার জন্য নিজের বড় ভাইয়ের কাছে এলকোহল চাচ্ছিস? ছোট ছোটর মতো থাক। এসব বাজে জিনিসের দিকে নজর দিলেও চোখ উঠায় নিব।”
“তুমি তো পান করছ।”
“তো কি? আমি তোর বড়ভাই।”
“আমি কেবল দুই বছরের ছোট ভাইয়া। আর তোমার আগে আমার বিয়েও হয়ে গেছে।”
“সাট আপ।” অভ্র ধমকের সুরে বলে চলে গেল সেখান থেকে। তার যাবার পর সভ্য বলে, “এত বড় মিউজিসিয়ান এবং কোম্পানির পরিচালক আমি। কিন্তু ঘরে কারও থেকে দুইপয়সার সম্মান পেলাম না। জীবনটা বেদনাদায়ক।
.
.
সুরভি সকালে উঠে জানতে পায় অভ্র ভোরেই চলে গেছে বাড়ি থেকে। তারাও সকাল সকাল বেরিয়ে যায়। সভ্য ও ইনারাকে এয়ারপোর্টে রেখে সুরভি যায় অফিসে। অফিসে যেতেই তার ডাক পড়ে আহনাফের রুমে। রুমে ঢোকার পূর্বে প্রতিবারের মতোই নক করে সুরভি, “স্যার আসবো?”
কিন্তু এইবার আহনাফ তার কন্ঠ শুনে দ্রুত উঠে যায় তার কাছে। তার হাত ধরে কেবিনের ভেতর এনে চিন্তিত সুরে বলে, “তুমি আমার কল ধরো নি কেন? এতবার দিলাম, একটিবার তো কল ধরে আমার কথা শুনতে পাড়তে। বিধির সাথে গতকাল দেখা করতে গিয়েছিলাম কারণ…”

“কারণ আমি শুনেছি,” সুরভি বলে কাঠ কাঠ গলায়, “কিন্তু এখনো বুঝতে পাড়ছি না আপনি আমাকে মিথ্যা বললেন কেন? কেন বললেন আপনি মিটিং এ যাচ্ছেন যখন আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন।”
“তুমি শুনে একথা কীভাবে বলতে পারো। ওর সাহায্যের দরকার ছিলো জেনেও তুমি…” সুরভি তার কথা কেটে বলে, “একথা আমি আগেও জানতে পাড়তাম। আর আগে জানলে এতকিছু হতো না। দোষ আমার উপর চাপাতে আসবেন না যে আমি ইনসেন্টিভ তাই এমন ব্যবহার করছি। আপনি মিথ্যা বলেছেন। তার না মেনে আমাকে দোষারোপ করতে আসবেন না।”
“তুমি কি বলছ সুরভি, আমি তোমাকে দোষারোপ কেন করব? দোষ আমি করেছি, মানছি। তার জন্য সরিও বলছি। তুমি বললে আর বিধির সাথে আমি দেখা করব না। আই প্রমিজ।”
সুরভি তার হাত ছাড়িয়ে নেয়, “অভ্রর সাথে কথা হয়েছে। সে বলেছে ভাববে ইন্টারভিউর ব্যাপারে। আমার কাজ আছে। আমি যাচ্ছি।”
সে যেতে নিলেই আহনাফ তার হাত ধরে নেয়। কাছে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে, “সুরভি প্লিজ এভাবে রাগ করে থেকো না। তোমার সাথে কথা না বললে আমার দম আটকে আসে। তোমার উপেক্ষা আমার সহ্য হয় না।”
“কেন? আমাকে ভালোবাসেন?”
প্রশ্নটা শুনে আহনাফ তাকে ছেড়ে দিলো। সুরভি আবারও প্রশ্ন করে, “আপনি কী আমাকে ভালোবাসেন?”
“জানি না। আমি তোমাকে আগেও বলেছি যে…”
“যে আপনি বিধিকে ভালোবাসতেন। আবার কাওকে ভালোবাসতে পাড়বেন কি-না সন্দেহ। আর সেই বিধির সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলেন আপনি। আমাকে মিথ্যা বলে। এখন আমার থেকে আশা করছেন আমি আপনাকে এত সহজে ক্ষমা করে দিব? আপনার সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক নেই, কিন্তু সম্পর্ক তো আছে। ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্ক টিকতে পারে, বিশ্বাস ছাড়া না।”
“সুরভি…” আহনাফ তাকে ডাক দেয়। কিন্তু সুরভি আর কিছু শুনে না বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। বের হবার পর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার বাহিরে। তার বুকের ভেতর কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে। ব্যাথা করছে। নিজ অজান্তেই তার চক্ষু দিয়ে জলের ধারা বইতে শুরু করে।
.
.
অভ্র তার চেয়ারে বসে কাজ করছিলেন। এমন সময় তার সহকারী ফজলু মিয়া বলে, “অভ্র ভাই জানি আমনার সিদ্ধান্ত হয় সব বাছা, কিন্তু বুঝলাম না আপনে কিল্লাই কইলেন বিয়ের জন্য হো, কন তো হাছা হাছা।”
“ফজলু তুমি জানো, নিজের লাভ ছাড়া আমি কিছুই করি না। আপাতত আমি দল পরিবর্তন করলেও তিন বছর পরের ইলেকশনে নিজের দলের প্রধান হয়ে দাঁড়াতে চাই। একারণে দাদাজানের কাছে সাহায্য চাইতে হয়েছে। কিন্তু সে প্রতিবারের মতো নিজের স্বার্থ বুঝে শর্ত দিলো। তার প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। আমার কী? বিয়েরই তো, করে নিব। আমার তো টাকা থেকে মতলব। তাই হ্যাঁ বলে দিয়েছি। দাদাজান বলেছে আমার যত ফান্ড লাগবে, উনি দিবেন।”
“এল্লাইগা আমনে জীবনডা বিসর্জনে দিবেন, হায় খোদা, হায় খোদা।”
“চুপ করে আর এন.আই চ্যানেলে কল করে জানাও আমি ইন্টারভিউ দিতে রাজি। আজ রাতে বাসায় এসে যেন আমার সাথে ইন্টারভিউ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলে যায়। আর হ্যাঁ, যেন সুরভীই আসে এখানে। অন্যকাওকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।”
“সুরভী…এই সুরভী কেডা ভাইজান
অভ্র হাসে, বলে, “আছে একটা মেয়ে। ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টর। ওর সাথে কথা বলে মজার টাইমপাস হয় আমার।”
.
.
জোহান আজ কিছুতেই দেরি করতে চায় না অফিসে যাবার জন্য। আজ তার চৌধুরী কোম্পানিতে যেতে হবে। সাক্ষাৎকারের পরই চুক্তি সাইন করা হবে। শুনেছে মায়া চৌধুরী দেরিতে আসা লোকেদেরও সহ্য করতে পারে না। তার অধীনে সকল কাজ সঠিক এবং সময়ে হওয়া চাই। জোহান কারও সামনে ইম্প্রেশন খারাপ করতে চায় না। বিশেষ করে কোম্পানির মালিকদের সামনে। জীবনের এই নতুন যাত্রায় তার প্রতিটি পদক্ষেপ যত্নসহকারে নিতে হবে। তাইতো সময়ের পূর্বেই রওনা দেয় সে। কিন্তু তার ভাগ্যটাই খারাপ। রাস্তায় বিশাল এক ট্রাফিকে আটকায় সে। প্রায় এক ঘন্টা সেখানেই আটকে থাকা। অবশেষে দেখতে পায় পনেরোমিনিট বাকি দশটা বাজার। তখন সে মাস্ক পড়ে নেমে যায় গাড়ি থেকে। দৌড়ে যেতে থাকে। কিন্তু তার শরীর অবস্থাও তেমন ভালো না। ক’দিন আগের এক্সিডেন্টে এখন তার বেডরেস্ট করবার কথা অথচ সে এভাবে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করছে। কি করবে? মাথা ঘুরাতে শুরু করে। সে মাঝ রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু থামা তো যাবে না। এই সুযোগ সে হাতছাড়া করবে না। এখন আর কিছু চাইতেই অর্জন করতে চায় না সে। পরিশ্রম করে নিজের যোগ্যতায় পেতে চায়।

একটি বাইক দেখে সে হাত নেড়ে থামায়। বাইকটা থামেও। সে বাইকটার কাছে যেয়ে, “ভাই আমার একটু জরুরী কাজে এক স্থানে যেতে হবে। প্লিজ ভাই, একটু লিফট দিন। আমি গায়ক জোহান, ” সে মাস্ক খুলে দেখায় বাইকে বসা মানুষটাকে। আবার বলে, “একটি কোম্পানির মিটিং আছে। আর শুনেছি যার সাথে মিটিং তার নাকের ডগায় সারাক্ষণ রাগ বিরাজ করে। আমার এক বন্ধু তো বলেছে কোম্পানির সকলে না’কি রাক্ষুসি বলে ডাকে। কারও উপর মায়া দেখায় না। তাই আমার অবস্থা বুঝেন। দয়া করেন, একটু গন্তব্যে পৌঁছে দিন।”
মানুষটা তাকে ইশারা দিয়ে বাইকে বসতে বলে এবং চালু করে বাইক। হাওয়ার বেগে চালায় বাইক। দশমিনিটে কোম্পানির সামনে নিয়ে আসে। জোহান বাইক থেকে নেমে বলে, “থ্যাংকস ব্রো, আপনার উপকার আমি কখনো ভুলবো না। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসি আমি। আবারও অনেক ধন্যবাদ ।”
সে দেখে সাইদ তার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে প্রবেশপথের সামনে। সে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠতে শুরু করে। সাইদ চিন্তিত সুরে বলে, “এত দেরি হলো কেন? ভাগ্যিস মায়া চৌধুরী আসে নি, নাহলে এই কোম্পানির ডিল যেত।”
“আরে ট্রাফিকে আটকিয়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস এই বাইকের লোকটাকে পেলাম। এত ভালো, একবার বলাতেই…ওয়েট আমি উনাকে বলিনি যে এখানে আসবো তাহলে কীভাবে….” তখনই সিকিউরিটিগার্ড কন্ঠ শোনা যায়, “আরে মায়া ম্যাডাম এসে পড়েছে। তোরা প্রবেশপথের খেয়াল রাখ, আমি ম্যাডামের বাইক পার্ক করে আসি।”
জোহান অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার পাশ দিয়ে যাওয়া সিকিউরিটিগার্ডকে। তারপর তাকায় পিছনে। দেখল ক্ষাণিক সময়ে সে যে বাইক দিয়ে এলো সে বাইকের কাছেই যাচ্ছে সিকিউরিটি গার্ড।

বাইকে বসা ব্যক্তিটা তার হেলমেট খুলল। হেলমেট খুলতেই অতিসুন্দর এক কন্যার দর্শন পাওয়া গেল। ঝরঝরে পড়ল তার কেশ কাঁধ ছড়িয়ে গেল। উপরের ব্লেজার খুলে নিলো। হেলমেট ও ব্লেজারটা সিকিউরিটি গার্ডের কাছে দিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে সে। তীক্ষ্ণ তার চক্ষু, ধারালো মুখের গঠন। সোজা সোনালী ভাবের চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত আসে। সে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় একদৃষ্টি তাকাল জোহানের দিকে। তীক্ষ্ণ সে চাহনি। জোহান তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। অবাক দৃষ্টিতে। এতটা পথ সে এক মেয়ের বাইকের পিছনে বসে এসেছিল অথচ একটিবারও বুঝল না? সে বুঝেছিল কোনো প্রফেশনাল রাইডার। এতটা ভালো বাইক চালায়। আর সে-ই মায়া চৌধুরী, এই কোম্পানির পরিচালক।

সাইদের কথায় ধ্যান ভাঙে তার, “ব্রো দাঁড়িয়ে আছো কেন? জলদি চলো।”
জোহান মাথা নাড়ায়। সাইদের পিছনে কোম্পনির ভেতর ঢুকে। হঠাৎ তার মনে পড়ে বাইকে উঠার পূর্বে সে বলেছিল, “শুনেছি যার সাথে মিটিং তার নাকের ডগায় সারাক্ষণ রাগ বিরাজ করে। আমার এক বন্ধু তো বলেছে কোম্পানির সকলে না’কি রাক্ষুসি বলে ডাকে।” সাথে সাথে নিজের কপালে হাত রাখে জোহান। আজ গেছে এই অফার তার হাত থেকে। ভেতরে যেয়ে সাক্ষাৎ এর সময় তার কি হবে ভাবতেই নিজের উপর রাগ উঠল তার।

চলবে….

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জোহানের ডাক পড়ে। সে সাহস জোগাড় করে ঢুকে কক্ষে। ভেবেছিল মায়ার সাথে আরও কিছু সদস্য থাকবে তার সাথে কথা বলার সময়। সব জায়গায় এমনই দেখে সে। কিন্তু এখানে মায়া একা বসা। সাদা রঙের টপসের সাথে লাল রঙের ব্লেজার পরা। চোখে টানা কাজল দেওয়া এবং ঠোঁটে লাল রঙের লিপ্সটিক। হাতে সোনালী রঙের ঘড়ি এবং চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো। মায়া চৌধুরীর সৌন্দর্যের গুনগান সে আগেও শুনেছিল। আজ দেখেও নিলো।
জোহান ভেতরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসে, “হ্যালো।”
মায়ার নজর ছিলো ফাইলের দিকে। সে চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় জোহানের দিকে। সরাসরি প্রশ্ন করে, “মিস্টার জোহান আপনি কাজ করছেন কয়বছর হয়েছে?”
“মানে গানের কাজ?”
“আচ্ছা কাজের কথা বাদ দিন, স্কুলে পড়েছেন?”
“অফকোর্স। এটা কেমন প্রশ্ন? অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়ে এসেছি আমি।”
“তবুও আদব শিখলেন না? সো স্যাড!”
“কী বলছেন আপনি এসব?”
“উঠে দরজার বাহিরে যান এবং জিজ্ঞেস করুন, ‘আসতে পারি?’ তারপর আপনি ভেতরে আসবেন। আমি আপনাকে বসতে বললে বসবেন।”
এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তার সামনে বসা মেয়েটা এই কথায় আসবে সে ভাবতেও পারে নি। খানিকটা বিরক্ত লাগে তার। সে উওর দেয়, “আপনার এত সময় বাঁচালাম, আমাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত।”
“আমাদের কোম্পানির আন্ডারের তারকাদের প্রথমে ভদ্রতা শিখা উচিত।”
জোহানের বিরক্তি লাগলেও উঠতে হলো কিন্তু মায়া বলল, “আচ্ছা বসুন, আমার কাছে এত সময় নেই।”
মেয়েটা কী পাগল না’কি? একবার এক কথা বলে কেন?

মায়া প্রশ্ন করে, “আপনি আমাদের কোম্পানি কেন জয়েন করতে চান?”
“আপনারা আমাকে অফার পাঠিয়েছিলেন সেখানে আমার সবই ভালো লেগেছিল। আর আপনাদের কোম্পানি দ্রুত সাফল্য অর্জন করছে তাই।”
“এছাড়া আপনাকে অন্যকোনো বড় কোম্পানি অফার দেয় নি। ইসমাত কোম্পানির সাব-ইউনিট ছাড়া। ইসমাত কোম্পানি আপনার বন্ধুর, যার দয়ায় আপনি কাজ করতে চান না। ইম্প্রেসিভ। এমন মানুষ পরিশ্রম বেশি করে।”
“আপনি এসব কীভাবে জানেন?” বিস্মিত সুরে বলে জোহান।
“সব জায়গারই খোঁজ রাখতে হয়। আর কিছু বিষয়ে নিজের বুদ্ধির প্রয়োগ করতে হয়। আমাকে একটি গান শুনান।”
“এক্সকিউজ মি, আপনাকে গান কেন শুনাব?”
“আপনি এখানে আমার সাথে প্রেম করতে এসেছেন?”
“কি বলছেন যা তা?”
“আপনাকে প্রেম করে শুনাতে বলিনি। আপনাকে আমার কোম্পানির আন্ডারে রাখব, সব সুবিধা দিব, আপনার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ চলছে তাও সামলাব। এর পূর্বে দেখতে হবে তো আপনার দৌড় কতদূরে। আমার ইনভেস্ট করার পূর্বে আপনার যোগ্যতা যাচাই করতে হবে।”
“আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমি দশবছরের বেশি এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছি। দেশের সবচেয়ে বড় গায়ক হিসেবে পরিচিত আমি। আপনি এখানে আমার অডিশন নিবেন?”
“আপনার এক্সপিরিয়েন্স যত বছরেরই হোক, কাজ তো আমার অধীনেই করছেন। তাই আমার হিসেবে কাজ করতে হবে। আপনি গান গাইলে গাইতে পারেন, নাহলে দরজা সামনে আছে। আমার সময় নষ্ট না করে যেতে পারেন। আমার সাথে কাজ করলে সব শুরু থেকে করতে হবে।”
জোহান কিছু সময় নেয় ভাবার জন্য এরপর রাজি হয় মায়ার কথায়। চোখ বন্ধ করে, গিটার কোলে নেয়, গিটারের তালের সাথে মধুর সুর মেলায়,

যে পাখি ঘর বোঝেনা উড়ে বেড়ায় বন বাদাড়ে
ভোলা মন মিছে কেন মনের খাঁচায় রাখিস তারে?
ও পাখি বাঁধন হারা ছন্নছাড়া, বাঁধন হারা,
মানেনা প্রেমের শিকল
ও পাখি দশ দুয়ারে, শত মন করে দখল
যে পাখি র বোঝেনা
যে পাখি ঘর বোঝেনাআআ……

গানের মাঝেই কাশতে শুরু করে সে। মায়া তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। জোহানেরও তার প্রয়োজন ছিলো। বোধহয় গানের পূর্বে একটু পানি খেয়ে আরও ভালো গান গাইতে পাড়তো। সে পানির গ্লাসে চুমুক দিতেই মায়া জিজ্ঞেস করে, “তো আপনার কোনো বন্ধু আমাকে রাক্ষুসি বলেছে।”
প্রশ্নটা শুনেতেই জোহানের নাকে মুখে পানি উঠে যায়। সে পানির গ্লাস রেখে আরও কাশতে শুরু করে। নিজেকে সামলে তাকায় মায়ার দিকে, “সরি?”
“আপনার কোন বন্ধু বলেছ আমি রাক্ষুসি।”
“না না, কোনো বন্ধু বলে নি। ও শুনেছিল কোম্পানির সকলে বলে।”
“তাহলে তো সকলের সাথে সেরকম ব্যবহার করতে হয়। এত সুন্দর নাম দিয়েছে নামের মর্যাদা তো রাখতেই হবে। যাই হোক, আপনার গান শুনলাম। আপনার গলার স্বর ও গান গাইবার ধরণ দুইটাই সুন্দর কিন্তু কিছু জায়গায় আরও ট্রেনিং প্রয়োজন। আপনাকে প্রথম দুইমাস ট্রেনিং দেবার পর এলবাম রিলিজ করা হবে।”
কথাটা শুনে চটে যায় জোহান, “আমি কত বড় মিউজিক স্কুল থেকে ট্রেনিং নিয়েছি আপনি জানেন? অনেক বড় বড় গায়কের কাছ থেকে গানের টেকনিক শিখেছি আমি।”
মায়া ছোট এক নিশ্বাস ফেলে। আবার নিজের কাজের ফাইল খুলে বলে, “তাহলে আসতে পারেন। যে মানুষ নিজের কমতি স্বীকার না করে নিজেকে সব দিক থেকে পার্ফেক্ট ভাবে সে মানুষের সাথে কাজ করা যায় না। কারণ সে মানুষের মাঝে সুপিরিয়র কমপ্লেক্স এসে পড়ে। নতুন কিছু শিখলে আপনি ছোট হয়ে যান না উল্টো আপনার জ্ঞানের ভাণ্ডার বাড়ে। সফল ব্যক্তিরা যত জ্ঞান অর্জন করে ততই তাদের কম মনে হয়। শিল্পের ক্ষেত্রেও তাই। যে মানুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে বুকে অহং পালন করে সে নতুন কিছু শেখার যোগ্য নয়।”
“আমি রাজি।”
মায়া চোখ তুলে তাকায় জোহানের দিকে, “কী বললেন?”
“আমি রাজি। আপনি ঠিক বলছেন। নিজের কমতিগুলো স্বীকার করলে আমি ছোট হয়ে যাব না। উল্টো তা শোধরাতে পাড়ব।”
“গুড, তাহলে আমি চুক্তির কাগজ পাঠিয়ে দিব। আপনার পড়ে ঠিক মনে হলে স্বাক্ষর করে দিবেন। ভবিষ্যতে একসাথে ভালো কাজ করতে পাড়ব আশা করি।”
সে উঠে হাত বাড়ায় জোহানের দিকে। হাত মেলানোর পূর্বে জোহান একটি শর্তই রাখে, “কেবল আমার একটি শর্ত আছে। আমার আগের ম্যানেজারই আমার সাথে এই কোম্পানিতে আসবে।”
“আই ডোন্ট কেয়ার। ভালোই হবে। নাহলে নতুন ম্যানেজার খুঁজে এমনিতেই আমার সময় নষ্ট হবে।”
জোহান হেসে হ্যান্ডশেক করে। তারপর বেরিয়ে যায়। বের হবার পর সাইদ অস্থির সুরে জিজ্ঞেস করে, “মিটিং কেমন হলো?”
“জলদিই জয়েন করছি।”
“গ্রেট। কনগ্রেটস ব্রো।”
“থ্যাঙ্কিউ। মায়ার নামে এতকিছু বললে কিন্তু ওকে এত খারাপ মনে হলো না তো।” হঠাৎ তার কিছু একটা মনে পড়ে। সে বলে, “হায় খোদা, গিটার তো কেবিনেই রেখে এসেছি আমি। তুমি দাঁড়াও আমি এক্ষুনি নিয়ে আসি।”
জোহান কেবিনের দিমে আবার ফিরে যায়। দেখে একটি লোক তার পূর্বেই কেবিনে ঢুকে গেছে। দরজায় টোকা দিতে নিবে তখনই লোকটার কন্ঠ শুনতে পায়,
“মায়া তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? জোহানের নামে কতকিছু চলছে এসব জেনেও ওকে আমাদের কোম্পানিতে কীভাবে আনতে পারিস? ওর বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, ওদের কোম্পানি ব্যাঙ্করাপ্ট হয়ে গেছে, জনগণ ওর উপর রেগে আছে। ওর ক্যারিয়ারে ফুলস্টপ লেগে গেছে। এরপরও আমাদের কোম্পানির সাথে ওর নাম যুক্ত করছিস?”
মায়া স্বাভাবিক স্বরেই উওর দেয়, “পাপা তুমি রিটায়ার হয়ে গেছো। এই কোম্পানির চিন্তা এখন আমাকেই করতে দেও।”
“মায়া ভুলে যাবি না এই কোম্পানি আমি শুরু করেছি। আর আমি মেজর শেয়ারহোল্ডারও। আমার সিদ্ধান্ত তোকে মানতে হবে।”
“পাপা, আমি কেবল নিজের সিদ্ধান্ত মানি। অন্যকারো না। তুমি আসতে পারো।”
চৌধুরী সাহেব বিরক্তির সুরে বলে, “আমি ভেবেছি এতবছর দেশের বাহিরে থেকে একটু তো শুধরাবি, কিন্তু না। আরও বাজে ব্যবহার হয়েছে তোর। ছোট থেকেই নিজের মনের করেছিস। কারও কোনো কথা শুনিস না। তোর এই ব্যবহারে কারণে কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে আমার। তোর কারণে আর একবার আমার অপমান হলে নিজের মেয়ে বলেও স্বীকার করব না। নিজের ভাইবোন থেকে কিছু তো শিখতে পারিস।”

মায়া হেসে উঠে আসে চেয়ার থেকে। টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে বলে, “কার থেকে কী শিখবো পাপা? আই মিন কে এমন কি করে উল্টায় ফেলছে যে আমার শিখতে হবে। আর করলে তারা আমার স্থানে নেই কেন?”
“কারণ আমি তোকে এই স্থান দিয়েছি। ওদের না।”
“পাপা এমন মশকরা করো না তো। হাসিও আসে না। আমি এখানে আমার যোগ্যতায় আছি। তোমরা তো সবসময়ই আমার থেকে কেবল বিরক্ত হয়েছ। আমাকে এত দূরে রেখেছ। বড় মেয়ে তোমার কলিজার টুকরো আর ছোট মেয়ে মা’য়ের। আর ভাই তো তোমাদের চোখের মণি। আমি কখনো তোমাদের ফ্যামিলি পোট্রের্টে ফিটই হই নি। বিগত পাঁচ বছর আমি যুদ্ধ করেছি, দিনরাত পরিশ্রম করেছি তার পরিণাম হলো আমার এই পজিশন। এই চাকরি একবার ছাড়লে বড় থেকে বড় কোম্পানিতে নিমিষেই ঢুকতে পাড়ব আমি। ওটা তো তুমি আমার পাপা বলে তোমার কথার মান রেখে এসেছি, আর এই প্রতিষ্ঠানকে ছয়মাসে এমন এক স্থানে নিয়েছি যা তুমি সারাজীবনে নিতে পারো নি। তাই আমার সিদ্ধান্তে সন্দেহ করো না। যেতে পারো, আমার কাছে নষ্ট করার মতো এত সময় নেই।”
“বেয়াদবির একটা সীমা থাকে। তোর ভাইবোনদের কাছে অন্যকিছু না, কেবল আদবটাই শিখে নিতে পারিস। নিজের পরিবারের কথা একবার চিন্তা করলে বিশেষ ক্ষতি হয়ে যাবে না।” চৌধুরী সাহেব রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে যায়।

মায়া তার যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। হতাশার নিশ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “যখন আদব দেখিয়েছিলাম তখন কেবল অবজ্ঞা পেয়েছি। তখন কেউ আমার কথা চিন্তা করে নি, একা ছেড়ে দিয়েছিল, এখন আমি কেন করব?”

দরজা থেকে বের হয়েই মুখোমুখি হয় জোহান এবং চৌধুরী সাহেব। চৌধুরী সাহেবকে দেখে বিব্রত হয়ে যায় জোহান। চৌধুরী সাহেবকে সে চিনে। ইন্ডাস্ট্রি থেকে বলে বহুবার দেখা হয়েছে পূর্বে। কিন্তু ক্ষাণিক সময়ের পূর্বের কথাগুলো শুনার পর কথা বলতেই কেমন লজ্জা লাগছে তার। যদি চৌধুরী সাহেব বুঝে যায় সে সকল কথা শুনে নিয়েছে? সে কৃত্রিম হেসে সালাম দেয়। কিন্তু চৌধুরী সাহেব তাকে এড়িয়ে চলে যায় সেখান থেকে।
জোহান অনুমতি নিয়ে কেবিনের ভেতরে ঢুকে দেখে মায়া কাজ করছে। সে গিটার নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। যাবার পূর্বে একটিবার মুখ ফিরিয়ে দেখে নেয় মায়াকে। কিছু মুহূর্ত পূর্বের কথোপকথনের পর সে এত স্বাভাবিক থাকে কীভাবে?
.
.
অভ্রর এপার্টমেন্টের বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুরভি ও তাইফা। ফজলু মিয়ার তাদের নিতে আসার কথা। অনুমতি ছাড়া কাওকেই এপার্টমেন্টে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তারা দুইজন প্রায় দশমিনিট হবে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। কল দেবার পরও আসার খবর নেই। তাইফা সুরভির পাশে দাঁড়িয়ে তার মেকাপ ঠিক করছিল। জিজ্ঞেস করল, “এই সুরভি আমাকে দেখ তো, সুন্দর লাগছে?”
সুরভি হাসে, “মনে হচ্ছে আজই তোর বিয়ে। এত সেজেছিস কোন দুঃখে?”
“সেজেছি? আমি যদি জানতাম আজ অভ্র…মিস্টার অভ্রর সাথে দেখা করতে আসব তাহলে একসাপ্তাহ আগের থেকে পার্লারে বসে থাকতাম। উনার উপর আমার কতবছর ধরে ক্রাশ আছে তুই বুঝবি না। উনার সামনে যেয়ে আমি হার্ট অ্যাটাক না করে বসি।”
“উনি এতও স্পেশাল না।”
“হ্যান্ডসাম আছে, একথা অস্বীকার করতেই পাড়বি না।”
সুরভির গতরাতের কথা মনে পড়ে। অভ্রকে এতটা কাছ থেকে দেখেছে সে। তার সৌন্দর্যর কথা অস্বীকার করার মতো নয়। সে আনমনেই বলে ফেলে, “হ্যান্ডসাম তো আছে। ছবি থেকে সামনা-সামনি বেশি হ্যান্ডসাম।”
“বলিস কী সত্যি? আর তুই তার প্রশংসা করছিস মানে আসলেই খুব স্পেশাল।”

ফজলু মিয়া এসে তাদের নিয়ে যায় উপরে। আটতলায়। ঘরের ভেতরের আসবাবপত্র সাধারণ। হাল্কা রঙের। অথচ প্রতিটি দেয়ালে রঙিন চিত্র দিয়ে ভরা। ড্রইংরুমের সোফায় বসে অপেক্ষা করে তারা আর ফজলু মিয়ার অহেতুক কথাবার্তা শুনে। তার সকল কথায় কেবল অভ্রর প্রশংসা। তার সাথে তাল মেলায় তাইফাও। দুইজনের মাঝে ভালোই কথা হয় কেবল চুপচাপ বসে থাকে সুরভি। সে দেখছিল সে চিত্রগুলো। তার মনে হলো প্রতিটি চিত্রের মাঝে কোনো বার্তা লুকানো, অথচ কোনোটিই সে ধরতে পাড়ল না। সামনের দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে ছিলো সে, একদৃষ্টিতে। তখনই পাশের দরজা দিয়ে মেরুন রঙের পাঞ্জাবি হাতে কণুই পর্যন্ত মোড়াতে মোড়াতে বের হয়। সুরভির দৃষ্টি যেয়ে আটকায় তার উপর।

দরজা দিয়ে বের হতেই প্রথম অভ্রর দৃষ্টি যেয়ে আটকায় সুরভির উপর। নয়ন বন্ধনের কাটে এক মুহূর্ত। অভ্রর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। সে ভ্রুঁজোড়া নাচাতেই সুরভি বিরক্তির দৃষ্টিতে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সে তাদের দিকে এগোতে এগোতে বলে, “কী কথা হচ্ছে ফজলু?”
“ভাই গো ভাই আমনার তারিফের মালা সাজাই, মালায় সুন্দর শব্দ মিলাই।”
তাইফা উঠে দাঁড়ায় তাকে দেখে। একদম সোজা রোবটের মতো। তার চোখ দুটো বড় বড়। সে আমতা-আমতা করে বলে, “স্যার আপনি…মানে আমি তাইফা। আপনাকে অনেক বছর ধরে দেখে আসছি। আপনার সাথে একবার দেখা করার খুব ইচ্ছা ছিলো।”
অভ্র হেসে উওর দেয়, “ধন্যবাদ। বসুন কথা বলি।”
ফট করে তাইফা বসে পরে। সে আনন্দের চোটে সুরভিকে খোঁচা মেরে চিকনসুরে বলে, “সুরভি অভ্র স্যার আমাকে বসতে বলেছে।”
সুরভি বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকায় তাইফার দিকে। কেন যেন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কিত কাওকেই সে সহ্য করতে পারে না। দেখলেই তার মাঝে এক ধরনের বিরক্তি কাজ করে। বিশেষ করে এই জবে জয়েন করার পর রাজনৈতিক ব্যাপারে যেসব সত্যি সে জেনেছে তার পর তার মনে কেবল ঘৃণা বেড়েছ।

অভ্র তাদের সামনের সোফায় বসে তাইফাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি সুরভির বান্ধবী?”
“বান্ধবী প্লাস কলিগ। আপনাকে একটা কথা বলি? আপনি বেশি রাগ করবেন না তো?”
“আপনার মতো মিষ্টি মেয়ের সাথে কেউ রাগ করতে পারে বলুন? নিশ্চিন্তে বলুন।”
“উফফ আপনি কত ভালো! সবার সাথে কত মিষ্টিভাবে কথা বলেন। ধনী গরীব সবাইকে কত সম্মান ও আদরের সাথে কথা বলেন।”
সুরভি বিড়বিড় করে বলে, “কচু করে। সব লোকদেখানো। উনার আসল রূপ তো গতকাল বের হয়েছিল।”
তাইফা আরও বলে, “যা বলছিলাম, আমাদের ইন্টারভিউর সাথে যুক্ত নয় কিন্তু আপনি দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। আর সামনা-সামনি দেখতে তো আরও হ্যান্ডসাম।”
“সো সুইট অফ ইউ। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
সুরভি আবারও বিড়বিড় করে বলে, “হ্যান্ডসাম না ছাই। বান্দরের মতো দেখতে।” নিজেকেই বলে ভেংচি কাটে সে।

“সুরভি যখন বলল আপনি সামনে আরও বেশি হ্যান্ডসাম তখন আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আপনাকে ম্যাগাজিনে এত হ্যান্ডসাম দেখায় এর থেকে কীভাবে লাগতে পারে? এখন দেখি সত্যিই বলেছে।” তাইফার কথায় সুরভি বড় বড় চোখ করে ড্যাবড্যাব করে একবার তাকায় তার দিকে আবার অভ্রর দিকে।
অভ্র তার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি আঁকে, ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে, “তাই? সুরভি বলেছে? নাউ দ্যাট’স ইন্টারেস্টিং।”

সুরভি ছটফট করে থাকে কথা পরিবর্তন করার জন্য, “আমরা যে কাজে এসেছি সে কথা বলি?”
“বলব, এত তাড়া কীসের? তোমার বান্ধবীর সাথে কথা বলতে আমার ভালোই লাগছে।”
নিজের প্রশংসা শুনে তাইফা আনন্দে হাসিই বন্ধ করতে পাড়ছিল না।
“আমার তাড়া আছে। রাত হয়েছে, বাসায় যেতে হবে।”
“আফসোসের ব্যাপার। আমি নিজের হাতে রাতের খাবার তৈরী করেছি তোমাদের জন্য। ”
“আপনি রান্না করতে পারেন?” তাইফা বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করে। উওর দিলেন ফজলু মিয়া, “ভাই আমার টেলেন্টের ভান্ডার, সকল কামে এক নাম্বার। এমন কোনো কাম নাই যা অভ্র ভাইয়ের জানা নাই।”
অভ্র হেসে বলে, “আসলে আমার কাজ অন্যকেউ করুক বা আমার জিনিস অন্যকেউ ধরুক আমার পছন্দের না। তোমরা বসো, আমি খাবার টেবিলে দিচ্ছি। তারপর নাহয় প্রশ্নের কাগজটা নিয়ে যেও।”
অভ্র যাবার পর তাইফা সুরভির হাত ধরে বলে, “অভ্র স্যার কতটা ভালো! আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য নিজের হাতে রান্না করেছে।”
“ভালো না ছাই। এত ভালোপণা দেখানোর পিছনে নিশ্চয়ই কিছু রহস্য আছে। এই লোক তো এত ভালো না।”
“তুই আর তোর সন্দেহ। শেষই হয় না। মানুষ ভালো কিছু করলেও তোর সন্দেহ লাগে।” সে তারপর কথা বলতে থাকে ফজলু মিয়ার সাথে। আবারও অভ্রের প্রশংসার কথোপকথন শুরু। যা শুনে বিরক্তি লেগে যায় সুরভির। তাই উঠে যায়। ঘুরে ফিরে রুমে দেখতে থাকে চিত্রগুলো। ছবিগুলো দেখতে দেখতে তার চোখ আটকায় দেয়ালের কর্ণারের দিকে। সম্পূর্ণ দেয়াল জুড়ে কেবল সার্টিফিকেট এবং মেডেল। সবগুলোই অভ্রর নামে। এর পাশেই বিশাল এক লম্বা চিত্র। কেবল কালো, সাদা ও ধূসর রঙের। দেখে মনে হচ্ছে কোনো মেয়ের ছবি, কিন্তু ছবিটা স্পষ্ট নয়। কেমন আবছা। অস্পষ্ট।

সে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো চিত্রটির দিকে। এমন সময় সামনের দরজা থেকে একটি হাত এগিয়ে এলো। তার হাতটা ধরল। এবং টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। সুরভি চিৎকারের পূর্বেই তার মুখে হাত রেখে দিলো অভ্র। সুরভির তাকে দেখে যেন মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সে জোরে কামড় দেয় অভ্রর হাতে।
“পাগল না’কি? এভাবে কেউ কামড় দেয়?” অভ্র হাত নাড়তে থাকে ব্যাথায়।
“তো এভাবে কেউ টান দিয়ে মুখে হাত রাখে মিস্টার অভদ্র? বলেন টান দিলেন কেন?”
“কাবাব ভাজবো। একা এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বোর হয়ে যাব তাই ভাবলাম একা বোর হওয়ার থেকে ভালো তোমার ক্যাঁক্যাঁ শুনি।”
“এই শব্দটা মুখ দিয়ে আবার বের করলে আপনাকেই গরম তেলে ভেজে উঠিয়ে দিব।”
শব্দ করে হাসতে থাকে অভ্র, যেন কোনো রসিকতা শুনেছে, “তুমি এতটুকু মানুষ আমাকে ওঠাবে? ওয়াট এ জোক।”
সুরভি হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করে, “আপনি তাইফার সাথ রসোগোল্লার মতো মিষ্টি করে কথা বলছিলেন কেন শুনি?”
“কেন তুমি জ্বেলাস ফিল করলে না’কি?”
“আমি আর আপনাকে নিয়ে জ্বেলাস ফিল করব? স্বপ্ন দেখেন। আপনার এত সুন্দর নাটক দেখে অবাক হয়েছি। ভালো অভিনেতা হতে পাড়বেন।”
“আমারও মাঝেমধ্যে তাই মনে হয়। এখন এমন প্রফেশনে আছি যে সবার গুডবুকে থাকা লাগে। বিশেষ করে মিডিয়ার মানুষদের সামনে। কি করার, একটু তো নাটক করতেই হবে।”
“কই আমার সামনে তো অভদ্র সেজে থাকেন।”
অভ্র বাঁকা হাসে। তার কাজ রেখে সুরভির দিকে ফিরে তাকায়। তার পিছনের কাউন্টারে হাত রাখে। তার দিকে ঝুঁকে বলে, “তোমার সঙ্গে ভালো সাজার আগে তুমি আমার কানের কাছে এসে ক্যাঁক্যাঁক্যাঁ শুরু করে দিয়েছিলে। মনে আছে তো অকারণে এসে ঝগড়া বাঁধিয়েছিলে তুমি না’কি ভুলে বসে আছো।”
সুরভি হাত দিয়ে অভ্রকে বুকে হাত রেখে তাকে নিজের সরায়, “সাবধানতাজনিত দূরত্ব বজায় রাখেন।”
অভ্র উল্টো তার হাত ধরে আরও কাছে আসে। জিজ্ঞেস করে, ” নাহলে কী আমার প্রেমে পড়ে যাবে? তোমার বান্ধবী তো বলছিলো তুমি নিজের মুখ দিয়ে বললে আমি কতটা হ্যান্ডসাম। আমার সামনে এত কঠিন সাজো, আর পিছনে এত প্রশংসা!”
সুরভি ছোট চোখ করে তাকিয়ে থাকে অভ্রর দিকে। তার চোখেমুখে বিরক্তির ভাব। সে হাত মাড়াতে থাকে। অভ্র আবার বলে, “এখনো যেভাবে দেখছ প্রেমে পড়তে বেশি সময় লাগবে না কিন্তু।” বলে বাম চোখটা ব্লিঙ্ক করে সে।
“আপনি পৃথিবীর শেষ পুরুষ হলেও অন্তত আপনার প্রেমে আমি পড়ব না।”
“তাই?” অভ্র সরু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। যেন হঠাৎ রেগে গেছে সে। এক পা এগিয়ে আসে সুরভির দিকে। আর সুরভি সাথে সাথে পিছনে যায়। এবার ভীত দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। সে সুরমা চোখদুটোর তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে বুক কেঁপে উঠে সুরভির। হাসিতে ছোট হয়ে যাওয়া চক্ষুদ্বয় কেমন মুহূর্তে তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। এমন ভাবে তাকাল যেন হৃদপিণ্ড বের করে আনবে। মুহূর্তে এত ভয়ানক দৃষ্টি কীভাবে আনল লোকটা? আবার পরের মুহূর্তে তাকে অবাক করে দিয়ে হেসে ফেলল। তাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যায়, “তুমিই তো বলেছিলে আমি এত ভালো অভিনয় করি যে অভিনেতা হতে পারব। আর তুমিই এত জলদি ঘাবড়ে গেলে?”
সুরভির যেন সবে নিশ্বাস ফেরে, “আপনি মজা করছিলেন? আমার জান বের হয়ে যাচ্ছিল।”
কথাটা যেন আরও বেশি মজা লাগলো অভ্রর। সে শব্দ করে হাসল। বিরক্তিকর লাগলো সে হাসিটি। তার হাসি থামে ফোনের স্ক্রিনে দাদাজানের কল দেখে। সব কিছু বাদ দিয়ে সে কলটি ধরে। কোনো কথা বলে না। কলটি রাখা মাত্রা সে সুরভিকে বলে, “ভেবেছিলাম এই সাপ্তাহে কেবল বুধবার ফ্রী আছি। তখন তোমাকে ইন্টারভিউ দিব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হবে না।”
“আপনি আমাদের কথা দিয়েছিলেন।”
“দিয়েছিলাম। কিন্তু তখন দাদাজান আমাকে নিজের ফিয়োন্সের সাথে দেখা করে এনগেজমেন্ট ডেট ফিক্স করার জন্য ডাকে নি।”

চলবে….