অনুভূতির খাঁচা পর্ব-২১+২২

0
32

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-২১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জোহান তাকায় মায়ার দিকে। তার মুখে হাসিটা মানায়। তার খিলখিলিয়ে উঠা হাসিটি দেখতে সুন্দর লাগে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখে তার সুন্দর হাসিটা মলিন হয়ে গেছে। মুখে কালো আঁধার নেমে আসছে। সে মায়ার দৃষ্টি অনুসারে সামনে তাকিয়ে দেখে দিয়া এবং ওয়াহিদ দাঁড়ানো।

তাদের দুইজনকে তন্নিও খুশি হয় না। সে মেহেদীর পিছনে শার্টের কলার ধরে তাকে টেনে কাছে এনে জিজ্ঞাসা করে,
“ওরা দুজন এখানে কি করছে?”
মেহেদী আমতা-আমতা করে বলে,
“দোস্ত যত যাই হোক ওয়াহিদও আমাদের ফ্রেন্ড। আমার ছোটবেলার ফ্রেন্ড। আমার খুশির উৎসবে আমার সব ফ্রেন্ডদের কাছে চাইতাম।”
“তাহলে ওকে নিয়েই থাক। আমি মায়াকে নিয়ে চলে যাচ্ছি।”
“দোস্তো আমার কথাটা শুন….”
তন্নি তার কথা শুনে না। সে মায়ার হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতে নেয় কিন্তু মায়া নড়ে না। সে বলে, “কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। আমার কোনো সমস্যা নেই। এসব ব্যাপার না।”
সে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু আমাকে আইস্ক্রিম খাওয়াতে হবে কিন্তু।”
“পুরো আইস্ক্রিম ভর্তি ফ্রিজ তোর সামনে এনে দিব।”
মায়া তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “ভাই এত চাপা মারিস না। জীবনে একটা বার্থডে ট্রিটের টাকা তোর পকেট থেকে বাইর হইল না আসসে আমাকে ফ্রিজ ভর্তি আইস্ক্রিম দিতে। কিন্তু আমি নিজে কিনতে পারি।” সে মেহেদী পকেট থেকে তার ওয়ালেট বের করে বলে, “গাইজ আজকের ট্রিট মেহেদীর পক্ষ থেকে।”
“এই না বাবা সব আয়োজন করছে। তুই আমার ওয়ালেট দে।”
“করুক তাও আমরা তোর টাকা দিয়েই বাহিরে খাব।”
“ওয়ালেট দে বলছি।”
মায়া ওয়ালেট তন্নিকে দিয়ে দেয়। তারপর তারা দুইজন দৌড়ে পালায়।
মেহেদী উচ্চস্বরে বলে, “এই টাকা দিয়ে খাবার খেলে তোদের পেট খারাপ হবে দেখিস।”
মায়া পিছনে তাকিয়ে হেঁটে বলে, “তোর অভিশাপে আমাদের পেট খারাপ হলে তুই সিঙ্গেল মরবি দেখিস। অভিশাপ দিলাম।”
“দেখ আমার সিঙ্গেলপণাকে এসবের মাঝখানে আনবি না।”
তন্নি তাকে বলে, “ওই তো এমনেও সিঙ্গেল মরবে হুদাই অভিশাপ ওয়েস্ট করে লাভ নেই।”

জোহান তাদের দুইজনের কথা শুনে হেসে দেয়।
ওয়াহিদও তাদের দেখে হাসে। দিয়া বলে, “অনেক বছর পর মায়াকে এত খুশি দেখছি। ও এখন আগের মতো হলেই হলো। আমাদেরকেও যদি ক্ষমা করে দেয়।”
ওয়াহিদ মায়ার যাবার দিকে তাকিয়েই বলে, “আমাদের ক্ষমাও করা লাগবে না। শুধু ও এভাবে খুশি থাক। আসো আমরা ভেতরে যাই।”
ওয়াহিদ ভেতরের দিকে যেতে থাকে।

আশরাফ মেহেদীর কাঁধে হাত রেখে বলে, “ভাই তোর ক্রেডিট কার্ড কোথায় আছে?”
“ওয়ালেটেই কেন?”
সে মেহেদীর মাথায় বারি মেরে বলে, “গাঁধা তুই ক্যাশ নিয়ে টেনশন না করে ক্রেডিট কার্ড নিয়ে টেনশন কর। তোর ব্যাংক একাউন্ট খালি হয়ে যাবে।”
“হেল্প কর ভাই।”
“আমার ঘুম আসতেছে। সকাল থেকে ড্রাইভিং করছি। ব্যাগগুলো ভেতরে নিয়ে রাখ।”
“আমি একা? হেল্প তো কর।”
জোহান বলে ,”আমি হেল্প করছি।”
“থ্যাঙ্কিউ ব্রো, তুমিই বেস্ট।”
কিন্তু আশরাফ বলে, “আরে না তুমি এখানের মেহমান আর জার্নি তো তুমিও করেছ। ক্লান্ত তো তুমিও হবে। আসো মেহেদীর বোনের সাথে দেখা করাই, ও অনেক খুশি হবে।” বলে সে জোহানকে নিয়ে ভেতরে যায়।
মেহেদী পিছন থেকে বলে, “শালা তোরা বন্ধু না শত্রু আমি নিজেই কনফিউজড।”
তারপর সে এত্তগুলা লাগেজ ও ব্যাগ দেখে কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে হতাশ হয়ে নিচেই বসে পড়ে।

ভেতরে যেতেই জোহানকে দেখে সবাই অবাক। কয়েকজন উৎসুক হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করে। মুহূর্তে তার আশেপাশে ভিড় জমে যায়। হোটেলটা বিয়ের জন্য নেওয়া হয়েছিল, সব মেহমানও আসে নি তাই বেঁচে গেল জোহান। কিন্তু যতজন উপস্থিত ছিলো তার আশেপাশেই দল বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার প্রশংসায় মেতে আছে। জোহান খুশি হয় আবার অখুশিও।
এই জনপ্রিয়তার জন্য সে মানুষের ভালোবাসা পেলেও, কখনো স্বাধীনতা পায়নি। মন খুলে কোন উৎসব উদযাপন করতে পারেনি। সে ভেবেছিল এটা তো আলাদা হবে, কিন্তু তারই ভুল ছিলো।

মায়া ও তন্নি একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। মায়া হাই তুলে বলে, “আমার তো সেই লেভালের ঘুম আসছে। এই ড্রামা শেষ হতে দেরি হলে আমাদের রুমটা দেখিয়ে দিক।”
তন্নি মায়ার পেটে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করে, “তুই কী ওকে পছন্দ করিস রে? বল না…বল বল…”
মায়া চোখ বড় করে তার দিকে তাকায়, “পাগল তুই? আমি জোহানকে পছন্দ করব কোন দু:খে? ও যাস্ট আমার কোম্পানির আর্টিস্ট।”
“তো কেউ সকালে তাকে দেখে ব্লাশিং ব্লাশিং করছিল কেন?”
“তোর মাথা।”
“তুই আমাকে না বললে আজীবন সিঙ্গেল থাকবি কিন্তু।”
“গেস হোয়াট? আমার প্লান এটাই।”
“এহ বললেই হলো? তোর বাচ্চাগাচ্চাদের নিয়ে টেডিবিয়ারের মতো খেলব। তোর বাচ্চাগুলো যা কিউট হবে… আমার তো ভেবেই ইচ্ছা করছে গাল টিপতে। আর ভাব তোর আর জোহানের বাচ্চা হলে আরও কিউট হবে। দুইজনের নাম মিলিয়ে আমি তো নামও ভেবে রেখেছি। মেয়ে হলে জোয়া আর ছেলে হলে মোহান…মোহান একটু ওল্ড ফ্যাশন। আচ্ছা আমি আরেকটা ভেবে নিব। তুই শুধু হ্যাঁ বল। তোদের সেটিং করার দায়িত্ব আমার।”
“ভাই পাগল হয়ে গেছিস তুই। এসব কথা ভাববিও না।”

এদিকে আশরাফ জোহানকে সবার থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসে। তাদের দেখে জিজ্ঞেস করে, “কী কথা বলছিস তোরা?”
“আমি বলছিলাম মায়ার ও জো…..”
মায়া তার মুখের উপর হাত রেখে নিজে বলে,
“আমি বলছিলাম কি ঢাকা রওনা দেবার সময় একটু পাবনার দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে পারবি?”
“কেন?”
“এই মেয়েকে একটু পাগলখানায় ফেলে আসবো। মাথার সব স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে। আর এই মেহেদীর বাচ্চা কই? আমি রুমে যাব রেস্ট করতে।”
“ওকে বাদ দে আমি আংকেল থেকে দুই রুমের চাবি নিয়ে এসেছি। জোহানকে দেখেই তারা স্পেশাল রুম দিয়েছে তাই এই বাহানায় দুইটা নিয়ে এসেছি। সবাই যে খুশি ওকে দেখে।”
আশরাফ দোতলায় নিয়ে যায় তাদের। পাশাপাশি রুম। সবাই রুমে ঢুকে পড়ে। মায়া তন্নিকে সতর্ক করে সবার পূর্বে, “যদি তোর মুখে এসব আলতু-ফালতু কথা আর আসছে তোর কি অবস্থা করব তুই নিজেও জানিস না।”
তন্নি তার কথায় পাত্তা না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় শাওয়ার নেওয়ার জন্য।
মায়া রুমে ঘুরে দেখে যায় বারান্দায়। দরজা খুলতে তীব্র বাতাস তার মুখে ছুঁয়ে গেল। সে দেখতে পায় তার ব্যালকনি থেকে লেক দেখা যাচ্ছে। লেকের উপর কিছু নৌকা চলছে। কী সুন্দর দৃশ্য! সে সামনে যেয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মিষ্টি হাওয়া অনুভব করছিল। আর গুনগুন করে গান গাইছিল। সে চোখ খুলে শান্তির এক নিশ্বাস নিয়ে আশেপাশে তাকাতেই দেখে তার পাশের বারান্দায় দাঁড়ানো জোহান। তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে হাত নাড়িয়ে হাই বলে। বারান্দাটায় দুই হাত দূরত্ব আছে বললেও ভুল হবে না। তাই যখন স্বাভাবিক সুরেই বলে, “তোমাকে বেশ খুশি দেখচ্ছে।” তখন স্পষ্ট শোনা না।
মায়া ড্যাবড্যাব করে কিছু মুহূর্ত জোহানের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ বানিয়ে রুমে ঢুকে যায়।
শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
জোহান হেসে নিজেকেই বলে, “মনে হয় এই মেয়ের প্রতিটি সেকেন্ডেই মুড সুইং হয়। তারপর সে রুমে ঢুকে দেখে আশরাফ বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে নিজের ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে যায় শাওয়ার নিতে। কিছুক্ষণ আরাম করে তাদের বিকেলেই বের হবার কথা। আজ সম্ভবত মেহেদীর ফাংশন হবে। আগামী সকাল, দুপুর মিলিয়ে রঙখেলা ও রাতে হলুদের পার্টি। আর পুরশুই বিয়ে। কেবল সে যদি এই ফাংশনগুলো স্বাভাবিকভাবে উৎযাপন করতে পারতো।
.
.
প্রায় দেড়সাপ্তাহ পর সুরভি অফিসে এসেছে। সে দ্বিধায় ছিলো, এই জবে আবার জয়েন করবে কি-না। কিন্তু এইদেশে চাইলেই তো চাকরি পাওয়া যায় না। এত ভালো ফলাফল থাকা সত্ত্বেও বহু ইন্টারভিউ দিয়েও টিকে নি সে। বহু কষ্টে এই চাকরি পেয়েছে। কারও জন্য চাকরি হাতছাড়া করাটা বোকামি হবে। সে অফিসে এসে তাইফার সাথে দেখা করে তুষারের রুমে যায়। তুষার তাকে জানায়, “আমি অনেক খুশি হয়েছি তুমি তোমার ব্যক্তিগত সমস্যা কাজ থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আহনাফ তোমাকে ডিস্টার্ব করবে না এই দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।”
সুরভি হেসে উওর দেয়, “থ্যাঙ্কিউ।”
“আমাদের সাথে জনাব অভ্রর লোক যোগাযোগ করেছিল। তারা জানিয়েছে জনাব অভ্র কিছু মনে করে নি সে ইন্টারভিউ নিয়ে। ইনফ্যাক্ট সে পরেও আসতে রাজি। কিন্তু সে তোমার তার জন্য কোনো সমস্যা হবে না এটা প্রথমে নিশ্চিত করেছে। কত ভালো সে!”
“অভ্র এমন বলেছে?” অবাক হয় সে।
“আর আবার ইন্টারভিউ এর জন্যও রাজি হয়েছে চিন্তা করো। গতবার যখন সে ইন্টারভিউ দিয়েছে তখন আমাদের টিয়ারপি অনেক হাই গিয়েছিল। আচ্ছা সুরভি তোমার কাছে একটা ফেভার চাওয়ার ছিলো। আমি জানতে পেরেছি অভিনেত্রী ইনারা তোমার কাছের বান্ধবী?”
সুরভি জোর করে ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকে। মনে মনে বলে, “এখন বুঝতে পারছি এত ভালো ব্যবহার কেন হচ্ছে আমার সাথে।” মুখে কেবল উওর দেয়, “হ্যাঁ।”
“তার যদি সময় হয় তাহলে আমাদের প্রোগ্রামে ইন্টারভিউ দিতে বলো। আর যদি তার স্বামী সভ্য সাথে আসে তাহলে টিআরপি এর রেকর্ডই ভেঙে যাবে।”
সুরভি উঠে দাঁড়ায়, “চেষ্টা করব। আমি এখন আসি।”
সে বের হয়ে অভ্রকে ফোন করে। কিন্তু তার ফোন বন্ধ আসছিল।

সুরভি যেয়ে তার ডেস্কে বসে। তাইফাকে জিজ্ঞেস করে, “কি করছিস?”
“রিসার্চ। দুইমাস আগে গ্যাং রে*প কেস হয়েছিল। আমাদের চ্যানেল থেকে সীমা কভার করেছিল নিউজটি। সব মিটমাট হয়ে গিয়েছিল।”
“তো? দোষীদের তো গেফতার করা হয়েছে। শাস্তিও দিয়েছে।”
“পুরো কথাটা শুন। গতসাপ্তাহে মেয়েটি সুই*সাইড করেছিল। সে নিউজটা আমি কভার করেছিলাম। মনে আছে?”
“হ্যাঁ, মনে আছে।”
“আমি মেয়েটির বাসায় গিয়েছিলাম নিউজটা কভার করার জন্য। মিডেলক্লাস ফ্যামিলি তাদের। বাবা কলেজের প্রফেসর আর মা হাউজওয়াইফ। দুইবোন টিউশনি করিয়ে নিজের পড়ার খরচ চালাতো। ওর বোন কলেজে আমার জুনিয়র ছিলো। তাই ওকে সান্ত্বনা দিলাম কিন্তু তখন ও আমাকে বলল যে আসল দোষীদের বিচারই দেওয়া হয় নি। অন্য লোকেদের টাকা খাইয়ে দোষী বানাল। তাদের জায়গায় শাস্তি পাওয়ার জন্য। বাহানা কি, অন্ধকার ছিলো তাই চেহেরাটা ভালো করে দেখে নি। ওর পরিবারের জানের হুমকি দিয়ে ওকেই মিথ্যা বলিয়েছিল। এতকিছু সহ্য করতে না পেরে মেয়ে শেষমেশ নিজের জীবনটা দিলো। কী অবস্থা! ওর বড় বোনের কাছে আমার নাম্বার দিয়ে এসেছিলাম। ও আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। হেল্প চাইছে।”
“আসল অপরাধী তাহলে কে?”
তাইফা একটি ফাইল দেখায় সুরভিকে। সেখানে সব দোষীদের বায়োডেটা দেওয়া।
তাইফা জানায়, “সব দেশের কোটিপতিদের ছেলে। নো ওয়ান্ডার কত সহজে এই কেইস থেকে বাহিরে এসে পড়েছে।”
“এগুলো ফটোকপি করে আমাকেও দিস। আমিও হেল্প করব। এতগুলো নিরীহ মানুষের জীবন নষ্ট করছে। তাদের ছাড়ব না।”
“তুষার স্যারের সাথে কথা বলব এই বিষয় নিয়ে?”
“এখন দরকার নেই। সে তার টিয়ারপি নিয়েই ব্যস্ত। আমরা কোনো ক্লু পেয়ে নেই তারপর তার টিয়ারপি জোর দেখিয়েই নিউজটা টিভিতে দিতে পারব।”
“পয়েন্ট আছে।”

লাঞ্চ ব্রেকের সময় কল আসে অভ্রর। সুরভি এবার তা দেখেও উঠায় না। নিজের খাবারের দিকে ধ্যান দেয়। আবার অভ্রর মেসেজ আসে, “আমি নিচে গাড়িতে বসে আছি। তুমি দুই মিনিটে নিচে না আসলে আমি উপরে আসছি।”
মেসেজ দেখে খাবার সুরভির গলাতেই আটকে যায়। সে দ্রুত পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাইফাকে বলে, “আমি একটু নিচের থেকে আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
সুরভি ভেবে পায় না কি বলবে। তাই আশেপাশে দেখে। তাইফার ডেস্ক থেকে ফাইলটি নিয়ে বলে, “এটা ফটোকপি করে আনি।”
“একটু বস। খাবার শেষ হোক, আমিও আসছি।”
“প্রয়োজন নেই। আমি যাচ্ছি আর আসছি।”
বলে সে দ্রুত বেরিয়ে যায়৷ নিচে এসে দেখে ফজলু মিয়া বিল্ডিং এর সামনে তার অপেক্ষা করছে। সে মেজাজ খারাপ করে বলে, “ফজলু ভাই আপনি এখানে কেন এলেন? কেউ আপনাকে দেখলে সমস্যা হবে না?”
ফজলু মিয়া তার টুপি ঠিক করে বলে, “ফজলু মিয়া করে না কোনো সমস্যা খাড়া, অভ্র ভাই আপনার জন্য অপেক্ষা করতাসে সে কখন থেকা, ফজলু মিয়া আইসে অভ্র ভাইয়ের পক্ষ থেইকা আপনাকে….”
“হয়েছে হয়েছে। এত সময় আমার কাছে নেই। এখন বলেন আপনার অভ্র ভাই কোথায়?”
“আমার অভ্র ভাই আইসে সব কাজ ছাইড়া, এত কষ্ট কইরা শুধু আপনার লাইগা।”
“দেখেন ফজলু ভাই আমার মেজাজ একশোতে একশো উঠে আছে। আরেকটা কথা বললে আপনার আর আপনার অভ্র ভাই দুইজনের খবর আছে। আমাকে শুধু দেখান সে কোথায়?”
ফজলু মিয়া ভয়ে হেসে তাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়।

সুরভি গাড়ির ভেতর ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, “আপনি আমার অফিসের সামনে এসেছেন কোন দু:খে?”
অভ্র জানালার ওপারে তাকিয়ে ছিলো। সুরভির কন্ঠ শুনেই তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে, “তোমার কলের নোটিফিকেশন দেখে মনে হলো খুব মিস করছিলে। তাই তোমার খাতিরে এসে পড়লাম।”
“ফালতু কথা বলবেন না। তুষার স্যার বলেছিল আপনি না’কি বলেছেন আমার জব রাখার জন্য।”
“তো থ্যাঙ্কিউ বলতে কল দিয়েছিলে?”
“স্বপ্নে দেখেন। যাস্ট বলার জন্য কল দিয়েছি আপনি আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করা বন্ধ করুন।”
অভ্র হাত উঁচু করে ইশারা দিতেই ড্রাইভার বেরিয়ে যায়।
সে হেসে বলে, “তোমার মুখ একটু বেশি চলছে না?”
“এবার আপনি যদি এক থেকে দুই করছেন সোজা দাদাজানের কাছে যেয়ে বিচার দিব। তারপর আপনার টাকা কীভাবে এরেঞ্জ করবেন।”
“তারপর তোমার কী অবস্থা হবে তাও যদি ভেবে নিতে। দাদাজানের কাছে অর্থের ক্ষমতা থাকতে পারে। আমার কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং বুদ্ধির ক্ষমতা দুটোই আছে।” সে সুরভির দিকে ঝুঁকে বলেন, “আমার মনে হয় না তোমাকে আর ডেমো দেওয়া লাগবে।”
সুরভি তার এত কাছে আসা দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়। তার হাতের ফাইলটা নিচে পরে যায়। কাগজ সব ফাইল থেকে বের হয়। সুরভি ঝুঁকে ফাইল নিয়ে কাগজ সংগ্রহ করতে শুরু করে। হঠাৎ অভ্রর চোখে কিছু একটা পরায় সে সুরভির হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে নেয়।

“এটা আবার কোন ধরনের বেয়াদবি?” সুরভি বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করে।
“এসব ছেলের বায়োডেটা তোমার কাছে কি করে?” অভ্রর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।
“কাজের ফাইল।” সে অভ্রর হাত থেকে ফাইলটা নিতে চায় কিন্তু অভ্র অনেক শক্ত করে ধরে ছিলো। আর এক নাগালে তাকিয়েই ছিলো। সুরভি বিরক্তি নিয়ে বলে, “আজব তো। দিবেন না না’কি?”
“তুমি এই কাজ থেকে দূরে থাকো। এই ছেলেদের থেকে দূরে থাকবে।”
“বিয়ের জন্য বায়োডেটা না। কাজের জন্য বায়োডেটা করেছি। ফটোকপির কথা বলেই নিচে আসলাম।” “ফটোকপি করবে? দাঁড়াও আমিই করিয়ে আনছি।”
অভ্র জানালার কাঁচ কিছুটা খোলার পরই ফজলু উঁকু মারে। সে ফজলুকে ফাইলটা দিয়ে বলে, “এটা ফটোকপি করে আনাও।” সাথে কিছু ইশারা করে। ফজলু মিয়াও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
সে যাবার পর অভ্র সুরভিকে উপদেশ দেয়, “তুমি এদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ো না আবার।”
“তাদের কারণে একটি মেয়ের সম্মান ও জীবন গিয়েছে। কিছুদিন আগে নীরমা নামের মেয়েটির কেসের অপরাধী ওরাই ছিলো। এটা শুনার পরও কী আপনি এই কথা বলবেন? আমি তাইফার সাথে প্রমাণ জোগাড় করে তাদের শাস্তি দেওয়াব।”
“তোমার মনে হয় তাদের শাস্তি দেওয়ানো এতটা সোজা?”
“তাহলে আপনার ইচ্ছা আমি সত্যিটা জেনেও চুপ থাকি?”
“তুমি চুপ থাকলেই যে ওরা শাস্তি পাবে না এমনটা তো বলিনি। কেবল তুমি এসবের মাঝে জড়িও না। ওদের শাস্তির ব্যবস্থা ওরা নিজেই করবে।”
“মানে?”
“মানে কিছু না। তোমার লাঞ্চ ব্রেক চলছিল তাই তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।”
সে পিজ্জার বক্স বের করে। সুরভি বলে,
“আপনার পিজ্জা আমার লাগবে না।”
“ভেবে নেও তোমার ফেভারিট কালাভুনা পিজ্জা এনেছি। তুমি না খেলে আমি খেয়ে নিচ্ছি।”
সে বক্স খুলে একটি পিজ্জার স্লাইস হাতে নেয়।

সুরভির একতো জোরে খিদে লেগেছিল। এর উপর তার ফেভারিট পিজ্জা দেখে মুখ পানি এসে পড়ে। সে লোভ সামলাতে না পেরে অভ্রর হাত থেকে পিজ্জার বক্স নিয়ে বলে, “আপনি যেহেতু এনেই ফেলেছেন তাহলে খেয়েই নেই।”
অভ্র হাতের পিজ্জা স্লাইস রেখে বলে, “আমার পিজ্জা পছন্দও না।”
“ভালো কথা আপনি কীভাবে জানেন আমার এই পিজ্জা সবচেয়ে বেশি পছন্দের।”
অভ্রর উওর দেবার পূর্বে সুরভি নিজেই বলে, “থাক বলা লাগবে না। এমনিতেই আমাকে একটা বুঝানোর জন্য বানিয়েই বলবেন। তাই বাদ দেন।” বলে সে খেতে শুরু করে।

অভ্র হেসে তার দিকে তাকায়। তার ফোনের শব্দ হয়, সে ফোন বের করে দেখে ফজলু মিয়া ছেলেগুলো কাগজের ছবি তুলে পাঠিয়েছে। পাঁচজন ছেলের ছবি ছিলো। সে তাদের বায়োডেটা দেখতে দেখতে একটি ছেলের ছবিতে থেমে যায়। তার ছবি দেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে। গ্যালারির অন্য এক পুরাতন এলবামে যেয়ে দেখতে পায় তার সাথে ছেলেটির ছবি। সুরভির ডাকে সে জলদি ফোনটা বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।
.
.
জোহান বিকেলে আশরাফের সাথে বের হয়। ফাংশনের স্থানে যাবার সময়ও তার কিছু একটা আজব লাগছিলো। সে দেখতে পায় সবাই তার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে
আর এই স্বাভাবিক ব্যবহারটাই তার কাছে অস্বাভাবিক। নাহলে প্রায় মানুষ তাকে দেখে ছবি তোলা অথবা অটোগ্রাফের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। এখানে আসার পরও এমন হয়েছিল। হঠাৎ সবাই এত স্বাভাবিক ব্যবহার করছে দেখেই তার অবাক লাগে।
আশরাফ জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে অবাক দেখাচ্ছে।”
“সবাই খানিকটা অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে।”
“মায়া বলেছিল সবাই যেন তোমাকে স্বাভাবিক ট্রিট করে। আমাদের গ্রুপে মেসেজ দিয়ে দায়িত্বটা দিয়েছিল আমাকে আর মেহেদীকে। মেহেদী অন্য সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। যেন তুমিও প্রোগ্রামটা ইনজয় করতে পারো। যেহেতু পুরো রিসোর্টটা বিয়ের জন্য বুক করা তাই ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেছে।”
জোহান খুশি হয় এমন কথা শুনে, “মায়া আসলেই সবার ব্যাপারে অনেক ভাবে দেখছি। এমনি ওরা কোথায়?”
“ভেতরে আসার সময় দেখেছিলাম না হোটেলের নিচেই অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো হচ্ছে। ওখানে আজকের মেহেদী ও আগামীকাল হলুদ হবে। বিয়ের ফাংশনের জন্য আরও ভালো একটি জায়গা বুক করেছে। আর বৌভাত হবে ঢাকায়। আসলে এখানে কিছু বছর পূর্বে মেহেদীর পরিবার ঘুরতে এসেছিল। ঢাকায় যাবার একসাপ্তাহ পর মেহেদীর দাদা মারা যান। তিন না’কি এখানে এসে অনেক খুশি ছিলেন। তাই দাদী চাইছিলেন তার নাতিনের অনুষ্ঠানটা এই জায়গায় হোক।”
“তাহলে এই জায়গাটা স্পেশাল।”
“অনেক।”

তারা বাহিরে যেয়ে দেখে কিছু চৌকিখাটের আশেপাশে সাজানো। গাঁদাফুল দিয়ে সাজানো। মাঝখানের চৌকিতে বসে মালা তার দুইহাত ভর্তি মেহেদী দিচ্ছিল। আর আশেপাশের চৌকিতেও মেয়েরা বসে মেহেদী দিচ্ছিল। তাদের দেখে তন্নি দৌড়ে আসে। আশরাফকে মেহেদী দেখিয়ে বলে, “দেখ কত সুন্দর মেহেদী দিয়েছি আমি। তোর নামও লিখেছি। খুঁজে বের কর।”
জোহান তন্নিকে একা দেখে জিজ্ঞেস করে, “তোমার বান্ধবী কোথায়?”
“মায়া? ওইখানে মেহেদী পরছে। যেয়ে দেখে আসো।”
জোহান সেদিকে যায়। মায়া তাদের পিঠ করে বসেছিল। সে এগিয়ে যায়। দেখে সে নিজের হাতের তালুতে মেহেদী দিচ্ছে। ছোট গোল করে, চারপাশে মেহেদী দিয়ে গোলাপ ফুল আঁকা আর মাঝখানে তার নিজের নাম লেখা। জোহান তা দেখে হাসে। ঝুঁকে মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“সবাই নিজের ভালোবাসার মানুষের নাম লিখাচ্ছে দেখে আমি কনফিউজড ছিলাম তুমি কার নাম লেখাবে। তুমি দেখি নিজের নাম লিখিয়েই বসে আছো।”
হঠাৎ জোহানের কন্ঠ শুনে চমকে উঠে মায়া। সে পিছনে ফিরতেই জোহানকে এত কাছাকাছি দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। চোখে চোখ মিলতেই দৃষ্টিবন্ধনের এক মুহূর্তে তার বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠে। সে চোখ নামিয়ে নেয়। মুখ ফিরিয়ে নেয়।

জোহান তার পিছনে বসে, “এমন ট্রেডিশনাল ওয়ারে তোমাকে সুন্দর লাগে। বাই দ্যা ওয়ে আমরা ম্যাচিং করেছি খেয়াল করেছ?”
“সবাই-ই আজকে সবুজ পরেছে। এটাই থিম।”
“হ্যাঁ বাট শী-গ্রিন তো আমরাই কেবল পরলাম।”
মেহেদী লাগানো শেষে উঠে যায় মায়া। জোহান তার পিছনে আসে, “এতটুকুই লাগিয়েছ? তাও একহাতে। সবাই তো দুইহাত ভর্তি মেহেদী লাগাচ্ছে।”
“দুইদিন পরে কি আমি দুইহাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে যাব অফিসে?”
জোহান মায়ার দিকে মুখ করে পিছন দিকে হাঁটতে থাকে। তাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে আফসোসের সুরে বলে, “কেন যে চুলগুলো কাটতে গেলে। বড় চুল হলে সবার মতো ফুল লাগাতে, একশোতে একশো লাগতো।”
“নিজের মুখ বন্ধ করে সাইডি যাও, নাহলে মাথায় এত জোরে মারবো যে দিনে একশোটা তারা ঘুরতে দেখবে।”
জোহান সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়, “আজব আমি তোমার প্রশংসা করছি। আর তুমি…”
মায়া হেঁটে এগিয়ে দিয়েছিল। জোহানের কথা শুনে সে থেমে যায়। পিছনে তাকিয়ে বলে, “আমি জানি আমি সুন্দর। তোমার প্রশংসা করা বা না করাতে কিছুই আসেযায় না।” বলে সে এগিয়ে যায়। হঠাৎ একটি ছেলের সাথে ধাক্কা খায় সে, “আই এম সরি।”
ছেলে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি মায়া চৌধুরী না?”
মায়া মাথা নাড়ায়। ছেলেটি বলে, “আমি আদিল। মালার ফিয়োন্সে। আমাদেরই বিয়ে।” বলে সে হাত বাড়ায়।
“ওহ নাইস টু মিট ইউ।” মায়াও তার সাথে হাত মিলায়। সে অনুভব করে ছেলেটা অন্যরকমভাবে হাত হাতটা ধরেছে। তার একটু আজবই লাগে। সে হাত ছাড়িয়ে নেয়।
ছেলেটা তার প্রশংসা করে, “আপনার হাতটা খুব নরম।”
কথাটা শুনে মায়ার কপাল কুঁচকে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে হেসে বলে, “থ্যাঙ্কিউ।”
এতে ছেলেটার সাহস বেড়ে যায়। সে মায়াকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে আবার বলে, “ভাগ্য খারাপ আপনার সাথে আগে দেখা হয় নি।”
“কেন?”
“দেখা হলে আপনাকে ছাড়া অন্যকারো দিকে চোখই যেত না। এর উপর একটি কোম্পানিকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গেছেন। বিউটি উইথ ব্রেইন। এত রেয়ার কম্বিনেশন কে হাতছাড়া করতে চায় বলেন।”
মায়া হাসিমুখে বলে, “থ্যাঙ্কিউ ফর দ্যা কমপ্লিমেন্ট।”
এমন সময় মালা তাকে ডাক দেয়। ছেলেটার মুখে এক মুহূর্তের জন্য বিরক্তি আসে। তারপর সে হেসে মায়া থেকে সময় নিয়ে যায় মালার কাছে।
মায়াও হাসি মুখে তাকে বিদায় দেয়। ছেলেটা যাবার পরই তার হাসি হাসি মুখটায় রাগ ছেয়ে যায়। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পায় মেহেদী আশরাফ, তন্নি ও জোহানের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। সে দ্রুত যেয়ে মেহেদীর পিঠে থাবা দেয়।

মেহেদী লাফিয়ে উঠে। তার হাতের জুসও পড়ে যায়। সে বলে, “আমি আবার কী করলাম?”
“তুই দেখেশুনে বোনের বিয়ে দিবি না?”
“কী হলো?” তন্নি জিজ্ঞেস করে।
“ওই ব্যাটার বিয়ে পুরশু। সে আমার সাথে ফ্লাট করছিল। আমার নাকি হাত নরম, মাথা থেকে পা পর্যন্ত জঘন্যভাবে দেখে বলে আমাকে আগে দেখলে না’কি তার চোখই সরতো না। আমার তো ওর তাকানো দেখেই ঘিনঘিন লাগছিল।”
মেহেদী হতভম্ব হয়ে বলে, “কী বলিস? আদিল এমন করেছে?”
জোহান রাগান্বিত স্বরে বলে, “আর তুমি এত সহজে ওকে যেতে দিয়েছ?”
আশরাফও তার সাথে তাল মেলায়, “ওর তো একটা শিক্ষা পাওয়াই উচিত। সাহস কত ওর।”
তারা যেতে নিলে য়ায়া তাদের ডাক দেয়, “এই বীর যোদ্ধারা ফেরত আসেন। মারতে হলে তো আমিই তার মাথা ফাটায় দিতে পারতাম কিন্তু এখানে যে তামাশা হতো ওইটার কী? তোমরা বিশ্বাস করেছ বলে কি যেকেউ করে নিবে? বিশেষ করে মালা তো ওকে ভালোবাসে, ও নিজের ভালোবাসার মানুষের কথা না শুনে আমার কথা কেন শুনবে?”
“এজন্যই আমি এত জলদি রিয়েক্ট করিনি। প্লান বল।” তন্নি মায়ার কথায় সায় দেয়।
মেহেদী বলে, “তুই ঠিক বলেছিস। বাবা তো জীবনেও মানবে না। তার ছোট বেলার বন্ধুর ছেলে বলে কথা। কিন্তু ছেলেটার নিয়ত যেহেতু এত খারাপ, সেহেতু আমার বোনের জীবন কোনোভাবেই নষ্ট করতে পারবো না। তুই শুধু বল কি করতে হবে।”
“যা করার তা করবে তো ওই ছেলেটাই। যদি আমার ধারণা ঠিক হয়, আর তার নিয়ত এতই খারাপ হয় তাহলে নিজেই বিয়েটা ভাঙবে। আমার কি মনে হয় জানিস ও এই বিয়েটা তোদের বিজনেসের জন্য করছে। আমি শিউর না বাট ফিল হচ্ছে।”
” যা ভালো হয় তাই কর, কিন্তু যেন এই ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে না হয়। কাল পর্যন্ত তোর প্লান কাজ না করলে আমি সরাসরি সবার সাথে কথা বলব, ওকে?”
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। মেহেদী সেখান থেকে ভেতরে চলে যায়। তার মন মেজাজ খারাপ হয়েছে বুঝা যাচ্ছে। তার বোনের জীবন বলে কথা। মায়া ইশারা দিয়ে আশরাফকে তার সাথে যেতে বলে।
আশরাফও তার পিছনে যায়।
“আদিল যে ভার্সিটিতে পড়েছিল সেখানে আমার এক কলিগ পড়তো। আমি ওকে ফোন দিয়ে দেখি কোনো ইনফরমেশন পাওয়া যায় না’কি!” তন্নি বলে চলে যায়।

মায়ার এসবে মাথা ব্যাথা হয়ে গেছে। তার এখন আর কিছু ভালো লাগছিল না। হঠাৎ করে সবার খুশিটা শেষ হয়ে গেল। তাই সে-ও সেখান থেকে চলে যায়। হাঁটতে হাঁটতে আসে লেকের পাশে। যতদূর পর্যন্ত নজর যাচ্ছিল। পানিতে আকাশের রক্তিমা রাঙা প্রতিমা ছলছল করছিল। সূর্য ডুবি ডুবি ভাবে ছিলো। মায়া সেখানে একটি গাছের নিচে বসে। কিছু মুহূর্ত পেরোতেই জোহানও এসে বসে তার পাশে।

“তুমি কেন এলে?” মায়া প্রশ্ন করে।
“বন্ধু কখনো বন্ধুকে একা ছাড়ে না।”
“কে তোমার বন্ধু?”
“তুমি।”
মায়া তার দিকে তাকায়। মৃদু হাসে।
জোহান বলে, “জায়গাটা আসলেই সুন্দর। শান্তি আছে এখানে।”
“লেকে নৌকা দিয়ে ঘুরা যায়। ঘুরতে যাবে?”
“এই পাগল এখন কীভাবে যাব? নৌকা দেখছ আশেপাশে? ঝামেলাটা যাক, তারপর।”
“ডান।”
তারপর নীরবতা কিছুক্ষণের।

হঠাৎ জোহান তার গুনগুন করাটা নকল করে। সে হেসে তাকায় সামনের দিকে। নিজেও গুনগুন করে তাল মেলায় জোহানের সাথে। চোখ বন্ধ করে সুরের সাথে মেলায় তার মধুর কণ্ঠ,

“মন কেমনের, স্মৃতি এসে মেলে দিলো আজ ডানা
যেখানে জিরোনো মানা…
হয়তো রঙিন খামের ভেতর,
সাদা কালো চিঠিখানা…
হারিয়ে ফেলিছি ঠিকানা।

সুখপাখিদের গান থেমে গেছে
দূর আকাশে পাই দেখা…
অসুখী গালে কার ছায়া পড়ে জেগে থাকে একলা…”

তার কন্ঠ শুনতেই কিছু মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে পড়ে জোহান। যেন এক মিষ্টি বাতাস তাকে ছুঁয়ে গেল কেবল। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়ার দিকে। সে শুনেছিল, মায়ার গানের গলা সুন্দর। কিন্তু এতটা মধুর সে ভাবতেও পারেনি। তার কন্ঠ যেন বৃষ্টি আসার পূর্বের মিষ্টি হাওয়ার ন্যায়, মধুর।

সূর্য লেকের জলের ভেতর ডুবে যাচ্ছিল। সে সময় সে সূর্যিমামার মধুর রশ্নি ছুঁয়ে যায় লেকের পাড়ে বসা দুইজনকে। মায়া তাকায় জোহানের দিকে। জোহান এখনো অবাক দৃষ্টিতে তার দিকেই দৃষ্টি আটকে রেখেছিল। চোখে চোখ পড়ে দুইজনের। মিষ্টি মুহূর্তটায় তার বুকের ভেতর যেন ঝড় ওঠে, আবারও।

চলবে…

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-২২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সূর্য লেকের জলের ভেতর ডুবে যাচ্ছিল। সে সময় সে সূর্যিমামার মধুর রশ্নি ছুঁয়ে যায় লেকের পাড়ে বসা দুইজনকে। মায়া তাকায় জোহানের দিকে। জোহান এখনো অবাক দৃষ্টিতে তার দিকেই দৃষ্টি আটকে রেখেছিল। চোখে চোখ পড়ে দুইজনের। মিষ্টি মুহূর্তটায় তার বুকের ভেতর যেন ঝড় ওঠে, আবারও।

জোহান অবিশ্বাস্য গলায় বলে, “তোমার গানের গলা এত সুন্দর হবে আমি ভাবতেও পারি নি। আই মিন অনেক শুনেছি তোমার গানের ব্যাপারে কিন্তু কখনো ভাবতে পারিনি যে এত মিষ্টি হবে। তোমার গানের জন্য চেষ্টা করা উচিত। সবাই প্রেমে পড়ে যাবে তোমার কন্ঠের।”
মায়া চোখ সরিয়ে নেয়। মাথা নামিয়ে মুচকি হাসে। আজকের আসমানের মতো তার গালেও লালচে আভা ছড়িয়ে গেছে। সে জোহানের কথার উওর দেয় না। কেবল আড়চোখে বারবার দেখে তাকে। জোহান তার গানের প্রশংসা করেই যাচ্ছে। নিশ্বাসও নিচ্ছে না যেন। সে থামাচ্ছেও না। তার এই প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগছে।
হঠাৎ করে জোহান জিজ্ঞেস করে,
“মায়া তুমি কী আমার কামব্যাকের প্রথম এলবামে আমার সাথে গাইবে?”
কথাটা শুনে অবাক হয় মায়া। সে জোহানের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর মাথা নাড়ায়। তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল।
জোহান বলে, “তোমার প্রতিভাটাই নষ্ট করছ।”
“সব প্রতিভা পৃথিবীর সামনে আনার প্রয়োজন হয় না।”
“কেন?”
“আমাদের অনুভূতি অনুযায়ী আমাদের ব্যক্তিত্বও পরিবর্তন হয়। এটা খেয়াল করেছ?”
জোহান তার কথাই বুঝে না, “কী বলছ?”
“হয়তো আমি ভালো করে বোঝাতেও পারব না। কয়েকবছর আগে থেকে অনুভূতি বাদে বিজনেস নিয়েই ভেবেছি, বুঝেছি, দক্ষ হয়েছি। তাই আমি নিজের কথা দিয়ে বলি, এই’যে যখন আমি স্যুটবুট পরে অফিসে আমার অর্জন করা চেয়ারে বসে সারাক্ষণ বসগিরি করতে থাকি না তখন নিজের ভেতর একটা শক্তি, সাহস অনুভব করি। তখন মনে হয় আমার নিজেকে প্রমাণ করতে হবে, নিজেকে রক্ষা করতে হবে, সব পরীক্ষায় জয়ী হতে হবে। যখন আমার বন্ধুদের থাকি তখন এতকিছু মাথায় থাকে না কারণ আমি নিজেকে অনেক সেইফ ফিল করি। ওরাই যেন আমার শক্তি, আমার সাহস। নিজেকে কোনো শক্ত খোলসে বন্দী রাখতে হয় না। তবে কোনো পরিস্থিতিতে আমার কোনো অনুভূতিই আমাকে কাবু করতে পারে না। কিন্তু যখন আমি গান গাই তখন মন হয় আমার গানের সুরগুলো আমার অনুভূতিকে গভীর করে তুলে। আমাকে কাবু করে ফেলে। আমি প্রতিটি গানের পঙক্তি অনুভব করতে পারি। আমার হৃদয়টা দুর্বল হয়ে যায়। আমি আমার অনুভূতির খাঁচা খুলতে চাই না। এই খাঁচা খুলে দিলে যদি অনুভূতি নামক পক্ষীটি উড়াল দেয় তাহলে হয়তো আমার সর্বনাশ হবে, নাহয় আমার হৃদয়ের।”
মায়া কথাগুলো বলে তাকায় জোহানের দিকে। জোহান তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো কিন্তু সে তাকাতেই জোহান মুখ ফিরিয়ে নিলো। হাসলো কেন যেন!

সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার নেমে আসছে। তবুও তারা সেখানেই বসে থাকে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। নীরবতার মুহূর্ত চলে। তবুও তারা বসে থাকে। সেখানেই।
.
.
পরেরদিন অভ্র যেয়ে পৌঁছায় সভ্যর অফিসে। তাকে হঠাৎ দেখে অবাক হয় সভ্য।
“ভাই আপনি এখানে?” সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।
“কেন আসতে পারি না?”
“তোমার অফিস, তুমি আসতে পারবেন না কেন? বসুন।”
অভ্র সোজা যেয়ে বসে সোফায়। সভ্যও এসে তার সামনের সোফায় বসে।
“চা খাবে?” সভ্য প্রশ্ন করে।
“রঙ চা।”
সভ্য তার এসিস্ট্যান্টকে পাঠায় তাদের জন্য চা আনতে। চা আসার পর অভ্র বলে দেয় অনুমতি ছাড়া কেউ যেন ভেতরে না আসতে পারে। সভ্য অবাক হয় তার কথায়।
সকলে বের হবার পর তাকে জিজ্ঞেস করে,
“কোনো জরুরি কথা ছিলো?”
“ছিলো তো,” সে প্রথমে আয়েশ করে চা’য়ের কাপে এক চুমুক দেয়, “চা ভালো হয়েছে। আগে যে চা বানাতো তা একটুও ভালো হতো না৷ নতুন কাওকে নিযুক্ত করে ভালো করলি।”
“ভাইয়া তুমি এত কষ্ট করে চা’য়ের জন্য এসেছে?”
অভ্র তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। একটি খাম তাকে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “দেখ এই ছেলেটাকে চিনিস না-কি? আর বলো, ওর কিছু হলে আমাদের কোম্পানির কোনো সমস্যা হবে না’কি?”
সভ্য খাম থেকে ছবি বের করে দেখে, বলে, ” ও তো আমাদের কোম্পানির নতুন আর্টিস্ট।”
“তা আমি ভালো করেই জানি। একারণে তোর কাছে এসেছি। ওর উপর কোনো কেইস হলে কোম্পানির ক্ষতি হবে?”
“ওটা তো হবেই কিন্তু… ”
“তাহলে প্লান চেঞ্জ করতে হবে।” অভ্র সভ্যর কথা কেটে বলে।
“কীসের প্লান? ভাইয়া আই হোপ তুমি আবার কোনো কান্ড ঘটাতে যাচ্ছো না। প্লিজ কারো কোনো সমস্যা করার প্রয়োজন নেই।”
অভ্র গভীর নিশ্বাস ফেলে চা’য়ের কাপটা টেবিলে রাখে। একটি ফাইল সভ্যকে দিয়ে বলে, “এটা পড়তে থাক, সব বুঝে যাবি।”
“এই কেইসের ব্যাপারে তো আমি দেখেছি। ও নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে। তাইতো গ্রুপে আবার জয়েন করতে পেরেছে।”
অভ্র বিরক্তির সাথে বলে, “তুই এখনো কি বুঝতে পারিস নি এই ইন্ডাস্ট্রিতে কীভাবে নিজের কোম্পানির সম্মান টিকিয়ে রাখতে হয়? যখন এত বড় একটা কেইস সম্পর্কে জেনেছিস তুই আরও খোঁজ নিবি না ছেলেটির ব্যাপারে? আর এত সহজে ও ঘুরে বেড়াতে পারে কীভাবে?”
“ও তো স্টুডেন্ট ভাইয়া।”
“হুম, তাই ভার্সিটির একটি মেয়েকেই টার্গেট করে ওর জীবন শেষ করে দিয়েছে।”
সভ্য কথাটা শুনে ফাইলটা ভালো করে দেখে। মেয়েটির কেসের সব তথ্য এখানে দেওয়া। এমনকি মেয়েটির শেষ চিঠিসহ কিছু প্রমাণও দেওয়া।
সভ্য জিজ্ঞেস করে, “প্রমাণ হাতে থাকলে এটা কেন পুলিশকে দিচ্ছো না?”
“মেয়েটা জীবিত থাকা অবস্থায় তারা শাস্তি পায় নি আর মরার পর এত সহজে পাবে? আর মেয়েটির পরিবার চায় না ওর মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়াতে ওকে নিয়ে সমোচলনা হোক।”
“তাহলে এখন?”
“তাহলে আমার মতন করে শাস্তি দিবো।”
“ভাইয়া কী করবে তুমি?” ঘাবড়ে প্রশ্ন করে সভ্য।
“আচ্ছা বল তো আমি বা তুই এমন জঘন্য কাজ করলে দাদাজান কী করতো?”
“মেরে ফেলতো একদম।”
“কেবল ওদের কাজের শাস্তি দিব, তাও সুদসহ। যেন অন্যকারো জীবন এভাবে নষ্ট না করতে পারে।”
সভ্য কিছুক্ষণ ভেবে বলে, “যেকোনো সাহায্য লাগলে আমাকে বলো, এই ব্যাপারে আমি তোমার সাথে আছি।”
“ইন্টারেস্টিং… এটা নতুন।”
“আমি সবসময়ই সঠিকের পাশে থাকি। তুমি জানো।”
সে এক এক করে দোষী পাঁচজনের প্রফাইল দেখে। শেষ পৃষ্ঠায় এসেই থেমে যায়, “ওকে আমার চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি…”
“অস্ট্রেলিয়ায়।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ অস্ট্রেলিয়ায়। এক মিনিট ও তো মেঘনা আপুর ছোট ভাই। মানে তোমার… ”
সে সম্পূর্ণ কথা শেষও করার পূর্বেই দরজা খুলে সভ্যর এসিস্ট্যান্ট ঢুকে পড়ে। অভ্র মেজাজ খারাপ করে বলে, “তোমাকে না বলেছিলাম এখন ডিস্টার্ব না করতে। আর তুমি অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়েছ।”
“মাফ করবেন স্যার কিন্তু জরুরি কাজ ছিলো। ইনারা ম্যাডামের ম্যানেজার কল দিয়েছিল। ম্যাডামের শরীর অনেক খারাপ হয়ে গেছে। হাস্পাতালে নিয়ে যাচ্ছে। সভ্য স্যারের ফোনে পাচ্ছিল না দেখে আমাকে জানাল।”
সভ্য আতঙ্কিত স্বরে বলে, “ইনারার কী হয়েছে?”
“জানি না তো স্যার। হাস্পাতালে নেওয়ার সময়ই কল দিলো।”
“কোন হাস্পাতালে?”
“আপনাকে মেসেজ দিয়ে রেখেছে।”
সভ্য তার ভাইকে জানায়, “ভাইয়া তোমার সাথে পরে কথা হবে। আমার এখন যেতে হবে।”
“দাঁড়াও আমিও আসছি।”
সভ্য দ্রুত রওনা দিলে তাকে এতটা অস্থির দেখে অভ্রও তার পিছনে যায়।

হাস্পাতালে পৌঁছে দেখে ইনারার একজন হেল্পার নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলো সভ্যর জন্য। তার ম্যানেজার আগে দিয়েই বলে রেখেছিল। সভ্য কেবিনে যেয়ে দেখে ইনারা বেডে শুয়ে আছে। ডাক্তার তার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে।

ইনারা তাকে দেখে একগাল হেসে হাত নাড়িয়ে হাই বলে। সভ্য তো আতঙ্কে ছিলো। সে বকা দেয় ইনারাকে, “তোমাকে এতদিন ধরে বলছি হাস্পাতালে আসতে। একটা কথা শুনো তুমি? দেখলে তো আজ এত অসুস্থ হয়ে গেছ যে। আমার কথা একটাও শুনো না। যদি কিছু হয়ে যেতো?” সে ইনারার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্বাস ফেলে, “আমার জান বেরিয়ে গিয়েছিল তোমার অসুস্থতার কথা শুনে।”
“আমি ঠিক আছি। ডোন্ট ওয়ারি।”
সে ইনারাকে ছেড়ে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”
ডাক্তার উওর দেয় তাকে, “সভ্য স্যার প্রথম আপমি আপনার অনেক বড় ভক্ত। দ্বিতীয়ত আমার সৌভাগ্য যে আমি আপনাকে খবরটা দিচ্ছি, আমার মনে হয় আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।”
সভ্য কথাটা শুনে স্থির হয়ে বসে থাকে। ড্যাবড্যাব করে একবার তাকায় ইনারার দিকে, আবার ডাক্তারের দিকে।

এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে সুরভি রুমে আসে। রুমে ঢুকেই প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো? ইনারার বাচ্চা তুই নিজের একটু খেয়াল….”
এতক্ষণে সভ্যর ধ্যান ভাঙে। সে প্রথমে স্বাভাবিক ভাষায় জিজ্ঞেস করে, “আমি বাবা হতে যাচ্ছি?”
আবার ইনারাকে জিজ্ঞেস করে, “আমি বাবা হতে যাচ্ছি?”
ইনারা লজ্জায় তার ওড়না দিয়ে মুখ লুকিয়ে নেয়।
সভ্য আবার উচ্চস্বরে বলে উঠে, “আমি বাবা হতে যাচ্ছি। আমি বাবা হতে যাচ্ছি।”
সে ইনারাকে জড়িয়ে ধরে। সে গালে চুমু খেতে নিলেই ইনারা থামায়। ইনারা অন্য সবাইকে দেখায় ইশারায়। বিশেষ করে তার বড় ভাইকে। সভ্য মাথায় আসে রুমে অন্য সবাই-ও আছে। সে প্রথম সুরভিকে বলে, “সুরভি তুমি খালামণি হতে যাচ্ছো।”
সুরভি তো সুযোগেই ছিলো সে সামনে যেয়ে বলে, “ভাইয়া এবার আমার পালা।”
সভ্য সরতেই সে ইনারাকে জড়িয়ে ধরে।

সভ্য দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে অভ্রকে,
“ভাইয়া আমি আজ অনেক খুশি।”
অভ্র প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। অনেক বছর ধরেই তার কারও সাথেই এত ভালো সম্পর্ক নেই। পরিবারের কারোর সাথেই আগের মতো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আজ সে-ও হেসে সভ্যর খুশিতে সামিল হয়।
ছোটবেলার মতোই তার মাথায় হাত রেখে বলে, “তুই জীবনের সব খুশিই ডিসার্ভ করিস।”
সভ্যর ঠোঁটের হাসি মলিন হয় এক মুহূর্তের জন্য। সে অভ্রকে ছেড়ে তাকে দেখে। ছোটবেলা থেকে কলেজ পর্যন্ত তার ভাই তার সব খুশির মুহূর্তে এটাই বলতো। আজ এতবছর পর তার মুখে এই কথা শুনে সে অবাক হবার সাথে আবেগীও হয়ে পড়ে। আবারও একগাল হেসে সে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে।

দুই বান্ধবীও তাদের দেখে অবাক হয়। অভ্রর এভাবে স্নেহ দেখানোটা তাদের কাছে স্বাভাবিক নয়। সুরভি ইনারার পাশে বসে বলে, “আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে সেদিন স্কুলে যে মেয়েটাকে দুই বেণি করে এসে বান্দরনীর মতো লাফাতে দেখতাম সে আজ মা হতে চলেছে।”
ইনারা তার গালে আলতো করে মেরে বলে, “আর তুই খালামণি।”
“আবার জিগায়। উফফ আমি তো ওদের জন্য নিজের হাতে ড্রেস বানাব, খাবার বানাব, তাদের পড়াবোও।”
“দেখ ভাই তোরই সব করতে হবে। আমার এত গুণ নাই।এত ধৈর্য্যও নাই। আর এখন তো সব আরও সহজ হয়ে যাবে, খালামণির সাথে বড় মা’ও হতে যাচ্ছিস।”
কথা শুনে সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে অভ্রর দিকে তাকায়। তারপর বিষয়টা পালটানোর জন্য বলে, “আরে সবাই নিজেদের মধ্যে খুশি পালন করলে হবে? ঘরেও তো জানাতে হবে।”
ইনারা বলে, “না, আজ না। এই উইকেন্ডে যেয়ে সবাইকে স্যারপ্রাইজ দিব। সবার রিয়েকশন আমি নিজের চোখে দেখব।”
“যা হুকুম আপনার মহারাণী।” সভ্য বলে।
ডাক্তারও জানায়, “উনি ঠিক বলেছেন। এছাড়া আমি চেকাপ করেছি তার রিপোর্ট আসলে ব্যাপারটা কনফার্ম হয়ে যাবে। আপনারা চাইলে উনাকে নিয়ে যেতে পারেন। আপাতত এই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী খাবার আর মেডিসিন দিয়েন। আবার রিপোর্ট দেখানোর পর এগুলো চেঞ্জ হবে।”

ডিসচার্জ হবার পর তারা বাহিরে আসলে সভ্য বলে, “সুরভি তোমাকে বাসায় ছেড়ে দিচ্ছি আসো।”
“আসলে ভাইয়া আপনার ভাই যখন মেসেজ দিয়েছিল ইনারার ব্যাপারে তখন অফিস থেকে দৌড়ে এসে পড়েছি। ছুটিও নেই নি। তাই আবার যেতে হবে। আমি রিক্সা নিয়ে চলে যাচ্ছি।”
“রিক্সা দিয়ে যাওয়া লাগবে না। আমরা তোমার অফিসের সামনে দিয়ে যাব।”
“না না…..আমার অফিস আপনাদের বাসার বিপরীত দিকে। আর এখন ইনারার রেস্ট দরকার। তাই একদম না।”

অভ্র তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে বলে, “আমার গাড়িতে জায়গা আছে। তাই তোমাদের সময় বরবাদ না করলে আমি খুশি হবো। সুরভি আসো।”
সুরভির উওরের পূর্বেই সভ্য বলে, “গ্রেট আইডিয়া। আর একসাথে সময় কাটানোর বাহানা কী লাভবার্ডরা ছাড়তে পারে? যাও যাও সুরভি।”
“না ভাইয়া…”
“কী না? আরে লজ্জা পাবার প্রয়োজন নেই যাও।”
সুরভি অভ্রর উপর মেজাজ খারাপ করে গাড়িতে উঠে।”
সভ্যও চড়ে তার গাড়িতে। গাড়ি সবার আগে তাদেরটাই চালু হয়। স্ট্রার্টের পর ইনারা জানালা দিয়ে মাথা বের করে তাদের বিদায় দিয়ে বলে, “টাটা আমার বাবুর বড়পাপা আর বড়’মা। একা ছেড়ে দিচ্ছি, দুইজন জমিয়ে প্রেম করো।”
কথাটা শুনে সুরভির মেজাজ খারাপ হলেও অভ্র ফিক করে হাসি দেয়।
সুরভি রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করে, “আপনি হাসছেন কেন?”
“আমি হাসলে তোমার কী সমস্যা?”
“ধ্যুর, আপনার সাথে কথা বৃথা।”
সে ফোন বের করে কল দেয় তাইফাকে। কথা বলার পর তাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল। সে বারবার আড়চোখে তাকায় অভ্রর দিকে।

অভ্র হেসে তার কাছে এসে বলে, “এভাবে লুকিয়ে দেখবার দরকার কী? দেখতে চাইলে ভালো করেই দেখো।”
সুরভি তার কপালে হাত রেখে পিছিয়ে দেয়, “দূরে থাকেন তো, যাস্ট বলতাম এখন বাসায় যাব।”
“অফিসে আবার কিছু হয়েছে?”
“আমি এসে পড়ায় তাইফা ইমার্জেন্সি বলে তুষার স্যার থেকে ছুটি নিয়েছে। এখন আর যাওয়া ঠিক হবে না। এখন ভাবছি আগামীকাল কী বলব? ইনারার কথা বললে সে এটাকে বড়সড় করে নিউজ বানিয়ে ছেড়ে দিবে।”
“বলো কেউ অসুস্থ হয়ে গেছে অথবা সিরিয়াস এক্সিডেন্ট করেছে। সিম্পল।”
“আপনার মতো অনায়াসে মিথ্যা বলার কৌশলটা যে আমার নেই।”
অভ্রর কথাটা শুনে মেজাজ খারাপ হয়। সুরভি তা বুঝে। তাইতো অভ্র তার দিকে তাকাতেই সে ভয়ে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
অভ্র আবারও হাসে তাকে দেখে। ড্রাইভারকে বলে, “সুরভির বাসার দিকে গাড়ি ঘুরাও।”
.
.
জোহান নিচে এসে দেখে জোরে গান ছেড়ে সবাই নাচছে। বাতাসে রঙধনুর রঙ উড়ে বেড়াচ্ছে। সবাই রঙ নিয়ে খেলা করছে। আশরাফ তাকে দেখেই এসে রঙ মাখিয়ে দেয়। তন্নিও তার পাশে ছিলো। সে তার গালে রঙ লাগায়। জোহান কাওকেই রঙ লাগায় না। সবার আগেই প্রশ্ন করে, “মায়া কোথায়?”
“ও আমাদের সাথে নামলো। তারপর আসছি বলে যে কোথায় গেল। ওর আবার এই নাচ গান পছন্দ না…এখন আরকি।”
“আচ্ছা আমি ওকে দেখে আসছি।”
“দাঁড়াও একমিনিট,” তন্নি দৌড়ে যেয়ে একটা রঙের থালা এনে বলে, “যেখানে দেখবে রঙ লাগিয়ে দিবে। তারপর জোর করে খেলতে নিয়ে এসো।”
জোহান একমুঠো লাল রঙ নিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে যায়। আশরাফ অবাক হয়ে তাকায় তন্নির দিকে, “কী করছিস তুই?”
“যাস্ট আমার বান্ধবীর নতুন প্রেমকাহিনী শুরু করায় সাহায্য।”
আশরাফ এখনো কিছু বুঝে না। তা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। তাই তন্নি বলে, “আমার সন্দেহ আছে, মায়া জোহানকে পছন্দ করে। ও তো নিজের থেকে কিছু বলবে না বা করবে না তাই আমারই করতে হবে। এবার বুঝলি?”
আশরাফ উপর নিচে মাথায় নাড়ায়।

জোহান গতকালের জায়গাতেই পায় মায়াকে। সেখানেই বসে ছিলো। সে পিছন থেকে এসে তার গালে রঙ মাখিয়ে দেয়। মায়া রাগি মুখে পিছনে তাকিয়ে বলে, “এসব কী? আমি সবাইকে মানা করেছি রঙ লাগাতে।”
তবে জোহান এখন আর ভয় পায় না তাকে। সে তার পাসে এসে বসে জিজ্ঞেস করে, “সবাই ওখানে মজা করছে, আর এখানে তুমি একা কেন?”
“এসব আমার পছন্দ না।”
“কোনো সময় পছন্দ ছিলো না, না’কি এখন পছন্দ না।”
মায়া উওর দেয় না।
জোহান বলে, “তুমি তো বলতে তুমি সবচেয়ে বেশি নিজেকে ভালোবাসো। তা-তো দেখা যাচ্ছে না। অন্যকারো জন্য নিজের চুল কেটে ফেললে, নিজেকেও চেঞ্জ করে ফেলেছ তাহলে নিজেকে ভালোবাসলে কীভাবে?”
“তুমি নিজেকে ভালোবাসো?”
জোহান হাসে, “এখন অন্যকেউ তো নেই তাই একটু একটু বাসি।”
মায়া মিটিমিটি হেসে মুখটা সামনের দিকে করে। জোহান বলে, “আসো সবার সাথে মজা করি।”
“তুমি যাও।”
“আমি কোনোমতে একা তো যাবো না। তুমি আমার সাথেই আসবে।”
সে মায়ার হাত ধরে নেয়।
সাথে সাথে কেঁপে উঠে মায়া। তার ভেতরের হৃদয়টাও। সে জোহানের দিকে তাকায় নরম দৃষ্টিতে। জোহান তার হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। অনুরোধের সুরে বলে, “আসো… প্লিজ।”
“এমন কিউট ফেস বানিয়ে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করছ?”
“আমি তো কিউটই।”
মায়া তার হাসি চাপা রেখে উঠে দাঁড়ায়। জোহান তার হাত ধরে তাকে নিয়েই দৌড় দেয় যেদিকে অনুষ্ঠান হচ্ছে।
মায়া একবার তাকায় জোহানের দিকে…আবার তাদের ধরা হাতটির দিকে…আবার জোহানের দিকে…

যেয়ে দেখে সবাই এখনো নাচানাচি করছে। তারাও সবার মাঝে ঢুকে পড়ে। মায়াকে পেয়ে তন্নি, আশরাফ, মেহেদী সবাই রঙের হামলা করে। সে বিরক্ত হয়ে জোহানকে বলে, “একারণেই বলেছিলাম আসবো না।”
জোহান হাসে কেবল তাদের দেখে।

তারা সবাই গ্রুপ করে নাচ শুরু করে। তন্নি দেখতে পায় মায়া ও জোহান সামনা-সামনি দাঁড়ানো। সে সুযোগ বুঝে মায়াকে সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। সে পড়ে যেতে নিলে জোহান তাকে ধরে নেয়। মায়া জোহানের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠে। সে সামনে তাকাতেই দৃষ্টিবন্ধন হয় দু’জনের। তার হৃদপিণ্ডটা আবারও বেহায়া হয়। স্পন্দনের গতি তার নিয়ন্ত্রণে বাহিরে হয়ে যায়।
“ঠিক আছো?” জোহান প্রশ্ন করে। হাত উঠিয়ে তার সামনে আসা চুলগুলো ঠিক করে দিচ্ছিল। তার পূর্বেই মায়া পিছিয়ে যায়। নিজের চুল ঠিক করে জোহানের প্রশ্নের উত্তর মাথা নাড়িয়ে দেয়।
যেতে নিলেই জোহান তার হাত ধরে নেয়। সে পিছনে তাকায়। জোহান তার কাছে এসে বলে, “তুমি আমাকে রঙ লাগাতে ভুলে গেছো।”
সে মায়ার হাতে রঙ দিয়ে সে হাতটা নিজের গালে ছুঁইয়ে দেয়। সে মুহূর্তে নিশ্বাস আটকে আসে মায়ার। সে চোখ বন্ধ করে নেয়।

আভাস পায় জোহান তার হাতটা ছেড়ে দিয়েছে। সে চোখ খুলতেই দেখে কয়েকজন জোহানকে নিয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে। হয়তো তার সাথে সময় কাটাতে। কে চাইবে না? সে তো বিখ্যাত তারকা জোহান। সবাই-ই তার সাথে সময় কাটাতে ব্যাকুল থাকবে। তাহলে জোহান তার সাথে থাকবে কেন? মায়া সব ভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে পিছনে ফিরে তার বন্ধুদের সাথে যোগ দেয়।

জোহান যাবার সময় পিছনে তাকায়। দেখতে পায় মায়া তার বন্ধুদের সাথে মজার সময় কাটাচ্ছে। তাদের সবাইকে এভাবে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকে।

চলবে…