অনুভূতির খাঁচা পর্ব-২৭+২৮

0
27

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-২৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

আধখোলা কাঁচ, বৃষ্টি ছোঁয়াচ
তোমার নামে মেঘের খামে চিঠি দিলাম আজ
আধভেজা প্রহর, আধভেজা শহর
আধভেজা তুমিও, আর আধভেজা আমার সফর….

মায়া সুর লাগিয়ে তার কন্ঠ মৃদু করে। গানটা শেষ করার পথে ছিলো সে। সে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। হঠাৎ তার কানের কাছে ভেসে উঠে জোহানের কন্ঠ,
“হালকা পায়ে রঙ ধোঁয়ানোর আবদার
মেঘ বলেছে বৃষ্টি আনবে বারবার
রাস্তা বেয়ে এক ছাতায় প্রেমের ঢল
রঙিন সাজুক আমার শহর অনর্গল….”

মায়া তার দিকে তাকায়। হেসে তার হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি জমাট করে। তা মারে জোহানের দিকে। নিজের চুলের ক্লিপ খুলে মুক্ত করে। সেখানে উঠে দাঁড়িয়ে পাখির মতো ডানা মেলে আকাশের দিকে তাকায়। দু’টো লাইন সে-ও গায়,
“মেঘেরা ক্লিপ খুলেছে, মন জুড়োয় খুশিতে
হালকা হাওয়ার সিম্ফনিতে কাটছে আজ অবসর,”
শেষ দুটো পঙক্তি জোহান ও মায়া একসাথে গান গায়,
“আধভেজা প্রহর, আধভেজা শহর
আধভেজা তুমিও, আর আধভেজা আমার সফর….”
জোহান তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মায়া তাকাতেই সে একগাল হেসে সামনের দিকে তাকাল। আবছা লাগছে চারপাশ। তাদের বোর্ট ফেরত যাচ্ছে। তবুও তার মনে হচ্ছে এত সুন্দর দৃশ্য সে অনেক বছর হয়েছে দেখে নি। আর এত ভালো সময় কবে কাটিয়েছে মনে নেয়। সে হাত তুলে মায়ার হাত ধরেই বলে, “পড়ে যাবে বসো।”
মায়া বসে পড়ে। বলে, “মনে হচ্ছে আজকের বৃষ্টি এই দৃশ্যকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য আমন্ত্রণে এসেছে। চারদিকে পানি আর পানি। মাঝখানে আমরা। আর বৃষ্টির টুপটুপ শব্দ। আর তার ছুঁয়ে যাওয়া। কী সুন্দর!”
“আর তোমার গান মুহূর্তটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে।”
“তাই? তাহলে তো তুমি আমার কাছে ঋণী থেকে গেলে আমি তোমার জন্য এই মুহূর্তটা আরও সুন্দর করে দিলাম।”
“তাহলে ম্যাডাম কীভাবে ঋণ শোধ করব আপনার?”
“একসময় চেয়ে নিব।”
“একটা প্রশ্নের উত্তর আজ পেলাম?”
“কী প্রশ্নের?”
“তুমিও গানকে আমার মতো ভালোবাসো না’কি?”
“আর কী উত্তর পেলে?”
“তোমার মুখের হাসি, প্রশান্তি আর এই মুহূর্তটার অনুভূতিতেই তো উওরটা পাওয়া যায়। আই থিংক তোমার আবার গান গাওয়া শুরু করা উচিত।”
“এখন বলবে তোমার এলবামের জন্য গাইতে।”
“আল্লাহ তুমি মানুষের মনের কথা পড়তে পারো?”
মায়া তাকে মাথা ঘুরিয়ে বলে, “কোনোমতেই সম্ভব না। আমি নিচে নামলাম।”
“একবার ভেবে দেখলে হতো না?”
মায়া তবুও তার কথা শুনে না। নিচে নেমে যায়।
নিচে নামলে তার বন্ধুরা ধরে তাকে। এত বছর পর সে গাইলো, হঠাৎ করে। কলেজের পর সে গানই বন্ধ করে দিয়েছিল। এত অনুরোধের পরও গাইলো না। তাহলে আজ কী হলো?
তাদের এত কথা কানে এসে জোহান নিচে উঁকি মারার চেষ্টা করে। তারপর হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে। তার ভেজা চুল আঙুল দিয়ে পিছনে করে নেয়।

দ্বিতীয় দিন আসে। আবারও গতকালের মতো সবার নৌকায় উঠে ঘোরার কথা। কিন্তু গতকাল বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগিয়ে বসে আছে মায়া। তন্নি গতকালের জন্য বকা দেয় অনেক। তাকে এত বলার সত্ত্বেও সে তার সাথেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তবে কি হয় কে জানে, হঠাৎ তার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটে আশরাফের কলের পর। সে চলে যায়। যাবার পূর্বে তাকে জানায় তার জন্য গরম চা’য়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কেয়ারটেকার চা নিয়ে আসে মায়ার জন্য। সে চা নিয়ে ধন্যবাদ জানায় কেয়ারটেকারকে। দরজা লাগাতে যাবার সে দেখে যে উনি যেয়ে পাশের রুমে নক দিচ্ছে। সে বলে, “রুমে তো কেউ নেই সবাই তো ঘুরতে গিয়েছে।”
তখনই পাশে দরজাটা খুলে। জোহান দরজা খুললে মায়া তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি নিচে যাওনি?”
“রাতে জ্বর ছিল ওষুধ খেয়ে ঘুম দিয়েছিলাম। তাই উঠতে পারি নি।”
চা নেবার পর কেয়ারটেকার চলে যায়। মায়া জোহানের দরজার সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, “জ্বর বেশি?”
সে জোহানের মাথায় হাত রেখে দেখে জ্বর আছে, তবে হাল্কা।
“এত বেশি নেই।”
জোহান রুমের ভেতর ঢুকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি যাও নি?”
“গলা ব্যাথা। ঠান্ডা লেগেছে। এজন্যই তন্নি মসলা চা পাঠালো।”
“আমারটাও খেয়ে নিও। আমার আবার চা পছন্দ না। ঘুমের মধ্যে আশরাফ চা’য়ের কথা বলল। মানা করার আগেই দৌড় দিলো। আর ভালো হলো তুমি আছো, নাহয় একা বোর হয়ে যেতাম।”
মায়া তার পিছনে রুমে ঢুকে। রুমের অবস্থা দেখে চোখ মুখ ফুচকা বলে, “রুমের অবস্থা কি করে রেখেছ? এই ডাস্টবিনের মতো রুমে থাকো কীভাবে?”
“যাবার আগে সব গুছিয়েই তো যাব।”
“আমার এলোমেলো জিনিস পছন্দ না।”
“তোমার সাথে তো থাকছি না। আশরাফের কোনো সমস্যা নেই। ইনফ্যাক্ট এখানের অর্ধেক জিনিসের বারোটা ওই বাজিয়েছে।”
মায়া বিরক্তির মুখ করে তার চা’য়ে চুমুক দেয়। তার নজর পরে টেবিলে রাখা জোহানের ডায়েরির উপর। ডায়েরিটা নিয়ে সে সোফায় বসে বলে,
“এটা তোমার গানের ডায়েরি না? নতুন কোন গান লিখেছ?”
সে ডায়েরিটা খুলে এক নজরে আগের কিছু গান দেখল। শেষের পৃষ্ঠাগুলোতে যাবার পূর্বেই জোহান এসে খপ করে ডায়েরিটি তার হাত থেকে কেড়ে নেয়।
সে আমতা-আমতা করে বলে, “লেখা শেষ হলে আমি নিজেই দেখাবো।”
তারপর তা নিজের ব্যাগে ভরে রাখে।

ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও মায়া এসে বিশেষ কিছু বলে না। জোহান বারান্দায় যেয়ে তার গিটার নিয়ে বলে, “এখানে আসো। আবহাওয়াটা সুন্দর।”
মায়া বারান্দায় যায়। আসলেই আবহাওয়াটা চমৎকার। মেঘলা আকাশ থেকে নামা হাল্কা বৃষ্টি বাতাসের সাথে মিশে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের। সাথে দক্ষিণা দিক থেকে ভেসে আসা বাতাসে মিলানো মিষ্টি ঘ্রাণ। সাথে জোহান তার গিটার বাজায়। তার গিটারের মৃদু সুরের সাথে আবহাওয়ার জাদু আরও মিষ্টি হয়ে যায়।

চা’য়ে চুমুক দিয়ে মায়া তা ছাদের বর্ডারে রাখে। সাথেই আবহাওয়া উপভোগ করে। জোহানের গিটারের সুর বন্ধ হয়ে যায়। সে চা’য়ের কাপ তুলে এক চুমুক দেয়। বলে, “বাহ মজা তো!” আবার আগের স্থানে রেখে দেয় কাপটা।
মায়া তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার চা তো আছেই।”
“এমনি ট্রাই করলাম। মজা আছে।”
মায়া সেদিকে ধ্যান না দিয়ে চা নিয়ে চুমুক দিলে জোহান আবারও তার হাত থেকে কাপটা নিয়ে যায়। এবার মায়া রাগ করে বলে, “আমাকে বিরক্ত করছ কেন?”
“আমি কী করলাম?”
“তোমার চা আছে রুমের ভেতরে। তাহলে আমার চা কেন ধরলে? ”
“সামান্য চা’য়ের জন্য এত রিয়েক্ট করছ? নেও তোমার চা।”
“সামান্য চা? চা’য়ের মূল্য বুঝো তুমি? আমার থেকে জিজ্ঞেস করো। আমেরিকায় যেয়ে কত কষ্টে ছিলাম আমার চা ছাড়া। না পেরে নিজেই শিখেছিলাম। আর এই চা এখন আর লাগবে না। তোমার চা আমি নিচ্ছি।”
“এটাই তোমার সমস্যা। কোনো এক কথা হলো আর তুমি রাগের বর্ষণ করে তুলো।”
মায়া তার কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজে যেয়ে রুম থেকে আরেক কাপ চা নিয়ে আসে। চা’য়ের এক চুমুক দেবার পর তার মাথা ঠান্ডা হয়।
সে বলে, “এক চুমুক চা’য়ের মূল্য তুমি কি বুঝবে জোহানবাবু?”
“একতো তোমার রাগ এর উপর তোমার যে হারে মুড চেঞ্জ হয় তা দেখেই মানুষ ভয় পায় বুঝলে? একারণেই কোনো ছেলে তোমার সাথে কথা বলতেও ভয় পায়। এই অবস্থা থাকলে সিঙ্গেলই থাকতে হবে সারাজীবন।”
“আমার চিন্তা করো না, একজনের সাথে চুক্তি করা আছে, ত্রিশ বছরের আগে কারও সাথে বিয়ে না করলে ওর সাথে করব।”
জোহান চোখ দুটো ড্যাবড্যাব করে তাকায় মায়ার দিকে। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমার কানে মনে পানি ঢুকেছে। আমি শুনেছি তুমি কারো সাথে চুক্তি করেছ বিয়ের জন্য!”
“ঠিকই শুনেছ।”
“তুমি মজা করছ তাইতো?”
মায়া চা’য়ে আয়েশে চুমুক দিতে দিতে ডানে বামে মাথা নাড়ায়।”
“তোমার মাথা কী আসলে ঠিক আছে? দুইদিন আগে অভ্র ভাইয়ার সাথে বিজনেস ডিল করতে বিয়ে করছিলে এখন আবার চুক্তি? ভালোবাসা, বিয়ে এসব কী তোমার কাছে মজা মনে হয়?”
“রিলেক্স এত হাইপার হচ্ছো কেন? ওর সাথে আমার কোনো বিজনেস নিয়ে চুক্তি হয় নি। আমেরিকায় আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। আশরাফের কাজিন। তারপর আমাদের বন্ধুত্ব হয়। ও আমেরিকায় আমার অনেক খেয়াল রেখেছে। কিন্তু একবছর পর বারবার প্রাপোজ করে। কিন্তু আমার কাছে তখন আমার লক্ষ্য থেকে কিছু বড় ছিলো না। তাই রিজেক্ট করে দেই। কিন্তু ও থামে না যেহেতু আমি কোনো সম্পর্কে ছিলাম না। তাই চুক্তি হয় যে ও আমাকে প্রাপোজ করবে না আমার ত্রিশ বছর না হওয়া পর্যন্ত। এরমধ্যে আমার বিয়ে না হলে আমি ওকে বিয়ে করবো, সিম্পল।”
“এটা সিম্পল?”
“শুনো এই কথা যেন তন্নি বা আশরাফ কেউ না জানে। ওদের বলিনি। এখানে দুইটা রিয়েকশন হতে পারে একতো আমি মাইর খেতে পারি নাহলে ওরা আমাকে ওরা সাথে সেট করার জন্য লেগে পড়বো।”
“ছেলের নাম কী?”
“সময় আসলে জানতে পাড়বে।”
জোহান নিশ্বাস ফেলে বলে, “অফিসের লোকেরা ঠিকই বলে তুমি আসলে অন্য জগতের প্রাণী।”
“কে বলে এই কথা? কার এত বড় সাহস?”
“সময় আসলে জানতে পাড়বে।”
“এই যে মিস্টার আপনি জানেন তো কাল থেকে আপনার অফিসের বস আমিই হবো?”
এমন সময় পাশের রুম থেকে মায়ার ফোনের শব্দ পাওয়া যায়। সে যাবার পর জোহান তার ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে শেষ পৃষ্ঠাটা খুলে আবার দেখে।

সেদিন রাতেই তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা যায়। যেয়ে পৌঁছায় ভোরে। ক্লান্তি দূর করার জন্যও বেশি সময় ছিলো না। কিছু ঘন্টা পরেই অফিস। মায়া তার অফিসে ঢুকে দেখে টেবিলের উপর তার ফেভারিট চকোলেট রাখা। সে অবাক হয় তা দেখে। তখনই তার কাছে ফোন আসে জোহানের। সে কল ধরে, আর ওইপাশ থেকে জোহানের কন্ঠ শুনা যায়,
“কেবিনে ঢুকতে দেখলাম তোমায়, টেবিলে কিছু রেখেছিলাম। পেয়েছ?”
“তুমি রেখেছ?”
“বাহ এত বড় কোম্পানি সামলাও অথচ দুইদিন আগে কাওকে তোমার ফেভারিট চকোলেটের কথা বললে আর আজ টেবিলে পেলে তাও বুঝতে পারো নি?”
“তোমার সাথে এতদিন ছিলাম না? তাই বুদ্ধি কমে গেছে।”
“এত প্রশংসা হজম হবে না।”
মায়া হাসে। প্রশ্ন করে, “তুমি কী করছ?”
“আপাতত প্রাক্টিস করছি। আর গানের সাথে কেমন মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট যাবে দেখছি। তোমার কোম্পানির টিম আসলেই অনেক টেলেন্টেড বলতে হবে।”
“বাছাই কে করেছে তাও দেখতে হবে। তো তোমার গান কবে শুনাচ্ছো?”
“এখন না, সম্পূর্ণ তৈরি হলে সবার পূর্বে তোমাকে শুনাবো।”
“আচ্ছা তাহলে তুমি তোমার কাজ করো, আমাকে আমার কাজ করতে দেও।”
“ওকে ম্যাডাম রাখছি।”
মায়া ফোন রেখে তার হাতের চকোলেটের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এতে তার গাল দুটোয় গোলাপি আভা ছড়িয়ে যায়।
.
.
শুক্রবার বিকেলবেলা, সুরভি যখন রাগে টগবগ করতে করতে রুমে ঢুকছিল, তখন সে দেখে অভ্র আয়েশে তার স্টাডিটেবিলে বসে বই পড়ছে।
“আপনি আমাকে বললে আমি নিজেই এসে পড়তাম। ফজলু মিয়াকে আমার বাসায় পাঠানোটা জরুরি ছিলো?”
“মেকাপ আর্টিস্টরা আসছে। চুপচাপ রেডি হয়ে নিও। আমরা সন্ধ্যা সাত টায় বের হবো।”
“আপনি আমার প্রশ্নের উওর না দিয়ে নিজের কথা রাখতে পারেন না।”
“আমি সবই করতে পারি। এখন তোমার চপরচপর বন্ধ করে চুপচাপ যেয়ে বসো। মেকাপ আর্টিস্টরা একটু পরই আসবে। আর আজ লক্ষ্মী মেয়ের মতো ব্যবহার করলে সময়ে তোমার বান্ধবীর কাছে নিয়ে যাব, নাহলে ওর স্পেশাল মুহূর্তটা মিস করতে হবে। ওকে?”
“আপনি আমাকে ব্লাকমেইল করছেন? আপনি মানুষটা এত খারাপ!”
অভ্র তার কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের বই’য়ে ধ্যান দেয়।
“আচ্ছা উনারা কয়টায় আসবে?” জিজ্ঞেস করে সুরভি।
“আসলে তো দেখবেই।”
সুরভির মন চাচ্ছিল টেবিলে রাখা পেপারওয়েট দিয়ে লোকটার মাথা ফাঁটিয়ে দিতে।
সে দেখতে চায় দেয়ালে অভ্রর সাথে তার দুইবন্ধুর ছবি এই রুমেও লাগানো। অভ্রসহ তার দুইবন্ধুর। সে ছবিটির সামনে যেয়ে দাঁড়ায়, জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা এইঘরে আপনার পরিবারের একটিও ছবি নেই। এই ছবিটি প্রায় প্রতিটা কক্ষেই, কেন?”
“অনেক সময় কিছু মানুষের সাথে সম্পর্ক পরিবার থেকেও গভীর হয়। জীবনের অর্ধেক সময় আমার ওদের সাথেই কাটানো।”
“আচ্ছা নক্ষত্র ভাইয়া এখন কোথায়? হঠাৎ করে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো, সাথে ইন্টারনেট থেকেও গায়েব হয়ে গেল।”
অভ্র বই পরার মাঝে তার কথা শুনে বইটা শব্দ করে টেবিলে রেখে দেয়। সে উঠে যায় সুরভির কাছে, “নক্ষত্র তোমার ভাই কবে থেকে হলো?”
“ও’মা রাগ করার কী আছে? আমি তো স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলাম।”
“তোমার কিছু জিজ্ঞাসা করা লাগবে না। রুমে যাও।”
“আজব একটা লোক আপনি।”
সুরভি বিরক্তি নিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। বের হবার পর ফজলু মিয়া তাকে একটি রুমে নিয়ে যায়।

রুমে যাবার পর ফজলু মিয়া বলে, “ভাবি একটা সাহায্য করেন ফজলু মিয়ারে, ফজলু মিয়া দোয়া দিবো আপনের ভরে ভরে।”
“দেখেন ফজলু ভাই আমি আপনার ভাবিটাবি না। আর বলেন কি সাহায্য লাগবে?”
“কোন শাড়িটা কিনছিলেন সেদিন ভুলে গেছি তো, একটু খুঁজে নিলে আমার অভ্র ভাই থেকে বকা খাওয়া লাগবো না-তো।”
“আমি কোথায় খুঁজবো?”
ফজলু বিয়ে আলমিরার দুই পাট খুলে দেয়। সুরভি দেখতে পায় সেদিন স্টোরে যতগুলো শাড়ি সে পরেছিল সব শাড়ি এখানে আছে। তার ভ্রু কপালে উঠে যায়, “এতগুলো শাড়ি!”
“আমার অভ্র ভাই তো গ্রেট, তাই নিজের বউয়ের লাইগা করে রাখছে সব শাড়ি সেট।”
সুরভি বিড়বিড় করে বলে, “এই বড়লোকদের টাকার মূল্য নেই। টাকা উড়ালেই নিজেকে গ্রেট মনে করে।”
এসব জিনিস মাথা থেকে বের করে সে তার জন্য বাছাই করা শাড়িটা বের করে বিছানায় রাখে। ফজলু মিয়া একগাল হেসে বলে, “অভ্র ভাইয়ের পছন্দ সেরা, তাইতো এত ভালো ভাবি বাছাই করল অনায়াসে।”
“আচ্ছা আপনার ভাই তো আপনাকে সব বলে তাই না? এটা বলেনি যে এই বিয়ে যাস্ট নাটক? আপনার অভ্র ভাই এই পৃথিবীর শেষ লোক হলেও তাই বিয়ে করব না আমি।”
এমন সময় মেকাপ আর্টিস্টরা আসে। দুইজন আসার পর ফজলু মিয়া সেখান থেকে চলে যায়।

অভ্রর তৈরী হতে দশ মিনিটও লাগে না। কিন্তু সে তৈরি হয়ে বসে থাকে একঘন্টা। সে ঘড়ি দেখতে দেখতে ফজলুকে ডাক দেয়, “এখনো হয় নি সুরভির?”
“অভ্র ভাই অপেক্ষা করে আর দুইমিনিট ধইরা, ভাবিরে দেইখা যদি বুক ধকধক না করে তাইলে মাইরেন আমারে মন ভইরা।”
অভ্র আরও বিরক্তবোধ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, “ওকে তাড়াতাড়ি বের হতে….”

ঘড়ির থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় সামনের দরজা দিয়ে আসছে একজন হুরকন্যা। সাদা শাড়ির সাথে, সাদা গহনা, তার খোলা কৃষ্ণকেশ থলথল করে বয়ে পড়ছিল কোমর পর্যন্ত। চুলে লাগানো সাদা রঙের মুক্তা। চন্দ্রের এক নূর তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বললেও ভুল হতো না।
অভ্র চোখ বন্ধ করে আবার খুলে দেখে, এটা কী স্বপ্ন? না, স্বপ্ন হলে তো এখনই ভেঙে যেত তাই না?
“আমাকে ঠিক লাগছে তো?” সুরভি জিজ্ঞেস করে।
অভ্র নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে, “হ্যাঁ ঠিকই লাগছে।” সে উঠে নিজের সাদা কুর্তার হাতা ঠিক করতে করতে বলে, “জলদি আসো তোমার জন্য দেরি হয়ে গেছে।” বলে বেরিয়ে যায় নিচে যাবার উদ্দেশ্যে।
সুরভি মনে মনে বলে, “অভদ্রের যদি এওয়ার্ড থাকতো তাহলে এই লোকটাই পেতো। ঠিকই লাগছে। ঠিক লাগছে কি কত সুন্দর লাগছে আমাকে।”
সে যাবার পথে আয়নায় একবার নিজেকে দেখে। আসলে সুন্দর লাগছে না? না, সুন্দর তো লাগছেই। লোকটাই খারাপ!

গাড়িতে বসেও অভ্র বারবার সুরভিকেই দেখছিল কিন্তু সুরভি তাকাতেই চোখ সরিয়ে নেয়। তারা পৌঁছায় পার্টির ভ্যানুউতে। অভ্র তার জন্য গাড়ির দরজা খুলে তার হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সুরভি তার হাত না ধরে নিজেই গাড়ি থেকে বের হয়ে বলে, “আপনার কী শরীর খারাপ?”
“না, কেন?”
“তাহলে জেনটালম্যান হবার চেষ্টা কেন করছেন?”
অভ্র তার দিকে সরুদৃষ্টিতে তাকায়। তারপর তার পাশে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরে নিজের কণুইয়ে রাখে। আর ক্কড়া কন্ঠে বলে, “পার্টিতে সবার সামনে একটু আদবের সাথে থেকো।”
“আমি আদব কায়দা জানি বেয়াদব তো…” তার কথা শেষ না হতেই অভ্র তার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়। তারা হেঁটে ভেতরে ঢুকতে থাকে। সুরভি আবারো মৃতুর সাথে বলে, “তাও ভালো হয়েছে লোক দেখানোর ভয়ে এত ভালো ব্যবহার করছেন, নাহলে আমি তো ভাবছিলাম কোন ভূতের ছায়া পড়লো আপনার উপর? মানে বুঝেছেন তো ভূত আপনার থেকে ভদ্র হবে এটা বলছি।”
অভ্র জোর করে হেসে বলে, “বেশি কথা বললে আজ বাড়িতে যাবার কথা ভুলে যাও।”
“আপনি না গেলে আমি দাদাজানের সাথে চলে যাব।”
“এটা তো পলিটিকাল পার্টি। দাদাজান এখানে আসবেন না।”
সুরভি থেমে যায়। অবাক স্বরে বলে, “আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন।”
অভ্র তার হাত ধরে নিজের সাথে নিয়ে যায়, “নিজের গলার স্বর নিচে রাখো। আর ভেতরে ভালোভাবে থেকো। এখানে সবাই সকলের বন্ধু ও শত্রু একত্রে। তোমার এক কথা হয়তো আমার জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে, নয়তো তোমার জন্য।”
সুরভি তার সাথে হাঁটতে শুরু করে। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “আপনি আমার সাথে এমন নাটক কীভাবে করতে পারেন?”
“এভাবে বলছো যেন কখনো তুমি নাটকই করো নি।”
“এনগেজমেন্টের দিনের কথা এখনো বলছেন?সেদিন আপনি আরও বড় ঝামেলা করেছিলেন।”
“এরপর করো নি? সেদিন রিসোর্টে তুমি আমাকে কল করে ডেকেছিলে রুমে। অথচ তোমার জায়গায় সেখানে ছিলো রেশমি। ও আমার সাথে ঘনিষ্ঠ সবার চেষ্টা করছিল আগের থেকেই।”
“আপনি জানতেন?” অবাক হয় সুরভি।
অভ্র বাঁকা হাসে, “আসলেই? আমি তো প্রথমে আন্দাজ করতে পেরেছি কিন্তু পরে কনফিউজড ছিলাম যখন ও তোমার নামে খারাপ বলেছে। তোমার কথা বাদ কিন্তু ইনারা কখনোই এমনটা করতে বলবে না। কিন্তু তুমি বলতেই পাড়ছিলে না কেন ডেকেছ আমায়। তারপর রাতে তোমার পা’য়ে পানি পড়েছিলো কিন্তু ইনারা এমন ব্যবহার করল যেন গরম পানি ছিলো। ডট কানেক্ট করলে ব্যাপার দুইটা সিম্পল হয়ে যায়। কিন্তু তোমাদের অভিনয় ভালো ছিলো, আমি তো আসলই ভেবে ছিলাম যতক্ষণ না পর্যন্ত জানতে পেড়েছি যে সেটা ঠান্ডা পানি ছিলো।”
“রাতের ব্যাপারটা আমিও জানতাম না। ইনারা আমাকে বলেনি। পরেরদিন সকালে জানতে পেরেছিলাম আপনি ওর পরীক্ষায় পাশ।”
“পরীক্ষায় পাশ?”
“হ্যাঁ, ও ভাবে আপনি আমাকে ভালোবাসেন, আমার কেয়ার করেন। আমি ভেবেছিলাম আমার বান্ধবীটা চালাক। কিন্তু আপনার নাটকের কাছে ও নিজেও ফেল হয়ে গেল।”
অভ্র হেসে তার দিকে তাকায়, “কেন তুমি চাও না আমি তোমাকে ভালোবাসি?”
সুরভি তাকায় অভ্রর দিকে। নজরে নজর আটকায়। সুরভি বিস্মিত দৃষ্টি দেখে অভ্র হাসে। সে চোখ সরিয়ে নেয়। তারা ভেতরে ঢুকে। অভ্র সুরভির হাত ছাড়ে না।

তারা ভেতরে ঢুকে। সেখানে যেয়ে জানতে পারে সুরভি এটা প্রধানমন্ত্রীর ছেলের এনেভার্সিরি পার্টি। তাই বেশিরভাগ তাদের রাজনৈতিক পার্টিরই লোক এখানে। অভ্র অনেকের সাথেই কথা বলে। তাদের সাথে সুরভিকে নিজের ফিয়োন্সে বলেই পরিচয় করায়। ঘন্টাখানিক ধরে এমনটাই চলে অথচ একমুহূর্তের জন্যও অভ্র তার হাত ছাড়ে না।

তারপর এনাউন্সমেন্ট হয়। যাদের এই এই আয়োজন তারা আসছে, “লেডিস এন্ড জেন্টালম্যান যাদের অপেক্ষা ছিলো এতক্ষণ ধরে তাদের স্বাগতম জানান। জনাব তৌসিক আর তার স্ত্রী মেঘলাকে।”
মেঘলা নামটা চমকে উঠে সুরভি। মেঘলা তাহলে প্রধানমন্ত্রীর ছেলের স্ত্রী? সে অভ্রর দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টিনুসারে তাকায় সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নামছিল তৌফিক ও মেঘলা। মেঘলার ছবিই সে অভ্রর বাসায় দেখেছিল। অভ্র ও নক্ষত্রের সাথের মেয়েটিই মেঘলা। তাকে দেখে সুরভি নিজেই চোখ সরাতে পারে না। ছবি তার সৌন্দর্য ধরতেই পারি নি, সামনা-সামনি তারচেয়ে দশগুণ বেশি সুন্দর মেঘলা। সে যত সামনে আসছিল ততই তার সৌন্দর্য বাড়ছিল। হলের সকলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। তার ফর্সা ত্বকে লাল রঙের শাড়িটা ফুকটে ছিলো। নীল রঙের চোখের মণি, সোনালী ও বাদামি রঙের ঘন চুল। এককথায় তার সৌন্দর্য দেখে চোখ ফেরাতে পারে না কেউ। তার ঠোঁটের কোণে ছিলো মৃদু হাসি। সে মৃদু হেসে সবাইকে সম্মান জানানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সামনে আসতে আসতে হঠাৎ তার হাসিটা মলিন হয়ে যায়। মেঘলা তার স্বামীর হাত ধরে তাদের সামনে দিয়ে যায় তবুও সে পিছনে তাকিয়ে তাদের দিকে তাকায়। সুরভি তা খেয়াল করে, সে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মেঘলা তার দিকেই তাকাচ্ছে।

চলবে…

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-২৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সুরভি তা খেয়াল করে, সে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মেঘলা তার দিকেই তাকাচ্ছে। অভ্রও তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তার চোখ আজ প্রথম ভেজা দেখল সুরভি। বিষয়টা তার কাছে অনেকটা বিভ্রান্তিকর লাগে।
আরিফুর ইসমাত অভ্রর চোখে সে কখনো পানি দেখবে বলে কল্পনাও করে নি।

অভ্র তাকায় সুরভির দিকে। সে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো, বিস্মিত দৃষ্টিতে। অভ্র অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। নিজেকে সামলে বলে, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আসলে প্রেমে পড়ে গেলে না’কি?”
“আমি হয়তো কল্পনা করছি, নয়তো আপনি সত্যিই কাঁদছিলে!”
“কল্পনাই ভেবে নেও।”
সুরভি দৃষ্টি স্থির করে মেঘলার দিকে। তারা প্রধানমন্ত্রীর পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। তাদের সামনে একটি ট্রলিতে কেক আনা হয়৷
সুরভি অভ্রকে বলে, “উনি কি সেই মেঘলা, যার কথা সেদিন ফজলু ভাই বলেছিলেন এবং তার ছবিই আপনার দেয়ালে লাগানো?”
“দুইটির উওরই এক, হ্যাঁ।”
“ওহ।”
“জিজ্ঞেস করবে না, মেঘলা আমার কে?”
“আপনার যেই হোক, আমার কী? এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
তৌফিক মাইকে একটা স্পিচ দেয় মেঘলাকে নিয়ে। তাকে কতটা ভালোবাসে, তাদের বিয়ের কথা, মেঘলাকে প্রথম দেখার অনুভূতি, সব। তখন তার শশুর এবং মেঘলার ভাইকে ডাকে।
আর তার ভাইকে দেখার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলো না সুরভি। সেই রেইপ কেইসের একজন দোষী হলো মেঘলার ভাই। অন্তত তার এটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে তার চিন্তাকে সত্যি মানতে পারে না। সে বাসায় যেয়ে আবারও ফাইল চেক করে ছেলেটার ছবি দেখে নিশ্চিত হবে।

হঠাৎ সে অনুভব করে অভ্র তার হাত আরেকটু শক্ত করে ধরেছে আর একটু উঁচুতে উঠায়। সে তাকায় তার হাতের দিকে, তারপর অভ্রর দিকে, এরপর তার দৃষ্টি অনুসারে মেঘলার দিকে। আবারও অভ্রর দিকে। তারা ইশারায় কিছু বলছিল কিন্তু কি বলছিল সে বুঝতে পারে না। তবে এইবার দুইজনের ঠোঁটের কোণে হাসি ছিলো। সুরভি বুঝে উঠতে পারে না তাদের মধ্যে কী চলছে? অথবা তাদের সম্পর্ক কী?
তারপরও কিছু সময় কাটে। অভ্র সুরভির সাথেই ছিলো সারাক্ষণ। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিলো মেঘলার উপর। সুরভি তা খেয়াল করলেও এতে ধ্যান দেয় না সে। সে তাইফাকে বাকি ছেলে দুইটার ছবি দিতে বলে।

সে সন্ধ্যায় প্রথমবার অভ্র সুরভির হাত ছাড়ে। আর সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে, “আমি না আসা পর্যন্ত এইখান থেকে কোথাও যাবে না। আর কারও সাথে কথা বলবে না। কারও সাথে না। বুঝলে?” বলে সে চলে যায়। সে দেখে মেঘলাও স্টেজে নেই। তার মনে হয় দুইজনের মধ্যে আসলেই কোনো যোগাযোগ আছে। কিন্তু আবার ভাবে সে তাদের নিয়ে এত ভাবছে কান? তারা দুইজন যা করার করুক, তার কি?
এমন সময় সে দেখে তাইফা হোয়াটসঅ্যাপে তাকে ছবি পাঠিয়েছে। কিন্তু সেগুলো ডাউনলোড হচ্ছে না। হয়তো নেটওয়ার্কের কারণে। তাই সে সামনের দরজার দিকে যেয়ে বারবার ছবি ডাউনলোড করার চেষ্টা করছিল। এমন সময় একজন ওয়েটারের সাথে ধাক্কা লেগে তার হাত থেকে ফোন পড়ে যায়।
“সরি ম্যাম…আই এম সো সরি।” ওয়েটার তার থেকে ক্ষমা চায়।
“ইট’স ওকে।”
সুরভি তার ফোন তুলতে নিলে দেখে একজন আগের থেকেই তার ফোন তুলতে ঝুঁকেছে। সে উঠে ফোনটা যখন তার দিকে এগিয়ে দেয় তখন সে দেখতে পায় লোকটা তৌফিক। সে ফোনটা নিয়ে জলদি স্কিন অফফ করে দেয়।
“ধন্যবাদ।” সুরভি জানায়।
“মাই প্লেজার। আপনার ফোন ঠিক আছে তো?” বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করে তৌফিক।
“জ্বি।”
“আপনি কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?”
সুরভি মাথা নাড়ায়।
তৌফিক প্রশ্ন করে, “আপনার ফোনে মৃদুলের ছবি কী করছে?”
“মৃদুল কে?”
“আমার শালাসাহেব।” সে হাত তুলে মেঘলার ভাইয়ের দিকে ইশারা করে। সুরভি সেদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয় এই ছেলেটাই সেদিনের রেইপ কেইসের সাথে জড়িত। সে সময় সুরভি বুঝতে পারে না সে কি বলবে বা করবে। তৌফিককে সত্যিটা বলা সম্ভব না এবং মিথ্যা কি বলবে ভেবে পায় না।
তখন তৌফিক হেসে বলে, “আপনি না বলতে চাইলে সমস্যা নেই। জোর করছি না।”
তখন শান্তির নিশ্বাস ফেলে সুরভি। তখনই কল আসে সুরভির ফোনে। ‘zonab ovodro’ নামে। সে কল ধরতেই ওপাশ থেকে অভ্র চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় তুমি?”
“পার্টিতেই আছি।”
“তোমাকে বলেছিলাম না এই জায়গা থেকে নড়বে না। এখানে কতরকমের মানুষ আছে। তুমি না বুঝে কোথাও গেলে কেন? কোথায় তুমি?”
“আহা অভ্র আমি ঠিক আছি। আপনি ওখানেই দাঁড়ান, আমি আসছি।”
তার কল কাটার পর তৌফিক আবারও প্রশ্ন করে, “আচ্ছা আপনাকে জনাব অভ্রর সাথে দেখেছি। আপনার কী হয়?”
সুরভি এখানেও দ্বিধাবোধ করে। সে আমতা-আমতা করে বলে, “আমার…আমার বাগদত্তা।”
“ওহ, আপনাদের একসাথে মানায়।”
“আমি তাহলে আসি। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো।”
“আমারও।”
তৌফিক হাসি দিয়ে বিদায় জানায় তাকে। সুরভি মনে মনে বলে, “রাজনীতিতে হয়তো ভদ্রভাবে কথা বলতে পারে এমনও লোক আছে। আমি অকারণে সবাইকেই খারাপ ভাবতাম। কোথায় উনি এত সুন্দর ভাবে কথা বলে আর কোথায় ওই অভদ্র, আমার সাথে ত্যাড়ামি ছাড়া কথা বলতে উনার পেট ব্যাথা হয় যেন।”
সুরভি জাবার পর তৌফিক তার এক লোককে ডাকে, “এই মি:অভ্র, তার পরিবার আর তার ফিয়োন্সের খোঁজ বের করো।”
“হঠাৎ? সব ঠিক আছে তো সাহেব?”
তৌফিক তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “আমার থেকে প্রশ্ন করার মতো সামর্থ্য তোমার আছে?”
“মাফ…মাফ করবেন সাহেব। ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না।”
“গেট লস্ট।”

সুরভি আগের স্থানে যেয়ে দেখে অভ্র সেখানেই তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তাকেই ফোন দিচ্ছে। সে অভ্রর সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে বিরক্তির সুরে বলে, “আমি তো বলেছিই আসছি। এতবার কল দেবার কী দরকার?”
অভ্র তার কন্ঠ শুনে পিছনে তাকায়। সুরভিকে দেখে তার যেন নিশ্বাস আসে। সে সুরভির গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় গিয়েছিলে তুমি? ঠিক আছো তো?”
“আপনি…আপনি এত চিন্তা করছেন কেন? আমি ঠিক আছি। এখানে এত চিন্তিত হবার কিছু নেই।”
“চিন্তিত হবার কিছু নেই? তুমি নিজে সেদিন দেখেছিলে ওই মেয়ের ফাইল। ক্ষমতার জোরে সবাই সব অপরাধ থেকে পাড় পেয়ে যায়। তাই অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। তুমি আমার দায়িত্ব, তোমাকে এখানে আনাই আমার উচিত হয় নি।”

সুরভি তার এমন চিন্তা দেখে নিজেও দ্বিধায় পরিচয়। মানুষটাকে সে আসলে বুঝতে পারে না। কখনো ভীষণ রুক্ষভাষী আবার কখনো ফুলের ন্যায় নরম তার সুর। কখনো নিজেই তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে, আর কখনো তার চিন্তায় আত্নহারা হয়। ঠিক কী চলে এই লোকটার মাথায়?
এখানে তারও মনটা একটু গলে, সে নরমসুরে বলে, “আমি একদম ঠিক আছি।”
“কারও সাথে কথা বলো নি তো তুমি?”
অভ্রকে এতটা চিন্তিত দেখে সুরভি মিথ্যা বলে দেয়, “না।”
এখন অভ্রর নিঃশ্বাস ফিরে। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে তার হাত ধরে বলে, “চলো আমরা এখন যাই।”
“কিন্তু সবে তো কেবল যাদের জন্য পার্টি তারা এসেছে। আপনি তো বলেছিলেন আপনার আরও সময় লাগবে।”
“আমি যে কাজের জন্য এসেছিলাম, তা শেষ। এবার তোমার ইচ্ছা পূরণ করি ঠিকাছে? তোমার বান্ধবীর স্পেশাল মোমেন্ট মিস করলে আবার আমাকে খোঁটা দিবে।”
“তা তো দিবোই।”
তারা সেখান থেকে বের হবার পূর্বে সুরভির দৃষ্টি মেঘলাকে খুঁজে। কিন্তু তার দেখা পায় না।

তারা গাড়িতে উঠার পর রওনা দেয় ইসমাত ম্যাশনের দিকে। সুরভি আড়চোখে তাকায় অভ্রর দিকে। কিন্তু অভ্রর দৃষ্টি তার উপর পড়তেই সে চোখ সরিয়ে নে। অভ্র বাঁকা হেসে বলে, “দেখতে হলে ভালো করেই দেখতে পারো। এভাবে চুরি করে দেখার কিছু নেই। আপাতত আমি তোমার জন্যই রিসার্ভ।” সে তার এনগেজমেন্ট রিং দেখিয়ে বলে।
সুরভি ভেংচি কেটে বলে, “আপনাকে দেখার মতো আছে কি?”
“লুকিয়ে তো তুমিই দেখছ।”
“ভাবছিলাম।”
“কী ভাবছিলে?”
“যে আপনি এত আজব কেন? কখনো আমাকে হুমকি দেন, আর কখনো যত্ন নেন।”
“আমার একটাই সমস্যা। আমার ইগো অনেক বেশি। পরাজিত হওয়া আমার চরমভাবে অপছন্দ। আমার যা চাই, তা পাবার জন্য যেকোনো পর্যায়ে যেতে পারি।”
.
.
মায়া আজ অনেক মাস পর তাদের বাসায় এলো। তার মা ফোন করে তাকে আসতে বলেছিল। আজ রাতে ফ্যামিলি ডিনার আছে। যদিও তারা আসতে দেরি হয়নি, তবুও সে এসে দেখে আমায় টেবিলে বসেছে খাবারের জন্য। সেখানে কেবল তার পরিবার ছিল না। সে সাথে তার বড় দুলাভাই ওমর, ওয়াহিদ এবং তাদের মা ছিলেন। ওয়াহিদের মা তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। তাকে জড়িয়ে ধরে তারপর ছাড়ে। তাকে দেখে বলে, “কত বড় হয়ে গেলে তুমি? আর কতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে তোমার।”
“ভালো আছেন আন্টি?” মায়া তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি এঁকে বলে।
“আল্লাহ যা রেখেছে আলহামদুলিল্লাহ। একটু অসুস্থ থাকি তাও সেটা আল্লাহর ইচ্ছা। আমি জানি তোমার আমাদের উপর রাগ করার অধিকার আছে কিন্তু তাও তুমি তোমার বড়বোনের বিয়েতে আসবে না?”
ওমর তার কথা সহমত হয়, “সত্যিই মায়া, তুমি বিয়েতে না আসায় আমি খুব মন খারাপ করেছি।”
“জিজু আসলে তার একমাস পর আমার এক্সাম ছিলো তো তাই…”
“দুইদিন আসতে বেড়াতে।”
মমতা বিরক্তির সুরে বলে, “ও আসে নি তো কী হয়েছে? বিয়ে তো হয়েছে না’কি?”
ওমর মমতাকে ইশারা দেয় চুপ করতে। মমতা এতে আরও বিরক্ত হয়ে বলে, “আমি কী খারাপ কিছু বলেছি?”
মিতা তখন বলে, “মমতা আপি তো আসলে ভুল বলে নি। বিয়েতে না এসে নিজের মুড নষ্ট না করে একদম ইউনিভার্সিটিতে প্রথম এসে গেছে। আমার মায়া আপি বেস্ট, বেস্ট, বেস্টেস্ট।”
ওয়াহিদের মা বলেন, “তোমার কথা শুনে আমি সত্যিই অনেক খুশি মামনী। এককালে সকলেই চিন্তা করতো তুমি জীবনে কিছু করতে পারবে না। আর আজ সবচেয়ে বেশি সফল তুমি। ওয়াহিদ আমাকে বলে তো তুমি কীভাবে সম্পূর্ণ কোম্পানিটাকে সামলেছো। আমাদের মেয়েরা এত এগিয়ে গেলে কত ভালো লাগে।”
ওয়াহিদের নাম শোনায় মায়ার ঠোঁটের হাসিটা এক মুহূর্তের জন্য উড়াল দেয়। সে তাকায় ওয়াহিদের দিকে। তারপর হাসিমুখে ওয়াহিদের মা’কে বলে, “আপনাদের দোয়ার কারণেই তো সব হয়েছে।”
এতক্ষণে মায়ার বাবা আসে, “মাফ করবেন বেয়াইন। বেয়াইকে আসার জন্য বলতে বলতে বিজনেসের কথা শুরু হয়ে গেছে তাই দেরি হয়ে গেল।”
“আরে বেয়াই কি বলেন এখানে ক্ষমা চাওয়ার কি হলো? আমি মায়ার সাথে কথাই বলছিলাম। মেয়েটা যা করেছে তাতে আমরা সবাই অনেক গর্বিত।” সে মায়াকে আবার বলে, “মামনী বসো।”
মায়া তার পাশের চেয়ারেই বসে। মায়ার বাবাও চেয়ারে বসে বলে, “এমন আহামরি আর কি করল? এতটুকু ক্যারিয়ার তো সবাইকেই গড়া উচিত।”
মায়া বসে কথাটা শুনে তার বাবার দিকে তাকায়। হেসে বলে, “তাও আফসোস এই ঘরে আর কেউ এতটুকুও পাড়ল না।”
কথাটা শুনে বাবার মুখ কালো হয়ে যায়। তখন তার ভাই রাগান্বিত স্বরে বলে, “মায়া এটা কেমন কথা?”
“আরে ভাইয়া তুমি গায়ে লাগিও না। তোমার এখনো সময় আছে। চেষ্টা চালিয়ে যাও। যদিও এতে তোমার বাবার সাহায্য লাগবে বাট চেষ্টা করতে কি সমস্যা?”
তার ভাইয়ের মেজাজ তখন খারাপ হয়ে যায় কিন্তু
সে সকলের সামনে কিছু বলতে পারে না। তবে ওয়াহিদ এবং মিতা খুব কষ্টে তাদের হাসি ধরে রাখে।

এমন সময় মায়ার মা রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে আসে।তার পিছনে সাহিয়া চাচীও খাবার নিয়ে আসে, “আরে মায়ামণি আসছে যে। কীগো মায়ামণি আমগো কথা মনে পড়ে না? দেহা করতে আহো না কে?”
“সবার তো আর মনে পড়ে না গো চাচী।”
“এডা কইয়ো না। তোমার কথা আমার খুব মনে পড়ে। কিন্তু তোমারে না কইছি চুল লম্বা কইরো রাজকুমারীর মতো চুলকি কাইট্টা কী অবস্থা কইরয়া লাইছো। এর উপরে কতডি লাল লিপিস্টিক থুইব্বা আইলে মিষ্টি দেহা যায় না তোমাকে। তুমি তো এমনেই পরীর মতো সুন্দর।”
মায়ার বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, “কথা শেষ হলে কাজও করেন, যান।”
মায়ার মা এসে তার পাশে দাঁড়ায়, “তোর নিজের বাসায় এত ফর্মালি আসা লাগে? আর তোকে দাওয়াত দিতে হয় কেন? সময় পেলে আমাদের সাথে দেখা করতে আসতে পারিস না? আজ দেরি করলি কেন? তোর দেরি হচ্ছিল বলে সবাই খাবার খেতে বসে গেছে।”
“আমি ভেবেছিলাম আগের মতো সবাই রাত দশটায় খাবার খায়।”
“আচ্ছা এসব বাদ দে। খাবার খেয়ে বল, কেমন হয়েছে? আজ সবার পছন্দের খাবার বানিয়েছি।”
মায়া খাবার দেখে খানিকটা হাসে। এখানে তার সব ভাই বোনদের পছন্দের খাবার হলেও, তার নেই। কিন্তু সে এই ব্যাপারে কিছু বলে না। তার মা তাকে কখনো খারাপ কিছু বলে নি বা তার অপমান করে নি তাই তাকে কোনোমতে কষ্ট দিতে চায় না মায়া।

মা এবং সাহিরা চাচী সবাইকে খাবার দিচ্ছিল। মা সবার সাথে মায়ার প্লেটেও খাবার দেয়। তাকে মালাই চিংড়ি দেবার সময় ওয়াহিদ ডাক দেয় তাকে, “আন্টি…”
“হ্যাঁ বাবা বলো কিছু লাগবে তোমার?”
“উমম আন্টি আসলে মায়ার গরুর মাংস এবং চিংড়ি থেকে এলার্জি আছে।”
“ওহ হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেক বছর হয়ে গেছে তো।”
মায়া ছোট একটি নিশ্বাস ফেলে। কিছু না বলে খাওয়া শুরু করে দেয়। কিন্তু তার মন খারাপ হয়ে যায় সেসময় থেকেই।

খাবার শেষে সে পিছনের বাগানে এসে বসেছিল। মন খারাপ হচ্ছিল তার। ভাবতেই কষ্ট লাগে মা বা বাবা কারও জন্যই সে এত গুরুত্বপূর্ণ হতে পাড়ল না। এত কষ্ট করে, নিজে পরিশ্রমের বিনিময়ে এতকিছু অর্জন করার সত্ত্বেও তাদের গর্বিত করতে পারলো না। এমন সময় তার নিজেকে অনাবশ্যক মনে হয়। সে এই পৃথিবীতে না থাকলেও বিশেষ ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।

“মন খারাপ?” ভারী কন্ঠ ভেসে আসে তার পিছন থেকে। সে পিছনে ফিরে দেখে ওয়াহিদ দাঁড়ানো। তাকে দেখে মায়া সেখান থেকে উঠে যেতে নেয়। কিন্তু এর পূর্বেই ওয়াহিদ বলে, “তোর যাবার প্রয়োজন নেই। আমি চলে যাচ্ছি। কেবল বলতে এসেছিলাম, কারও কথা মনে নেবার প্রয়োজন নেই। তোর মূল্য কারও কাছে হয়তো কম হতে পারে কিন্তু এমনও কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে তুই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।” তারপর সে তার কাছে কিছু রেখে আবার বলে, “আরেকটা কথা বলতাম। আমি জানিনা তোকে কষ্ট দেবার পর এই কথা বলার অধিকার আমার আছে কি-না তবে তাও বলছি। বুঝেশুনে মানুষকে নিজের জীবনে প্রবেশ করতে দিস। আর…. বুঝে শুনে ভালোবাসিস। বাসায় যাচ্ছিলাম। বিদায় দিতে আসলাম।” তারপর ওয়াহিদ চলে যায়।

সে যাবার পর মায়া তার পাশে দেখে। একটি জুসের সাথে কাগজের স্মাইলি বানানো। জিনিসটা দেখে তো ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। যখন ওয়াহিদের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। তার বাবার সাথে আলাউদ্দিন আংকেল নতুন নতুন ব্যবসায় জড়িয়ে ছিলেন। তাদের পরিবারের দাওয়াত ছিলো। মায়া তো ছোট থেকে চঞ্চল। খেলতে খেলতে সেদিন তার জন্য তার বড়বোনের পছন্দের খেলনা ভেঙ্গে যায়। সেদিন বকা খেয়ে এখানেই বসে কাঁদছিলো মায়া। তখন ছোট ওয়াহিদ এসে তার পাশে বসেছিল। এভাবেই তাকে জুসের বোতল দিয়েছিল। জুসের বোতলের উপর স্মাইলি আঁকা ছিলো। সেদিন তাদের প্রথম বন্ধুত্ব হয়। তার প্রথম বন্ধু হয়।

কথাটা ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মায়া। জুসের বোতলটা দেখে হেসে বলে, “আমার ভালোবাসা হারানোর দুঃখ নেই, কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুটাকে এভাবে অচেনা করে দেবার জন্য আমি কখনো তোকে ক্ষমা করতে পাড়ব না।”
.
.
সুরভী এবং অভ্র বাড়িতে এর যেয়ে দেখে সকলে সেখানে তাদের অপেক্ষাতেই ছিল। সভ্য ও ইনারা তো দুপুরেই এসে পড়েছে। সুরভিকে দেখে তো ইনারা দৌড়ে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, “জান তুই তো এমনেই পরীর থেকে কম না। কিন্তু আজ তো তোকে দেখে পরীরাও হিংসায় পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে।” সে আবার অভ্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া আপনার হার্ট ঠিক আছে না? আমার বান্ধবীকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যান নি তো?”
অভ্র তার কথায় পাত্তা না দিয়ে সোফায় বসে। ইনারা তবু তার পিছু ছাড়ে না। সে অভ্রর পিছু পিছু এসে বলে, “ভাইয়া উওর না দিয়ে আসলেন কেন? আজ সুরভিকে অনেক সুন্দর লাগছে না বলেন?”
“হুম।” ছোট করে উত্তর দেয় অভ্র।
“তাহলে আজকেই আপনাদের বিয়ে করিয়ে দেই?”
ইনারার কথায় একবার তার দিকে তাকিয়ে। চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু ইনারা তার পিছুই ছাড়ে না। সে অবাক সুরে বলে, “ভাইয়া আপনি কী ব্লাশ করছেন? হাউ কিউট! দেখ সুরভি অভ্র ভাইয়া ব্লাশিং ব্লাশিং করছে বিয়ের কথা শুনে।”
সুরভি এসে তাকে বকুনি দেয়, “এসব ফাজলামো বন্ধ করে বল তো এত দৌড়াদৌড়ি করছিস কোন দু:খে? এরপর থেকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখলে মাইর খাবি।”
ফুফু বলে, “ওর তো বাচ্চাদের মতো দৌড়াদৌড়ি করা ছাড়া সময় কাটে না। এই বয়সে কোথায় বাচ্চাদের পালবে আর নিজে বাচ্চাদের মতো দৌড়াদৌড়ি করে।”
মা আবার ইনারার পক্ষ নিয়ে বলে, “আপু এভাবে বলছেন কেন? ও তো এখনো ছোট। আর ও এভাবে হাসিখুশি আমারও ভালো লাগে। ও আসলেই তো এই নির্জন ঘরটা আনন্দে মেতে থাকে।”
” ভাবি আপনিই ওকে মাথায় তুলে…”
তার কথায় বিরতি লাগায় অভ্র, “ফুপি মানুষের ক্ষুত ধরা ছাড়া কখনো পজিটিভলিও ভাবুন। ইনারা, সভ্য তোমরা কি যেন বলতে জলদি বলো, আমার ক্লান্ত লাগছে। আমি এখন রেস্ট করতে যাব।”

দাদীজান জিজ্ঞেস করে, “এমন কী বলবে যে সেখানে সবার থাকাই লাগবে?”
সভ্য এবং ইনারা দুইজনই লজ্জা পাচ্ছিল সে সময়। সভ্য তার ভাইকে খোঁচা মারে, “ভাইয়া তুমি বলো, প্লিজ।”
“সারাদিন যা মুখে আসে দুইজন তাই বকবক করিস, এখন লজ্জা লাগছে?” বিরক্ত হয়ে পরিবারের দিকে তাকিয়ে বলে দিলো, “সভ্য আর ইনারা বাবা মা হতে যাচ্ছে।”
এত সরল ভাবে বলে দেওয়ায় সভ্য থতমত খেয়ে তার দিকে কান্নামাখা মুখে তাকিয়ে বলে, “ভাইয়া সাসপেন্স ক্রিয়েট করে তারপর বলতে…”
অভ্র বিরক্ত হয়ে বলে, “তুই-ই বলে দিতি।”
ইনারাও মুখ বানায় সে সভ্যকে বলে, “আমি কত কিছু প্লান করেছিলাম তুমি বললে তুমি সব সামলে নিবে অনেক সুন্দর করে এনাউন্সমেন্ট হবে। আমি চারদিন অপেক্ষা করেছি আর এটা তোমার ফালতু প্লান। তোমার খবর আছে।”

সবাই তো এসবে ধ্যানই দেয় না। সকলে খুশিতে আত্মহারা। মা তো সবার আগে এসে ইনারাকে জড়িয়ে ধরে। সে তো খুশিতে কান্না করে দেয়। তার পরপরই দাদীজান এসে আদর করে দোয়া করে দেয় তাকে। বাবা সভ্যকে অভিনন্দন জানিয়ে জড়িয়ে ধরে। তারা দুইজন দাদজানের কাছে যেয়েও দোয়া নেয়। দাদাজানকে সহজে আবেগী হতে দেখা যায় না তবে সে-ও আবেগী হয়ে উঠে। সে সভ্য এবং ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতে করতে কান্না করে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে দাদীজান তার রুমে যেয়ে নিয়ে আসে একজোড়া চুড়ি। সে ইনারার হাতে চুড়ি দিয়ে বলে, “আমি আমার মেয়ে ও বউকে তাদের প্রথম সন্তানের খবর শুনে স্বর্ণ দিয়েছিলাম। কিন্তু এই চুড়ি কাওকে দেই নি। কাওকে ছুঁতেও দিতাম না। এগুলো আমার জন্য বিশেষ। তোমাদের দাদাজান তার প্রথম পরিশ্রমের কামাই দিতে আমাকে এগুলো দিয়েছিলেন। বলে না ছেলেমেয়ে থেকে নাতি নাতনীর আদর বেশি থাকে? তাই আজ এত খুশির খবরে এই জোড়া চুড়ির একটা আমার নাতবৌকে দিলাম।” দাদীজান খুশিতে চোখের পানি গাল বইয়ে ঝরাতে ঝরাতে ইনারার হাতে চুড়ি পরিয়ে দেয়। ইনারা তার গাল ধরে টেনে বলে, “আমার নায়িকার মতো দাদীজানের চোখে দেখতে তো ভালো লাগে না।”
বলতে বলতে সেও কান্না করে দেয়। দাদীজান তার গালে আস্তে করে মেয়ে বলে, “পাগল মেয়েটা।” সে আজ প্রথম ইনারাকে চুমু দেয়।
তারপর সে নিজের ডাকে সুরভিকে। আরেকটা চুড়ি সে সুরভিকে পড়াতে যাবে এর আগেই সে হাত পিছিয়ে নেয়, “এটা কী করছেন দাদীজান?”
“এইটা তো আমার আরেক নাতবৌয়ের জন্য। মানে তোমার জন্য।”
“দাদীজান আমি এটা কীভাবে নিতে পারি?”
“তুমি আমার অভ্রের হবুবউ তুমিই নিতে পারো।”
“বিয়ের পর দিলে হয় না দাদীজান?”
“আজ এই খুশির দিনেই আমি আমার দুই নাতবৌয়ের হাতে এটা পরাতে চাই। তুমি আমার ইচ্ছার মান রাখবে না?”
সুরভীর খারাপ লাগে। সে এভাবে কারও আবেগ নিয়ে খেলতে পারে না। সে অভ্রর দিকে তাকায়। এই আশায় যে অভ্র কোন একটা কোথায় বের করবে। কিন্তু অভ্র তো মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল কেবল। দাদীজান তার হাত ধরে চুড়িটা পরিয়ে দেয়।
তখন ফুফু বলে, “নিয়ে নেও। এমনিতেও এই বাসায় বিয়েই হচ্ছেই তাহলে অর্থ, স্বর্ণ এসবের আর অভাব হবে না। কিন্তু ভুলভাবে কথাটা নিও না, খুশির খবর আগে বড় বৌ’য়েরই দেওয়া উচিত ছিলো।”
অভ্র আড়চোখে তাকায় ফুপুর দিকে, “আচ্ছা ফুপু আপনার কী ঘরের খুশির খবরে কটু কথা না বললে খাবার হজম হয় না? আপাতত আপনি সভ্য ও ইনারার জন্য খুশি হন আমাদের ব্যাপারটা আমরা দেখব ঠিকাছে?”
“তা তো আছেই বাবা। আমি এমনি বলছিলাম আরকি।”
“আর এমনি বলার দরকার নেই,” সে বিরক্তির সুরে সবাইকে জানায়, “আমার ক্লান্ত লাগছে। উপরে যাচ্ছি আমি।” তারপর সে উপরে চলে যায়।

তখন গভীর রাত। আসমানে মেঘেরা গর্জন করছিল। অভ্র আহত অবস্থায় পড়েছিল রাস্তায়। তার কপাল দিয়ে রক্ত বইছিল কেবল। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল তখন। তবুও সে বহুকষ্টে চোখগুলো খোলা রাখে। উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু তার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। তার গলা দিয়ে শব্দও বের হচ্ছিল না। শুধু সে দেখছিল কতগুলো লোক একজনকে ধরে করুণভাবে মারছে। লোকটা চিৎকার করছে। কিন্তু কারও বুকে একটুও দয়া ছিলো না। কিছু সময় পর একটা গাড়ি এসে থামে। একজন নামে গাড়ি থেকে। তার হাতে ছিলো পিস্তল। সে এসেই লোকটার মুখে প্রথমে লাথি মারে। এইটার পর একটা মারার পর তার উপর বন্দুক তাক করে। তারপর শব্দ হয় তিনবার। আর লোকটা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে।
লোকটা অভ্রর সামনেই নিশ্বাস ত্যাগ করে। সে নির্জন রাস্তায় তারা দুইজনই ছিলো কেবল। অভ্র অনেক চেষ্টা করে তার কাছে যাবার। শক্তি পায় না। কিন্তু তার নিষ্প্রাণ দেহ দেখে নিজেকে আর সামলাতে পাড়ে না। সেখানেই জ্ঞান হারায় সে।

হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে বসে অভ্র। সে ঘামিয়ে একাকার। এই শীতল হাওয়ার মাঝে ঘামানোটা স্বাভাবিক নয়। সে নিশ্বাসটাও ঠিকমতো নিতে পাড়ছে না। সে দ্রুত উঠে যায় বাথরুমে। শাওয়ার ছেড়ে দেয়ালে দুইহাতে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখদুটো লাল হয়ে আছে। এই পানির নিচে সে বুঝতেও পাড়ছে না তার চোখের পানিও এই জলের সাথে মিশছে না’কি! অনেকক্ষণ সে ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক সময় পাড় হবার পর সে স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নিতে পাড়ছে।

চলবে…