অনুভূতির খাঁচা পর্ব-৩৫+৩৬

0
23

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জোহান রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংরুমে এতকিছু দেখে সেখান থেকে গাজরের হালুয়ার বাটিটা তুলে নেয়। রান্নাঘর থেকে চামচ নিয়ে ড্রইংরুমে যায়। মা’কে জিজ্ঞেস করে, “আজকে কোনো অনুষ্ঠান আছে না’কি যা আমি জানি না?”
“না তো।” তার মা উওর দেয়।
“আমি আরও দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমার জন্মদিন কি আজ না’কি? তুমি তো আবার আমার প্রতি জন্মদিনে গাজরের হালুয়া বানাও।” কথাটা বলে সে এক চামচ খাবার মুখে দিয়ে ভ্রু কপালে তুলে নেয়, “সেই হয়েছে তো। তুমি যেমন রান্না করো তার থেকে আলাদা, কিন্তু অনেক মজার হয়েছে।”
“আমি রান্না করিনি। আলাদা তো হবেই। মায়া রান্না করেছে।”
জোহান মা’য়ের পাশে বসা মায়াকে দেখে বলে, “অসম্ভব ব্যাপার।”
“সত্যি সব মায়া এনেছে। আমার জন্য এত্তগুলা ভর্তাও এনেছে। আবার ব্লুবেরি চিজ কেক এনেছে তা ফ্রিজে।”
জোহান মায়াকে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি বলো বাহির থেকে আনিয়েছ তাই না?”
“তোমার মতো অকর্মা না আমি। সবকিছু করতে পারি, বুঝলে?”
“তোমার সাথে যার বিয়ে হবে সে আসলেই খুব ভাগ্যবান হবে।” জোহানের মা বলেন। সে আরও যোগ করে, “ছেলে মেয়ে সবাইকে তোমার মতো হওয়া উচিত, নিজের ঘরের টুকটাক কাজ যেমন করতে পারে তেমন ক্যারিয়ারের দিকেই ধ্যান দিতে পারে। আমার অনেক বছর পূর্বে তোমার মতো হওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু কখনো নিজের কথা রাখার সাহস ছিলো না।” আফসোসের নিশ্বাস ফেলেন সৌমিতা। আবার মায়ার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, “কিন্তু তোমার মতো আজকালকার মেয়েদের দেখলে ভালো লাগে যারা স্বাধীনভাবে নিজের জীবন উপভোগ করতে পারে। আমাদের সেসময় খুব কম মেয়েরাই এমন সুযোগ পেতো অথবা সুযোগ তৈরি করতে পারতো।”
“আপনার কী হবার ইচ্ছা ছিলো আন্টি?”
“এক নাম্বার, একটি সুখী সংসার বানানোর। দুই নাম্বার, ভালো মা হবার। তিন নাম্বার, ক্যারিয়ারে সফলতা অর্জন করার। এর মধ্যে একটি স্বপ্ন ভুল প্রমাণিত হলো, আরেকটির ব্যাপারে জানি না, আর শেষটা কখনো হয়-ই নি।”
বলে তার মন খারাপ হয়ে যায়।

মায়া তাকায় জোহানের দিকে। তারও মন খারাপ মনে হচ্ছিল। সে জোহান মা’য়ের হাত ধরে বলে, “অফকোর্স আপনি একটা ভালো মা হয়েছেন। আপনার ছেলে মেয়ে
দুইজন জীবনে এত সফল। এতে কৃতিত্ব তো আপনারও আছে। আন্টি আপনি জানেন আপনার ছেলের এলবামের প্রি-অর্ডার চালু হতেই কতগুলো রেকর্ড ব্রেক হয়েছে?”
“সত্যি?” মা’য়ের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে।
“তিন সত্যি।”
মায়া হেসে জোহানের দিকে তাকাতেই দেখে জোহান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।তার তাকানোর ভঙ্গিটাই এমন সে হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
.
.
সকলে সোফায় বসে ছিলো। কেবল মেঘলা ছাড়া। সে দাঁড়িয়ে ছিলো তৌফিকের পাশে। আশেপাশে কতগুলো কর্মী ঘুরঘুর করছে।
টেবিলে নাস্তা দেওয়া হয়েছে কয়েক রকমের। একজন কর্মী সুরভি ও অভ্রকে চা দিলেও তৌফিককে দেয় না। তাকে চা দেয় মেঘলা। তৌফিক চা’য়ের কাপ নিয়ে হেসে বলে,
“আসলে মেঘলা নিজে আমাকে চা বা খাবার না দেওয়া পর্যন্ত আমি খেতেই পারি না। বিয়ের আগে মা এমন করতো আর এখন আর বউ।” বলে সে মেঘলার হাত ধরে চুমু খায়। মেঘলা তখনও কাঁপছিল। ভয়ে।

সুরভি মেঘলাকে বলে, “আপু, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।”
“না না, আমি ঠিক আছি।”
তৌফিক তাকে বলে, “সুরভি ঠিকই বলছে। আমার পাশে বসো।”
মেঘলা তাকায় তার দিকে, আতঙ্কিত দৃষ্টিতে। সে সাথে সাথে এসে বসে তৌফিকের পাশে। তবে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে।

তৌফিক পা’য়ের উপর পা তুলে জিজ্ঞেস করে, “আপনাদের দুইজনের লাভ ম্যারেজ না এরেঞ্জ ম্যারেজ?”
সুরভি চা’য়ে চুমুক দেবার সময় বিড়বিড় করে বলে, “ঘাপলা ম্যারেজ।”
অভ্রর কানে তার কথাটা যায়। সে সুরভির দিকে ফিক করে হেসে দেয়।
তৌফিক বলে, “আমি মজার কিছু বলেছি বলে মনে হয় না।”
অভ্র তার প্রশ্নের উওর দেয়, “আমার সাইড থেকে লাভ ম্যারেজ, ওর পক্ষ থেকে এরেঞ্জ।”
কথাটা শুনে তৌফিক তার ভ্রু কপালে তুলে নেয়, “ইন্টারেস্টিং। এটা এক্সপেক্ট করিনি।”
“আপনাদের লাভ ম্যারেজ ছিলো তাই না?” সুরভি প্রশ্ন করে।
“আমার তো লাভ এট ফার্স্ট সাইট ছিলো। একটা পার্টিতে ওকে দেখেই মন দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর ওকে নিজের না করা পর্যন্ত শান্তি হয় নি আমার। তাই না জান?” সে মেঘলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। মেঘলা ভীত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। জোর করে হেসে মাথা নাড়ায়।

তৌফিক হেসে এবার জিজ্ঞেস করে অভ্রকে, “আপনি এবং মেঘলা তো আগের পরিচিত। তাই না?”
কথাটা শুনে মেঘলার চোখ মুখে আতঙ্কের ছায়া পড়ে। সে ভীত দৃষ্টিতে তাকায় অভ্রর দিকে। কিন্তু অভ্র বেশ স্বাভাবিক গলায় বলে, “আমরা ক্লাসমেইট ছিলাম। দেখা হয়েছে আগে কিন্তু এত ভালো পরিচয় ছিলো না।”
উওরটা শুনে সুরভি অবাক হয়। মেঘলা তার এত কাছের মানুষ যে তার বাসায় কেবল দুইজনের ছবি লাগানো আছে। নক্ষত্র ও মেঘলা। তাহলে সে মিথ্যা বলছে কেন?

তৌফিক হেসে বলে, “তাহলে তো এটা ভাগ্য। যদিও আমি ভাগ্য তো বিশ্বাসী নই। তবুও আপনি যেহেতু বলছেন বিশ্বাস করছি। তো আপনার ইলেকশনের পূর্বে কি পরিকল্পনা?”
“এখানে রাজনীতি তুলছেন? ওরা দুইজন বিরক্তিবোধ করবে তো।”
তৌফিক হেসে মেঘলাকে বলে, “তুমি সুরভিকে নিয়ে আশেপাশে ঘুরেফিরে দেখাও। আমি ততক্ষণ আমাদের রাজনৈতিক কিছু ব্যাপারে কথা বলি।”
“জি।” ছোট করে উওর দেয় মেঘলা।

মেঘলা সুরভিকে নিয়ে যায়। বাড়িটা দেখানোর জন্য। তারা হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে আসলে সুরভি জিজ্ঞেস করে , “আপনার মন খারাপ কেন?”
মেঘলা আমতা আমতা করে বলে, “এমন কিছু না তো।”
“আপনার ভাই জেলে গেছে বলে আপনার মন খারাপ?”
“না, ও যা অপরাধ করেছে তার শাস্তি পাওয়া আবশ্যক ছিলো। এক না একদিন তো ওর এই পরিণতি হতোই। ওই মেয়ের উপর কি গিয়েছে তা আমি ভালো করে অনুভব করতে পারি।” মেঘলা চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে।
“শেষ বাক্যগুলোর অর্থটা বুঝলাম না আপু।”
মেঘলা দেখে উপরে। সিলিং এর সাথে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। ঘরের বেশিরভাগ স্থানেই এমন ক্যামেরা লাগানো আছে। তা দেখে কিছুই বলে না মেঘলা। সে উপরে নিয়ে যায় সুরভিকে। আশেপাশে দেখিয়ে তারপর তাদের বেডরুমে আনে। ঘরে এই জায়গাটাতেই কোনো সিসিটিভি নেই। সে সুরভিকে রুমে সোফায় বসিয়ে হঠাৎ উৎসুক স্বরে বলে, “অভ্রর সাথে সেদিন তোমাকে দেখে আমি অনেক খুশি হয়েছি জানো?”
খুশি হয়েছে? কিন্তু কেন? অভ্রকে অন্য মেয়ের সাথে দেখে সে খুশি হবে কেন?
সুরভি বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “আপনি আমাকে চিনতেন?”
“তুমি আমাকে চিনো নি? বহুবছর পূর্বে একবার আমাদের ফোনে কথা হয়েছিল?” সে সুরভির পাশের সোফায় বসে। তার ব্যক্তিত্ব আচমকায় পরিবর্তন হয়ে যায়।
“আমাদের কথা হয়েছে?”
“মনে নেই তুমি একবার অভ্রর সাথে কথা বলছিলে ফোনে আর আমি পিছন থেকে দুষ্টুমি করছিলাম তারপর আমাদের কথা হয়েছিল।”
“সেটা তো অভ্রর সাথে না নক্ষত্রের সাথে।”
“হ্যাঁ আমিও তো সেই কথা বলছি। এক মিনিট অভ্র তোমাকে কিছু বলেনি?”
“কি বলবে?” তার নজর পড়ে মেঘলার হাতের দিকে। সে হাত হাতে দাগ দেখে জিজ্ঞেস করে, “আপনার এখানে কী হয়েছে?”
দ্বিধাবোধ করে মেঘলা। সে আমতা-আমতা করে বলে, “ওই পিছলে যেয়ে পড়ে ব্যাথা পেয়েছিলাম।”
“কিন্তু দেখে তো এমনটা মনে হচ্ছে না।”
“না আসলেই পড়ে যেয়ে ব্যাথা পেয়েছি।”
“আচ্ছা আপু আপনারা তৌফিক স্যারের সাথে মিথ্যা কেন বললেন? আপনারা দুইজন তো অনেক ক্লোজ। তার বাড়িতে কেবল আপনার এবং নক্ষত্রের ছবি। আপনাকে সেদিন দেখার পর তার চোখে প্রথম পানি দেখেছি আমি। তাই বলাই যায় আপনারা অনেক ক্লোজ। সে আপনাকে অনেক পছন্দ করে তাহলে মিথ্যা বলার প্রয়োজন কী ছিলো?”
“বুঝেছি অভ্র তোমাকে কিছু বলে নি। হয়তো কোনো কারণ আছে। ও যেহেতু তোমায় কিছু বলে নি, আমিও পাড়ব না। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রেখো, তুমি অনেক লাকি যে অভ্রর মতো জীবনসাথী পেয়েছ। এটা কখনো ভুলো না ঠিকাছে? শত রাগ অভিমান থাকুক, শত ঝগড়া হোক একে অপরকে ছেড়ে যেও না। কারণ ছোট ভুলও আমাদের জীবনকে নরক সমতুল্য করে তুলে।” কথাগুলো বলতে বলতে মেঘলা খানিকটা উদাসীন হয়ে গেলেও পরক্ষণেই একগাল হেসে বলে, “জানো সেদিন যখন তোমাদের একসাথে দেখেছি, ও তোমার হাত ধরেছিল, তখন কতগুলো বছর পর আমার ভেতরে এত খুশি অনুভব হয়েছে। অভ্র আমার কাছে পরিবারের মতো। প্লিজ তুমি অভ্রকে কোনো ওকে কষ্ট দিও না।” সে সুরভির হাত ধরে বলে, “ওয়াদা করো আমাকে।”
তখনই একটি মেয়ে এসে দরজায় নক দেয়, “ম্যাম তৌফিক সাহেব আপনাদের ডেকেছে রাতের খাবারের জন্য।”
সুরভির হাত মেঘলার হাত থেকে ছুটে যায়। সে বলে, “তাহলে নিচে যেতে হবে। আসো।”
সে যেতে নিলে সুরভির দৃষ্টি যায় তার পিঠেও। সেখানে দাগ দেখতে পায় সে। বিষয়টা খেয়াল করলেও সে কিছু বলে না। কারণ সে বুঝেছে মেঘলাকে প্রশ্ন করলেও সে ব্যাপারটা কিছু দিয়ে ঢেকে দিবে।

সে আনমনে নিচে নামতে শুরু করে। মেঘলার কথাগুলো তার মাথায় ঘুরতে থাকে। মেঘলা অভ্র ও নক্ষত্রের মধ্যে ঘুলিয়ে ফেলতে পারে কীভাবে? নক্ষত্রের সাথে তো তার দেখা হয়েছিল, আর সে কোনো দিক থেকে দেখতে অভ্রের মতো না। ভাবতে ভাবতে সে সিঁড়ি থেকে নামছিল। ধ্যান না থাকায় সে পড়ে যেতে নিলে মেঘলা তাকে ধরে নেয়।
“ঠিক আছো তুমি?” মেঘলা ঘাবড়ে যেয়ে প্রশ্ন করে।
“থ্যাঙ্কিউ।” সুরভি তাকায় তার দিকে। সে আবারো দেখতে পায় মেঘলার কাঁধে লম্বা কাঁটা স্থান। তা দেখে সুরভিও আতঙ্কিত হয়ে উঠে।
অভ্র এবং তৌফিক আসে তাদের কন্ঠ শুনে। অভ্র জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে?”
“সুরভি পড়ে যেতে নিয়েছিল সিঁড়ি থেকে।” মেঘলা বলে। সে আবার সুরভির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “ব্যাথা পাও নি তো?”
সুরভির কিছুই হয় নি। কিন্তু সে নিজের পা ধরে বলে, “পা’য়ে ব্যাথা পেয়েছি। পা মচকে গিয়েছে হয়তো।”
অভ্র দ্রুত দৌড়ে আসে তার কাছে। সে চিন্তিত হয়ে বকুনি দেয় সুরভিকে, “একটু দেখেশুনে হাঁটতেও কি তোমার কষ্ট লাগে? দেখি কোথায় ব্যাথা পেয়েছ?”
“না না দেখা লাগবে না, বাসায় যাব।”
তৌফিক বলে, “আমি ডাক্তার ডেকে আনছি। এখানে অনেক রুম আছে তুমি আরাম করতে পারো।”
অভ্র কিছু চিন্তা করে বলে, “আমারও মনে হয় ওকে বাসায় নেওয়াই উচিত হবে। সেখানে ও ভালো করে রেস্ট করতে পাড়বে। আপনি কিছু মনে না করলে আমরা যেতে পারি?”
তৌফিক অনুমতি দেয়। অভ্র সাথে সাথে সুরভিকে কোলে তুলে নেয়। সুরভি তখন মেঘলা ও তৌফিকের সামনে কিছু বলে না। অভ্র তাকে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়। সারারাস্তা তার চিন্তা করছিল। সুরভি তখনও কিছু জানায় না অভ্রকে। সে কেবল বলে, “আপনার বাসায় নিতে পাড়বেন? এই অবস্থায় আমার বাসায় গেলে সবাই চিন্তা করবে।”
“হাস্পাতালের দিকে আগে দেখিয়ে তারপর যাই।”
“আমি হাস্পাতালে যাব না।” সে বাচ্চামো কন্ঠে বলে। অভ্রও তার আবদার মানে। সে গাড়ির সামনে সিটে বসা ফজলু মিয়াকে বলে, “ডাক্তারকে কল দিয়ে বাসায় আসতে বলো।”

বাসার সামনে এসে যখন অভ্র সুরভিকে আবার কোলে নিতে ভায় তখন সে বাঁধা দেয়, “প্রয়োজন নেই আমি হেঁটে যেতে পাড়ব।”
“এতক্ষণ তোমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল এখন কীভাবে পারবে? চুপচাপ আসো।”
সে সুরভিকে কোলে তুলে নেয়। সুরভি অভ্রর দিকে তাকায় না একবারও। তবুও তার বাহুডোরের উষ্ণতা অনুভব করতে পারে। সারাক্ষণ সবাইকে বকতে থাকা এই খাটাইশ লোকটা তারই এত যত্ন নেয় কেন?
তার হৃদয়ের কৌতুহল বাড়তে থাকে। তার মনে জাগ্রত সব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত এই কৌতুহল কমবে না।
তার মিথ্যা কথা বলার কারণও এই কৌতুহলই। তার নিজের সকল প্রশ্নের উওর আজই পেতে হবে।

অভ্র তাকে নিজের রুমে শুইয়ে উচ্চস্বরে ফজলুকে ডাক দেয়, “এখনো ডাক্তার আসে নি কেন? ডাক্তার কোথায়?”
“ভাইজান সবর করেন একটু, ডাক্তার আসতাসে। এত রাগ কইরেন না ডাক্তারে…”
অভ্র তাকে ধমক দিয়ে বলে, “এই ফালতু কথা এখন আমার সামনে বলবে না। আমার মাথা ভীষণ গরম।” সে সুরভিকে বলে, “তুমি রেস্ট করো আমি নিজে যেয়ে ডাক্তার আনছি।”
যে সুরভির পাশ থেকে উঠে যেতে নিলে সুরভি তার হাত ধরে নেয়, “আমি না ভুলেই গিয়েছিলাম আমার একটা ই-মেইল করা লাগবে অফিসে। আপনার কোনো কম্পিউটার বা লেপটপ হবে?”
“তোমার মাথা খারাপ? এই অবস্থায় তুমি কাজের কথা ভাবছ?”
“আপনি তো জানেন আমি নিজের কাজের প্রতি কত সিনসিয়ার। আমি ওটা না করা পর্যন্ত শান্তি পাব না।”
অভ্র বিরক্তি নিয়ে তার আলমিরা থেকে একটি ল্যাপটপ বের করে দেয় সুরভিকে।
অভ্র তাকে ল্যাপটপ বের করে দেয়। সুরভি জিজ্ঞেস করে, “পাসওয়ার্ড।”
“1606….” সে যেতে নিয়ে আবার থেমে যায়। জানিয়ে যায়, “ই-মেইল এপপ এরও পাসওয়ার্ড একই।”
অভ্রর যাবার পর সুরভি পাসওয়ার্ড দিয়ে ল্যাপটপ ওপেন করে কিন্তু ফেসবুক ওপেন করার সময় এই পাসওয়ার্ড কাজে দেয় না। সে জি-মেইল সহ অন্যান্য এপেও চেষ্টা করে এই পাসওয়ার্ডে কাজ হয়। কেবল ফেসবুকেই হয় না। সে কিছুক্ষণ ভাবে। ১৬০৬ মানে ১৬ ই জুন। এইদিন তার সাথে নক্ষত্রের শেষ কথা হয়েছিল। এরপর আর কোনো উওর আসে নি সেই আইডি থেকে। তাই সে ফেসবুকে তার সাথে নক্ষত্রের যেদিন প্রথম কথা হয়েছিল সেদিনের পাসওয়ার্ড দেয় এবং তা কাজেও আসে। ফেসবুকে খুলে যায়। কিন্তু সেখান থেকে সে নক্ষত্রের কোনো আইডি খুঁজে পায় না। তারপর সে ঢুকে মেসেঞ্জারে। সেখানে ঢোকার পর সে আইডি দ্বারা সে অন্যান্য আইডিতে ঢোকার জন্য আরেকটা পাসওয়ার্ডের প্রয়োজন হলেও তার প্রয়োজন পড়ে না। তার প্রশ্নের উওরগুলো সে পেয়ে গেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অভ্র ডাক্তারকে নিয়ে রুমে ঢুকে। সুরভির দৃষ্টি তখনও ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে ছিলো। অভ্র বলে, “তোমার কাজ পড়ে করো। আগে ডাক্তার দেখিয়ে নেও।”
সুরভি তার দিকে ল্যাপটপ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনার কিছু এক্সপ্লেইন করার আছে?”
অভ্র তো স্ক্রিনে নক্ষত্রের আইডিটা দেখে অবাক হয়। কয়েকদিন পূর্বে সুরভি তাকে বলেছিল সে নক্ষত্রকে মেসেজ দিয়েছে। তাই সে দেখতে ঢুকেছিল। হয়তো মেসেঞ্জারের আইডি রিমুভ করতে ভুলে গেছে।
সে শান্ত গলায় বলে, “আগে ডাক্তার দেখিয়ে নেও। আমি পড়ে এক্সপ্লেইন করছি।”
সুরভি উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে যেয়ে ফজলু মিয়াকে বলে, “ফজলু ভাই আপনি ডাক্তারকে নিয়ে বাহিরে বসুন অথবা ফেরত যাবার ব্যবস্থা করে দিন। আমি সুস্থ আছি ঠিকাছে?”
পরিস্থিতি বুঝে ফজলু মিয়া দ্রুত পালায়। তার যাবার পর সুরভি দরজা লাগিয়ে ফিরে তাকাতেই অভ্র জিজ্ঞাসা করে, “তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছ? তুমি কোনো ব্যাথা পাও নি তাই না?”
“আপনি যে হারে মিথ্যা বলেছেন তার তুলনায় এটা তো কিছু না।”
অভ্র চোখ সরিয়ে নেয়, “আমার ল্যাপটপ থেকে আগে নক্ষত্র ওর আইডিতে ঢুকেছিল তাই….”
সুরভি তার কথা কেটে জোর গলায় বলে, “মিথ্যা বলবেন না। আপনিই নক্ষত্র। আর এটা আমি তোক্কা মেরে বলছি না। আমি নিশ্চিত হয়ে বলছি। বলুন, আমাকে মিথ্যা বলার কারণটা কী?”
অভ্র কিছু বলে না।
সুরভি আবার জিজ্ঞেস করে, “আপনার ল্যাপটপে তৌফিক স্যারকে নিয়ে এত তথ্য কেন? আর মেঘলা আপু এত কাছের মানুষ যে সেদিন তাকে দেখে আপনার চোখে পানি এসে পড়েছে। তাহলে আপনি তৌফিক স্যারকে মিথ্যা কথা কেন বললেন যে আপনি যাস্ট তার ক্লাসমেট? আরেকটা প্রশ্ন, আপনি কি জানেন মেঘলা আপুর সাথে শারীরিক নির্যাতন হয়?”
সব শেষ প্রশ্নটা শুনে অভ্র তার দিকে তাকায়, “তুমি কিভাবে জানো?”
“ওয়াও, মানে আপনি জানেন কিন্তু তার হেল্প করার জন্য কিছু করছেন না। আপনি অপরিচিত একজনের ন্যায়ের জন্য এতকিছু করলেন কিন্তু আপনার এত কাছের মানুষের জন্য কিছু করছেন না কেন?”
“এতটুকু বুঝে রাখো, সবকিছুর একটা সময় থাকে। সময়ের আগে কিছু করাটা উচিত নয়। সময়ের পূর্বে কিছু করলে তা উল্টো বিপুল বিপদ ডাকতে পারে।”
“আচ্ছা মানলাম মেঘলা আপুর ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সময় দরকার। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে আপনি আমাকে বলবেন আপনি কেন লুকিয়েছেন যে আপনিই নক্ষত্র। আর আপনি নক্ষত্র হলে ওই লোকটা কে?”
অভ্র এবারও চুপ করে থাকে। তার প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না।

সুরভী এবার প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলে, “আপনি এই মুহূর্তে আমাকে উত্তর না দিলে আমি এখানেই সব শেষ করে চলে যাব। আপনার ও আমার নামমাত্র সম্পর্কটাও। এরপরে আমি এক মুহূর্তের জন্য আপনার চেহারাটাও দেখবো না।”
অভ্র তার দিকে তাকায়। কিন্তু কিছু বলে না।
“ঠিকাছে। তাহলে আমি চললাম। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না।” সে তার আঙুল থেকে তাদের বাগদানের আংটিটা খুলে বিছানায় রেখে সেখান থেকে চলে যেতে নেয়। তখনই তার হাত ধরে নাই অভ্র। সে মৃদুস্বরে বলে, “ও গগন। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আমার পরিবার, আর মেঘলার ভালোবাসা।”
উওরটা এমন হবে তা ভাবে নি সুরভি। সে পিছনে ফিরে তাকায় অভ্রর দিকে, অবাক দৃষ্টিতে, জিজ্ঞাসা করে, “আপনার সে বন্ধু যে এই পৃথিবীতে আর নেই?”
“হুম…” অভ্র তার হাত ধরেই বিছানায় বসে পড়ে। সে কাঁপানো গলায় বলে, “সে তৌফিক মেঘলাকে পাবার জন্য গগনকে আমার সামনে মেরে ফেলেছে। আমার সামনে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে নির্মমভাবে হ*ত্যা করেছে। ”

চলবে…

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তৌফিক রেকর্ড করা ক্যামেরায় দেখছিলো সুরভি ও মেঘলার কথোপকথন। কিন্তু তার মন মতো কিছু পেল না।সে তো চাইছিল যেন তারা দুইজন অভ্রকে নিয়ে কোনো কথা বলুক। অন্তত অভ্রকে নিয়ে কিছু বলুক। একারণেই তো সে সুরভির সাথে সেদিন দেখা করেছিল। সে ভেবেছিল সুরভির মুখ থেকে অভ্রর করা কোনো অপরাধ তো বের করাবেই। কিন্তু তা হয় নি। সুরভিকে সে যতটা সরল ভেবেছিল মেয়েটা ততটাও সরল না। তারপর সে ভেবেছিল সুরভিকে বাসায় একা ডাকলে কথায় কথায় কিছু একটা তো বের করতেই পাড়বে। মিদুলের চার বন্ধুর মধ্যে কারও কথা তার মুখ দিয়ে বের করলে তা অস্ত্রের মতো ব্যবহার করা যেত। সে সুরভির সাথে মেঘলাকে একারণেই পাঠিয়েছিল যে তারা অন্তত একে অপরকে কিছু বলুক অভ্রকে নিয়ে। কিন্তু যত্তসব ফালতু কথা দিয়ে ভর্তি। তার কাজের কোনো কথাই এখানে নেই। তার বাবাকে ফুটেজ দেখানোর পর কিছু একটা বুঝিয়ে অভ্রর ব্যবস্থাটাও করতে পাড়তো সে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পাড়ছে না। অভ্র তো আর সাধারণ কেউ না যে হঠাৎ করে উধাও হয়ে কেউ জানবেও না। সে পরিচিত মুখ। দেশের অধিকাংশ লোকেরা তাকে চিনে। জনপ্রিয় তারকা সভ্যর ভাই সে। ইসমাত কোম্পানির উওরাধিকারী। আর তার বাবাও আজকাল প্রচুর অভ্র অভ্র করতে থাকে। তার উপর কী জাদু করেছে কে জানে?

তৌফিক পা’য়ের উপর পা তুলে হেলান দিয়ে বসে চেয়ারে। চোখ বন্ধ করে বলে, “অভ্র অভ্র অভ্র…. তোমার থেকে একটা খারাপ ভাইব আসে আমার। তুমি আমার এখনো কোনো ক্ষতি করো নি কিন্তু আমার মন বলছে তোমাকে ছেড়ে দিলে আমি অনেক বড় এক ভুল করব। আর আমার মনের কথা কখনো ভুল হয় না।”

সে নিজের বেডরুমে যেয়ে দেখে মেঘলা বই পড়ছে বিছানায় বসে। তাকে দেখেই মেঘলার হাত থেকে বই পড়ে যায়। সে তাড়াহুড়ো করে বইটা ঠিক করে রেখে বসে। তৌফিকের অগুছালো জিনিস দেখলে রাগ হয়। আর তার রাগ ভয়ংকর। মানুষের রুহ কেঁপে উঠে তার রাগ দেখলে।

“ডার্লিং তুমি কাঁপছো কেন? কিছু হয়েছে?” তৌফিক তার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে।
মেঘলা চোখ নিচু রেখে দ্রুত মাথা নাড়ায়।
“তাহলে এভাবে ভয় পাচ্ছো যে? কোনো ভুল করেছ তুমি? আমার সাথে কোনো মিথ্যা বলেছ?”
মেঘলা তাকায় তার দিকে। তার চোখেমুখে আতঙ্ক।
তৌফিক আবারও বলে, “ভেবে উওর দিও। আমার মিথ্যা শুনাটা অপছন্দের তা তো তুমি ভালো করেই জানো, তাই না?”
মেঘলা এক ডোক গিলে।
“তোমার কিছু বলার আছে আমাকে?” তৌফিক এই শেষ সুযোগ দেয় তাকে। যখন মেঘলা এবারও কিছু বলে না তখন সে ল্যাপটপটা মেঘলার সামনে রেখে ভিডিও অন করে। সে দেখতে পায় তার ও সুরভির কথোপকথনের রেকর্ডিং। সে বিস্ময় নিয়ে তার রুমের আশেপাশে দেখে। কিন্তু কোথাও ক্যামেরা দেখতে পায় না।
সে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আপনি আমাদের বেডরুমেও ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছেন?”
তৌফিক আলমিরা খুলে সেখান থেকে কিছু একটা বের করতে করতে বলল, “তোমার মনে হয় আমি তোমাকে এখানে একা ছেড়ে দিব? দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা আমার নজর তোমার উপর থাকে। এখন দোষ তো তোমার। আমি এত আদর করে বুঝাই তুমি তো বুঝো না। তাইতো আমার উপায়ে তোমাকে বুঝাতে হয়।”

আলমিরা থেকে একটা বেল্ট বের করে তার হাতে পেঁচিয়ে নেয়। তারপর বলে, “তোমার ভিডিও ফুটেজের চিন্তা করো না। এমনিতেও তোমাকে আমি ছাড়া কেউ মন ভরে দেখতে পাড়বে না। এর আগে তার প্রাণ না কেড়ে নেই? কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি বলো আমাকে মিথ্যা কেন বলেছ? যদি একটু শাস্তি কমিয়ে দেই।”
“আমি…আমি মিথ্যা বলিনি তো।”
“তো যখন অভ্র বলল যে তুমি শুধু ওর ক্লাসমেট তখন মুখ খুলো নি কেন? সুরভির সামনে তো লাফিয়ে লাফিয়ে বলছিলে ও তোমার পরিবারের মতো। পরিবারের মতো? এত ক্লোজ তোমার?”
“আপনি যেমন ভাবছেন তেমনটা না। ও…ও তো আমার কেবল বন্ধু ছিলো। আমার ভাইয়ের মতোন।”
“ভাইয়ের মতো?” তৌফিক শব্দ করে হেসে দেয়, “তুমি জানো তোমার আপন ভাই আজ ওর কারণে জেলে আছে।”
“কিন্তু ওকে তো আপনি ওর অপরাধের জন্য….”
“না জানার ভান করবে না….” চেঁচিয়ে উঠে তৌফিক, ” তুমি সব জানো।”

মেঘলা লাফিয়ে উঠে। সে পিছিয়ে যায়। আমতা-আমতা করে বলে, “কিন্তু আমি….আমি কীভাবে জানতে পারি? আমি তো সবসময়ই আপনার নজরে থাকে।”
“একতো মিথ্যা বলছো, এর উপর মুখের উপর জবাব দিচ্ছো। আমার সাথে তর্ক করছ তুমি? তোমার এতো বড় সাহস!” সে তার বেল্টটা দিয়ে মেঘলাকে মারতে সে হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে। তৌফিক একের পর এক তাকে মারতেই থাকে বেল্ট দিয়ে। মেঘলা শক্ত করে তার মুখ চেপে ধরে। অন্য হাত দিয়ে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে রাখে। তার চোখ দিয়ে পানি ঝরতেই আছে। থামার নাম নেই। তবুও শব্দ করে না। কারণ সে জানে শব্দ করলে তৌফিকের রাগ বাড়বে, আর তার রাগ বাড়লে তার রেহাই নেই। তাকে অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে হবে।
.
.
.
“মানুষ না ওই লোক, জানোয়ার। জানোয়ার থেকেও অধম।” অভ্র কাঁপানো নিশ্বাস ফেলে কথাটা বলে। তারপর থামে। তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল।
সুরভি অভ্রর কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তৌফিককে দেখতে খুবই সরল-সোজা মনে হয় কিন্তু সে নির্মল চেহেরার পিছনে এত বড় এক অপরাধী লুকিয়ে আছে সে ভাবতেও পারি নি। সে এখন বুঝতে পাড়ছে মেঘলার শরীরে এত আঘাতের চিহ্ন কোথা থেকে আসলো!

অভ্রর দৃষ্টি ছিলো মেঝের দিকে। সে উপরে সুরভির দিকে তাকাতেও পাড়ছিল না। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল,
“কেবলমাত্র মেঘলার সৌন্দর্য দেখে তাকে পাওয়ার জেদে আমার বন্ধুকে আমার চোখের সামনে শেষ করে দিলো। একবার দুইবার না তিনবার গুলি করেছিল। কতটা কষ্ট পেয়েছিল ও! তুমি জানো, দশ বছর বয়স থেকে আমরা রুমমেট ছিলাম। একসাথে ছিলাম, সবসময়। আমাদের সাথে আমাদের পরিবার ছিলো না। একে অপরের হাসিতে, খুশিতে, দু:খে,অসুস্থতায় একসাথে কাটিয়েছি। আর আমার সামনে কি-না ওকে….” অভ্র চুপ করে যায়।

সুরভি তার সামনে এসে বসে দেখে অভ্রর চোখে পানি। সে কি বলবে বুঝতে পারে না। সান্ত্বনা দেবার মতো তার কাছে শব্দই নেই। সে হাত রাখে অভ্রের হাতের উপর। অভ্র তখনও তার দিকে তাকায় না। কেবল সুরভির হাতে একফোঁটা নোনাপানি পড়ে।

অভ্র আবার বলে, “গগন ছোট থাকতে ওর মা’কে হারিয়েছে। ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ের পর ওকে টাকা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে নি। না সময়, না যত্ন আর না আদর। আমার কাছে তবুও কমপক্ষে দিনে দশবার মা, বাবা, দাদীজান, দাদাজান সবার কল আসতো। তিনবছর পর সভ্যও এসে পড়ে। কিন্তু ওর ফোনে মাসে একবার কেবল ওর বাবার কল আসতো টাকা পেয়েছে কি-না জানার জন্য। ওর কাছে কেবল আমি ছিলাম। আর পাঁচবছর পর আমাদের জীবনে এলো মেঘলা। শুরুতে আমরা তিনজন ভালো বন্ধু হলেও তারপর ওদের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি হলো। সবকিছু পার্ফেক্ট চলছিল। ওদের যখন প্রেম চলছিল। তখন আমি একটু একা হয়ে গিয়েছিলাম । আমি তখন সহজে মানুষের সাথে কথা বলতে পাড়তাম না তাই ওয়েবসাইট শুরু করি। সেখান থেকে তোমার সাথে পরিচয় হয়। সবকিছু অনেক ভালো যাচ্ছিল। আমরা পড়াশোনা শেষ করার পর দেশে ফিরলাম নিজেদের স্বপ্ন পূরণের জন্য। আমি আমাদের কোম্পানিতে যুক্ত হলাম। মেঘলা তার ফ্যাশন স্টোর খোলার কাজে ব্যস্ত ছিলো। আর গগন ওর মা’য়ের দিক থেকে পাওয়া জমিতে বিশাল এক আশ্রম তৈরি করল। সবকিছু ভালোই যাচ্ছিল এর মধ্যে একদিন মেঘলা ও গগনের ঝগড়া হলো। মেঘলার কাজিনের বিয়ে ছিলো, সে পরিকল্পনা করেছিল গগনকে সেদিন তার বাবার সাথে পরিচয় করাবে। কিন্তু গগনের আশ্রমের কাজে শহরের বাহিরে যেতে হতো। একারণে তাদের ঝগড়া হয়। মেঘলার অভ্যাস ছিলো ঝগড়া হলে সে অভিমান করে কথা বলতো না। ফোন অফফ রাখতো, যোগাযোগ একদম বন্ধ করে দিতো। সেবারও তাই হয়েছিল। ঢাকার বাহির থেকেও গগন অনেক চেষ্টা করে মেঘলার সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু তা হয় না। এক সাপ্তাহ পর সে ঢাকায় আসে। তার বাসায়ও যায় কিন্তু সেখানে কাওকে পায় না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মেঘলার বাবা অর্থ ও ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে তার মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। তাই দশদিনের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করে। মেঘলাকে এই কয়দিন এক রুমে বন্দী করে রেখেছিল। যখন গগন আমাকে এসব জানায় তখন সব খোঁজ বের করে আমরা বিয়ের আগেরদিন মেঘলার কাছে যেয়ে ওকে লুকিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে আসি। ওর কাজিনের সাহায্যে। কিন্তু আমাদের ভাগ্য খারাপ ছিলো। আমি জানি না কীভাবে তৌফিক ব্যাপারটা জানলো। রাস্তার মাঝেই আমাদের গাড়ির সামনে কতগুলো গাড়ি এসে থামে। জানি না তখন গগন ওর নিয়তি জানতো না’কি! কিন্তু ও আমাকে ওর শেষ ইচ্ছাটা জানায়। আমি তখন ওর উপর রাগ করারও সুযোগ পাই নি। কতগুলো লোক ঘিরে ধরে আমাদের, আমাদের গাড়ি টেনে বের করে। এক গাড়ি থেকে মেঘলার বাবা বের হয়ে ওকে টেনে নিয়ে যায়। ও কাঁদছিল, অনুরোধ করছিল, ভিক্ষা চাইছিল নিজের বাবার কাছে কিন্তু তার মন এক মুহূর্তের জন্যও গলে নি। তাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যায়। আমরা থামাবার অনেক চেষ্টা করেছি জানো? যখন মেঘলাকে বাঁচানোর জন্য আমরা যাই তখন কতগুলো লোক আমাদের মারতে শুরু করে। আমরা ফাইটব্যাক করার অনেক চেষ্টা করি কিন্তু এতজনের সাথে পেরে উঠি না। এর উপর তাদের কাছে হাতিয়ারও ছিলো। তারা নির্দয়ের মতো হামলা করছিল আমাদের উপর। একজন প্রথমে আমার মাথায় আঘাত করে এরপর ধারালো কিছু একটা দিয়ে আমার পিঠে আঘাত করেছিল, আমি তখনই রাস্তায় পড়ে গেলাম। আমার অনেক ব্লাডলস হয়েছিল। সে দ্বিতীয়বার আঘাত করার পূর্বে গগন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। ও এর পূর্বে সামলে নিচ্ছিল সবাইকে কিন্তু সে আঘাতের পর ও নিজেও দুর্বল হয়ে পড়ে। কয়েকজন তাকে ধরে আরও নির্দয়ের মতো মারতে থাকে। তারপর সেখানে এক গাড়ি এসে থামে, গাড়ি থেকে বের হয় তৌফিক। তার হাতে ছিলো পিস্তল। সে এসেই গগনের মুখে প্রথমে লাথি মারে। তখন আমার এত জেদ উঠেছিল যে ইচ্ছে করছিল সেখানেই শেষ করে দেই ওকে। কিন্তু এত শক্তি ছিলো না আমার। তারপর সে বন্দুক গগনের উপর তাক করে। শব্দ হয় তিনবার। সে তিন তিনটা গুলি করে আমার বন্ধুকে। আমার সামনে। সে সময় আসমানও তার বুক চিরে কাঁদছিল। ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি ঝড়ছিল। গগনের দেহ আমার সামনে পড়েছিল কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না। আমি তো উঠে যেয়ে আমার বন্ধুকে শেষ বারের মতো জড়িয়েও ধরতে পারি নি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি জ্ঞান হারাই। দুইদিন পর আমি উঠি হাস্পাতালে। সেখানে জানতে পারি গগন আর নেই। তাকে কবরও দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমি শেষ বারের মতো আমার বন্ধুকে একটু ধরে দেখারও সুযোগ পেলাম না। একটিবার ওকে…ওকে শেষ বার ছুঁতে পাড়লাম না।” অভ্র চোখ বন্ধ করে নেয় কথাগুলো বলার সময়। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।

সুরভি নিজেও বুঝতে পারে না তার চোখে কখন পানি এসে পড়লো। কথাগুলো শুনে তার চোখেও পানি চলে আসছিল। সে কাঁপা কাঁপা হাত অভ্রর গালে রেখে তার ভেজা গাল থেকে পানি মুছে দেয়। অভ্র তাকায় তার দিকে। তার হাতটা আলতো করে ধরে। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “জানো গগন তার শেষ ইচ্ছায় আমার কাছে কি চেয়েছিল?”
“কী?”
“ও চলে গেলেও আমি যেন সবসময় মেঘলাকে রক্ষা করি। কারণ ও বেঁচে থাকতে আমার কিছু হতে দিবে না।”
সুরভির নিশ্বাসও আটকে আসে। সে আন্দাজ করতে পাড়ছে না অভ্রর উপর কথাগুলো বলার সময় কি যাচ্ছে। সে শক্ত করে ধরে অভ্রর হাত।

অভ্র আবারও বলে, “তুমি প্রশ্ন করেছিলে না যে হঠাৎ নক্ষত্র তোমার সাথে কেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল? কারণ আমি তোমাকে সেদিন অর্থাৎ ১৬ ই জুনে গাড়িতে থাকা অবস্থায় তোমাকে শেষ মেসেজ দিয়েছি। সেদিন আমার বন্ধুকে হারানোর পর আমি প্রতিশোধ ছাড়া কিছু ভাবতে পারি নি। আমি কত জায়গায় গিয়েছি ন্যায়ের জন্য। কিন্তু ওর ক্ষমতার সামনে আমার অর্থও কোনো কাজের ছিলো না। দাদাজান আমার আহত অবস্থা দেখে আমাকে দ্বিতীয়বার সে ঝুঁকিতে ফালাতে চান নি। আমি এখন বুঝতে পাড়ছি তিনি চাইলেও কিছু করতে পাড়তেন না কিন্তু তবুও আমাকেও কিছু করতে দিলেন না। আমাকে হারানোর ভয়ে। তার পরিবারের জানের ঝুঁকির ভয়ে। কিন্তু আমি তো কোনো রাত শান্তির ঘুমাতে পারি না। আজও, প্রতিরাতে আমি গগনকে স্বপ্ন দেখি। আর আমার ভেতরটা শেষ হয়ে যায় যে আজও আমি তার জন্য কিছু করতে পাড়লাম না। ঠিক একারণে আমি সব ছেড়ে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছি। আমার গগনের প্রতিশোধ ছাড়া জীবনে অন্যকোনো লক্ষ্য ছিলো না। আমি অন্যদিকে ধ্যান দিতেও নারাজ ছিলাম। একারণে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এতবছর পর তোমাকে আমি আবার দেখলাম। সভ্যর বিয়েতে।”

সুরভি উঠে বসে তার পাশে। অভ্রর হাত সে এখনো ছাড়ে নি। সে দ্বিধাবোধ করে নিজের মুখ খোলার পূর্বে। মৃদুস্বরে বলে, “আমি জানতাম না আমার মনে জাগা কিছু প্রশ্নের পিছনে এত কষ্টদায়ক উওর হবে। অতীতটা এত ভয়াবহ জানলে আমি প্রশ্নই করতাম না।”
“আমি তোমাকে কথাগুলো বলতে চাই নি কারণ তুমি এসবে জড়ালে তোমার জীবনের ঝুঁকি হতো। কিন্তু সম্ভবত তোমাকে সেদিন পার্টিতে নিয়ে এসবে জড়িয়ে বিরাট বড় ভুল করেছি। কিন্তু মেঘলার জন্য তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম আমার সাথে তোমাকে দেখে ও শত কষ্টের মাঝে হলেও এক মুহূর্তের খুশি পাবে।”
“আপু এই কথাই আমাকে বলেছিল।” সে অভ্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি জানেন যে মেঘলা আপুর উপর শারীরিক নির্যাতন হয়। তার দেহে অনেক আঘাত দেখেছি আমি।”
“জানি। সেখানে আমার কিছু লোক আছে। ওদের দ্বারা এটাও জেনেছি যে ওদের বিয়ের রাতেই ওর যে কাজিন আমাদের সাহায্য করেছে তাকে মেঘলার সামনে রেইপ করেছিল তৌফিক।”
কথাটা শুনে চোখদুটো বড় হয়ে যায় সুরভির। সে বিশ্বাস করতে পাড়ছে না এই লোকটাই সেদিন ন্যায় অন্যায়ের কথা বলছিল!
সে বলে, “বিশ্বাস করা কষ্টকর যে এত মাসুম চেহেরার পিছনে এত বড় জানোয়ার লুকিয়ে আছে। সেদিন কত ন্যায় অন্যায়ের কথা বলল আমাকে। তাহলে কী মিদুলকে যে এজন্য জেলে পাঠাল যেন নাম খারাপ না হয়?”
“একারণ তো আছেই। সাথে যেন মিদুলের অবস্থা ওর বন্ধুদের মতো না হয়। সে মিদুলকে জেলে পাঠিয়ে ওকে প্রটেক্ট করছে। আর আমার তো মনে হয় জেলে আরও আরামে থাকবে ও। আমার ও দোষ আছে, আগেই মিদুলকে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু আমি মেঘলার সাথে প্রথমে এই ব্যাপারে কথা বলতে গেলাম।”
“মেঘলা আপু জানতো এই ব্যাপারে?”
“সেদিন পার্টিতে এই নিয়েই ওর সাথে কথা বলেছিলাম। মেঘলা বলল ও জানতো যে ওর বাবার অতিরিক্ত আদরে এবং তৌফিকের সাপোর্টে মিদুল একদিন ঠিক ও ভুলের পার্থক্যই ভুলে যাবে।”
“এখন চিন্তা করেছেন যে কীভাবে মেঘলা আপুকে সেখান থেকে বের করতে পাড়বেন?”
“এখনো ফিগারআউট করতে পাড়ছি না কীভাবে ওকে সেখান থেকে বের করব। আর এখন আমার তোমার সেফটিরও চিন্তা হচ্ছে।” অভ্র সুরভির দিকে তাকিয়ে বলে। তার চোখদুটো জলে ভরা ছিলো কিন্তু তবুও সে চোখজোড়ায় সুরভি তার জন্য চিন্তা, ভালোবাসা সব অনুভব করতে পাড়ছিল। সে মুহূর্তে তার হৃদপিণ্ডটা হঠাৎ বেগতিক হয়ে গেল। তবুও সে নিজেকে সামলে নেয়। সে অভ্রকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আমি নিজের যথেষ্ট খেয়াল রাখব। আর আমরা একসাথে মেঘলা আপুকে সে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবো।”
“তুমি এসবে পড়ো না। আমি নিজে কোনো একটা রাস্তা বের করে নিব।”
“কিন্তু আমি….”
“আমি মানা করেছি। তো করেছি….” এবার উচ্চস্বরেই বলে অভ্র। সুরভি এখন তার মুখের উপর কিছু বলে না। আপাতত তাকে কিছু বলা ঠিক হবে না। সে অবস্থা তার নেই। সে মৃদুস্বরে বলে, “আচ্ছা প্লিজ আপনি শান্ত হন, আমি আপনার জন্য পানি নিয়ে আসছি।”

সুরভি উঠে যায় ডাইনিং রুমে। পানি নেওয়ার বাহানায় ভাবে কি বলা যায় অভ্রকে কি বলে শান্ত করা যায়। কিন্তু কিছুই খুঁজে পায় না। আপন কাওকে হারানোর দু:খটাই এমন। সবকিছুর সান্ত্বনা আছে কিন্তু কাওকে সারাজীবনের জন্য হারানোর পর তাকে কিছু শব্দ দিয়ে কীভাবে সান্ত্বনা দেওয়া যায় সে জানে না। কিন্তু সে অভ্রর কষ্ট বুঝে, কেননা সে-ও এভাবেই হারিয়েছিল তার প্রিয় বন্ধুকে। নিজের চোখের সামনে আপন কারও মৃতদেহ দেখা থেকে ভয়ানক আর কিছুই হতে পারে না।

সুরভি গভীর নিশ্বাস ফেলে, নিজেকে প্রস্তুত করে যার অভ্রর রুমের দিকে। সে রুমে ঢুকে দেখে অভ্র তার দেয়ালে লাগানো তার বন্ধুদের ফটোফ্রেমের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখভরা জল দেখে সুরভির বুকটা কেঁপে উঠে। সে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। অভ্রর কাঁধে হাত রেখে তাকে ডাকার কথা ভাবে। কিন্তু ডাকে না।

সে কাঁধ থেকে হাত সরাতেই তার দৃষ্টি যেয়ে আটকায় তার পিঠে। অভ্র বলেছিল তার পিঠে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করেছিল। আচ্ছা তার পিঠে কি এখনো সে আঘাতের দাগ আছে? এখনো কি সে স্থানে ব্যাথা হয় অভ্রর? সে হাত দেয় তার পিঠে। সাথে সাথে অভ্র ঘুরে তার দিকে মুখ করে, আর হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরে।

বিস্ময়ে সুরভির হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটা পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এর আগে কোনো ছেলে তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে নি। এত শক্ত করে তো কখনোই না। তার বুকের ভেতর কেমন ধুপপুক শুরু হলো। সে অভ্রকে সরাতে চাইলে অভ্র মৃদুস্বরে তাকে বলে, “প্লিজ সুরভি। কিছু মুহূর্ত কেবল।”
সুরভির কাঁধ ভিজছিল। তা সে অনুভব করতে পাড়ছে। সে অভ্রকে সরায় না। আলতো করে ধরে নেয় তার পাঞ্জাবিটা। সে দেখে জানালার ওপারে, বৃষ্টি হচ্ছে। এই অসময়ের বৃষ্টিটা অস্বাভাবিক। আজকের দিনটির মতোন।

চলবে…