অনুভূতির খাঁচা পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
31

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৪৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

দরজা খুলে বের হতেই তৌফিককে দেখে থমকে দাঁড়ায় সে। চোখেমুখে আতঙ্ক ভেসে উঠে। তার কোমল হৃদয়খানা এতটা কেঁপে উঠে যেন এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। যদি মায়ার সাথে কথাগুলো তৌফিক শুনে তাহলে আজ তাকে মৃ’ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিয়েই ছাড়বে।

তৌফিক মেঘলার ঘাবড়ে যাওয়া দেখে ভ্রু কুঁচকাল, “ব্যাপার কী? তুমি এত ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন? কী করেছ তুমি?”
আতঙ্কে মেঘলার কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল। সে বরফ হয়ে গেল যেন। তার বোধশক্তিও লোপ পেল আতঙ্কে জড়িয়ে।
তৌফিক আবারও কড়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এতক্ষণ এখানে কী করছ? আর তোমাকে না সকালে আমার প্রশংসার সব শিখিয়ে দিয়েছিলাম? ছাড় পেয়ে কি পেখম গজিয়েছে তোর?” বলে সে শক্ত করে ধরে বসে মেঘলার বাহু। আজ সকালের তাজা আঘাত থাকায় সে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে।

এমন সময়ের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মায়া। তাকে দেখে তৌফিক ভাবভঙ্গি পালটে নেয়। ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে তার বাহু ছেড়ে তার গাল আলতো করে ছুঁয়ে বলে, “কফি গরম ছিলো না তো জান? কোথাও লাগে নি তো?”
তারপর তাকায় মায়ার দিকে। মায়া তাকে দেখেও সেখান থেকে যেতে নিলে তৌফিক ডাক দেয়, “মিস মায়া না?”

মায়া থেমে যায়। তাকায় তৌফিকের দিকে। হাত বুকের উপর ভাঁজ করে আলতো স্বরে বলে, “আর আপনার মতো উচ্চ পদবির লোক আমাকে কীভাবে চিনেন?”
“মাত্র টিভিতে দেখলাম। বউকে দেখার জন্য ছেড়েছিলাম। বউ দেখি নার্ভাস তাই চলে এলাম।”
কথাটায় বাঁকা হাসে মায়া। তার সামনে কী নাটকই করছে এই জানোয়ারটা। আগের মতোই চোখে চোখ রেখে বলে, “বেশ ভালো স্বামী দেখছি।”
“চেষ্টা করি আরকি। তো আপনি….”
“আই থিংক ইন্টারভিউ কন্টিনিউ হবে। আপনার মহান কর্মী অফিসের একজনের সাথে ঝগড়া করে অলরেডি মিসেস মেঘলার সাথে আমার কোর্টটাও নষ্ট করে দিয়েছে। এতক্ষণ ধরে আমরা উঠানোর চেষ্টায় ব্যর্থ ছিলাম। এখন এটা পড়ে আমি ন্যাশনাল টিভিতে ইন্টারভিউ দিতে হবে।” বলে রিয়াদের দিয়ে তাকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। তারপর কাওকে পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে লাগলে তৌফিক দ্রুত মেঘলার হাত ধরে তার পিছে রওনা দেয়। সে চোখ দিয়ে তীক্ষ্ণভাবে যাচাই করছে মায়াকে। দেখছে আর চোখ দিয়ে গিলছে।

ইন্টারভিউ রুমে এসে মেঘলাকে বসিয়ে সে সবাইকে একই কথা বলল, বউ নার্ভাস তাই এসেছে তার সাপোর্টে। এই এক কথায় তার বাহবা হলো চারদিকে। মেঘলা তখনও স্থির। মায়াও কিছু বুঝতে দিলো না। তৌফিককে আলাদা বসানো হলো। সে সুমনকে ডাক দিলো, “এই মেয়ের সব ডিটেইলস আমার চাই। সব। ওকে আমার একদিন না, বহুদিনের জন্য চাই। ওকে একদিন কাছে পেলে মন ভরবে না আমার। তৌফিকের চোখে চোখ রেখে এই প্রথম কোনো মেয়ে কথা বলেছে। আমিও দেখতে চাই ওর শরীরে কত তেজ।”
“স্যার বেদ্দ’ব মেয়ে মনে হয়। যেখানে আপনার সাথে কথা বলার জন্য মানুষ উতলা হয়ে থাকে। কতমাস অপেক্ষা করে সেখানে আপনাকে পাত্তাই দিলো না।”
তৌফিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সুমনের দিকে। সুমন ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলে সে হেসে উঠে, “একারণেই তো মনে বেশি ধরেছে একে। তর সইছে না। একে আমার লাগবে। যেমন করেই হোক লাগবে। মেয়েটা রূপ একদম আগুন। আমি এই রূপ আমার নামে করতে চাই। অতি জলদি।”
.
.
জোহান বসে আছে অন্ধকার রুমে। মেঝেতে বসা সে। হাতে তার ফোন। আজ শেষদিন ছিলো মায়ার দেওয়া শর্তের। আর দুইঘন্টা বাকি। সে কি করবে কিছুই বুঝতে পাড়ে না। তার কি করা উচিত? সে মায়াকে ছাড়া না থাকতে পাড়ছে, না তাকে নিজের কাছে রাখতে পাড়ছে। তার তো নিজের উপরই ভরসা নেই। জীবনের কোন মোড়ে সে মায়াকে কষ্ট দিয়ে বসে আবার!

সে মেঝেতে বসে ছিলো। চোখ বন্ধ করে মাথাটা ঠেকায় বিছানাতে। সাথে সাথে তার চোখের সামনে মায়ার হাসিটা ভেসে উঠে। তীব্র যন্ত্রণা বোধ করে করল নিজের হৃদপিঞ্জরায়। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে এক ঢাকা নোনাজল ঝরে পড়ল। সে নিজেও বুঝল না।

হঠাৎ যখন চোখের সামনে মায়ার ছবি ভেসে আসতে আস্তে অন্ধকার হয়ে গেল সবটা তখন সে আতঙ্কে চোখ খুলে নিলো। তার হৃদপিণ্ডটা ভারী হয়ে ব্যাথা করে উঠল। যেন কেউ চেপে ধরেছে। সে সাথে সাথে ফোনটা নিয়ে মায়ার নাম্বার বের করল। না, এই মেয়েটাকে ছাড়া নিজের অস্তিত্বটা কল্পনা করতে পাড়ছে না সে। এই মেয়েকে তার লাগবেই। না পেলে মনে হয় এই হৃদয়ের যন্ত্রণাতেই তার মৃ’ত্যু হবে।

কলটা দিতে যাবে সেই মুহূর্তে তার একটা ভাবনা এলো। সে লাইট জ্বালাল। তার বুকসেল্ফ থেকে ডায়েরি বের করল। তার আগের ডায়েরিটা। তা পড়তে শুরু করল সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। তারপর বসে পড়ল বিছানায়, তারপর মেঝেতে। সম্পূর্ণ পড়তে হলো না তার। মাথা চাপড়ে ধরল। তার এই অন্ধকার জীবনে সে কীভাবে আনবে মায়াকে? তার দোষে সে আপন সব মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। মায়াকেও যদি কষ্ট দিয়ে ফেলে? যদি একসময় এই দম বন্ধ হওয়া অনুভূতি হারিয়ে যায় তাহলে কী করবে সে? মায়ার কষ্ট তার তখন সহ্য হবে? ভাবতেও পাড়ল না সে। হাতের ফোনটা দূরে ছুঁড়ে মেরে দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। মাথা তার যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। তবে তার বুকের ভেতরের যন্ত্রণার কছে হার মানছে। এ যন্ত্রণা কীভাবে সহ্য করবে সে?
.
.
মায়া বাসায় এলো রাত সাড়ে দশটায়। খুব ক্লান্ত সে। সারাদিন অফিস করে রাতে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া ভীষণ কষ্টের। শরীর ভেঙে আসছিল তার। খিদেও পেয়েছিল প্রচুর। তবুও সে ফ্রেশ হলো না, কিছু খেল না। তাকিয়ে রইলো ফোনটার দিকে। মুহূর্ত কাটল, সময় কাটল, কিন্তু ফোনের স্ক্রিন অন হলো না। তবুও সে নড়ল না। যদি এক মুহূর্ত চোখ সরালে জোহানের ফোন মিস হয়ে যায়?

সময় ঘনিয়ে এলো। মায়ার হার্টবিট বাড়ল। ফোন এলো না। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠায় সে আশান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল ফোনের দিকে। দেখল এলার্ম বাজে। বারোটা বাজে সে এলার্ম দিয়েছিল। সময় শেষ?

সময় শেষ। তাও জোহানের কল এলো না? ভেবেই তার মনটা বিষাদে ভরে গেল। চোখ সিক্ত হয়ে এলো। সে তাকিয়ে রইলো ফোনটার দিকে। আজ সে মেঘলাকে দেখে আফসোস করছিল। তার প্রেমিকের সাথে বোধহয় একরাশ স্বপ্ন সাজিয়েছিল সে। অপূর্ণ থেকে গেল। চেয়েও তার এক হতে পাড়ে নি। আর এদিকে এক হতে পেরেও জোহান তাকে চায় না?

মায়া সময়ের খুবই পাঁকা। কিন্তু আজ সে তার এই নিয়মটাও ভাঙল। কাটল একঘন্টা, দুইঘন্টা, তিনঘণ্টা। সে বসেই রইলো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফোনটার দিকে। কোনো কল এলো না। এবার সে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। সে রাত তিনটা বাজেই কল দিলো আতিফকে…
.
.
দুইদিন পর,
ইনারা দাঁড়িয়েছিল মায়ার বাসার সামনে। সে তার ফ্লাটের সামনে যেয়ে কল দিলো মায়াকে। বেশ কয়েকবার কল দেবার পর মায়াটা ধরল। ধরার সাথে সাথে ইনারার বাচ্চাসুলভ সুরে অভিযোগ আসল,
“মায়া আপু তুমি আমাকে পাত্তা দিচ্ছো না কেন?”
মায়া বিস্মিত স্বরে বলল, “আমি আবার তোকে পাত্তা দেই নি কবে?”
“কতবার করে কল দিচ্ছি। কল ধরেছ?”
মায়া তার বাচ্চামো অভিযোগ শুনে হাসল। মেয়েটা মিতা থেকেও বেশি নাটকবাজ। এই কয়মাসে কত আপন হয়ে গেল মেয়েটা। আপন বোনের মতো। এটা কী রক্তের টান?

“বাইক চালাচ্ছিলাম। এতবার কল শুনেই সাইড করলাম বাইক। ভাবলাম কোনো ইমাজেন্সি।” মায়া বলল।
“ইমাজেন্সিই। আমি তোমার বাসার সামনে বাবুকে নিয়ে কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।”
“তুই বাসায় এসেছিস?”
“হ্যাঁ খুব মন টানছিল তোমার জন্য।”
তার আদুরে কথা শুনে মায়ার চোখ ভিজে গেল। মিতা বাদে তার দুইটা ভাইবোন আছে। কেউ তার খোঁজও নেয় না। কাজ ছাড়া কথা বলে না। এই’যে সারাদিন কাজ করে একাকী থাকে। বেঁচে আছে না নেই তাও জিজ্ঞেস করে না। অথচ এই দূর সম্পর্কের মেয়েটা তাকে কত আপন করে নিলো।

ইনারা হঠাৎ একটা বিকট শব্দ পেল ফোন থেকে। সে ঘাবড়ে জিজ্ঞেস করে, “আপু ঠিক আছো তো তুমি?”
ওপাশ থেকে মায়ার উচ্চ চিৎকারের শব্দ পায়। তারপর কন্ঠ শোনা আয়, “কী আজব গাড়ি দেখে চালাতে পাড়েন না। রোড সাইডে কীভাবে এক্সিডেন্ট…. ” সম্পর্ক কথা শোনা যায় না। ইনারা আরও আঁতকে উঠে, “আপু…মায়া আপু? কই তুমি? আপু?”
অনেকক্ষণ ধরে ডাকার পরও আর কথা আসে না। কেবল গাড়ির শব্দ পায় সে। ইনারা বিচলিত হয়ে যায়। কল কেটে আবার দেয়। কল কেউ ধরে না। সে ঘাবড়ে যায় ভীষণ। দাঁড়িয়ে থাকতেইও কষ্ট হচ্ছে তার এই পেট নিয়ে। সে সিঁড়িতে যেয়ে বসে কল দেয় সভ্যকে।

সভ্য ফাইল চেক করছিল তার কেবিনে বসে। আর এসিস্ট্যান্টের সাথে কথা বলছিল। ফোন বেজে উঠায় সেদিকে নজর দেয়। ইনারার নাম দেখে হাসি ফুটে ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম। এসিস্ট্যান্টকে পাঠিয়ে দিয়ে কল ধরে মধুর সুরে জিজ্ঞেস করে, “মহারাণী কী পৌঁছে গেছেন?”
“সভ্য… শুনো…. ”
ইনারার আতঙ্কিত কন্ঠ শুনেই তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। সে নিজেও বিচলিত হয়ে যায়, “কী হয়েছে পাখিটা? তুমি ঠিক আছো তো? সব ঠিক আছে?”
“মায়া আপুকে কল দিয়েছিলাম বাসার সামনে এসে। আপু কল ধরে কথা বলল আর…” এতটুকুতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে।
“কী হয়েছে ইনারা বলো?”
“আর হঠাৎ শব্দ হয় কিসের যেন! অনেক জোরে শব্দ হয়। তারপর আপু কিছু বলছিল মাঝপথেই কথা কেটে যায়। আর কলে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“তুমি…তুমি চিন্তা করো না। আমি আছি না? আমি দেখছি। তুমি এক কাজ করো তুমি জোহানের বাসায় যাও। ওর মা’য়ের কাছে যেয়ে বসো।”
“তুমি প্লিজ আপুকে খুঁজো। অভ্র ভাইয়ার তো অনেক ক্ষমতা তাকে বলো না। আমার আপুকে যেন খুঁজে দেয়।”
“তুমি কান্না বন্ধ করো। আমি দেখছি। অভ্র ভাইয়াকে কল দিচ্ছি। তুমি সৌমিতা আন্টির কাছে যাও।”
“হু”

সভ্য কল কেটে অভ্রকে কল করতে যেয়েও থেমে যায়। তার আগে কল দেয় জোহানকে।
“কী ব্রো ভুলেই গেলি? বাবা হওয়ার খুশিতে এতদিন পর আমার খবর নেবার কথা ভুলে গেলি?” বলে হাসল জোহান।
তবে সভ্য হাসল না। সে বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় তুই?”
“গাড়িতে। কেন? তোর কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন?”
“গাড়ি তুই চালাচ্ছিস?”
“না ড্রাইভার কেন?”
“কোথায় আছিস?”
“প্রডাক্ট লঞ্চ ছিলো একটা। সেখানে গেছি। এখন বাসায় ফিরছি।”
“তোদের অফিস থেকে বাসার দিয়ে যে রাস্তা দিয়ে যায় সেদিকে গাড়ি ঘুরা।”
“কেন ভাই? কী হয়েছে?”
“মায়া….”
মায়ার নাম শুনতেই জোহান যেন শকড খায়। সভ্য এমন মলিন কন্ঠে মায়ার নাম নিচ্ছে কেন? তার বুক ধুকপুক করতে লাগলো। সে কোমল সুরে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে মায়ার?”
“তুই বেশি ঘাবড়াবি না। শান্ত থাকিস প্লিজ।”
এবার জোহান রেগে গেল। সে উচ্চ স্বরে বলল, “ফাজলামো না করে বলবি কী হয়েছে মায়ার? ও ঠিক আছে তো?”
“জানি না। ইনারা ওর বাসায় গিয়েছিল। কথা বলার মাঝে কি বিকট শব্দ হলো এরপর থেকে ওকে পাচ্ছে না। আই ডোন্ট নো ঠিক আছে না’কি কিছু…. ”
“পরের শব্দ মুখেও আনিস না। ওর কিছু হবে না।”
জোহানের ঘন নিশ্বাস শুনে সভ্য বলল, “প্লিজ তুই শান্ত হ। ওর কিছু হবে না। তুই ওই রাস্তায় দেখ। আমি অভ্র ভাইয়াকে কল দিচ্ছি অভ্র ভাইয়া ঠিকই ট্রাক করে নিবে। তুই মায়াকে পেলে আমাকে কল দিস।”
জোহানের গলা সিক্ত হয়ে উঠে, “প্লিজ ভাই ওকে খুঁজে বের কর। ওর যেন সুস্থ থাকে প্লিজ। নাহয় আমি কীভাবে থাকব?”
সভ্য তার শেষ কথা শুনে মনে মনে হাসল। ছেলেটা কী এবার আসলেই প্রেমে ডুবেছে না’কি? নিশ্চিত ডুবেছি। সাংঘাতিক ভাবে ডুবেছে। তারপরও বুঝতে পাড়ছে না। এতটা গাঁধা কেন তার বন্ধু?
জাহান কল কেটে ড্রাইভারকে বলল তার অফিসের রাস্তা দিয়ে নিতে।

সভ্য অভ্রকে কল দিয়েও সবটা জানায়। সাহায্যের আবেদন করে। সবটা শুনে অভ্র বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে স্থির হয়ে বলে থাকে কতক্ষণ। তারপর বলে, “তোকে জানাচ্ছি।”
কল রেখে চোখ বন্ধ করে এক হাত দিয়ে চুল আঁকড়ে ধরে। তারপর হঠাৎ টেবিলে হাত মুঠো করে ঘুষি মেরে বলে, “শীট! শীট! শীট!”
ফজলু মিয়া তার পাশেই ছিলেন দাঁড়িয়ে। হঠাৎ তার অভ্র ভাইয়ের কী হলো বুঝলেন না। সে কৌতুহল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন, “ভাই ভাই আপনারে লাগতাসে চিন্তায় মগ্ন কিছু কি ঘটছে না’কি যার এখনো জানি নো।”
“ভুল হয়ে গেছে ফজলু। আমি কেন এসবের মধ্যে মায়াকে জড়াতে গেলাম? ওকে এসবে জড়ানো ঠিক হয়নি। কেন ওকে এসবে জড়িয়ে বিপদে ফেললাম!”
ফজলু চিন্তিত স্বরে বলল, “ভাই ডেঞ্জারাস আপা তো বলেছিল সব প্লান মতো গেছে। তাহলে বিপদের শঙ্কা এলো কীভাবে?”
“বুঝতে পাড়ছি না। কিছু বুঝতে পাড়ছি না। ফজলু জলদি মায়ার ফোন ট্রাক করো।”
তারপর থেমে বলল, “আর ওকে ফোন দেও। তৌফিক নিশ্চয়ই মায়াকে কোথায় নিবে ওকে বলেছে। খোঁজ নেও।”
“ভাই ওকে ফোন দেওয়া যাবে না। ও তো এই সময় তৌফিকের সাথে থাকে। যদি তৌফিক একবার জানে তাহলে সব তো শেষ হবেই , সাথে কতগুলো মাসুম জান যাবে।”
“তাহলে নাজিমকে কল দেও।”
“জিজ্ঞেস করো কিছু জানে না’কি? আর সব জায়গায় খোঁজ লাগাও জলদি।”
ফজলু কাজে লেগে পড়ে। অভ্র টেবিলে কণুই রেখে মুখে হাত রাখে। তার জন্য কারো জীবন ঝুঁকিতে পড়বে এটা সে সহ্য করতে পাড়বে না। যেভাবেই হোক মায়াকে তার খুঁজতেই হবে।

জোহান রাস্তার মাঝে দেখতে পায় একটি বাইক সাইডে পড়া আছে। তা দেখে সে জলদি বলে ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি থামায়। দ্রুত নেমে দেখে বাইকটা আসলে মায়ার। নিচে পড়ে আছে। মনে হয়েছে কিছুর সাথে ধাক্কা লেগেছে। কিছু ফোঁটা র’ক্তও পড়া ছিলো সেখানে। তা দেখে আত্মা কেঁপে উঠে জোহানের। ভয় তার বুক কাঁপিয়ে দেয়৷ মায়ার কিছু হয় নি তো? না, সে ভাবতেও পাড়ছে না। সে পাশেই মায়ার মোবাইল দেখতে পায়। তা তুলে। আশেপাশে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পাড়ে না। উলটো মানুষ তাকে দেখে ভিড় লাগিয়ে দেয়। সে বিরক্ত হয়ে গাড়িতে উঠে। ডাইভারকে বলে। এখান থেকে যতগুলো রাস্তা যায়। সে সব রাস্তায় তাদের যেতে হবে।
তারা কতক্ষণ গাড়ি নিয়ে ঘুরে কিন্তু পাচ্ছিল না সে মায়াকে। তার ভেতরটা ধীরে ধীরে শূন্য হতে লাগল। মনে হচ্ছিল সে মায়াকে হারিয়ে ফেলেছে। এই অনুভূতিটা সে সইতে পাড়ছে না। দম আটকে আসছে। সে সময় হঠাৎ মেসেজ এলো সভ্যের।
.
.
মায়া টিপটিপ করে চোখ খুলে। তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ঘুরাচ্ছে ভীষণ। বাম হাত পা’য়ে ব্যাথায় কেঁপে উঠছে। সে মিটিমিটি করে চোখ খুলে দেখে সে একটা গাড়িতে। তার পাশে একটি লোক। সামনের দুই সিটে বসা দুই লোক।

সে কপাল কুঁচকে নিল। শেষ তার মনে আছে একটি গাড়ি এসে বাইকে ধাক্কা মেরে ছিল। সে রোড সাইডে পার্ক করেছিল তবুও। সে পড়ে হাতে পা’য়ে ব্যাথা পেল। তাদের বকতে নিলো। এর মাঝেই মাথায় তীব্র ব্যথা অনুভব হলো তার। সে তার মাথার পিছনে হাত রেখে দেখে র’ক্ত।

চলবে….

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৪৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মায়া টিপটিপ করে চোখ খুলে। তার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ঘুরাচ্ছে ভীষণ। বাম হাত পা’য়ে ব্যাথায় কেঁপে উঠছে। সে মিটিমিটি করে চোখ খুলে দেখে সে একটা গাড়িতে। তার পাশে একটি লোক। সামনের দুই সিটে বসা দুই লোক।

সে কপাল কুঁচকে নিল। শেষ তার মনে আছে একটি গাড়ি এসে বাইকে ধাক্কা মেরে ছিল। সে রোড সাইডে পার্ক করেছিল তবুও। সে পড়ে হাতে পা’য়ে ব্যাথা পেল। তাদের বকতে নিলো। এর মাঝেই মাথায় তীব্র ব্যথা অনুভব হলো তার। সে তার মাথার পিছনে হাত রেখে দেখে র’ক্ত।

মায়া খেয়াল করল কারো ধ্যান তার দিকে নেই। সে অতি ধ্যান সহকারে তার জ্যাকেটের পকেট থেকে তার কী-চেইন বের করল। আশেপাশে তাকাল সাবধানতার সাথে। আচমকা তার পাশেরজনকে এক জোরে লাঠি মারায় সে নিজেকে সামলাতে না পেড়ে নিচে পড়ে গেল। সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না। কেউ বুঝে উঠার আগেই পিছন থেকে ড্রাইভারের গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। একসাথে দু’টি অ’স্ত্র ধরে দু’হাতে। ড্রাইভারের গলায় ধরে একটি ধারালো লম্বা অ’স্ত্র। আরেকটি ইলেকট্রনিক স্টান গান বাকি দুইজনের দিকে তাক করে। যা বাটন চিপলেই বিদ্যুতের শকড দেয়। সে কড়া গলায় আদেশ করে, “পার্ক করো নাহলে এই মুহূর্তে গলায় ঢুকিয়ে দিব।”

ড্রাইভার পার্ক করে না। সে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায় তার সাথীদের দিকে। ইশারায় তার পাশের জনকে কিছু বললে সে ঝাপিয়ে পড়ে মায়ার উপর। মায়াও কম যায় না’কি? সে সাথে সাথে তার থুতনিতে স্টান গান রেখে শকড দেয়। কাতরাতে থাকে লোকটা। কাতরাতে কাতরাতে নিচে পড়ে যায়। মায়া মোটেও তার চিন্তা করে না। উলটো সে তার পাশেরজনকেও শকড দেয়। তারপর ড্রাইভারের গলায় আসলেই ছু’রির ন্যায় অস্ত্রটা কিছুটা ঢুকিয়ে দিতেই সে সাথে সাথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে এক গাছের সাথে। মায়া ছু’রিটা বের করে তাতে রক্ত দেখে তার সাথীর জামাতেই মুছে নেয়। তারপর দরজা খুতে যেয়ে দেখে লক করা। তার হাতের অ’স্ত্র দিয়েই জানালার কাঁচ ভেঙে তাকায় লোকদের বলে, “আজ মাথা ঘুরাচ্ছে বলে সহজে ছেড়ে দিলাম, নাহলে এই পৃথিবীতে জাহান্নাম দেখিয়ে আনতাম তোদের। মায়া চৌধুরী কি জিনিস তা বুঝিয়ে দিতাম।”
বলে জানা দিয়ে লাফ দিয়ে বের হতে যেয়ে পা’য়ে আরও বেশি ব্যাথা পায়। ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে নেয়।

বের হয়ে একটু এগোতেই দেখে তার পিছনে ড্রাইভার বাদে বাকি দুইজন আসছে। মায়া গভীর নিশ্বাস ফেলে। বিরক্তি তার চোখমুখে স্পষ্ট। সে বিড়বিড়িয়ে বলে, “বলছিলাম ভালো লাগছে না। জান ভিক্ষা দিলাম নিলো না। সুখে থাকলে ভূতে কিলায় আরকি।”
সে দাঁড়িয়ে নিজের হাত পা টান টান করার চেষ্টা করলো। ব্যাথা চোখ বন্ধ করে নিলো। মুখ চেপে ধরল। তারপর গভীর নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকাল। দেখল পুরুষ দু’টিকে। একজন সামনে এগিয়ে আসতেই মায়া এক পা উচিয়ে তাকে লাথি মারল প্রথমে মুখে তারপর সজোরে পেটে লাথি মারতেই সে যেয়ে পড়ল রাস্তায়। এক ইটে লেগে তার মাথা ফাটল। অন্যজন আসতেই সে হাত দিয়ে ছু’রিটা ঘুরিয়ে সামনে ধরল মুহূর্তে লোকের মুখে দাগ বসিয়ে দিলো। র’ক্ত বের হলো কিন্তু লোকটা দমলো না। উলটো মায়ার হাত ধরে বসল। মায়া তাচ্ছিল্য হাসলো তার সাহস দেখে। তারপর তার পা’য়ে লাথি মেরে লোকটার হাত দু’হাতে ধরে উঠিয়ে আছাড় মারল। তার পেটে উপর হাঁটু করে লাফ দিতেই যেন লোকটার জান বেরিয়ে গেল।

তার অবস্থা খারাপ করে মায়া তাকালেও অন্য লোকটার দিকে। সে হা করে তাদের দেখছিল। মায়া তাকাতেই পেট ধরে গোঙাতে শুরু করল।

মায়া সেদিক থেকে চলে এলো। খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। কারো সাহায্য নেওয়া দরকার। মাথা দিয়ে র’ক্ত পড়েছে তার। মাথা ঘোরাচ্ছে। যে কোনো সময় অজ্ঞান হতে পারে। কিন্তু কাকে ভরসা করবে সে? এই দুনিয়াতে মানুষ ভরসার মান রাখতে জানে? আপন মানুষরাই তো জানে না তাহলে অপরিচিত মানুষদের উপর ভরসা করবে কীভাবে সে? তবুও সে হাঁটতে থাকলো। নিজের সবটা জোর দিয়ে।

সভ্যর মেসেজ পেয়ে জোহান সেদিকে গাড়ি ঘোরায়। তার দৃষ্টি বিচলিত হয়ে খুঁজতে থাকে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে। সভ্য কিছুক্ষণ আগেই তাকে একটা মেসেজ দিলো। জায়গার নাম দিয়ে।বহু আশা নিয়ে সে এসেছে এই স্থানে। তার বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য লাগছে। তার হাত পা কাঁপছে রীতিমতো। ভয়ে। আতঙ্কে। সে জীবনের প্রতি ধাপে একে একে সব হারিয়েও সহ্য করতে পেড়েছে কিন্তু তার মনে হলো মায়াকে হারালে সে সহ্য করতে পাড়বে না। তার কিছু হলে সে কীভাবে থাকবে?

তার ভাবনার মধ্যে রাস্তায় চোখ পড়ে তার। দূর থেকে একটি মেয়ে প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। খুব সূক্ষ্ম দেখা যাচ্ছিল তাকে। কিন্তু তাকে দেখতেই জোহানের শূন্য বুকের ভেতর উষ্ণতা ছড়িয়ে গেলে। সে জোরে কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস ফেলে ড্রাইভারকে বলল, “দ্রুত মেয়েটার কাছে নেও।”
কাছে নিতেই জোহান মায়াকে স্পষ্ট দেখতে পেল। খুশিতে তার চোখ সিক্ত হয়ে গেল। সে ড্রাইভারকে বলল, “স্টপ।”
কিছু ব্রেক কষার পূর্বেই সে দরজা খুলে দিলো। ড্রাইভার সাথে সাথে ব্রেক মারল। জোহান নেমে দৌড়ে গেল মায়ার কাছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল মায়াকে প্রাণ ভরে। সে একহাত দিয়ে অন্যহাত ধরে রেখেছে। হাত ছিঁলে গেল অনেকখানি। হাঁটছেও খুঁড়িয়ে।

মায়া হাঁটার সময় খেয়াল করল একটি গাড়ি তার সামনে এসে থেমেছে। সে ভাবলো লোকদের সাথী হবে হয়তো। তাই সে নিজেকে প্রস্তুত করল। কিন্তু সেখান থেকে জোহানকে বেরিয়ে আসতে দেখল। সে জোহান এসে দাঁড়ায় তার সামনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে যাচাই করে তাকে। তারপর আচমকা বাহুডোরে ভরে নেয়। এতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যেন ছাড়লেই হারিয়ে যাবে।

তার ছোঁয়া পেতেই মায়ার সব জোর যেন শূন্য হয়ে যায়। সে আর পাড়ল না জোর করেও নিজের শক্তি ব্যবহার করতে। লুটিয়ে পড়ল জোহানের বুকে।

জোহান যখন নিজের বুকের উপর ভার অনুভব করল সে মায়াকে ছেড়ে দেখে সে তার বুকের উপর নিজের শরীর ছেড়ে দিয়েছে। তার চোখ নিভু নিভু। তার মনে প্রশ্ন ছিলো কিন্তু সে তা করল না। কোলে তুলে নিলো মায়াকে। ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুললে মায়াকে নিয়ে ভেতরে গেল। তাকে কোলে বসিয়েই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখল। তাকে ছেড়ে চোখেমুখে কতগুলো ছোট ছোট চুমু খেল। মায়া তখন চোখ খুলে তাকাল তার দিকে। জোহানের চোখে দেখতে পেল ভাসা পানি। জোহান সাথে সাথে তাকে বুকে ভরে নিলো। এত জোরে বুকে আঁকড়ে ধরলো যেন চাইছে তাকে এই বুকের মাঝেই ভরে নিতে। তার এক হাত ছিলো মায়ার পিঠে। অন্যহাত মায়ার চুলের মধ্যে রাখল। সে অনুভব করলো তার হাতটা ভিজে গেছে হঠাৎ। সে হাত সরিয়ে দেখল তার হাতে রক্ত মাখা। সাথে সাথে সে আঁতকে উঠে, “ড্রাইভার দ্রুত….দ্রুত হাস্পাতাল নেও।”
তারপর সে মায়াকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে মায়া?”
“না।”
“কে করেছে এসব? কার এত সাহস? তাদের মে’রে ফেলব আমি।”
মায়া জোহানের বুকে শুয়ে থেকেই মিনমিনে গলায় বলে, “অলরেডি আধাম’রা করে এসেছি।”
জোহান হাসে তার কথায়। তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে মুখ গুঁজে মায়ার গলায়। গভীর নিশ্বাস ফেলতেই মায়া কেঁপে উঠে। টের পেয়ে সে আলতো করে চুমু খায় সে স্থানে।

জোহান দাঁড়িয়ে ছিলো মায়ার পাশে। নার্স তার মাথায় পট্টি করে দিচ্ছিল। সে সময় তার ফোনে কল আসে সভ্যর। সে মায়ার অবস্থা দেখে তাদের কল দিতে ভুলেই গিয়েছিল। সে কল ধরে সাথে সাথেই বলল, “সরি ভাই মায়াকে হাস্পাতালে আনতে যেয়ে তোকে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে ওকে খুঁজে পেয়েছি।”
মায়া জোহানের কথা শুনে তার দিকে তাকায়।

ফোনের ওপাশ থেকে সভ্য জিজ্ঞেস করে, “মায়া ঠিক আছে তো?”
“মাথা দিয়ে র’ক্ত পড়ছে ব্যান্ডেজ করছে। হাত পা’ও ছিঁলে গেছে।”
“কে নিয়েছিল জানিস?”
“এখনো জিজ্ঞেস করিনি। আপাতত স্ট্রেস না দেওয়াই উচিত। যেলোকগুলো নিয়েছিল তাদের না’কি আধম’রা করেছে।” বলে সে তাকাল মায়ার দিকে।
সভ্য ওপাশ থেকে হেসে দিলো, “দুইবোন একই রকম হয়েছে। তোরটা বেশি ডেঞ্জারাস ভাই। অভ্র ভাইয়া গিয়েছিল সেখানে বলল গাড়ির আশেপাশে লোকদের র’ক্তার’ক্তি অবস্থা। মায়াকে না পেয়ে টেনশনে পড়ে কল দিলো। উনাকে জানাচ্ছি।”
কথাটা শুনে জোহানের কপালে ভাঁজ পড়ল, “উনি মায়াকে এত টেনশন করছে কেন? তোর ভাই কাজ ছেড়ে নিজের মা বাবার সাথে দেখা করতে যায় না সে গেল নিজে মায়ার খোঁজ করতে? এই তোর ভাইয়ের না সুরভির সাথে এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে?”
তার কথা শুনে সভ্য জোরেই হেসে দিলো, “ভাই এত জ্বলিস না। আমার ভাইয়ের নজর সুরভির দিকেই আছে। আমার ভাই ওকে ছাড়া কোনো মেয়ের দিকে প্রেমের নজরও দেয় নি জীবনে। হয়তো আমি এত ঘাবড়ে কল দিয়েছিলাম এজন্য।”
“এটাই যেন হয়।”
“থাক ভাই আর জ্বলিস না। আশেপাশে আগুন ধরে যাবে।”
“রাখ তো।”
“তোর বাসায় যাচ্ছি তাহলে। ইনারাও ওখানে। মায়াকে নিয়ে ওখানে আসবি।”
“ওকে।”

কথা বলা শেষে সে মায়ার দিকে তাকাল চোখ মুখ কুঁচকে। মায়া জোহানের কথার ধরণ শুনেই বুঝেছিল ব্যাপারটা কি। সে বিরক্তি নিয়ে মুখ সরিয়ে নিলো। বিড়বিড় করে বলল, “ঢঙে বাঁচি না। নিজের তো করবেই না। অন্যকারো সাথে নাম শুনলে আমার না’কি তার জ্বলে যত্তসব ঢঙ!”

ডাক্তারের ভিসিট দিয়ে জোহান এসে মায়াকে উঠাতে নিলে মায়া বলে, “লাগবে না। আমি যেতে পাড়ব। থ্যাঙ্কিউ হেল্পার জন্য।”
“এমন ফর্মালিটি করছ কেন?” জোহানের কপালে ভাঁজ পড়ল।
“আমার সম্পর্ক তো ফর্মালই। তুমি আমার এন্টারটেইনমেন্টের আন্ডারের আর্টিস্ট আর আমি তোমার বস।”
জোহান হেসে ঝুঁকে মায়ার দুইপাশে হাত রেখে ভার দিয়ে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রেখে মৃদু স্বরে বলে, “তো বস আপনার জন্য যে এতক্ষণ আমার জীবন চলে যাচ্ছিল তার জরিমানা কীভাবে দিবেন?”
সে তার মুখে কিছুটা এগোতেই মায়া পিছিয়ে যায়। বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে, “কী চাই?”
“জরিমানা।” মায়ার ঠোঁটের দিকে তার নজর আটকে রেখে বলে। তার অধরের দিকে এগিয়ে ছুঁতে নিলেই মায়া মুখ ফিরিয়ে নেয়।
জোহান তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কোলে তুলে নেয় তাকে। মায়া ক্ষিপ্ত স্বরে বলে, “বলেছিলাম না আমি হাঁটতে পাড়বো?”
“তুমি তো সবই পাড়ো। মানুষকে আধম’রা করতে পাড়ো, র’ক্তার’ক্তি করতে পারো, আমার হৃদয় পুড়াতে পারো। সবই পারো। অলরাউন্ডার পুরো।”
মায়া চোখমুখ কুঁচকে নেয় তার কথা শুনে। বুকে একটা কিল বসিয়ে দেয়। জোহান ব্যাথা পায় তাতে কিন্তু কিছু বলে না। গাড়িতে উঠে মায়াকে আবার কোলে বসালেও মায়া সরে যায়। দূরে গিয়ে বসে। জোহান কিছু বলে না। তাকিয়ে থাকে মায়ার দিকে। অথচ মায়া সারা রাস্তায় একটিবারের জন্যও তার দিকে তাকায় না।

বাড়ির সামনে এসে জোহান আবারও মায়াকে কোলে তুলে নেই। নিজের বাড়ির দিকে এগোতে নিলে মায়া বলে, “আমার বাসায় যাব।”
“ইনারা তোমার জন্য বাসায় অপেক্ষা করছে। সভ্য আসছে।”
“আচ্ছা।”
জোহান খেয়াল করে সে মায়াকে ধরলেও মায়া তাকে ধরে নি। সে টিটকারি করে বলে, “একটু আগে বাচ্চাদের মতো আমার আষ্ঠেপৃষ্ঠে লিপ্টে ছিলে। এখন কী ধরতে ঘিন করছে না’কি?”
মায়া কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে, “তুমি কি বেশি কথা বলছো না?”
“কী করব ম্যাম আপনি তো কথাই বলছেন না আমার সাথে।”
“কী বলব?”
“তুমি যা ইচ্ছা বলো আমি শুনতে পাড়ব সারাদিন ভরে।”
মায়া তাচ্ছিল্য হাসে, “সে সুযোগ তো আপনি নিজের হাতেই শেষ করে দিলেন মিস্টার জোহান হক।”
জোহান তার কথা ভান ধরতে না পেরে কপাল কুঁচকে তাকায়। প্রশ্ন জাগাটা দাবিয়ে দিতে হয়। কারণ লিফট এসে পড়েছে তার ফ্লোরে। সে নেমে দরজার সামনে যেয়ে মায়াকে বলে, “কলিংবেল বাজাও।”
“এবার নামাও। বাসায় আন্টি আছে। আন্টি দেখে ফেলবে।”
“দেখুক। সমস্যা কী?”
“ফাজলামো করো না। নামাও বলছি।”
এমন সময় এসে হাজির হয় সভ্য। তাদের দেখে ভ্রু উঁচিয়ে দুষ্ট স্বরে বলে, “বাহ ওদিকে আমরা টেনশনে ম’রছি আর এদিকে আপনাদের প্রেমকাব্য চলছে?”
তার কথা শুনে দুইজনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মায়া ঝাঁজালো গলায় বলল, “কোনো প্রেমট্রেম চলছে না এখানে।”
“তা তো দেখতেই পাড়ছি। একটু না, অনেক প্রেমট্রেম চলছে ।” বলে দুষ্ট হাসল।

জোহান সভ্যর দিকে ঝুঁকে বিড়বিড় করে বলে, “ক্ষেপা বাঘিনীকে আরও ক্ষেপিয়ে বিপদ ডাকছিস কেন নিজের জন্য?”
“ক্ষেপলে তোর কাছেই আছে। আমার কিছু করতে পাড়বে না। ক্ষেপে টেপে গলায় জোরে একটা লাভবাইট দিলে তোরই লাভ।”
মায়া দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আমি এখানেই আছি। সব শুনছি।”
সভ্য মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কলিংবেল দেয়।

সৌমিতা দরজা খুলে মায়াকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। মমতাভরা সুরে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ঠিক আছো মামণি?”
এমন আদুরে ডাক শুনে মায়ার মন গলে পড়ে যেন। সে হাসি দিয়ে তাকায় আন্টির দিকে বলে, “জ্বি আন্টি?”
“মাথায় পট্টি কেন? কী হয়েছে?”
জোহান উওর দেয়, “এক্সিডেন্ট হয়েছিল। ডাক্তার বলেছে এক সাপ্তাহ বেডরেস্টে থাকতে।”
“ওকে ভেতরে নিয়ে যা আমি জুস করে আনি। খেলে ভালো লাগবে।”
তারপর তাকে ভেতর নিয়ে গেল। ড্রইংরুমে যেয়ে দেখে ইনারার সাথে সাথে অভ্রও বসে আছে সেখানে। তাকে দেখে জোহানের কপালে ভাঁজ পড়ে।

ইনারা মায়াকে দেখে একপ্রকার দৌড়েই আসে। অভ্রও উঠে দাঁড়ায়।
ইনারা ঠোঁট উল্টে কেঁদেই দেয়, “আপু আমি যে ভয় পেয়েছিলাম। শব্দ শুনে আমার জান আটকে গিয়েছিল।”
জোহান মায়াকে সোফায় বসালে সে আবার দৌড়ে এসে মায়াকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। মায়া রাগান্বিত স্বরে বলে, “এই অবস্থায় তুই দৌড়াদৌড়ি করছিস কোন সাহসে? আমার বোন’জি এর কষ্ট হলে তোর খবর আছে।”
সে আরও শক্ত করে ধরে মায়াকে, “সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সকাল থেকে তোমার জন্য মন আকুম বাকুম করছিল।” ইনারার কথায় মায়া আদুরে দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মেয়েটা তাকে এত তাড়াতাড়ি একটু বেশিই আপন করে নিয়েছে।

মায়া একপাশ থেকে তার গালে হাত রেখে বুলিয়ে দেয়। বলে, “একারণেই তো তাড়াতাড়ি আসতে পেড়েছি। তুই ফোনে না থাকলে এতক্ষণেও হেঁটে আসতে হতো।”
ইনারা সাথে সাথে সোজা হয়ে বসে, “তুমি না’কি লোকদের মেরেমুরে ভর্তা বানিয়ে দিয়েছ? এই নাহয় ইনারার বড় বোনের মতো কাজ করলে।”
মায়া তার কথায় হেসে দেয়।

অভ্র তখনও দাঁড়িয়ে ছিলো। চুপচাপ। অপরাধবোধ তাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। সে নরমস্বরে ক্ষমা চাইল মায়ার কাছে, “সরি মায়া। আমার জন্য তোমার এত বড় বিপদ এসেছে। আমার তোমাকে এসবের মাঝে টানা উচিতই হয় নি।”
সবাই অবাক হয় তার কথা শুনে। জোহান কপাল কুঁচকে নেয়, “আপনার জন্য মানে কী?”
মায়া উওর দেয়, “কিছু না। অভ্র আপনি বসুন। এখানে আপনার দোষ নেই।”
ইনারা জিজ্ঞেস করে, “এখানে অভ্র ভাইয়া কোথা থেকে এলো। আর ওই লোকগুলো-বা কেন তোমাকে নিলো আপু? টাকার জন্য?”
“যা হবার হয়েছেই তো। আমি তো ঠিক আছি। এখন কথা টানার প্রয়োজন কী?”
জোহান উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কেন বললেন আপনার জন্য এসব হয়েছে?”
সভ্য জোহানের দিকে তাকায়, “জোহান আস্তে কথা বল। আমার বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলছিস ভুলে যাবি না।”
অভ্র জানায়, “আমার দোষ আছে। আমার জন্যই আজ মায়ার এত বড় বিপদ হয়েছে।”
মায়া বিরক্তি নিয়ে বলল, “আপনাকে একথা সবার সামনে কে তুলতে বলেছে?”
সভ্য থামায় সবাইকে, “সবাই চুপ করবে? এখানে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পাড়ছি না। ভাইয়া মায়ার এক্সিডেন্টের সাথে আপনার কী সম্পর্ক?”

চলবে….

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৪৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সভ্য থামায় সবাইকে, “সবাই চুপ করবে? এখানে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পাড়ছি না। ভাইয়া মায়ার এক্সিডেন্টের সাথে আপনার কী সম্পর্ক?”

অভ্র অপরাধী কন্ঠেই বলল, “ও আমার হেল্প করতে যেয়েই বিপদে পড়েছে। আমার শত্রুর লোকেরাই ওকে….” কথা শেষ করবার পূর্বেই একপলকে জোহান এসে তার পাঞ্জাবির কলার ধরে নেয়, “আপনার জন্য ওর এই অবস্থা? রাজনীতি আপনার, শত্রু আপনার আপনি মাঝখানে আমার মায়াকে কেন আনলেন? ওর কিছু হলে আমি আপনাকে শেষ করে ফেলতাম।”

ইনারা আর মায়া দাঁড়িয়ে পড়ে আশ্চর্যে। শব্দ শুনে সৌমিতাও দৌড়ে এলেন কিচেন থেকে। সভ্য এসে ছাড়ায় জোহানকে, “জোহান ছাড় বলছি। সম্পূর্ণ কথা না শুনেই তুই….”
“সম্পূর্ণ কী কথা শুনবো? উনি উনার রাজনৈতিক ব্যাপার নিজের মধ্যে রাখবে। মায়াকে এসবে জড়াতে গেল কেন? আজ যদি ওর কিছু হয়ে যেত? ওর অবস্থা দেখ।”

মায়া বিরক্তি প্রকাশ করে, “আমি ঠিক আছি বলেছি না?”
“ঠিক আছো? তোমার র’ক্তের দাগ এখনো আমার শার্টে লাগানো। হাত ছিঁলে গেছে। পা একটুর জন্য ফ্রাকচার হয়নি। আর উনি না’কি ঠিক আছে। তোমাকে না পেয়ে আমার জান চলে যাচ্ছিল। পাবার পর তোমাকে এই অবস্থায় আমার কী অবস্থা হয়েছিল তুমি ভাবতে পাড়ছ?” কথাগুলো বলে জোহান ঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে।

মায়ার কঠিন দৃষ্টি নম্র হয় তার কথায়। সে চোখ সরায় সাথে সাথে। নরম কন্ঠে সভ্যকে বলে, “আপনার বন্ধুকে বসিয়ে শান্ত করুন। পানি দিন।”
“লাগবে না কিছু। আগে আমার উওর দিতে হবে।”
মায়া এবার ক্ষেপে যায়, “পানি পান না করলে মাথায় ঢেলে দিন।” বলে বসে পড়ে।

ইনারার একবার জোহানের দিকে তাকাল আবার মায়ার দিকে। তার খুব করে মন চাইল জোহানের কথা ধরে একটু মজা নিতে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে ইচ্ছাটা পূরণ করবে কি-না বুঝে পেল না। তখনই সভ্য তাকায় তার দিকে। চোখের ইশারাতে যেন হুমকি দেয়, যা মনে চলছে মনেই দাবিয়ে দিতে। আর কি করার ইনারা মন মে’রে বসে পড়ে।

সভ্য জোহানকে বসিয়ে সৌমিতা আন্টিকে বলে, “আন্টি আপনি মায়ার জন্য জুস নিয়ে আসুন। সব ঠিক আছে এখানে।”
সৌমিতা যাবার পর সে অভ্রকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া ভণিতা ছাড়া সরাসরি বলো কি হয়েছে? আর কে ওই লোকগুলোকে পাঠিয়েছে?”
অভ্র বসলো। সে মায়ার দিকে তাকিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “তৌফিক।”
ইনারা সাথে সাথে বলে উঠে, “এই তৌফিক ব্যাটা আবার কে? তার এত বড় সাহস আমার মায়া আপুকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করেছে। তাকে তো লাত্থি মেরে ব্লাকহোলে পাঠিয়ে দিব।”
সবাই তার দিকে এবার তাকায়। বিরক্তি দৃষ্টিতে। সবার এই দৃষ্টিতে সে নুইয়ে যায়।
সভ্য বলে, “তৌফিক মানে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, মেঘলা আপুর স্বামী? সে কেন মায়ার ক্ষতি করতে যাবে আর তোমারই বা তার সাথে শত্রুতামি থাকবে কেন?”
অভ্র দুই হাঁটুতে কণুই ভর দিয়ে বসে থাকে। তার গলা বসে যাচ্ছে উওর দিতে যেয়ে।

মায়া হয়তো তার যন্ত্রণা বুঝতে পারে তাই সে উওর দেয়, “উনার বন্ধু গগণকে খু’ন করে মেঘলার সাথে জবরদস্তি বিয়ে করেছে তৌফিক।”
কথাটায় যেন সভ্যর বুক কেঁপে উঠে, “কী! গগণ ভাইয়া…গগণ ভাইয়া নেই?” তার কথাটা ভীষণ অবিশ্বাস্য মনে হল। অস্ট্রেলিয়ায় গগণ তাকে বড় ভাইয়ের মতোই আদর করতেন। তাকে পড়ানো থেকে শুরু করে ঘুরানো সবকিছুতে এগিয়ে থাকতেন। অনেক হাসিঠাট্টায় মাতিয়ে রাখতেন তার আশেপাশের সবাইকে। একসময় যোগাযোগ না থাকলেও সে আর নেই কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না সভ্যর।
সে তাকাল অভ্রর দিকে। সে জানে গগণ ভাই অভ্রর জন্য কি ছিলো। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ। কেবল বন্ধু না, ভাই ছিলো। হয়তো তার থেকেও বেশি আপন ছিলো। সে যেয়ে বসলো তার ভাইয়ের পাশে।কাঁপানো সুরে বলে, “ভাইয়া…জানাও নি কেন?”
অভ্র উওর দেয় না।
সভ্য আবার বলে, “তুমি আগে বললে এতদিনে ভাইয়ার মৃ’ত্যুর বিচার আমরা নিতে পাড়তান না?”
অভ্র শক্ত কিন্তু কাঁপানো কণ্ঠে বলে, “পাড়তাম না।”
ইনারা বলে, “কিন্তু আপনি তো মুশতাক সাহেবকে এক দিনে শেষ করে দিয়েছেন। যেখানে আমি বছরের পর বছর চেষ্টা করেও পাড়ি নি তাহলে এবার কেন নয়?”

অভ্র এবার তাকাল ইনারার দিকে। এত বছরে এই প্রথম সে অভ্র সিক্ত চোখ দেখেছে। এমনকি শুধু ইনারা না, সভ্যও অবাক হয় তার ভাইয়ের এই নরম সত্তা দেখে। কেননা সে এই জীবনে এতগুলো বছরে তার ভাইলে ভেঙে পড়তে দেখে নি। তার কাঁপানো কন্ঠ শুনে নি।

“কারণ তার ক্ষমতা আমার থেকে অনেক কম ছিল। তাই আমি তোমার সাহায্য করতে পেড়েছি। কিন্তু তৌফিকের ক্ষমতা আমার থেকে অনেক বেশি। আমি কেবল ওর জন্যই এই ক্ষমতার জগতে এসেছি। ওর শেষ পরিণতি হবার জন্য।” অভ্রর কন্ঠে প্রতিশোধের সুর স্পষ্ট।
“দাদাজানকে বলতে। সে সাহায্য করতো।” সভ্য বলে।
“দাদাজান সব জানে। কত আকুতি মিনুতি করেছিলাম তাকে। কিন্তু সে পাড়তো না। ক্ষমতার কাছে টাকা মূল্যহীন। তাই ক্ষমতা বানাতেই এই রাজনীতিতে এসেছি আমি। ”

মায়া তাদের সাথে জানায়, “তৌফিক কেবল এই জঘন্য কাজ করে নি। তার জঘন্য কাজের লিস্ট শেষ হবে না। সেদিন ইন্টারভিউতে যাওয়াই ছিলো আমাদের প্লান। আমি মেঘলার সাথে দেখা করেছিলাম। ও আমাকে জানিয়েছে তৌফিক একটা ফার্মহাউসে মেয়েদের বন্দী রেখে তাদের… তাদের সাথে খারাপ কাজ করে। তাদের টর্চারও করে। হি ইজ আ সাইকো। মেয়েদের যন্ত্রণার কন্ঠ শুনতে না’কি তার ভালো লাগে। তার স্ত্রী মেঘলা আমাকে কেবল তার এক হাতের আঘাত দেখিয়েছিল। যা দেখে আমার আত্না পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। তাহলে মেয়েগুলোর উপর কি করে খোদা জানে। মেয়েরা তার অত্যাচার সহ্য করতে পেরে যদি বেঁচে থাকে তাহলে তাদের পাঁচার করে দেয়। এছাড়া অনেক ইললি’গাল ব্যবসা আছে তার।”

অভ্র আবারও বলে, “গগণ আমার আঘাত ওর উপর নিয়েছিল। আমার জীবন ওর আমানত। যদি ওর প্রতিশোধ আর ওয়াদা পূরণ না করতে পারি আমার এই জীবন ব্যর্থ।” সে আবার তাকায় মায়ার দিকে। অনুশোচনা নিয়ে বলে, “কিন্তু এতে তোমাকে জড়ানো আমার ঠিক হয়নি। আই এম সরি মায়া। সো সরি।”
“এখানে ব্যাপার অন্যকিছু। ওদিন কোনো কিছু ধরা পড়ার চান্স ছিলো না। আমি তৌফিককে কিছু বুঝতে দেই নি। তাহলে এমনটা কেন হলো ধরতে পাড়ছি না।”
বলে সে ভাবা শুরু করল। ওদিনের সব কথা তার মাথায় ঘুরলো। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার কিছু মাথায় এসে আটকাল, “ওয়েট। আজকের ঘটনাটা এইজন্য হয় নি যে তৌফিক আমাকে সন্দেহ করেছে।”
সে তাৎক্ষণিক তাকায় অভ্রর দিকে, “ব্যাপারটা সেদিন আমার মাথায় ধরেনি। সেদিন তৌফিকের আসার কথা ছিলো না। তাও সে স্টুডিওতে এলো। আমি তাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে আমাকে বারবার ডেকে কথা বলার চেষ্টা করছিল। ইনফ্যাক্ট আমি সেখান থেকে রওনা দেবার পর আমার পিছনেও আসলো।”

জোহান এতক্ষণ সবটা শুনে চুপ ছিল। বলার মত কোন শব্দ সে খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু মায়ার কথা শুনে তার মাথার রগ কেঁপে উঠে ক্ষোভে। সে কপাল কুঁচকে মায়ার দিকে তাকায়, “ওই জানোয়ার তোমার দিকে খারাপ নজরে তাকিয়েছে? অর্থাৎ আজ তোমাকে এজন্য নিয়ে….” ভাবনার আসতেই রাগে জোহানের শরীর জ্বলে উঠে। সে উঠে তার শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল, “তাহলে আজ ওর শেষ পরিণতি আমার হাতেই হবে।” বলে যেতে নিলে সভ্য তাকে থামায়। বলে, “যেখানে অভ্র ভাইয়া রাজনীতিতে থাকার পরও এত বছরে কিছু করতে পারিনি। সেখানে তুই কীভাবে পাড়বি? ওর ঘরের সামনেও যেতে পাড়বি না। তুই কি বুঝতে পাড়ছিস না ও কার ছেলে?”
“তাহলে ওই কুত্তা মায়ার দিকে খারাপ নজর দিছে আর আমি বসে চুপচাপ দেখব? তাই করতে বলছিস তুই?”

মায়া বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নেয়, “সভ্য, আপনার বন্ধু একটা গর্দভ জানেন?”
জোহান কথাটা শুনে রাগি চোখে তাকায় মায়ার দিকে, “তুমি কি বুঝতে পাড়ছো না আজ তোমাকে কেন কিডন্যাপ করা হয়েছিল?”
“আমার কাছে যথেষ্ট জ্ঞান আছে তাই সেখান থেকে ফিরে আসতে পেরেছি। তোমার মতো হুটহাট রেগে গিয়ে বুদ্ধিমত্তা হারানোর গুণ আমার নেই। ওহ সরি হুটহাট না। একসাপ্তাহ ভাবার পরও তো যথেষ্ট বুদ্ধি আসে না তোমার।” সে ভেংচি কেটে তাকায় অভ্রের দিকে,
“আই হেভ আ প্লান। বাট আপনাকে সবকিছু এরেঞ্জ করতে হবে।”
অভ্র চিন্তিত সুরে বলে, “আজকের ঘটনার পর আমি তোমাকে আর এসবে জড়াতে চাই না।”

জোহানও তাকে মানা করে, “খবরদার মায়া তুমি আর এসবে জড়াবে না। আমি চাই না তুমি আবার কোনো বিপদে পড়ো।”
মায়া এবার ক্ষীপ্ত বাঘিনীর ন্যায় তাকায় জোহানের দিকে, “আর ওই মেয়েগুলোর কী যাদের জীবন ওই জানোয়ার খেলা করছে আর করবে।”
“তা আমরা দেখবো। আমি আর সভ্য অভ্র ভাইয়ের সাহায্য করবো।”
“এক্সকিউজ মি আমি মেয়ে বলে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করছ? একটা মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েদের জীবন শেষ হতে আমি চুপচাপ দেখতে পাড়ব না। এন্ড ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন তোমাদের মতো তিনটাকে একটু আগে উঠিয়ে কাপড়ের মতো ধোলাই দিয়ে এসেছি। তাও এই অসুস্থ শরীর নিয়ে। সুস্থ থাকলে ওদের অবস্থা ভেবে নেও। নিজেদের তো বডিগার্ড লাগে আসছে আমাকে প্রটেক্ট করতে। আমি ক্যারাটে, বক্সিং দুইটাই প্রফেশনালি শিখেছি ওকে?”
কথাটা শুনে তিনজন একে অপরের দিকে তাকায়। আর ইনারা শব্দ করে হেসে দেয়।
মায়া তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলে, “তুই দাঁত কেলাবি না। এসব থেকে সব হাত দূরে থাকবি। আমার বোন’জির কিছু হলে তোর কপালে শনি আছে।”

তারপর মায়া সবার দিকে তাকিয়ে বলে, “তৌফিককে বোকা ভাবলে আমাদের ভুল হবে। বোকা হলে এত বছর সব লুকাতে পাড়তো না। এতবছর লুকিয়েছে কেউ ধরতেও পাড়ে নি।”
অভ্র বলে, “ধরা পড়লেও কীভাবে জানব? ক্ষমতা দিয়ে মুখ বন্ধ করাতে কতক্ষণ?”
“তাই এবার জনগণের সামনে লাইভ দেখাতে হবে। একটা পরিকল্পনা তো মাথায় আছে। হবে না’কি জানি না।” সে কিছুটা চিন্তা করে বলল, “আপনি যেহেতু আমার খোঁজ পেয়েছেন এর মানে তৌফিকের কাছে আপনার লোক আছে। তাকে দিয়ে কিছু তথ্য বের করতে পাড়বেন?”
“কি করতে চাইছ?”
“আগে তথ্য বের করুন। সে হিসেবে বলব। ঘরের কোথায় সিকিউরিটি ক্যামেরা আছে আর কোথায় নেই? সিকিউরিটি ক্যামেরা কন্ট্রোল কোথায় থাকে? আর যেদিন তৌফিক নাসরিননিবাসে থাকে না সেদিন সেখানের সিকিউরিটি কেমন থাকে? তৌফিকের দৈনিক রুটিনও। আরও কোনো তথ্য প্রয়োজন হলে আপনাকে জানাব।”
“তুমি যা ভাবছো হয়তো আমি ধরতে পেড়েছি। কিন্তু কাজটাতে রিক্স আছে।”
“নো রিক্স, নো গেইন। আমি ব্যবসা হোক বা জীবন এই কথাটা মেনে চলি।”
“তোমার চিন্তাভাবনা আসলেই আমার মতো।”

জোহান তার পাশে দাঁড়ানো সভ্যর পেটে কণুই মেরে বলে, “তোর ভাইকে এখান থেকে হয়তো বিদায় কর, নাহয় সুরভিকে ডেকে দে।”
সভ্য তার কথা শুনে হেসে দেয়। সে জোহানের কাঁধে চাপড় মেরে বলে, “ভাই তোর জ্বলার এখানে কারণ নেই। দুইজন একেকটা চিজ। তুই না বলেছিলি দুইজন বিয়ের কথা বলতে যেয়ে বিজনেস ডিল করে এসেছিল?”
“মনে করাইস না ভাই। মনে হচ্ছিল এলিয়েন শো দেখছি।”

সৌমিতা এতক্ষণে এসে পড়েছে জুস নিয়ে। মায়ার পাশে বসে তাকে বলে, “পুরোটা শেষ করবে। ইশশ কত র’ক্ত বের হয়েছে! তুমি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে থাকবে। আমি ছাড়বোই না।”
সে জোহানের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে, “না না আন্টি আমি ঠিক আছি। আপনার কষ্ট করার প্রয়োজন নেই।”
“কষ্ট মানে? তুমি আমার মেয়ের মতো। তোমাকে এই অবস্থায় আমি একা রাখব?”
“একা না আন্টি আমি আমার বান্ধবীর বাসায়….”
“কেন আমি কী তোমার পর না’কি? তুমি আমাকে পর ভাবো? আমি তো তোমাকে আমার মেয়েই ভেবেছি।”
সৌমিতার আবেগি কথা শুনে মায়া গলে যায়। সে সাথে সাথে সৌমিতার হাত ধরে বলে, “আচ্ছা আন্টি আমি থাকব। আপনি ইমোশনাল হবেন না প্লিজ।”

সভ্য এবার জোহানের পেটে কণুই মেরে বলে, “দোস্ত আন্টি মেয়ে বানালে কিন্তু সমস্যা তোর বোন হয়ে যাবে।”
কথাটা শুনে জোহান তাৎক্ষণিক অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যর দিকে। আর সভ্য তার মুখ দেখে হাসতে হাসতে শেষ।

অভ্র যাবার পর সৌমিতা মায়াকে ঐশির রুমে আরাম করতে রেখে আসে। ঐশি ও ইরফার এখন বিদেশে। দেশে থাকলে অর্ধেক সময় কাটায় তাদের বাসায় ও অর্ধেক সময় ইরফানদের বাসায়।

জোহানও চলে গেছে ফ্রেশ হতে। সারাদিনে অনেক ক্লান্তি গেছে তার। সবাই যেতেই সৌমিতা ধরে বসে সভ্য ও ইনারাকে।
“এই তোরা বলতো কি চলছে মায়া ও জোহানের সাথে?”
সভ্য ও ইনারা একে অপরের দিকে তাকায়। সভ্য বলে, “সঠিক জানি না। জোহান কিছু বলে নি। কিন্তু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছে। তোমার ছেলে আসলেই একটা গর্দভ বুঝেছ আন্টি? মায়াকে ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু অতীতের ভুলগুলোর জন্য এগোচ্ছে না। আর মায়ার ব্যাপারটা জানি না কিন্তু দেখে তো মনে হয় মায়াও ওকে পছন্দ করে।”
ইনারা তাল মেলায় তার কথায়, “অফকোর্স করে। আমি শিউর। কিন্তু আমি বুঝতে পাড়ছি না দুইজনে একে অপরের কাছে তা প্রকাশ কেন করছে না?”
সৌমিতা সভ্যকে অনুরোধের সুরে বলে, “তুই ওকে বুঝা সভ্য। আমি চাই আমার ছেলেটার জীবন আবার স্বাভাবিক হোক। আমার ছেলেটা এক জীবন ভুল করেই এসেছে। এইবার যেন মায়াকে হারিয়ে সে ভুলটা না করে।
ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়া খুব কষ্টের। জীবনে মানুষ এগিয়ে যায় কিন্তু সে মানুষটার শূন্যতা কখনো মিটে না। আমি চাই না আমার ছেলের জীবন এই শূন্যতায় কাটুক।”
সভ্য ও ইনারা একে অপরের দিকে তাকায়। তাদের মুখখানা মলিন হয়ে যায়। তারা জানে আজমল সাহেব ও সৌমিতার ব্যাপারে। ঠিকই তো, জীবনে সবকিছু অর্জন করা সত্ত্বেও এই একটি কমতি মানুষের ভেতরটা শূন্য করে রেখে দেয়। কীভাবে একটি অচেনা মানুষ জীবনে এতটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে যে তাকে ছাড়া সব নিঃস্ব মনে হয়।
.
.
তৌফিক তার হাতে থাকা গ্লাস ছুঁড়ে মারে সুমনের দিকে। যা একটুর জন্য তার মাথায় লাগে নি। সে হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “আমি দুইঘন্টা ধরে মায়ার জন্য রুমে ওয়েট করছি আর তোরা আমাকে এসে বলছিস ও তিনজনকে মেরে চলে গেছে? একটা মেয়ে তিনজনকে কীভাবে মারতে পারে?”
“স্যার সত্যি। ওর কাছে ধারালো আর ইলেকট্রনিক কিন্তু ছিলো ওগুলোতে ওরা দুর্বল হয়ে গেছে। আর সে মনে হয় কোনো ফাইটিং টেকনিক জানে।”
তার কথায় কপাল কুঁচকায় প্রথমে তৌফিকের। তারপর সে হেসে দেয়। শব্দ করে, “তোকে বলেছিলাম না মেয়েটার রূপ আগুন। এখন দেখি সে পুরাই আগুন। এখন তো ওকে আমার যেকোনো মূল্যেই লাগবে। সোজা ভাবে না হলে ত্যাঁড়া ভাবে। কাল ওর অফিসে যাবার ব্যবস্থা করবি।”
“স্যার আপনি ওর অফিসে যাবেন?”
“তোরা যেহেতু ওকে আমার কাছে আনতে পাড়িস নি। আমারই তো যেতে হবে।”
সুমন অবাক হয়, “স্যার আপনি নিজে একটা মেয়ের কাছে যাবেন? আপনি তো কেবল মেঘলা ম্যামের….”
“ও মেঘলা থেকেও বেশি ইন্টারেস্টিং বুঝলি? মেঘলা কেবল আমায় মানা করেছিল তাতেই ওকে নিজের কাছে সারাজীবনের জন্য আটকে রেখেছি। ওর বাপ ভাই একটা হারামি একারণে এত সহজে পেড়েছি। কিন্তু মায়ার পরিবারই তো ওর কৃপায় চলে। ওর উপর ওর এটিটিউড আরও আকর্ষণ করছে আমাকে। যে জিনিস পাওয়া যত বেশি কষ্টের সে জিনিস পাওয়ার মজা ততই বেশি।”
.
.
জোহান লম্বা একটি শাওয়ার নিয়ে বের হয়। সে একটি কালো টি-শার্ট ও ট্রাউজার পরা। বেরিয়ে শুনে সভ্য ও ইনারা চলে গেছে। ইনারার রাতের মেডিসিন নেওয়া বাকি। সে মা’য়ের কথা শুনে সেখান থেকে যায় মায়ার রুমে। যেয়ে দেখে মায়া শুয়ে আছে। সে যেয়ে তার পাশে বসে তার আঙুল আলতো করে ছুঁতেই মায়া তাৎক্ষণিক চোখ খুলে। তাকায় তার দিকে, “কী চাই?” তারপর উঠে বসে, “নক করে আসো নি কেন?”
জোহান তার দিকে তাকায় ভালো করে, “ড্রেস চেঞ্জ করে নিয়েছ?”
“হ্যাঁ। ইনারা ও সভ্যকে ঘরের চাবি দিয়েছিলাম এনে দিয়েছে।”
সভ্য হেসে তার গাল টেনে দেয়, “তুমি জানো তোমাকে মেকাপ ছাড়া একটু বেশিই কিউট লাগে।”
মায়া বিরক্তিতে তার হাত ঝারা দিয়ে সরিয়ে দেয়, “এসেছ কেন তা বলো।”
“তোমাকে দেখতে এসেছি। মেডিসিন নিয়েছ?”
“তোমার আমাকে দেখতে হবে না সৌমিতা আন্টি আছে আমার খেয়াল রাখার জন্য। আন্টিকে আমার অনেক ভালো লাগে।”
“আর তার ছেলেকে?”
প্রশ্নটা শুনে মায়া তার দিকে তাকায়। বিছানা থেকে নেমে সরাসরি বলে, “দেখো জোহান, আমি কোন ভণিতা ছাড়া বলছি তোমার আর আমার মধ্যে এখন আর কোনো কিছু হবার সম্ভবনা নেই। তোমাকে আমি দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিলাম। যা আমি কখনো কাওকে দেই না। কারণ… ” সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “কারণ নাহয় বাদ দেও। তোমাকে কারণ বলাও ব্যর্থ। আমি তোমাকে সাজেস্ট করবো তুমি অন্য ভালো একটা এন্টারটেইনমেন্টে যাও। যেহেতু এখন তুমি নিজেকে প্রমাণ করেছ, আবারও দেশের সবচেয়ে বড় সুপার স্টারদের মধ্যে এসেছ সেহেতু সভ্যর কোম্পানিতে যোগ করলে এখন আর তোমার সম্মানে ব্যাপারটা লাগবে না। সভ্যর কোম্পানি তোমার জন্য অনেক ভালোও হবে।”
জোহান তার কথায় ভ্রু কুঁচকায়, “তুমি এ কথা বলছ কেন?”
“কারণ আমার এদেশে এসে কোম্পানি সামলানোর একটি মাত্র কারণ ছিলো এই কোম্পানিকে সবার উপরে উঠিয়ে একবারে ধ্বংস করা।”
“হোয়াট!” জোহান বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করে।
মায়া ভীষণ শান্ত স্বরে গেল, “এ কথাটা আজ পর্যন্ত কেউ-ই জানে না। এটা কেবল আমার মনে ছিলো। আমার পরিবার, ওয়াহেদ এবং ওয়াহেদের বাবা আমাকে যে কষ্টগুলো দিয়েছিল তা ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। একারণে অভ্রর সাথে শর্তের বিনিময়ে বিয়েও করতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু….” সে জোহানের দিকে তাকায়।
“কিন্তু?”
“কিন্তু এখন আর তাদের জন্য আমার সে কষ্ট কাজ করে না। হৃদয়ে প্রতিশোধের আগুন তাদের জন্য নিভে গেছে।
এখন আর এসব আমার ভালো লাগছে না। এখন সব বাদ দিয়ে একটু শান্তির জীবন কাটাতে চাই। কটু স্মৃতি না মিষ্টি কিছু স্মৃতি নিয়ে যেতে চাই এখান থেকে।”
“যেতে চাও?” জোহান আঁতকে উঠে তার বাহু ধরে শক্ত করে, “কোথায় যাবে তুমি?”
মায়া তাকায় তার দিকে। কোমল সুরে উওর দেয়, “কোম্পানি ছেড়ে।”
উওরটায় যেন জাহানের জানে জান আসে। সে বিছানায় বসে। টান দিয়ে মায়াকেও বসায় তাকে কোলে। মায়া ভড়কে যায়, “কী ফাজলামো করছো?”
মায়া হাত পা নাড়াতে শুরু করলে জোহান শক্ত করে তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। মায়া কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায় জোহানের দিকে, “আজ তুমি যখন কাঁচুমাচু হয়ে আমার বুকে শুয়ে ছিলে আমার কতটা শান্তি লেগেছে জানো? এমন শান্তি বহুবছর ধরে উপভোগ করিনি।”
সে তার নাক ঘষে মায়ার কাঁধে, “তোমার মাঝে এমন কী আছে মায়া?”
মায়া ধাক্কা দেয় তার বুকে, “আন্টি এসে পড়বে। ছাড়ো বলছি। অসুস্থ মেয়েকে হ্যারেজ করতে লজ্জা লাগে না?”
জোহান তার কাঁধে মাথা রেখেও হাসে, “তুমি নিজেই তো ছাড় পেতে চাও না। চাইলে এতক্ষণে আমার হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে যেত। তুমি এসব কাওকে জানাও নি তাহলে আমায় কেন জানিয়েছ মায়া?”
“গান তোমার সুখ। আর আমি চাই না তোমার সুখ পাখি তোমার থেকে উড়াল দিক।”
“ভালোবাসো?” কেমন নেশাধরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে জোহান। তার কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকায় মায়া। চোখে চোখ পড়ে এক মুহূর্তের জন্য। সাথে সাথে মায়া চোখ নামিয়ে নেয়, “না।”
“ভালোবাসো না?”
“না।”
জোহান তার থুতনিতে রেখে মুখ উঁচু করে, “চোখে চোখ রেখে বলো।”
“ভালোবাসি বললেই বা কী হবে? কিছুই না। যা যেমন আছে তেমনই থাকবে।”
এই কথায় জোহান আরও শক্ত করে ধরল মায়াকে। তার গলায় মুখ গুঁজে রইল, “আজ তোমাকে যখন পাচ্ছিলাম না আমার নিশ্বাস আটকে আসছিল বারবার। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পাড়ব না মায়া। কিছুতেই থাকতে পাড়ব না। এখন আমার গানের সাথে তুমিও আমার সুখপাখি।”

মায়া তার কথার উওর দিলো না। কিন্তু তার গলায় যখন জোহানের উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করল তখন তার শরীরের ভেতরের শিরায় শিরায় কেঁপে উঠল। তার দেহ তার আদেশের বিরুদ্ধে অবশ হয়ে এলো। সে বুঝতে পাড়লো এই লোকের সঙ্গ তার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। সে ঘন নিশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলে, “জোহান ছাড়ো।”
জোহান উলটো তার গলায় কিস করে বসে। কেঁপে উঠে মায়া। সে জোহানের শার্টটা খামচে ধরে। আবারও বলল, “ছাড়তে বলেছি জোহান।”
জোহান তবুও না ছাড়ে না। এবার সে জোহানের গলায় খামচি বসিয়ে দেয়। এতো জোরে দেয় যেন তার র’ক্ত বেরিয়ে যাবে। তা বুঝে মায়া তাকে ছেড়ে দেয়।কিন্তু জোহান একচুলও নড়ে না। সেভাবেই বসে থাকে। এতে মায়া আরও বিরক্ত হয়ে। সে জোরগলায় বলে, “তুমি না ছাড়লে আমি এই মুহূর্তে আমার বাসায় চলে যাব।”
এই কথা শুনে জোহান সাথে সাথে মুখ তুলে তাকায়। অসহায় দৃষ্টিতে। তবুও মায়ার মন গলে না। সে বলে, “আমি যতদিন এ বাসায় আছি তুমি এই রুমে বা আমার কাছে আসলে আমি সে মুহূর্তে এইখান থেকে চলে যাব।”
“এমন করছ কেন মায়া?”
মায়া তার থেকে ছাড়া নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। জোহান সেভাবেই বসে থাকে। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়ার দিকে। মায়াও কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, চোখে চোখ রেখে উওর দেয়, “আমার বুকে অশান্তির ঝড় এনে তুমি শান্তি ভোগ করবে কেন?”

চলবে….