#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০১
আলোকপর্ণা দেবী অবাক হয়ে তার ছেলে পরাগের দিকে তাকিয়ে আছে। পরাগ এইমাত্র কী বলল? কীভাবে বলতে পারল? ওর কী একটুও বুক কাঁপলো না? তবে কী বিয়ের পর সত্যি সত্যিই ছেলেরা মা-বোনের কাছে পর হয়ে যায়? নাহলে এতবড় কথাটা ওমন মুখ ফুটে অকপটে বলতে পারতো না। তার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল। মোটা ফ্রেমের চশমা ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে শুরু করল। পরাগ অনড়। মায়ের মায়া কান্না আজ আর তার হৃদয় স্পর্শ করতে পারল না। তার মা ছিঁচকাঁদুনে। হুটহাট কেঁদে ফেলার অভ্যাস আছে। মায়ের মায়া কান্নায় গলে গেলে নিশ্চিত বউকে হারাতে হবে। এই বয়সে মেয়ে, বউকে হারাতে পারবে না পরাগ। তার থেকে ভালো। বউয়ের কথা মেনে নেওয়া। তাছাড়া বউ তো ভুল কিছু বলেনি। বাড়িতে এমন পাগল-ছাগল থাকলে তার ছোট্ট মেয়েটা অস্বস্তিকর পরিবেশে বড় হবে। বয়সের তুলনায় এমনিতেই মেয়েটা কথা কম বলে। কথা কম বলার যথেষ্ট কারণ আছে। পরাগের বউ নমিতা তার একমাত্র মেয়ে পাখিকে পরাগের মা-বোনের সাথে মিশতে দেয় না। কথা বলতে দেয় না। সারাক্ষণ একপ্রকার ঘরবন্দী করে রাখে। পরাগের পাঁচ বছরের মেয়েটা প্রথম প্রথম খুব কান্নাকাটি করতো। দিদুন-পিসির কাছে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতো। নমিতা যেতে দিতো না। মেয়েকে জোর করে আটকে রাখতো। এক সময় মেয়েটা একা একা থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। তবে অনেক চুপচাপ হয়ে গেল। খুব একটা কথা বলে না, হাসে না, ব্যথা পেলে কাঁদেও না। যেন অনুভূতিশূণ্য কোনো ব্যাটারি দেওয়া পুতুল।
আলোকপর্ণা দেবী চশমা খুলে, একটা রঙচটা, ফুল-লতাপাতা নকশা আঁকা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জলটুকু মুছে নিল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“পারুমিতা কোথাও যাবে না।”
পরাগ বিরক্তবোধ করল। বলল,
“অযথা জেদ করো না তো মা। ওখানে কত মানুষ গিয়ে ভালো হয়ে আসছে। তুমি কী চাও না..তোমার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাক?”
“চাই। তারজন্য মানসিক হাসপাতালে পারুকে ভর্তি থাকতে হবে কেন?”
“কারণ তোমার মেয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন একটা পাগল মা।”
আলোকপর্ণা দেবী ক্লান্ত বোধ করলেন। ধীর কণ্ঠে বলল,
“আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে, এই কথাটা বলতে পারতি খোকা?”
“আমি কী এমন ভুল বলেছি বলো তো মা? রাত হলেই তোমার মেয়েটা বাসা থেকে বের হয়ে চলে যেতে চায়। এমনিতে চুপচাপ থাকলেও স্নান করার সময় পাগলামি করে। কিছুতেই স্নান করতে চায় না। খেতে চায় না। আপনমনে সারাক্ষণ বিড়বিড় করে। তোমাকেও তেড়ে মারতে আসে।
এগুলো দিনের পর দিন দেখে, ভয় পেয়ে, আমার ছোট্ট মেয়েটার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে।”
“আগে তো এমন করতো না। ঠিকমতো চিকিৎসা করলে এতদিন সুস্থ হয়ে যেত। তুই তো ওকে ভালো ডাক্তার দেখাতে চাস না।”
“তোমার মেয়েকে পাগল হতে কে বলেছে। আমি বলেছি? যার জন্য পাগল হয়েছে। তার কাছ থেকে টাকা এনে মেয়েকে চিকিৎসা করাও।”
আলোকপর্ণা দেবী কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তার বোধহয় একটু একটু করে প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। তার খুব অস্থির লাগছে। পরাগ বলল,
“আমি সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছি মা। সামনে সোমবার পারুকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে রেখে আসব।”
আলোকপর্ণা দেবী ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন। এই বাড়িতে চারটে বড় বড় শোবার ঘর থাকতেও পারুর জায়গা হয়েছে, ড্রয়িং রুমের পাশে একটু ঘরের মতো ছোট্ট জায়গা আছে। সেখানেই চাদর আর একটা মিনি সাইজের তোশক বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পারু শুয়ে শুয়ে বিড়বিড় করে আপনমনে কথা বলছিল। কখনো বা হাসছিল। হাসলে পারুর গালে ঢোল পরে। দেখতে সুন্দর লাগে। দিনের বেলা মেয়েটা ভালোই চুপচাপ থাকে। রাত হলেই কেমন পাগল পাগল হয়ে যায়। শুরু হয় পাগলামি। সেই পাগলামি চলতে থাকে রাতভর। ঘুমের ঔষধেও আজকাল কাজ হচ্ছে না। আলোকপর্ণা দেবীর বিশ্বাস পারুকে বড় ডাক্তার দেখালেই পারু সুস্থ হয়ে যাবে। পারু তো আর জন্মগত পাগল না। এই এক বছর যাবৎ পারুর মাথায় সমস্যা হয়েছে। আলোকপর্ণা দেবী নিচু হয়ে পারুর পাশে বসলেন৷ একসময় পারুর মাথায় কোমর ছুঁই ছুঁই কুঁকড়ানো সুন্দর চুল ছিল। সেই চুল অযত্নে, অবহেলায় জট বেঁধে গিয়েছিল। পরে আলোকপর্ণা দেবী ঘাড় পর্যন্ত কেটে দিয়েছে। হঠাৎ আলোকপর্ণা দেবীর কী হলো কে জানে! ক্রোধে জ্বলে ওঠে পারুর এলোমেলো চুলগুলো শক্ত হাতে মুঠো করে ধরল। চাপা কণ্ঠে বলল,
“এত মানুষ মরে। তুই মরতে পারিস না?”
পারু ব্যথা পেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে শব্দ করে কেঁদে দিল। আলোকপর্ণা দেবীর এতে যেন রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। বলল,
“একদম ঢঙ করবি না। নাহলে গলা টিপে মেরে ফেলব তোকে।”
পারু মায়ের হাতটা টেনে ধরে জোরে কামড় বসিয়ে দিল। আলোকপর্ণা দেবীর হাতে পাঁচটা দাঁতের দাগ বসে গেল। ব্যথা পেয়ে শব্দ করে কেঁদে দিলেন তিনি। পরাগ ছুটে এলো। মায়ের হাতখানা লাল হয়ে গেছে। অতিরিক্ত রাগে, ক্ষোভে ফেটে পরে পারুকে ইচ্ছেমতো মারলো। পারু চিৎকার করে কাঁদছে। আলোকপর্ণা দেবী ছেলেকে বাঁধা দিলেন। ভেঁজা কণ্ঠে বলল,
“আর মারিস না। মেয়েটা মরে যাবে তো।”
“মরুক। ওর সাহস হয় কীভাবে? তোমাকে কামড় দেওয়ার। ওকে আজ আমি মেরেই ফেলব।”
কথাগুলো বলেই পারুর টুঁটি শক্ত হাতে চেপে ধরল।
পারু গো গো শব্দ তুলে গোঙরাতে লাগল। পরাগ এক পর্যায়ে পারুকে ছেড়ে দিল। মাকে বলল,
“এরজন্যই এই পাগলকে বাড়িতে রাখতে চাই না। আজ তোমার গায়ে হাত তুলছে। আগামীকাল না আমার ছোট্ট মেয়েটার গায়ে হাত তুলে।”
আলোকপর্ণা দেবী বুকচিরে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পারু পাগল-ছাগল যাই হোক। তারই তো পেটের মেয়ে। এই মেয়েটা তার কত আদরের ছিল। বেশি আদর দিয়েই মেয়েটার জীবন তিনিই বোধহয় ধ্বংস করেছেন। ইস..তখন যদি একটু শাষণ করতে পারতো। তাহলে মেয়েটার আজ এই অবস্থা হতো না।
আগামীকাল সোমবার। পারুকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে রেখে আসবে পরাগ। মাকে বলেছে, খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে পারু। কিন্তু একবার পারুকে বাড়ি থেকে বের করতে পারলে সহজে আর বাড়িতে আনবে না পরাগ। টাকা লাগুক। সুস্থ না হলে হাসপাতালেই ফেলে রাখবে। মাকে তো আর কথাটা সরাসরি বলা যায় না।
রাতের আকাশে তারার মেলা। চাঁদের আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরের মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। পাখি এতক্ষণ চোখ বুঁজে ঘাপটি মেরে বাবা-মায়ের মধ্যিখানে শুয়ে ছিল। বাবা-মা ঘুমিয়ে যেতেই পাখি উঠে গেল। খুব সাবধানে ঘরের দরজা খুলে পা টিপে টিপে চলে গেল পারুর কাছে। পারু ঘুমায়নি। কেমন করুণ সুরে কাঁদছে আর একা একা কথা বলছে। এ নতুন কিছু না। দিনে মায়ের ভয়ে না আসলেও প্রায় রাতেই লুকিয়ে লুকিয়ে পিসির সাথে দেখা করতে আসে পাখি। বাবা বলেছে, পিসি আগামীকাল কোথায় যেন চলে যাবে। আর কোনোদিনও আসবে না। পিসিকে না দেখলে পাখির খুব কষ্ট হবে। কথাগুলো ভেবেই পাখি ফুঁপিয়ে উঠল। পারু মুখ তুলে তাকাল। পাখিকে দেখে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। পাখির পিঠে, মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল পারু। পাখি পিসির হাতখানা ছোটো ছোটো দুইহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল। বলল,
“বাবা বলল, তুই নাকি কাল চলে যাবি? তুই যাস নে পিসি। তুই চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে রে..”
ছোটো পাখির কণ্ঠ কী করুণ শোনালো। পারু আবারও হাসল। হয়তো পাখির কথাটা বুঝতেই পারেনি পারু।
পাখি অনেকক্ষণ পারুর পাশেই চুপটি করে বসে রইল। পারুকে ঘুমপাড়ানি গান শোনালো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, কপালে চুমু খেল। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর পাখি উঠে চলে গেল।
(চলবে)
#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০১