বেলাশেষে পর্ব-০৩

0
34

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৩

হুবুহু সেই চোখ, সেই মুখ, সেই জোড়া ভ্রু। একটা মানুষের এতটা মিল থাকে নাকি? এটা কীভাবে সম্ভব? প্রণয়ের বুকের ভেতর হাহাকার। কণ্ঠে কম্পন। প্রণয় নিজেকে স্বাভাবিক করতে জানালার ফাঁক গলে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাল। আপনমনে বিড়বিড় করে বলল,
“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না হৈমন্তী। তুমি আমার এতটা কাছে!”
প্রণয়ের মা বলতো, পৃথিবীতে সাতজন মানুষের চেহারা দেখতে হুবুহু এক রকম। চলার পথে অনেক মানুষকেই দেখে মনে হয়েছে, এই মানুষটা তার পরিচিত মানুষের মতো অনেকটা দেখতে। তবে এতটা হুবহু মিল কখনো কারো চেহারায় পায়নি প্রণয়। এমন চেহারা শুধু জমজ বোনের ক্ষেত্রেই হয়। কিন্তু প্রণয়ের জানা মতে, হৈমন্তীর তো কোনো বোন ছিল না। শুধু একটা ভাই আছে। বয়সে অনেক ছোটো। তাহলে এই মেয়েটা কে? প্রণয় হাতে ধরে রাখা ফাইলে চোখ বুলালো। পারুমিতা সাহা। নার্সকে নিচু কণ্ঠে বলল,
“ওনার কী সমস্যা? দেখি রিপোর্ট গুলো?”
“এখনো কোনো টেস্ট করানো হয়নি। আগের রিপোর্ট আছে। দিচ্ছি।”
প্রণয় রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে বলল,
“ওনার তো মেজর কোনো সমস্যা নেই। ট্রমা আর মানসিক ডিপ্রেশন থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। নিয়মিত ঔষধ সেবন করলেই ঠিক হয়ে যেত। যদিও একটু সময় লাগতো।”
“ওনার দাদাকে বলা হয়েছে। কিন্তু ভদ্রলোকের বাড়িতে নাকি এক বৃদ্ধ মা ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়েটা দিনের বেলা ভালো থাকলেও রাতে নাকি পাগলামি করে। বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যেতে চায়। বৃদ্ধা মা একা একা সামলাতে পারে না। তাছাড়া ওনার দাদাও সবসময় বাড়ি থাকে না। উপায় না পেয়ে এখানে ভর্তি করতে বাধ্য হয়েছে।”
প্রণয় বলল,
“ও আচ্ছা। আমি ঔষধ লিখে দিচ্ছি। নিয়মিত সেবন করিয়ে দিবেন।”
“জি স্যার।”
প্রণয় ঔষধ লিখতে লিখতে কী মনে করে বলল,
“ওনার একটু যত্ন নিবেন।”
“জি স্যার।”
প্রণয় ঔষধ লেখার বাহানায় আর একবার পারুর দিকে তাকাল। বুকের ভেতর শিরশিরে অনুভূতি। চোখ জুড়ে একরাশ মুগ্ধতা। এই মুখটা প্রণয়ের কতটা আপন, কতটা কাছের, কতটা প্রিয়। তা বোধহয় এই মেয়েটা নিজেও জানে না। জানার কথাও না। আচ্ছা হিয়া যদি ওনাকে দেখে কী করবে? মা বলে ডাকবে? না অতিরিক্ত খুশিতে কথা বলতেই ভুলে যাবে। বোকা বোকা ভাবনার জন্য ঠোঁটের কোণে খুব অল্প বয়সের জন্য একটুখানি হাসি খেলে গেল। প্রণয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল। বাকি রোগী দেখে, নিজের চেম্বারে গিয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিল। এতক্ষণ ঘুমে দুচোখ বুঁজে আসলেও এখন পারুর মুখটা মানসপটে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রণয় ফোন বের করে, হৈমন্তীর ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল,
“এটা কীভাবে সম্ভব হৈমন্তী? তুমি আমাদের জীবন থেকে চলে গেছো আজ চারবছর যাবৎ। জীবনে কখনো আমি এতটা চমকাইনি জানো? হুবুহু যেন তোমার চোখ-মুখ কেটে বসানো। মেয়েটাকে দেখে আমার হার্টবিড কী পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। ভাবলেই আমার বুকের ভেতর এখনো কম্পন অনুভব করছি।”
বাকি রাতটুকু হৈমন্তীর ছবির সাথে কথা বলেই কাটিয়ে দিল প্রণয়।
সকালে বাসায় পৌঁছে দেখল, বুয়া রান্না করছে। বাবা স্নান সেরে গলায় গামছা পেঁচিয়ে ঠাকুর ঘরের দিকে যাচ্ছে। বোধহয় পূজা দেবে। হিয়া এখনো ঘুমে। প্রণয়ের মা মারা গেছে তিনমাস যাবৎ। আর হিয়ার জন্মের সময় হৈমন্তী মারা গেছে। প্রণয়ের মায়ের কাছেই হিয়া মানুষ হয়েছে। এতদিন মা বেঁচে ছিল। তাই হিয়াকে নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয়নি। প্রণয়কে বাবা বিয়ের কথা বললেও প্রণয় এড়িয়ে গেছে। বাবার বয়স হয়েছে। ইদানীং হিয়াকে নিয়ে একা একা বাবার সময় কাটতে চায় না। প্রায়ই প্রণয়কে বিয়ের জন্য চাপ দেয় বাবা। মা মারা যাওয়ার পর সংসারে একজন মমতাময়ী নারীর খুব প্রয়োজন বোধ করে বাবা ছেলে।
হিয়া ঘুম থেকে উঠে এসে দেখল, পাপা এসে গেছে। হিয়া দৌড়ে এসে প্রণয়ের গলা জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
“কখন বাসায় ফিরেছো পাপা?”
প্রণয় মেয়ের নাক টিপে ধরে আদর করে দিল। বলল,
“ভোরে এসেছি মা।”
“মাকে কবে আনবা পাপা?”
প্রণয় উদাস হয়। হিয়াকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। মানসপটে ভেসে উঠে পারুর মায়াবী মুখটা।

“আমাকে পারুর কাছে নিয়ে চল পরাগ?”
আলোকপর্ণা দেবী দৃঢ় কণ্ঠে বললেন। পরাগের মেজাজ গরম হয়ে যায়। মাকে বুঝ দিয়ে বলল,
“তুমি ওখানে গিয়ে কী করবা মা?”
“আমার মেয়েটা কেমন আছেন, কী অবস্থায় আছে। আমি মা হয়ে দেখব না?”
“আমার মাথা বিগড়ে দিও না তো মা। পারুকে রেখে এসেছি পনেরো দিনও হয়নি। এত তাড়াতাড়ি ওরা কাউকে এলাউ করে না।”
শেষের কথাটা মিথ্যে করে বলল পরাগ। আলোকপর্ণা দেবীর বুকটা কষ্টে ভেঙে এলো। মেয়েটা মাত্র পনেরো দিন চোখের আড়াল হয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে পনেরো যুগ হয়ে গেছে। মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় আলোকপর্ণা দেবী খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ গুমরে গুমরে কাঁদে। এই বাড়িতেও আর মন টিকে না। মেয়েটাকে এক পলক দেখতে পারলে অশান্ত মনটা বোধহয় শান্ত হতো।

নিয়মিত খাবার, ঔষধ সেবন করতে করতে পারুর বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এখন খাওয়ার সময়টুকু বাদে সারাক্ষণ ঘুমায় পারু। মুখের কথাও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে শরীর খুব দুর্বল। এখন আর রাত-বিরেতে চেঁচামেচি করে না পারু। কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ সেবন করে দিন-রাত ঘুমায়। বোধহয় মুখে রুচি হওয়ারও ঔষধ দিয়েছে। ইদানীং এত পরিমাণ খিদে বেড়ে গেছে। জেগে থাকলে শুধু খেতে ইচ্ছে করে।

প্রণয় পারুর ফাইলগুলোতে মুখ গুঁজে বসে আছে। পারুর বয়স চব্বিশ বছর। গুনে গুনে প্রণয়ের চৌদ্দ বছরের ছোটো। এত ছোটো মেয়েকে নিয়ে বোধহয় বিয়ের কথা ভাবা ঠিক না। অবচেতন মনে না চাইতেও বার বার পারুকে নিয়ে ভেবে যায় প্রণয়। যতটুকু খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছে। পারুমিতার একটা ভয়ংকর অতীত আছে। শোনা কথায় কতটুকুই বা সত্যাতা আছে? পারুমিতার মুখ থেকে শুনতে পারলে বেশি ভালো হতো। তার আগে মেয়েটাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। পরাগ বেস্ট কোম্পানির ঔষধ গুলো সাজেস্ট করেছে। পারুমিতার সেরে ওঠতে খুব বেশি সময় লাগবে না। একবার হিয়াকে এনেও পারুমিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে প্রণয়। বলবে, দ্যাখো তো এই আন্টিকে পছন্দ হয় হিয়া? হিয়ার পছন্দ হলে, আর পারুমিতা সুস্থ হয়ে উঠলে খুব শীঘ্রই বাবাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে প্রণয়। অনেক তো হলো যাযাবরের মতো জীবন কাটানো। এবার হিয়ার জন্য হলেও সংসারে একজন নারীর বিশেষ প্রয়োজন বোধ করছে প্রণয়।

(চলবে)