বেলাশেষে পর্ব-০৭

0
32

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ০৭

শার্টার তোলা কনফেকশনারি দোকান। চারপাশ নানান জিনিসপত্রে ঠাসা। অনি পারুকে দোকানের কর্ণারে নিয়ে গেল। পারু ঘন-কালো পাপড়ি যুক্ত মায়াবী চোখ তুলে অনিরুদ্ধর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। অনিরুদ্ধ দেখতে অনেকটা তামিল নায়কদের মতো। গায়ের রঙ ফর্সা, মুখে চাপদাড়ি স্টাইল করে ছেটে রাখা, খুব বেশি লম্বা নয়। তবে চওড়া কাঁধযুক্ত মেদহীন পেটানো শরীর। মাথার চুলগুলোও কপালের দুই সাইডে খুব সুন্দর করে ছেটে রাখা। দেখতে বেশ লাগে। অনিরুদ্ধ পারুর গালে হাত রাখতেই পারু আবেশে দুচোখ বুঁজে ফেলল। নিঃশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। অনিরুদ্ধ বলল,
“একা এসেছো কেন?”
পারু চোখ তুলে তাকাল। বলল,
“তমালিকা পিসির ঠাণ্ডা লেগেছে।”
“সারা রাস্তা কুয়াশায় ঢাকা। এতদূর একা একা যাবে?”
“হুম।”
“যদি পথে কোনো বিপদ হয়?”
“হবে না।”
“চলো আমি এগিয়ে দিচ্ছি।”

অনিরুদ্ধ গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে পারুকে নিয়ে বের হলো। পারু চট করে চাদর দিয়ে মুখটা ভালো করে ঢেকে নিল। যেন কেউ পারুকে দেখে না চিনতে পারে।
সাদা তুলোর মতো কুয়াশা ঢাকা পিচঢালা রাস্তা দিয়ে দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। কিছুদূর গিয়ে অনি পারুর একহাত চেপে ধরলো। পারুর বুকের ভেতর ধুকপুক করে উঠল। মনের ভেতর অন্যরকম ভালোলাগা। অনি হাঁটতে হাঁটতে নিচু কণ্ঠে বলল,
“চলো একদিন ঘুরে আসি।”
“কোথায়?”
“পার্কে যাব।”
“দাদা জানলে মেরে ফেলবে।”
“স্কুল ফাঁকি দিয়ে যাবে। কেউ জানবে না।”
“ভয় লাগছে। যদি ধরা পরে যাই?”
“আমি আছি তো। এত ভয় পাও কেন?”

ওরা আর একটু সামনে গিয়ে দেখতে পেল রাস্তার পাশেই বিভিন্ন ফুল-ফল গাছের বেশ বড় একটা নার্সারি। অনি বলল,
“চলো ভেতরে যাই?”
শীতের সকাল দেখেই বোধহয় আশেপাশে কারো দেখা মিলল না। পারু অনির হাত ধরেই নার্সারির ভেতরে ঢুকলো। অনি প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দুজনের বেশকিছু ক্লোজ ছবি তুলে নিল। যদিও প্রথম দিকে এত ঘনিষ্ঠ ভাবে ছবি তুলতে পারু বারণ করলো। অনি শুনলো না। পারুও আর অমত করলো না। নার্সারিতে দুজনে বেশ কিছুক্ষণ একান্ত সময় কাটিয়ে তারপর প্রাইভেট পড়তে চলে গেল পারু।
সারাদিন প্রাইভেট, স্কুল, কোচিং করেই কাটলো পারুর। বিকালের দিকে বাড়ি যাওয়ার সময় দেখল, অনিরুদ্ধদা দোকানে বসে আছে। পারুর চোখে চোখ পড়তেই পারুকে ইশারায় ডাকলো। পারু আশপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে, এগিয়ে গেল। অনিরুদ্ধ চকলেট, আইসক্রিম, চিপস, জুসসহ আরও হাবিজাবি বড় একটা পলিথিন ব্যাগে ভরে পারুর হাতে তুলে দিল। পারু নেব না। নেব বলেও শেষমেশ নিতে বাধ্য হলো। পারুর ব্যাগে জিনিস গুলো তুলে নিয়েই অনিরুদ্ধ নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“রাতে মেসেজ দেব। রিপ্লে দিও।”
পারুমিতা মাথা নেড়ে আচ্ছা বুঝিয়ে পাছে কেউ দেখে ফেলার ভয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।

বাড়ি এসে স্নান সেরে খেয়ে নিল পারুমিতা। বাকি বিকালটুকু টিভি দেখেই কাটলো পারুর। সন্ধ্যার দিকে পড়তে বসল পারু। পরা কম। অনিরুদ্ধর সাথে বাটন ফোনে একমনে চ্যাট করায় ব্যস্ত। পারুর কাছে যে একটা বাটন ফোন আছে। মা ছাড়া আর কেউ জানে না। অনিরুদ্ধর সাথে পারুর যে কিছু একটা চলছে। ইদানীং ঠাম্মিও একটু আধটু জানে! যখন প্রথম প্রথম আলোকপর্ণা দেবী জানতে পারলো পারমিতা অনিরুদ্ধ নামের একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে। মেয়েকে খুব বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বয়সে ছোটো হলে কী হবে, ঘাড়ত্যাড়া, জেদি মেয়েটা আলোকপর্ণা দেবীর কোনো কথাই শুনলো না। উল্টো ভয় দেখালো। যদি পারুর বাবাকে কথাটা বলে দেয়। তাহলে পারু কুয়োতে ঝাপ দেবে। একমাত্র মেয়েটা খুব আদরের। যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলে। সেই ভেবে আলোকপর্ণা দেবীও মেয়েকে একসময় নীরব সম্মতি দিল। অনিরুদ্ধ নামের ছেলেটা তিন/চারদিন রাতে পারুদের বাসায় এসেছিল। তখন পারুর বাবা আর দাদা দোকানে থাকতো। ঘরে ওরা তিনজন। অনিরুদ্ধ এলে আলোকপর্ণা দেবীও মেয়েকে অনিরুদ্ধর সাথে রেখে নাস্তা বানাতে রান্নাঘরে চলে যেত। দুজন একা ঘরে প্রায়ই খুনশুটিতে মেতে থাকতো। অনিরুদ্ধ পারুদের ঘরে দাঁড়িয়েও পারুর সাথে বেশকিছু ক্লোজ ছবি তুলেছে। প্রথম প্রথম অনিরুদ্ধর হাবভাব আলোকপর্ণা দেবীর ভালো না লাগলেও একসময় কী হলো কে জানে! ছেলেটা জাদুকরী কণ্ঠে আলোকপর্ণা দেবীকে মামণি বলে ডাকে। পারুর সাথে কোনো কারণে ঝগড়া হলে ছেলেটা না খেয়ে থাকে। ঘুমের ঔষধ খেয়েও পরে থাকে। ছেলেটার জন্য আলোকপর্ণা দেবীর অদ্ভুত মায়া হয়। ছেলেটার বাবা নেই। বোনের বাড়ি এসে একটা কনফেকশনারি দোকান দিয়েছে। পাশাপাশি পড়াশোনাও করে। খুব বেশি বয়সও না ছেলেটার। দুটিকে বেশ মানায়।
পারুমিতা পড়া শেষ করে খেয়ে নিল। রাতে ঘুমাতে গিয়ে ঘুমালো না। প্রায় অর্ধেক রাত জেগে অনিরুদ্ধর সাথে মেসেজে কথা বলল।
পারুর খাট ঘেঁষেই দক্ষিণের জানালা। পাশেই ঠাম্মি নাক ডেকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। জানালায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। পারু ছটফটিয়ে উঠল। মেসেজে বাংলিশে লিখল,
“এত রাতে তুমি এসেছো কেন?”
“জানালা খুলো?”
পারু জানালা খুলে দিল। ফোনের আলো জ্বেলে পারুর মুখে ধরতেই পারু চোখদুটো বুজে ফেলল। অনিরুদ্ধ জানালার ফাঁক গলে পারুর এক আঙুল পেঁচিয়ে ধরলো। আবেগী কণ্ঠে বলল,
“ঘুম আসছিল না। তাই তোমাকে দেখতে এলাম।”
পারু লজ্জাবতী পাতার মতো নুইয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক চিলতে লাজুক হাসি। অনিরুদ্ধ পারুর হাতে একমনে আঁকিবুঁকি করছে। পারুর বুক কাঁপছে। পায়ের পাতা শিরশির করছে। আস্তে করে বলল,
“দেখা হয়েছে? এখন যাও। শীতের রাতে এতক্ষণ দাঁড়িতে থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
“লাগুক।”
“শুধু শুধু জেদ করছো কেন?”
অনিরুদ্ধ জাদুকরী কণ্ঠে বলল,
“তোমাকে ছাড়া আমার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না পারু।”
পারু মনে মনে বলল,
“আমারও।”
অনিরুদ্ধ বলল,
“আগামীকাল যাবে তো আমার সাথে পারু?”
পারু ফিসফিস করে বলল,
“কোথায়?”
“পার্কে যাব।”
“ক্লাস ফাঁকি দিয়ে?”
“হ্যাঁ।”
পারু একটু ভেবে বলল,
“আচ্ছা।”
“আমি অপেক্ষায় থাকবো পারু।”
অনিরুদ্ধ আরও কিছুক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। বাকি রাতটুকু পারুর ঘুম হলো না। অনিরুদ্ধর কথা ভেবে ভেবেই কাটিয়ে দিল।

সকালে উঠে পারু দেখল, মা উনুন জ্বেলে রান্না করছে। পারু দাঁত ব্রাশ করে স্নান করতে গেল। মাথায় শ্যাম্পু করে স্নান করলো। স্নান সেরে এসে মায়ের পাশে বসল। টেবিল ফ্যান ছেড়ে চুলগুলো শুকিয়ে নিচ্ছে পারু। আলোকপর্ণা দেবী বলল,
“কি রে আজ প্রাইভেটে যাবি না?”
“না।”
“ওমা কেন?”
পারু নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি মা।”
“কী?”
“আগে কথা দাও? কাউকে বলবে না।”
“আচ্ছা বলব না। এবার বল?”
“আমি আজ অনিদার সাথে ঘুরতে যাব।”
“কোথায়?”
“পার্কে।’’
“ সে-তো অনেকদূর।”
“ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যাব মা।”
আলোকপর্ণা দেবী আঁতকে উঠল। মুখে হাত দিয়ে বলল,
“তোর বাবা আর দাদা জানলে সর্বনাশ হয়ে যাবে পারু।”
“কিছুই হবে না মা।”
“যাসনে পারু।”
“আমি কিন্তু ওকে বলে দেব। তুমিই আমাকে যেতে বারণ করেছো।”
“আমার কথা বলবি কেন? ছেলেটা কষ্ট পাবে তো।”
“তুমি চিন্তা করো না মা। সারাদিন ঘুরে বিকালেই চলে আসব।”
“তোর বাবা জানতে পারলে..?”
“তুমি এত ভয় পেও না তো মা। রিলাক্স থাকো। কেউ কিছুই জানতে পারবে না।”

পারমিতা একটা থ্রী-পিছ পরলো। হালকা সেজেগুজে, ব্যাগে শুধু একটা বই নিল। মাকে বলে অনির সাথে স্কুলের নাম করে ঘুরতে চলে গেল পারু। অনিরুদ্ধর বাইক আছে। অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে মাথায় ভালো করে ওড়না পেঁচিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে অনিরুদ্ধর বাইকের পেছনে উঠে বসল পারু।
অনিরুদ্ধ প্রাণ প্রেয়সীকে বাইকের পেছনে বসিয়ে মনের সুখে চালাতে লাগলো। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। মুক্ত বাতাসে প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারুর খুব ভালো লাগছে। একটু ভয় ভয় করছে বৈকি!
পার্কে যেতে প্রায় দেড়ঘণ্টা মতো সময় লাগলো। দুজন টিকেট কেটে হাত ধরে পার্কের সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে পারুর হাত ছেড়ে দিয়ে কাঁধে হাত রাখলো অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধর হাতের আঙুল গুলো পারুর কাঁধ বেয়ে বুক ছুঁয়েছে। পারু ইতস্তত করে অনির হাতখানা সরিয়ে দিতে চাইল। অনি পারুকে পাত্তা দিল না। বেহায়া হাতখানা আর একটু এঁটে বসল বোধহয়। নিচু কণ্ঠে বলল,
“এত লজ্জা পাচ্ছো কেন পারু? আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখো? রোমান্টিক শুটিং চলছে।”
পারু অনিরুদ্ধর কথার মানে বুঝলো না। অনিরুদ্ধ কেমন করে যেন হাসল। বলল,
“আমার কথার মানে বুঝলে না তো? ওই পাশটায় চলো বুঝাচ্ছি?”
অনিরুদ্ধ পারুকে নিয়ে লেকের পাড়ে। এই পাশটা বেশ ফাঁকা। বড় বড় লতা পেঁচিয়ে রেখেছে। আশেপাশে লতার জন্য দেখা যায় না। অনিরুদ্ধ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। পারুর ঘাড়ে মুখ গুঁজে লেকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেমন লাগছে?”
“আমরা কখন বাড়ি যাব?”
“সবে এলে। এখুনি বাড়ি যেতে চাইছো?”
“না..মানে..”
“কী এতো মানে মানে করছো পারু? আসো আমরা ছবি তুলি?”
অনি পারুকে সামনে নিজের সামনে বসিয়ে দিয়ে পারুর গালে গাল ঠেকিয়ে বেশ কিছু ছবি তুললো। পারু বিরক্ত হয়ে বলল,
“তখন থেকে এত ছবি তুলছো কেন?”
“আমরা যখন বুড়ো-বুড়ি হয়ে যাব। তখন এই ছবিগুলোই আমাদের প্রেমময় জীবনের মেমোরি হয়ে থাকবে।”
“তবুও সবসময় আমার এত ছবি তোলা ভালো লাগে না।”
“তুমি কী আমাকে বিশ্বাস করো না পারু?”
“করি।”
“তাহলে ছবি তুলতে বাঁধা দিচ্ছো কেন?”
“আমার ভালো লাগছে না।”
অনিরুদ্ধ জোর করে পারুর গালে চুমু এঁকে দিল। পারুকে আর একটু শক্ত করে ঝাপ্টে ধরলো। পারুর পেটের ভেতর কী যেন কামড়ে ধরলো। হাত-পা একটু একটু করে অবশ হয়ে আসছে।

“এই পরাগ?”
“কিছু বলবি?”
“তোর বোনকে পার্কে দেখে এলাম।”
পরাগ চমকে উঠল। বলল,
“কী বলছিস, ও তো স্কুলে।”
“ভালো করে খোঁজ নিয়ে দ্যাখ। আমি কী ভুল দেখেছি নাকি?”
“কার সাথে গেছে জানিস কিছু?”
“সাথে অনিরুদ্ধকে দেখলাম বোধহয়।”
পরাগ আর বাজারে গেল না। সাইকেল ঘুরিয়ে পারমিতার স্কুলে চলে গেল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো পারমিতা সত্যিই আজ স্কুলে আসেনি। পরাগ বাড়ি চলে গেল। মাকে ডেকে বলল,
“পারমিতা কোথায় মা?”
আলোকপর্ণা দেবী জড়তা নিয়ে বলল,
“স্কুলে গেছে।”
“তারমানে তুমি কিছুই জানো না? নাকি আমার কাছে লুকাচ্ছো?”
“কী লুকাব আশ্চর্য।”
“আসুক আজ বাড়ি। ওর এত সাহস বেড়েছে। ও কোন সাহসে ওই বখাটে ছেলেটার সাথে পার্কে গেল। যদি পারুর বড় কোনো ক্ষতি করে দেয়।”
পরাগ বাড়িতে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারলো না। ওর বন্ধুর মোটরসাইকেল নিয়ে পারুকে খুঁজতে চলে গেল।

(চলবে)