বেলাশেষে পর্ব-১৭+১৮

0
21

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৭

হিয়ার আবদারে পার্লারের লোকেরা খুব সুন্দর করে পারমিতাকে বউ সাজিয়ে দিল। ভারী কাজ করা বেনারসি শাড়ি পরেছে পারমিতা। শাড়িটা নতুন। পারমিতাকে খুব মানিয়েছে। প্রণয় এক ফাঁকে ঘরে এসে হৈমন্তীর গহনা গুলো পারমিতাকে পরার জন্য দিয়ে গেছে। পারমিতা না করেছিল। প্রণয় শুনেনি। বলেছে,
“এই গহনা গুলো আজ থেকে তুমি পরবে।”

পারমিতার সাজ কম্পিলিট হতেই আয়নার সামনে দাঁড়াল পারমিতা। ওকে দেখতে এত সুন্দর লাগছে। নিজেকে দেখে নিজেই অভিভূত হয়ে গেল। হিয়া পারমিতাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে মা। একদম বউ বউ লাগছে।”
পারমিতা আদর করে হিয়ার গাল টিপে দিল। বলল,
“তোমাকেও খুব সুন্দর লাগছে হিয়া মণি।”

প্রণয় পারমিতার শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লেজার পরেছে। দেখতে দারুণ লাগছে।

প্রণয় ঘরে এসে দেখল, হিয়া আর পারমিতা জড়াজড়ি করে বসে আছে। দুজনকে একসাথে দেখে প্রণয়ের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। বলল,
“মা-মেয়ে রেডি?”
হিয়া উঁকি দিয়ে বাবাকে দেখে দৌড়ে গেল। প্রণয় চট করে হিয়াকে কোলে তুলে নিল। হিয়াও পারমিতার শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে সুন্দর একটা জামা পরেছে। তিনজনকে এত মানিয়েছে। কেউ না জানলে ধরতেই পারবে না। হিয়া পারমিতার মেয়ে না। ওরা তিনজন ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখল সবাই একসাথে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলে বড়ো সাইজের একটা কেক রাখা। কেকের পাশে লাল-সাদা অজস্র বেলুন উড়ছে।
প্রণয় পারমিতার একহাত ধরে রেখেছে। ওরা হেঁটে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। প্রণয় হিয়াকে আস্তে করে কোল থেকে নামিয়ে দিল। পারমিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পারমিতার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিল৷ ইশারায় প্রণয়কেও পরিয়ে দিতে বলল। পারমিতার খুব লজ্জা লাগছে৷ আবার প্রণয়ের আগ্রহ দেখে খুব ভালোও লাগছে। ছোট্ট হিয়া বাবা-মাকে মালাবদল করতে দেখে খুশিতে হাততালি দিচ্ছে। মালাবদল করে সবার সামনে আবারও পারমিতার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিল প্রণয়। আবেগে পারমিতার চোখে জল এসে গেল। দুচোখ আলতো করে বুঁজে ফেলল। এক ফোঁটা নোনাজল পারমিতার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিল প্রণয়। মাথা নেড়ে পারমিতাকে কাঁদতে মানা করল। পারমিতা হেসে ফেলল।
তিনজন একসাথে কেক কাটলো। প্রণয়-পারমিতা প্রথমে হিয়াকে কেক খাইয়ে দিল। তারপর হিয়া বাবা-মাকে কেক খাইয়ে দিল। প্রণয় পারমিতাকে কেক খাইয়ে দেওয়ার সময় হাসিমুখে নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“বিয়ের দিন বিবাহবার্ষিকী পালন করতে কেমন লাগছে?”
পারমিতা হেসে ফেলল। বলল,
“দারুণ।”

অতিথিরা ভরপেট খেয়েদেয়ে ওদের বিয়ে উপলক্ষে উপহার দিয়ে রাতে বিদায় নিয়ে যার যার বাসায় চলে গেল। সবার খাওয়া হলেও ওদের এখনো খাওয়া হয়নি।
হিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। পারমিতা হিয়াকে কোলে তুলে নিল৷ বলল,
“আমি ঘরে যাচ্ছি।”
প্রণয় পিছু ডেকে বলল,
“তোমাকে আর এখানে আসতে হবে না। আমি খাবার নিয়ে ঘরে আসছি।”
পারমিতা মাথা নেড়ে আচ্ছা বলে ঘুমন্ত হিয়াকে নিয়ে ঘরে চলে গেল।

পারমিতা হিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিল। একটা কোলবালিশ হিয়ার পাশে রেখে আস্তে করে উঠে পড়ল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পারমিতা। তখনই সেলফোনটা তারস্বরে বেজে উঠল। চমকে উঠল পারমিতা। ফোনটা একটু আগে ড্রেসিংটেবিলের সামনে নামিয়ে রেখেছিল। চট করে হাতে তুলে নিল। ফোনের স্ক্রীনে অপরিচিত নম্বর। এতরাতে কে ফোন দিতে পারে। বুঝতে পারল না পারমিতা৷ ফোনটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরল। বলল,
“হ্যালো কে?”
“এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলে পারু?”
পারমিতা হতভম্ব হয়ে গেল। অনিরুদ্ধ ফোন দিয়েছে। কড়া কণ্ঠে বলল,
“এতরাতে কেন ফোন দিয়েছ তুমি?”
অনিরুদ্ধ নেশা জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“বরের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাচ্ছিলে বুঝি। উপস্.. সরি ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করার জন্য।”
“মুখ সামলে কথা বলো অনিরুদ্ধ।”
“তুমি আমার কাছে চলো আসো পারমিতা।”
“মরে গেলেও তোমার কাছে আর কখনো ফিরে যাব না।”
“তোমাকে আমার কাছে ফিরে আসতেই হবে পারমিতা।”
পারমিতা নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। বলল,
“অনেক কষ্টে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছি। দয়া করে, আমার সাজানো গোছানো জীবনে অশনি হয়ে ঢুকে, তছনছ করে দিও না।”
“আমি ভালো না থাকলে তোমাকেও যে ভালো থাকতে দেব না পারমিতা।”
“তোমার খারাপ থাকার পেছনে তো আমি দায়ী নই। তুমি নিজের দোষে আমাকে হারিয়েছ। আমাকে সর্বশান্ত করেছ তুমি। তোমার কখনো ভালো হবে না। যদি একবাবার সন্তান হয়ে থাকো। আমাকে আর কখনো বিরক্ত করবে না।”
“এই কি বললি তুই? আমি একবাবার সন্তান না। মাগি.. তুই বারো বাপের সন্তান। আমাকে বলে আমি নাকি একবাপের সন্তান না। সামনে পেলে তোর মুখ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব।”
“নেশাখোর, মেয়েবাজ, খারাপ লোক কখনো ভালো হয় না। তুই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ জানোয়ার। আসিস আমার মুখ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। তোর হাত আমি ভেঙে গুড়িয়ে দেব। অজাতের বংশ। মর তুই মর। এত মানুষ মরে। তুই মরতে পারিস না।”
তীব্র আক্রোশে কথাগুলো বলেই ফোনের লাইন কেটে দিল পারমিতা। তারপর ড্রেসিংটেবিলে দুইহাত রেখে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে অঝরে কাঁদতে লাগল। কিশোরী বয়সের আবেগ, একটা ভুল সিদ্ধান্ত
সারাজীবন ভোগাবে পারমিতাকে। বেশ বুঝতে পারছে পারমিতা। এই অমানুষটার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কি, বুঝতে পারছে না পারমিতা।

“পারমিতা?”

পারমিতা চোখের জল মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। প্রণয় খাবারের প্লেট টি-টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল। তারপর পারমিতার পেছনে এসে দাঁড়াল। পারমিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানের দুল খোলার চেষ্টা করছে। প্রণয় মুগ্ধ দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রণয়ের মুখের গরম নিঃশ্বাস পারমিতার ঘাড়ে উপচে পড়ছে। পারমিতা চোখ তুলে আয়নার দিকে তাকাল। পারমিতার চোখদুটো লাল হয়ে আছে। প্রণয় পারমিতার কাঁধে হাত রাখল। পারমিতার দুই কাঁধ আলতো হাতে চেপে ধরে পারমিতাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। পারমিতা মাথা নিচু করে ফেলল। প্রণয় পারমিতার চিবুকে হাত রাখল। মুখটা সামান্য উঁচু করে তুলে ধরল। বলল,
“কেঁদেছ কেন?”
পারমিতার চোখদুটো জলে ছলছল করছে। প্রণয় বলল,
“এই বিয়েতে তুমি খুশি নও পারমিতা?’’
“ না..না আপনি ভুল ভাবছেন।”
“তাহলে কাঁদছ কেন?”
“এমনি।”
“সত্যিটা আমাকে বলা যায় না?”
কি বলবে পারমিতা? এই মুহূর্তে অনিরুদ্ধর ব্যাপারে কথা বলতে ভালো লাগছে না। তাছাড়া সংক্ষেপে বলেও শেষ করা যাবে না। প্রথম থেকেই বলতে হবে। পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মিথ্যা করে বলল,
“মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল।”
প্রণয় একহাতে পারমিতার মাথাটা নিজের বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরল। পারমিতা প্রণয়ের বুকে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে দিল। প্রণয় পারমিতার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। বলল,
“কেঁদো না। বাবা-মা সারাজীবন বেঁচে থাকে না। তবে তাদের আশীর্বাদ সারাজীবন আমাদের মাথার উপরে থাকে। চলো খেয়ে নেবে।”
পারমিতা ইতস্তত করে বলল,
“আমি চেঞ্জ করব।”
প্রণয় বিড়বিড় করে বলল,
“এভাবেই তো দেখতে বেশি ভালো লাগছে।”
কথাটা পারমিতা শুনে ফেলল। প্রণয় বলল,
“ওইদিকে ওয়াশরুম। যাও।”
“থাক এখন চেঞ্জ করব না।”

প্রণয় খুশি মনে পারমিতাকে হাত ধরে বসিয়ে দিল। নিজেও পারমিতার পাশে বসল। খাবারের প্লেট থেকে খাবার তুলে পারমিতাকে খাইয়ে দিল। প্রায় সবগুলো আইটেম রান্না ভালো হয়েছে। প্রণয় ভরপেট খেলেও পারমিতা খুব বেশি খেতে পারল না।

পারমিতা গয়না গুলো একটা একটা করে খুলছে। গলার হার খুলতে গিয়ে বাঁধল বিপত্তি। প্রণয় বলল,
“আমি হেল্প করি?”
পারমিতা মাথা নেড়ে আচ্ছা বলল।
প্রণয় পারমিতার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। পারমিতার গলায় হাত রাখতেই আবেশে কেঁপে উঠল পারমিতা।
প্রণয় একটা একটা করে পারমিতার সবগুলো গহনা খুলে দিল। পারমিতা গহনা গুলো বাক্সে ভরে প্রণয়ের হাতে তুলে দিল। বলল,
“এগুলো আপনার কাছে রাখুন।”
“তোমার কাছে রেখে দাও।”
“আমি কোথায় রাখব?”
প্রণয় হাত ধরে পারমিতাকে আলমারির সামনে নিয়ে গেল। ড্রয়ার খুলে বলল,
“এখানে রাখো।”
পারমিতা গহনা গুলো রেখে দিল। আলমারির চাবি কোথায় রাখা থাকে। পারমিতাকে দেখিয়ে দিল প্রণয়। বলল,
“আজকের পর থেকে এই আলমারিতে তোমার কাপড়সহ প্রয়োজনীয় যা কিছু আছে রাখবে। এবং যখন যা প্রয়োজন হবে এখান থেকে নিয়ে পরবে। আমি অনেকগুলো নতুন শাড়ি, থ্রি-পিছ কিনে এনেছি। তাছাড়া হৈমন্তীর অনেক নতুন শাড়িও রাখা আছে। তোমার পরতে ইচ্ছে করলে পরো।”

পারমিতা হৈমন্তীর একটা সুতি শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল। “আমি স্নান করব। আমার ঘুমাতে দেরি হবে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”

মেকাপ তুলে, মাথায় শ্যাম্পু করে স্নান করে ঘরে আসতে অনেকটা সময় লাগল পারমিতার। এসে দেখল, প্রণয় হিয়ার একপাশে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ পারমিতার আর প্রণয়কে ডাকতে ইচ্ছে করল না। ঘরে এসি চলছে। শীত শীত লাগছে। বাবা-মেয়েকে কাথা টেনে ডেকে দিয়ে অন্যঘরে চলে গেল পারমিতা।

সকালে ঘুম ভাঙল চেঁচামেচির শব্দে। কে যেন এসেছে। প্রণয়ের সাথে একটা মহিলা খুব উঁচু গলায় কথা বলছে। হিয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব অশান্তি করছে। পাশের ঘর থেকে সবকিছু স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। এত সকালে কে এসেছে?

(চলবে)

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৮

প্রণয় খুব বিচলিত বোধ করছে। ভদ্রমহিলা বলল,
“আমি আমার নাতনিকে নিয়ে যাব। আমি বেঁচে থাকতে সৎমায়ের কাছে আমার নাতনিকে বড়ো হতে দেব না।”
প্রণয় বলল,
“আপনি ভুল ভাবছেন মা। আমি হিয়ার জন্যই বিয়ে করেছি।”
ভদ্রমহিলা বিদ্রুপ করে বলল,
“তুমি কার জন্য বিয়ে করেছ। সে আমার বেশ জানা আছে বাবা। হিয়া কোথায়? হিয়াকে ডাকো। আমি ওকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব।”
“আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন। ও আমার মেয়ে। আপনি ওকে কোনোভাবেই আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারেন না।”
ভদ্রমহিলার চোখদুটো ছলছল করে উঠল। বলল,
“সবে বিয়ে করেছ। বছর দুই পরে, আবারও বাবা হতে পারবে তুমি। এই ঘরে সন্তান এলে তুমি হয়তো আমার হৈমন্তীর মেয়েটাকে আগের মতো আদর-যত্ন করবে না। যে কটাদিন বেঁচে আছি। আমার মেয়ের শেষচিহৃকে আমার কাছে থাকতে দাও।”
“মা দরকার হয়, আপনি কিছুদিন এখানে থাকুন। নিজে চোখে দেখুন হিয়া অযত্নে অবহেলায় আছে নাকি ভালো আছে। আর একটা কথা, পারমিতা যে হিয়ার সৎমা। এইকথাটা ভুলেও হিয়াকে বলবেন না।”
ভদ্রমহিলা চোখের জল মুছে হেসে ফেলল। তাচ্ছিল্যের হাসি। বলল,
“আমার নাতনিকে তুমি এতই ছোটো ভাবো নাকি? আমি না বললে বুঝতে পারবে না। তোমার বর্তমান স্ত্রী আমার নাতনির সৎমা।”
“না বুঝতে পারবে না। হিয়া জানে আমার বর্তমান স্ত্রীই হিয়ার আসল মা।”
ভদ্রমহিলা চমকে উঠল। বলল,
“এসব কি বলছ তুমি? হিয়া তো হৈমন্তীর ছবি দেখেছে। হৈমন্তীকে ভালো করেই চিনে হিয়া।”
“হৈমন্তীকে চিনে দেখেই তো পারমিতাকে নিজের মা বলে মেনে নিয়েছে।”
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মিথ্যা কথা বলছ তুমি।”
“একটু অপেক্ষা করুন। প্রমাণ পেয়ে যাবেন।”
প্রণয় উঁচু কণ্ঠে বলল,
“পারমিতা কোথায় তুমি? একটু এইঘরে আসো তো?”

পারমিতা ইতিমধ্যে হাতমুখ ধুয়ে চট করে পরনের বাসি শাড়িটা পাল্টে ফেলেছে। মাথায় ঘোমটা টেনে ধীর পায়ে প্রণয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। পারমিতাকে আসতে দেখে, ভদ্রমহিলা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। প্রণয় ইশারায় ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বলল,
“হৈমন্তীর মা। প্রণাম করো।”
পারমিতা নিচু হয়ে প্রণাম করতে গেল। ভদ্রমহিলা সরে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“থাক..থাক প্রণাম করতে হবে না। আমার নাতনি হিয়া কোথায়?”
প্রণয় বলল,
“হিয়া ওর দাদুর সাথে বাজারে গেছে।”
“কখন আসবে?”
প্রণয় ঘড়ি দেখে বলল,
“আসার সময় হয়ে গেছে। পারমিতা মাকে চা করে দাও।”
পারমিতা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে চলে যেতে নিল। তখনই ভদ্রমহিলা কি মনে করে যেন পারমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। বাকরুদ্ধ হয়ে একধ্যানে পারমিতার মুখের আদলে গড়া হৈমন্তীকে দেখতে লাগল। ভদ্রমহিলার বুকের ভেতর কাঁপছে। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লাগল। চোখদুটো ছলছল করছে। কাঁপা হাতে পারমিতার একহাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে পারমিতাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
“হৈমন্তী… আমার হৈমন্তী। আমার মেয়েটাকে তুমি কোথায় পেলে বাবা? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মেয়েটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”
কিছু সময়ের জন্য প্রণয়ও আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“মা ও হৈমন্তী না। ওর নাম পারমিতা।”
ভদ্রমহিলার মতিভ্রম কেটে গেল। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,
“হ্যাঁ ও কীভাবে হৈমন্তী হবে। হৈমন্তী তো মারা গেছে। ওদের দুজনের চেহারায় এত মিল। আমারই গুলিয়ে যাচ্ছে।”
প্রণয় কৌতূহলবশত বলল,
“মা হৈমন্তীর কি কোনো জমজবোন ছিল?”
“না তো।”
ভদ্রমহিলার নাম রেখা। রেখা তখনো পারমিতার একহাত ধরে রেখেছে। বার বার পারমিতার আদলে গড়া হৈমন্তীর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বলল,
“ওকে তুমি কোথায় পেলে বাবা?”
প্রণয় বলল,
“সে অনেক কথা মা। সময় করে বলব। পারমিতা যাও মায়ের জন্য এককাপ চা নিয়ে আসো।”

পারমিতা চলে যেতেই রেখা আবারও ওর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। প্রণয় সংক্ষেপে পারমিতার অতীতের কথা খুলে বলল শাশুড়িমাকে। সবশুনে ভদ্রমহিলা বলল,
“সবই তো বুঝলাম বাবা। কিন্তু ও কি আর আমাদের হৈমন্তীর মতো হৈমন্তীর মেয়েকে আদর-স্নেহ দিয়ে বড়ো করবে?”
প্রণয় ভরসা দিয়ে বলল,
“করবে মা।”
“এখন হয়তো করছে। কিন্তু ওর নিজের বাচ্চা-কাচ্চা হলে তখন হয়তো না-ও করতে পারে।”
“পারমিতা কখনো মা হতে পারবে না।”
“এসব কি বলছ তুমি?”
“হ্যাঁ মা। একদিকে হিয়াকে পেয়ে ওর যেমন মাতৃত্বের স্বাদ পূরণ হয়েছে। হিয়াও ওর মাঝে নিজের মাকে ফিরে পেরেছে। আমি শুধু ওদের দুজনের মনের ইচ্ছে পূরণ করেছি মাত্র। তাছাড়া আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি। পারমিতা প্রচণ্ড বাচ্চা পছন্দ করে। ওর ভাতিজিও ওর জন্য পাগল ছিল। আপনি যখন এসেছেন। কিছুদিন এখানে থাকুন৷ দেখুন ওকে কাছ থেকে তাহলেই বুঝতে পারবেন।”
“ইশ, আগে বলবা না। ও হুবুহু আমার হৈমন্তীর মতো দেখতে। তাহলে তো তোমাদের বিয়েতেই আসতাম আমি।”
“আমি তো বলেছিলাম, আমি হিয়ার জন্য মা এনেছি। আপনারা তো তখন আমার কথা বিশ্বাস করেননি। উল্টো আমাদের বিবাহবার্ষিকীর ডেটে বিয়ে করেছি দেখে ফোনে রাগ দেখালেন।”
রেখা ইতস্তত করে বলল,
“আমি এখানে থাকলে তোমার বউ হিয়ার সামনে আমাকে কি বলে ডাকবে?”
“আপনি কি ডাকলে খুশি হবেন?”
হৈমন্তীর ছবির দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলার চোখ দুটো আবারও ছলছল করে উঠল। বলল,
“ও কি আমাকে মা ডাকবে?”
প্রণয় হেসে ফেলল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“ওর মা নেই। বললে, অবশ্যই আপনাকে মা ডাকবে। শুধু আমার একটাই অনুরোধ থাকবে, হিয়ার সামনে কখনো বলবেন না। পারমিতা হিয়ার সৎমা। হিয়া মন থেকে ওকে মা বলে মেনে নিয়েছে। আশা করি, আপনিও মেনে নিবেন।”

রেখার তিন ছেলে এক মেয়ে। তিনছেলের আলাদা আলাদা সংসার হয়েছে। হৈমন্তী বেঁচে থাকতে প্রায়ই এখানে এসে থাকতেন তিনি। হৈমন্তী মারা যাওয়ার পর, খুব একটা আসতে পারতেন না। ছেলের বউরা আসতে দিতে চাইতো না। যদি ছোটো হিয়াকে ওনার সাথে গছিয়ে দেয় সেই ভয়ে। তা-ও মন ছুটে গেলে প্রায়ই নাতনিকে দেখতে আসতেন তিনি। হৈমন্তী মারা যাওয়ার পরও নিজের কর্তব্য ভুলেনি প্রণয়। প্রায়ই শাশুড়িকে হাতখরচা বাবদ টাকা পাঠাতো। তিনি না করলেও শুনতো না। রেখার স্বামী মারা গেছে তখন হৈমন্তী ছোটো। অনেক কষ্ট করে একা হাতে ছেলেমেয়েদের বড়ো করেছেন তিনি। ছেলেরা বড়ো হয়েছে। সবাই আজ প্রতিষ্ঠিত। যার যার সংসার আলাদা হলেও মাকে খুব সম্মান করে ছেলেরা। প্রণয় আবার বিয়ে করেছে। এইকথা শুনে হৈমন্তীর দাদারাই হিয়াকে নিয়ে যেতে মাকে পাঠিয়েছে। তারাও আসতে চেয়েছিল। তবে রেখা মানা করেছে। বলেছে, আগে আমি গিয়ে দেখি, কি অবস্থা। তারপর নাহয় তোরা যাবি।

পারমিতা শুধু চা না। অল্প সময়ে কাজের মাসিদের সাহায্যে চায়ের সাথে অনেককিছুই রান্না করে ফেলল। খাবারগুলো টেবিলে দিয়ে হিয়ার দিদাকে ডাকতে এলো। বলল,
“চলুন। জলখাবার খাবেন।”
রেখা বলল,
“শুধু চা হলেই তো হতো।”
“আপনি চলুন তো। আমিও খাইনি। চলুন একসাথে বসে খাব।”
রেখা আর দ্বিমত করল না। দুজন একসাথে বসে জলখাবার খেল। প্রণয় আগেই খেয়ে নিয়েছে। ওদের সঙ্গ দিতে শুধু চা খেলো। পারমিতার আন্তরিকতা দেখে
রেখার খুব ভালো লাগছে। মেয়েটা এটাসেটা রেখার পাতে তুলে দিচ্ছে। না করলেও শুনছে না। হৈমন্তীও এমন করতো। বলতো,
“খাও তো মা। একদিন একটু বেশি খেলে কিছুই হয় না।”
এই মেয়েটাকে দেখে আজ না চাইতেও বার বার হৈমন্তীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পারমিতা জলের জগ আনতে রান্নাঘরে চলে গেল। প্রণয়ও চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পারমিতার পিছু পিছু গেল। বলল,
“কিছু মনে না করলে, আমার একটা রিকুয়েষ্ট রাখবে পারমিতা?”
পারমিতা প্রণয়ের চোখের দিকে তাকাল। বলল,
“কি কথা?”
“হৈমন্তীর মা কিছুদিন এখানে থাকবে।”
“থাকুক। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“তুমি কি ওনাকে হিয়ার সামনে মা বলে ডাকবে পারমিতা?”
“ওনি যদি অনুমতি দেয়, শুধু হিয়ার সামনে কেন! আমি ওনাকে সবসময় মা বলে ডাকব।”

আত্মতৃপ্তিতে প্রণয়ের মনটা ভরে গেল। প্রণয়ের বউ ভাগ্য এতটা ভালো হবে। এটা ভাবনাতেও ছিল না।

হিয়া বাজার থেকে এসেই দিদাকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরল। পারমিতাকে দেখিয়ে বলল,
“তুমি সবসময় বলতে, তোর মা আকাশের তারা হয়ে গেছে। আমি বলতাম, আমার মা আকাশের তারা হয়নি। একদিন মা ঠিকই আমার কাছে ফিরে আসবে। দেখলে তো, আমার মা সত্যি সত্যি এসেছে।”
রেখা নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি ভুল বলতাম দিদিভাই। বুড়ো হয়ে গেছি তো। কত কথা মনে থাকে না।”
হিয়া হেসে ফেলল।

(চলবে)