বেলাশেষে পর্ব-২৩+২৪

0
22

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৩

পারমিতা ঘুমিয়ে গেলেও ঘুম নেই প্রণয়ের চোখে। মা-মেয়ে ঘুমিয়ে আছে৷ হিয়া ঘুমের ঘোরে একটা হাত দিয়ে পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। অন্যদিন এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলেও আজ মনটা খুব অশান্ত হয়ে আছে। রনিতা খুব ধুরন্ধর একটা মহিলা। ওকে বিশ্বাস নেই। প্রণয় যদি এখন একবার না গিয়ে রনিতার সাথে দেখা করে। তাহলে ক্ষেপে যাবে রনিতা। আর ওর মাথা বিগড়ে গেলে হয়ত হৈমন্তীর মতো পারমিতাকেও ভুল বুঝিয়ে প্রণয়ের নতুন সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করবে। প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়াল। একটা শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে একবার ঘড়ি দেখে নিল। ঘড়ির কাটায় রাত ১:০০ ছুঁই ছুঁই করছে। প্রণয় ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখল, রনিতা আধশোয়া হয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে টেলিভিশন দেখছে।
প্রণয় রনিতার সামনে দাঁড়িয়ে চাপা কণ্ঠে বলল,
“এত রাতে আমাকে ডেকেছেন কেন?”
প্রণয়কে দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল রনিতা। মুখে হাসি খেলে গেল। প্রণয়ের হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে দিল রনিতা। প্রণয় সরে বসল। সেদিকে তাকিয়ে রনিতা আবারও হাসল। বলল,
“বিবাহিত জীবন কেমন কাটছে তোমার? নিশ্চয়ই বউকে খুব আদর করা হয়?”
প্রণয় কণ্ঠে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,
“মাঝরাতে এগুলো বলার জন্য আমাকে ডেকেছেন?”
“না..একদম না।”
রনিতা উঠে এসে প্রণয়ের গা ঘেষে বসল। ফিসফিস করে বলল,
“তোমার দাদা তো বিছানায় গেলেই বিড়াল হয়ে যায়।”
প্রণয়ের গা গুলিয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ডাক্তার দেখান। এই রোগের চিকিৎসা আছে।”
“ধ্যুৎ.. ওটাকে আমার আর ভালোই লাগে না। আমার ভালো লাগে তোমাকে। তুমি তো আমাকে পাত্তাই দিলে না।”
প্রণয় চট করে উঠে দাঁড়াল। কড়া কণ্ঠে বলল,
“ভেবেছিলাম ভালো হয়ে গেছেন। বয়স বাড়লে কি হবে আপনার স্বভাব চরিত্র একটুও বদলায়নি। আর কখনো যদি এই ধরনের কথা বলেন। আমি আর কাউকে মানব না। সরাসরি হৈমন্তীর দাদাকে বলে দেব।”
“আর আমি যদি এখন নিজের ব্লাউজ ছিঁড়ে, তোমার শার্টে সিঁদুর লাগিয়ে দিয়ে, পারমিতাকে ডেকে দেখাই। তখন কি করবে তুমি?”
রনিতার কথা শুনে অতিরিক্ত রাগে প্রণয় থরথর করে কাঁপছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এই একই নোংরা মিথ্যা নাটক আপনি হৈমন্তীর সাথেও করেছিলেন। শুধুমাত্র আপনার জন্য আমাদের দুজনের সুখের সংসারে অশান্তি লেগেই থাকতো। ও সন্দেহ করত আমাকে। ভাবত, আপনার সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক আছে৷ আমি ওকে বোঝাতেই পারিনি। সব ভুল ছিল। সব মিথ্যা ছিল। আমি শুধু হৈমন্তীকেই ভালোবাসতাম। হৈমন্তীই আমার জীবনের প্রথম ও একমাত্র নারী ছিল৷ অথচ আপনি আমাদের সুখের সংসার তছনছ করে দিয়েছিলেন৷ একে তো ওর বাচ্চা পেটে ছিল। তারউপর আমাকে সন্দেহ করে সারাক্ষণ মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগতো। তখন আপনাকে ছেড়ে দিয়েছি বলে যে এখনও ছেড়ে দেবে। এটা যদি ভেবে থাকেন। ভুল ভাববেন আপনি। কারণ হৈমন্তী আপনাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। আমার থেকেও আপনাকে বেশি বিশ্বাস করত। নিজের মাকে যা না বলত। আপনাকে অকপটে তা বলে দিত। অথচ আপনিই পেছন থেকে ওর পিঠে ছুড়ি মেরেছিলেন। এখন যেহেতু হৈমন্তী বেঁচে নেই। আমার আর কোনো পিছুটানও নেই। তখন হৈমন্তী ওর দাদার সংসার ভাঙার ভয়ে আমাকে দিব্যি দিয়েছিল দেখে আমি অন্যায় দেখেও চুপ করে ছিলাম৷ এখন আর চুপ করে থাকব না। যে আমার অশান্তির কারণ হবে। তাকে আমি শেকড় থেকেই উপড়ে ফেলল।”
রনিতা বলল,
“তাই নাকি? এখন আমি চিৎকার করে ডাকব নাকি সবাইকে? এতরাতে আমার সাথে একাকী কি করতে পারো। আশা করি, তা আর কাউকে বলে বোঝাতে হবে না।”
“গলা টিপে মেরে ফেলব আপনাকে। অসভ্যতামির একটা লিমিট থাকা প্রয়োজন। হৈমন্তীকে আমার সম্পর্কে ভুল বুঝিয়েছিলেন দেখে যে পারমিতাকেও ভুল বুঝাতে পারবেন। যদি ভেবে থাকেন। তাহলে ভুল ভাবছেন। এবার যদি বেশি বাড়াবাড়ি করেন। আমি আর আত্মীয় মানব না। বলে দেব হৈমন্তীর দাদাকে। এতগুলো বছর ধরে আপনার মতো চরিত্রহীনার সাথে সংসার করেছে তারও জানা প্রয়োজন।”
“সে কোনোদিনও আমাকে অবিশ্বাস করবে না।”
“আমি প্রমাণ দেব।”
“তোমার মুখের কথা তো আরও বিশ্বাস করবে না।”
“আপনার মুখের কথা তো বিশ্বাস করবে। আমি সেই ব্যবস্থাই করব।”
প্রণয় মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে পড়ল। কিছু মনে পড়তেই বলল,
“সত্যি করে একটা কথা বলুন তো? আপনি তো হৈমন্তীকে নিজের ছোটো বোনের মতো ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। তাহলে কেন ওর জীবনে অশান্তির কারণ হলেন? কেন ওকে ভুল বুঝালেন, আমি আপনার সাথে জোর করে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছি।”
রনিতা প্রণয়ের মুখোমুখি বসল। উদাস হয়ে বলল,
“শুনলে বিশ্বাস করবে নাকি জানি না তোমার দাদা আমাকে কোনোদিনও পরিপূর্ণ সুখী করতে পারেনি। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই বোধহয় এমন। হৈমন্তীকে যেমন আমি প্রচণ্ড স্নেহ করতাম। তেমন ওর বিয়ের পর থেকে প্রচণ্ড হিংসা করতাম মনে মনে। আমি ছিলাম ওর গোপন ডায়েরি। সেই স্কুল লাইফ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ও আমার সাথে সবকিছু শেয়ার করত। তোমাদের বিয়ের পর ও তোমাদের সুখের গল্প প্রায়ই বলত। তোমার প্রতি আমার কৌতূহল তখন থেকেই বেড়ে যায়। ওর মুখে তোমার কথা শুনতে শুনতে আমিও মনে মনে তোমাকে পছন্দ করে ফেলি। তোমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের গল্প শুনে আমারও ইচ্ছে করত তোমার সাথে অন্তত একটা রাত কাটাতে। দেখতে চেয়েছিলাম সত্যিই কি তুমি এমন। নাকি হৈমন্তী বানিয়ে বানিয়ে বলছে। তোমাকে আমি আমার প্রতি প্রায়ই আকর্ষণ করার চেষ্টা করতাম। আফসোস তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাতে না। সারাক্ষণ হৈমন্তীতে মত্ত থাকতে। হৈমন্তীও দিন দিন আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। ওর সংসারে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
আমার ভেতরও প্রচুর জেদ চেপে গেল। তোমাদের এত মিল, ভালোবাসা কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না আমার। হৈমন্তী যখন প্রেগন্যান্ট হলো। প্রথম তিনমাস আমাদের বাড়িতেই রইল। কিছু সমস্যার জন্য ডাক্তার ওকে পুরো বেড রেস্ট দিয়েছে। তুমিও ছুটি পেলে প্রায়ই আসতে। হৈমন্তী অসুস্থ থাকার কারণে তুমি যেহেতু ওর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারতে না। আমি ঠিক সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছি। সেদিন বাড়ি ফাঁকা ছিল। একটা বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে সবাই রাতে সেখানে থেকে যায়৷ বাড়িতে ছিলাম আমি তুমি আর হৈমন্তী। আমি তখন রাতে তোমাকে আমার কাছে ডেকে নিলাম। তোমার সাথে কথা বলতে বলতে খুব জোড়াজুড়ি করলাম তোমাকে আমার সাথে অন্তত একটা রাত কাটাতে। তুমি যখন কিছুতেই রাজি হচ্ছিলে না। তখন আমার মাথায় প্রচণ্ড জেদ চেপে গেল। আমি নিজের শাড়ির আঁচল টেনে খুললাম, ব্লাউজ ছিঁড়লাম। যেই দেখলাম হৈমন্তী কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে এইদিকে আসছে। ওমনি তোমাকে জাপ্টে ধরে চিল্লাতে লাগলাম। আর কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম,
“তুমি আমার এতবড়ো সর্বনাশ করো না। হৈমন্তী জানতে পারলে মরে যাবে। তোমার বউ অসুস্থ দেখেই তো এখন তোমাকে সঙ্গ দিতে পারছে না। যখন সুস্থ হয়ে যাবে। তখন নাহয়….
তারপর যা হওয়ার তাই হলো। হৈমন্তী ভুল বুঝল তোমাকে। তোমার হয়ে ক্ষমা চাইল আমার কাছে। তোমাদের এত মধুর সম্পর্ক আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে গেল। হয়ত ঘৃণা করত হৈমন্তী তোমাকে।”
প্রণয়ের ইচ্ছে করছে এই মহিলাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। যুগে যুগে নারীরাই নারীর বড়ো শক্র প্রমাণিত। শুধুমাত্র হৈমন্তীর সুখ সহ্য করতে পারেনি দেখে, এই মহিলা হৈমন্তীর সংসারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের সুখের গল্প শুনতে শুনতে হিংসা জ্বলেপুড়ে সুখের সংসারটাই ধ্বংস করে দিতে পারে। এই মহিলা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
ওই ঘটনার পর থেকে হৈমন্তী প্রণয়ের সাথে এক বিছানায় ঘুমাতো পর্যন্ত না। একে তো প্রেগন্যান্ট ছিল। তারউপর সারাক্ষণ মানসিক ডিপ্রেশনে ভুগতো। হৈমন্তীর মলিন মুখের দিকে তাকানো যেত না। কষ্টে প্রণয়ের বুক ফেটে যেত। সেদিনের পর ওই মহিলাকে আর কোনোদিনও প্রণয়ের বাড়িতে আসতে দেয়নি প্রণয়। একবার এসেছিল হৈমন্তী মারা যাওয়ার দিন। আর আজকে পারমিতাকে দেখার বাহানায় আবার এসেছে।
প্রণয় কতবার কতভাবে হৈমন্তীকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে। হৈমন্তী বুঝতেই চায়নি। বউদির মিথ্যা কথাটাকে সত্যি ভেবে প্রণয়কে ভুল বুঝে দূরে দূরে থাকতো সবসময়। শেষের দিকে অবশ্য ওর বউদির আসল রূপ ধরে ফেলেছিল হৈমন্তী। তখন মেয়েটা খুব অনুতপ্ত হয়েছিল। বার বার প্রণয়ের একহাত জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতো। আর সারাক্ষণ দু-চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ত। ওর বউদির প্রতারণা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। এত কিছুর পরও প্রণয় সমস্ত দুঃখ-কষ্ট, অভিমান-অভিযোগ একপাশে সরিয়ে রেখে কথা দিয়েছিল হৈমন্তীকে। বাবুটার জন্ম হলে ওরা আবারও নতুন করে শুরু করবে। ওদের সংসার সুখের হবে। ভালোবাসায় ভরে উঠবে। কিন্তু মেয়েটাকে জন্ম দিতে গিয়ে হৈমন্তী প্রণয়কে ফাঁকি দিয়ে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গেল।

রনিতা প্রণয়ের কাছে আসতে চাইল। প্রণয় সজোরে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল রনিতাকে। রনিতা ছিটকে গিয়ে পড়ল ট্রে-টেবিলের কোণায়। কপালে বেশ চোট পেয়েছে। প্রণয় বলল,
“আগামীকাল সকালে আমি ঘুম থেকে ওঠার আগে এই বাড়ি থেকে চলে যাবেন আপনি। নাহলে আমি নিজের মুখে প্রমাণসহ হৈমন্তীর মাকে সবকিছু বলে দেব। তাদেরও জানা উচিত তাদের বাড়ির বউয়ের মেন্টালিটি কতটা নোংরা।”
“তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।”
প্রণয় হাসল। বিদ্রুপের হাসি। বলল,
“কনফিডেন্স থাকা ভালো। তবে ওভার কনফিডেন্স থাকা একদম ভালো না। আপনার চরিত্র তো আমি জানি। এবার আর বোকামি করিনি। আপনি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা যা বলেছেন। মোবাইলে সবকিছু রেকর্ড করে রেখেছি।”
রনিতা ভড়কে গেল।

(চলবে)

#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৪

রনিতা ভড়কে গেল। ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না। প্রণয় এমন একটা কাণ্ড ঘটাতে পারে। প্রণয়ের এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রনিতা তীব্র আক্রোশে বলল,
“তোমার ফোনটা কোথায়? দাও আমাকে?”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে রনিতার দিকে তাকাল। বলল,
“আজব! আমার ফোন আপনাকে দেব কেন?”
রনিতা নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রণয়ের উপরে। প্রণয়ের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। প্রণয় হতভম্ব হয়ে গেল। এভাবে ধস্তাধস্তি করলে বাড়ির সবাই জেগে যাবে। এভাবে দুজনকে জড়াজড়ি করা অবস্থায় দেখলে সবাই প্রণয়কেই ভুল বুঝবে। প্রণয় শক্ত হাতে রনিতার মুখটা চেপে ধরল। যেন কোনোরকম আওয়াজ করতে না পারে। চাপা কণ্ঠে বলল,
“চুপপ.. এতরাতে বাড়ির সবাইকে জাগিয়ে তামাশা করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার৷ বেশি বাড়াবাড়ি করলে এখানেই গলা টিপে মেরে দেব। তারপর যা হয় হবে।”
রনিতা বহুকষ্টে প্রণয়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাশতে লাগল। প্রণয়ের চোখের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বলল,
“ফোন থেকে রেকর্ডটা ডিলিট করে দাও।”
“ডিলিট তো অবশ্যই করব। তবে সবাইকে দেখাব। তারপর…”
“প্রণয় ভালো হবে না কিন্তু.. আমি হিয়াকে বলে দেব কিন্তু পারমিতা ওর নিজের মা নয়। সৎমা।”
“সেই সুযোগটা তো আপনাকে আগে পেতে হবে। আপনার নিজের সংসার বাঁচে নাকি আগে তাই দেখুন…”
“আমার বাচ্চা আছে। এই বয়সে স্বামী সন্তান ফেলে কোথায় যাব আমি। তুমি আমার এতবড়ো সর্বনাশ করো না প্রণয়।” রনিতার কণ্ঠ নরম হয়ে এলো।
“অন্যের সর্বনাশ করার আগে এই কথাগুলো মাথায় রাখতে হয়।”
“আমার ভুল হয়ে গেছে। শেষবারের মতো একটা সুযোগ দাও। ক্ষমা করে দাও আমাকে।”
“সুযোগ দেওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। প্রথমবার সুযোগ পেয়েই তো আপনি এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। শুধুমাত্র আপনার হিংসার জন্য আমরা দুজন মাসের পর মাস মানসিক কষ্ট পেয়েছি। হৈমন্তী আমাকে ভুল বুঝে মনের দিক থেকে অনেকদূরে সরে গিয়েছিল। তারপরও শিক্ষা হয়নি আপনার। আবারও আমাকে নিয়ে নোংরা খেলায় মেতেছিলেন। এবার তো একচুলও ছাড় দেব না আমি আপনাকে।”
রনিতা দিকদিশা না পেয়ে আচমকা প্রণয়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। প্রণয় লাফিয়ে উঠল। তবে সরে যেতে পারল না। ততক্ষণে রনিতা প্রণয়ের পাদুটো শক্তহাতে ধরে ফেলেছে। প্রণয়ের খুব ভয় লাগছে। রনিতার হাবভাব মোটেও সুবিধার না। এই অবস্থায় যদি কেউ ওদের দেখে ফেলে লজ্জার শেষ থাকবে না। বিশেষ করে পারমিতা দেখে ফেললে ভুল বুঝবে প্রণয়কে। এমনিতেই মেয়েটা চরমভাবে অনিরুদ্ধর কাছে ঠকে গিয়েছিল। হয়তো ছেলেদের প্রতি বিশ্বাস ভরসাও ওঠে গেছে। প্রণয়ের উপর যতটুকু ভরসা তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় দুজনকে দেখলে আবারও ভুল বুঝবে। আর এই ভুল যদি কখনো ভাঙাতে না পারে…প্রণয় আর কিছু ভাবতে পারে না। পারমিতা ভুল বুঝে দূরে সরে গেলে প্রণয় নিঃস্ব হয়ে যাবে।
খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই পারমিতাকে সব সত্যি বলে দেবে প্রণয়। কোনোকিছু লুকাবে না। প্রণয়ের দিক থেকে পারমিতার কাছে স্বচ্ছ থাকবে সবসময়। যেন আর কখনো দুজনের ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি নাহয়। প্রণয় বিরক্তি চেপে বলল,
“আমার পা ছাড়ুন তো। নাহলে আপনাকে আর কষ্ট করে কাউকে ডাকতে হবে না। আমিই ডেকে নেব।”
রনিতা চট করে প্রণয়ের পা’দুটো ছেড়ে দিল।
প্রণয় আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। হন্তদন্ত পায়ে ঘরে চলে গেল। ঘরের ভেতর থেকে দরজাটা আটকে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল প্রণয়।
“কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?”
চমকে উঠল প্রণয়। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল, পারমিতা খাটের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পারমিতার চোখমুখ স্বাভাবিক। কোনোকিছু বুঝতে পেরেছে নাকি তাই তো প্রণয় বুঝতে পারছে না। প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কয়েকপা হেঁটে এসে পারমিতার সামনে হাঁটু মুড়ে বসল। পারমিতার দুইহাত আলতো হাতে চেপে ধরে নিজের গালে ঠেসে ধরল প্রণয়। বলল,
“তুমি আমার স্ত্রী। আমার সন্তানের বর্তমান মা।
আমার জীবনের খুটিনাটি সব বিষয়ে তোমার জানার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাব না পারমিতা৷ যেন এই সুযোগে পরবর্তীতে অন্যকেউ আমার ব্যাপারে একগাদা মিথ্যা কথা বলে তোমাকে ভুল বুঝাতে না পারে। অনেক রাত হয়েছে। তুমি কি আজকেই সবটা শুনতে চাও?”
পারমিতার প্রচণ্ড ভয় লাগছে। কি এমন সত্যি থাকতে পারে প্রণয়ের জীবনে? রনিতার সাথে প্রণয়ের গভীর কিছু নেই তো? কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে দেখে, প্রণয় পাশে নেই। পারমিতার বাথরুম চেপেছিল। বাথরুমে গিয়ে দেখে ওখানেও প্রণয় নেই। মানুষটা এতরাতে কোথায় গেল? বুঝতে পারেনি পারমিতা। ঘরের বাইরে প্রণয়কে খুঁজতে গিয়ে দেখল, রনিতা প্রণয়কে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। প্রণয়ের পেছনের দিক দেখা যাচ্ছে। অনিরুদ্ধকে হাতেনাতে ধরে যতটা চমকে গিয়েছিল। প্রণয়কে দেখে একটুও চমকায়নি পারমিতা। শুধু বিশ্বাসের খুঁটিটা একটু নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। আর দুচোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছিল। এত অল্প সময়ে প্রণয়কে পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও ভরসা করত খুব৷ সেই মানুষটাও পারমিতাকে ঠকিয়ে দিল। এই ভাবনাটা মনে হতেই পারমিতার প্রচণ্ড হতাশ লাগছিল। কি করবে বুঝতে না পেরে নিঃশব্দে ঘরে এসে বসে আছে। পারমিতা ভেবেই নিয়েছিল। অনিরুদ্ধর মতো প্রণয় হয়ত একগাদা মিথ্যা কথা বানিয়ে বলবে পারমিতাকে। পারমিতা কৌতূহল চেপে বলল,
“আপনার অসুবিধা না থাকলে এখুনি বলুন।”
“চলো ব্যালকনিতে যাই। যদিও হিয়া ঘুমিয়ে আছে। তবুও হিয়ার সামনে এসব ব্যাপারে আলোচনা করতে চাচ্ছি না।”
পারমিতা মাথা নেড়ে সায় দিল। প্রণয় পারমিতার একহাত ধরে নিয়ে গেল ব্যালকনিতে। প্রণয় রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা রেকর্ড করা অডিও ক্লিপ ছেড়ে দিয়ে ফোনটা পারমিতার হাতে তুলে দিল। বলল,
“এটা শুনো। আমি এতক্ষণ কোথায় ছিলাম। এইটা শুনলে সবকিছু বুঝতে পারবে।”
পারমিতা খুব মনোযোগ দিয়ে রেকর্ডটা শুনলো। একবার না দুইবার শুনলো।
এতক্ষণ প্রণয়কে মিছিমিছি ভুল বুঝার জন্য মনে মনে খুব অনুতপ্ত হলো পারমিতা। ছিঃ.. একটা মেয়েমানুষের মন-মানসিকতা কতটা নিচ জঘন্য হতে পারে। এই রেকর্ডটা না শুনলে বুঝতেই পারত না পারমিতা। পারমিতার গা গুলিয়ে উঠছে। ইচ্ছে করছে ওই মহিলার চুল টেনে ছিঁড়ে দিতে। অন্যের স্বামীর দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেওয়ার শখ সারাজীবনের মতো মিটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
প্রণয় বলল,
“এই মহিলাকে কখনো প্রশ্রয় দেবে না। আর হিয়ার আশেপাশে তো ভুলেও যেতে দেবে না। যে মহিলা নিজের স্বার্থের জন্য আমার সংসার ভাঙার নোংরা ছক কষতে পারে। সেই মহিলা সুযোগ পেলে আমার মেয়ের মন আমার বিরুদ্ধে বিষিয়ে দেবে না তার কি গ্যারান্টি। তুমি একটা কাজ করবে পারমিতা?”
“কি করতে হবে বলুন?”
“হৈমন্তীর মাকে আমি এই রেকর্ডটা শুনাতে পারব না। আমার লজ্জা লাগছে। আমার হয়ে তুমি একটু এই ক্লিপটা ওনাকে শুনাবে? ওনারও জানা উচিৎ ওনি দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষছে।”
“অবশ্যই শুনাব। তাছাড়া আমি দেখালে ওই মহিলা সন্দেহও করতে পারবে না। আপনি আমার ফোনে সময় করে এটা দিয়ে রাখবেন।”
প্রণয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল পারমিতাকে। পারমিতার কাঁধে চিবুক রেখে ফিসফিস করে বলল,
“ভাগ্যিস রেকর্ডটা করে রেখেছিলাম। নাহলে তুমিও হৈমন্তীর মতো আমাকে ভুল বুঝতে। হয়ত মনের দিক থেকেও দূরে সরে যেতে। যদিও তোমার মনের কাছাকাছি এখনো আসতে পারিনি।”
পারমিতার বুকের ভেতর কামড়ে ধরল। অনুশোচনা শতগুণ বেড়ে গেল। পারমিতা সামনে ঘুরে প্রণয়কে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল। প্রণয় নিজের বুকের ভেতর পিষে ফেলল পারমিতাকে। বলল,
“কাঁদছ কেন? কেঁদো না প্লিজ…”
পারমিতা হেঁচকি তুলে বলল,
“আমি সত্যিই আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম।”
প্রণয় থমকে গেল। পারমিতা বলল,
” কাঁচা ঘুম ভেঙে আপনাকে না দেখে আমি খুঁজতে খুঁজতে ড্রয়িংরুমে চলে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি…
প্রণয় পারমিতার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আবারও বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
“কি দেখেছিলে?”
“দেখি ওই মহিলা আপনাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। একমুহূর্তের জন্য আমার পুরো পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। আমি আবারও ঠকে গেলাম ভাবতে গিয়ে আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। ধরেই নিয়েছিলাম আপনিও অনিরুদ্ধর মতো একগাদা মিথ্যা কথা বানিয়ে বলবেন আমাকে। যে দৃশ্য একটু আগে নিজের চোখে দেখে এসেছি। তা আপনি অস্বীকার করবেন। এবারও হয়ত আমার সংসারটা টিকবে না। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই পারমিতা। একটা সত্যি লুকাতে একশোটা মিথ্যা বলতে হয়। এমনিতেই তো পাপের শেষ নেই। জেনেশুনে পাপ বাড়িয়ে কি লাভ বলো। একদিন তো সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাব দিতে হবে। তাছাড়া তুমি কি আমার কথা শুনোনি? আমার কথা শুনলে তো আমাকে ভুল বুঝতে না।”
“আপনাদের ওই অবস্থায় দেখে আমার আর কোনো কথা শোনার মনমানসিকতা ছিল না। আমি আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। তখুনি ঘরে চলে এসেছি। মনের দিক থেকে প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি।”
“সবসময় চোখের দেখা সত্যি হয় না। ভাগ্যিস রেকর্ডটা করে রেখেছিলাম।”
“ওনি আপনার এতবড়ো ক্ষতি করার পরও এই মহিলাকে এই বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছেন কেন?”
“আমি বাড়িতে প্রবেশ করার আগেই তো মহিলা ঢুকে গেছে। তাছাড়া তুমি এই বাড়িতে নতুন এসেছ। ওনার সম্পর্কে কিছুই জানো না। তোমার সামনে সিনক্রিয়েট করতে চাইনি। ভেবেছিলাম আড়ালে ডেকে চলে যেতে বলব। তার আগেই এত বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। বুঝ হবার পর থেকে আমি আমার জীবনে কাউকে এতটা ঘৃণা করিনি। যতটা ঘৃণা ওনাকে করি আমি।”
পারমিতা বলল,
“আমি যদি ওনাকে আড়ালে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেই। আপনি কি মাইন্ড করবেন?”
প্রণয় হেসে ফেলল। সত্যিকারের মন ভালো করা হাসি। পারমিতার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“মোটেও না। বরং প্রচণ্ড খুশি হবো আমি।”

(চলবে)