#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৭
রেখা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রনিতার কু-র্কীতি মানতেই পারছে না রেখা। বুকের ভেতর হাহাকার। প্রেসার বেড়ে গেছে। দুইবার বমি করেছে। ঘাড়ে চিনচিনে ব্যথা। মাথা তুলে বসে থাকতে পারছে না। পারমিতা তেঁতুলগোলা নিয়ে এলো। বলল,
“এটা খেয়ে নিন মা।”
রেখা শুয়ে ছিল। পারমিতা রেখাকে ধরে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। রেখা তেঁতুলের গ্লাস হাতে নিয়ে খেল। তারপর পারমিতার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল। বলল,
“আমাকে ক্ষমা দিস রে মা। তোকে ভুল বুঝে কত কথা শুনিয়েছি।” রেখার কণ্ঠে অনুশোচনা ঝরে পড়ছে। পারমিতা রেখার একহাত ধরে বলল,
“আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন! আপনি তো আর জানতেন না সর্ষের ভেতরে ভূত লুকিয়ে ছিল।”
রেখা নরম স্বরে বলল,
“আমার একটা কথা রাখবি মা?”
পারমিতা বলল,
“কি কথা?”
“আগে বল রাখবি।”
পারমিতা আগেপিছে না ভেবে বলল,
“রাখব।”
রেখা ইতস্তত করে বলল,
“বড়ো বউমার কু্র্কীতির কথা তোরা আমার বড়ো ছেলেকে বলিস না। ওদের সংসারটা ভেঙে যাক আমি চাই না।”
পারমিতা হতবাক হয়ে গেল। বলল,
“কেন মা? তার-ও তো জানা উচিত।”
রেখা কেঁদে দিল। বলল,
“হয়ত জানা উচিত। জানলে কি হবে বল? আমি তো আর হৈমন্তীকে ফিরে পাব না। আজ আমার বড়ো খোকা যদি ভুলেও এই ব্যাপারে কিছু জেনে যায়। তাহলে ওদের সুখের সংসারে আগুন লেগে যাবে। কে বলতে পারে, এই ঘটনার জের ধরে ওদের ছাড়াছাড়িও হয়ে যেতে পারে। আর এটাই হয়ত উচিত ছিল। কিন্তু আমি তো মা। আমাকে সবদিকই ভাবতে হবে। আজ যদি বড়ো বউমার সাথে বড়োখোকার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বড়ো খোকা আবার বিয়ে করবে। বড়োবউমাও হয়ত বিয়ে করবে। কিন্তু আমার নাতি-নাতনি দুটো? ওদের বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হলে সবচেয়ে বাজে প্রভাব পড়বে ওদের উপরে। ওরা আর পাঁচটা বাচ্চার মতো হেসে খেলে বড়ো হতে পারবে না। শারীরিক ভাবে না হোক মানসিক ভাবে বাবা-মাকে সারাজীবনের জন্য হারাবে। প্রতিটা পদে পদে ওদের লাঞ্ছণা সহ্য করতে হবে। মেয়েটা বড়ো হলে হয়ত ভালো ঘরে বিয়েও হবে না। মায়ের অতীত জেনে গেলে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এই ঘটনা জানাজানি হলে কারো কিছুই হবে না। শুধু মাঝখান থেকে সারাজীবনের জন্য আমার নাতি-নাতনি দুটো বাবা-মা হারাবে। ওদের শৈশব নষ্ট হয়ে যাবে। জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকবে ওরা। আমি একজন মা হয়ে আরেকজন মায়ের কোল খালি করতে পারব না।”
“এতবড়ো অন্যায়ের কথা জানার পরও ওনাকে ছেড়ে দিবেন আপনি?”
“একটা মানুষের জন্য যদি তিনটা মানুষ ভালো থাকে। তাহলে মাঝে মাঝে ছেড়ে দিতে হয়। একজনের জন্য আমি তিনটা জীবন নষ্ট করতে পারি না।”
“আপনার ছেলের তো জানা উচিত তার বউয়ের আসল রূপ।”
“কিছু কিছু তিক্ত সত্যি আড়ালে থাকা ভালো।”
“এটা অন্যায় আবদার মা। আপনি জেনেশুনে আপনার বড়ো ছেলেকে ঠকাচ্ছেন।”
“ওর ঠকে যাওয়ার বিনিময়ে আমার নাতি-নাতনি দুটো সুস্থ জীবন পাক। সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ওঠুক। ভালো থাকুক ওরা। তাছাড়া এখন থেকে বড়ো বউমাকে আমি কড়া নজরে রাখব। যদি আর কখনো এমনকিছু দেখি বা শুনি ভয় দেখাব। আশা করি শুধরে যাবে।”
“যার নয়ে শিক্ষা হয় না। তাকে নব্বইতেও শিক্ষা দিতে পারবেন না।”
“একবার চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কি!”
ওরা কথা বলতে বলতে হিয়া স্কুল থেকে এসে পারমিতাকে ডাকতে লাগল। রেখা চোখের জল মুছে বলল,
“যাও। দিদিভাই এসে গেছে।”
পারমিতা উঠে চলে গেল। হিয়া পারমিতাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। গাল ফুলিয়ে বলল,
“আগামীকাল থেকে তুমি আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে মা। দাদু খুব পঁচা। আমাকে আইসক্রিম কিনে দেয়নি।”
পরেশ বাবু হেসে ফেলল। হিয়ার গাল টেনে দিয়ে বলল,
“ওসব হাবিজাবি খেতে দিলেই ভালো আর না দিলেই দাদু পঁচা।”
পারমিতা হিয়াকে বুঝিয়ে বলল,
“দাদু তোমার ভালোর জন্যই বারণ করেছে মা। এগুলো খাওয়া ভালো না। বাইরে থাকে। বাতাসে ধুলোবালি যায়। তাছাড়া কিসব ক্রেমিক্যাল দিয়ে বানায় ঠাকুর জানে। তোমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে তো? আচ্ছা আমি বানিয়ে দেব।”
হিয়া খুশি হলো খুব। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
“তুমি আইসক্রিম বানাতে পারো মা?”
পারমিতা হেসে ফেলল। বলল,
“পারি একটু একটু।”
“তাহলে চলো এখুনি বানিয়ে দেবে।”
“এখন না সোনা। বিকালে বানাব। আগে চলো স্নান করবে। তারপর ভাত খেয়ে ঘুম দেবে।”
পারমিতা হিয়াকে নিয়ে ঘরে চলে গেল। পেছন থেকে সেই দৃশ্য দেখে পরেশ বাবুর দুচোখ জুড়িয়ে গেল। প্রণয় এতদিনে একটা কাজের কাজ করেছে। মানুষ চিনতে ভুল করেনি প্রণয়। হিয়ার জন্য সত্যিকারের মা খুঁজে এনেছে। মেয়েটা দেখতেও যেমন লক্ষ্মীমন্ত্র, কথাও বলে গুছিয়ে সুন্দর করে। আর মিশুক খুব। নাহলে হৈমন্তীর মাকে এত সম্মান দিয়ে কথা বলত না।
বিকালে হিয়ার আবদারে আইসক্রিম বানাতে গেল পারমিতা। হিয়াও পারমিতা পিছু পিছু ঘুরঘুর করছে। আইসক্রিম বানাতে যা যা লাগে একফাঁকে শ্বশুরকে দিয়ে বাজার থেকে আনিয়েছে। গরুর দুধটা অবশ্য ফ্রিজেই ছিল। হিয়ার কৌতূহলের শেষ নেই। আইসক্রিম কীভাবে বানায় খুব কৌতূহল নিয়ে দেখছে হিয়া। পারমিতার হাতে হাতে এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছে। হিয়া ছোটো মানুষ। কাজ করার ব্যাপক আগ্রহ। পারমিতা হিয়ার আগ্রহ নষ্ট করে না। এভাবে একটু একটু করে শিখবে। সবকিছুতে আগ্রহ থাকা ভালো।
পারমিতা একটা কড়াইতে এক লিটার গরুর দুধ ভালো করে জ্বাল দিয়ে নিল। জ্বাল দেওয়া দুধ নামিয়ে রেখে আবার কড়াইয়ে এককাপ পাউডার দুধ দিল। আধাকাপ কনডেন্সড মিল্ক দিল। পরিমাণ মতো চিনি দিল, রসের গুড় দুই চামচ দিয়ে আগে থেকে জ্বাল করে রাখা দুধটা ঢেলে দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিল। তারপর মিডিয়াম আঁচে জ্বাল করে ঘন করে নিল। তারপর বাজার থেকে কিনে আনা টপিক্যাল হোয়াইট ক্রিম এককাপ পরিমাণ মতো নিয়ে ভালো করে ফেটে নিল। তারপর জ্বাল করা ঘন দুধের মিশ্রনটা ঠাণ্ডা করে নিয়ে টপিক্যাল হোয়াইট ক্রিমের সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে একটা ইয়ার টাইট আইসক্রিম বক্সে ঢেলে নিল। তার উপরে কিছু কিসমিস, কাঠবাদাম কুঁচি, কাজুবাদাম কুঁচি দিয়ে বাক্সটা ভালো করে বন্ধ করে ১০ থেকে ১২ ঘন্টার জন্য ডিপফ্রিজে রেখে দিল। হিয়া বলল,
“আইসক্রিম হতে আর কতক্ষণ লাগবে মা?”
পারমিতা হিয়ার গাল টেনে দিল। বলল,
“আগামীকালই খেতে পারবা সোনা।”
“এত দেরি?”
“একটু অপেক্ষা তো করতেই হবে।”
“মা..”
“বলো হিয়ামণি?”
“আজকে বাবার জন্মদিন।”
“সত্যিই?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি জানলে কীভাবে?”
“আমার মনে আছে। তাছাড়া দাদু আসার সময় বাবার জন্য কেক অর্ডার দিয়ে এসেছে। প্রতিবছর কেক কেটে দাদু আর আমি বাবার জন্মদিন সেলিব্রেট করি।”
“আমাকে আগে বলোনি কেন সোনা?”
“আমি তো ভেবেছি তুমি জানো।”
পারমিতা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। বলল,
“উফ, আমার তো মনেই নেই। আচ্ছা সোনা তোমার বাবার সবচেয়ে পছন্দের খাবার কি বলোতো?”
“বিরিয়ানি। কেন তুমি জানো না?”
“জানি তো।”
“তাহলে জিজ্ঞেস করলে যে?”
“দেখলাম তোমার মনে আছে নাকি!”
হিয়া হাসল।
পারমিতা ঘড়ি দেখল। বিকেল পাঁচটা বাজে। প্রণয় আসবে আরও পাঁচ/ছয় ঘণ্টা পরে। যা করার এখুনি করতে হবে। ইশ আগে জানলে ভালো হতো। পারমিতা ফ্রিজ থেকে মাংস, দুধ বের করে জলে ভিজাতে দিল। ঘরে পোলাও চাল, বিরিয়ানির মসলা নেই। শেষ হয়ে গেছে। পারমিতা কাজের মাসিকে দিয়ে আনিয়ে নিল। হিয়া বলল,
“বাবার জন্মদিন বড়ো করে সেলিব্রেট করবে নাকি মা?”
“বড়ো করে বলতে তোমার বাবার পছন্দের খাবার রান্না করব। তারপর সবাই একসাথে বসে খাব।”
“খুব মজা হবে মা।”
পারমিতা নিজের হাতে বিরিয়ানি, পায়েস রান্না করল। ডিম সেদ্ধ করে হালকা নুন হলুদে ভেজে নিল। আরও কিছু রান্না করার ইচ্ছে ছিল। ঘরটাও তো সাজাতে হবে। সময়ের অভাবে রান্না করা হলো না।
ওদের ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলল। বড়ো জন্মদিনের ব্যানার টানিয়ে বেলুন দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলল। তারপর ট্রি-টেবিলের উপরে কেক রেখে কেকের চারপাশে গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলল।
তারপর হিয়াকে রেডি করিয়ে দিয়ে নিজেও রেডি হয়ে নিল পারমিতা। সবই তো হলো। এখন কি গিফট দেওয়া যায়। তাই তো বুঝতে পারছে না পারমিতা। অবশ্য একটা ফুলের বুফে কিনে আনিয়েছে। পারমিতার কাছে তো টাকাও নেই। প্রণয় যা দিয়েছিল। তা আজকে টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে আনতে টাকাগুলো খরচ হয়ে গেছে।
পারমিতা আর হিয়া প্রণয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। আজ রাত দশটার পর পরই ফিরে এলো প্রণয়। পাপাকে দেখে হিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল। মা-মেয়েকে এতরাতে সাজুগুজু করে বসে থাকতে দেখে প্রণয় পারমিতাকে শুনিয়ে হিয়াকে বলল,
“আজ কোনো স্পেশাল দিন নাকি মা?”
“হ্যাঁ পাপা। খুব স্পেশাল দিন।”
“পাপার কানে কানে বলো? আজকে কি?”
“এখুনি বলা যাবে না পাপা। আগে গিয়ে স্নান করে নতুন পোশাক পরে আসো।”
“আমাকেও নতুন জামা পরতে হবে?”
“হ্যাঁ পাপা।”
প্রণয় ঘরে যেতে নিল। হিয়া পেছন থেকে প্রণয়ের হাত ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“ঘরে যাব মা।”
“এখন ঘরে যাওয়া যাবে না। ওই বাথরুমে তোমার জামা-কাপড় রাখা আছে। দ্রুত স্নান করে আসো।”
“কি ব্যাপার বলোতো পারমিতা?”
পারমিতা মুখে হাসি টেনে বলল,
“সবকিছুতে এত কৌতূহল ভালো না। মেয়ে যা বলছে তাই শুনুন।”
প্রণয় বাথরুমে গিয়ে স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে এলো। ড্রাইনিংয়ে বসতে বসতে বলল,
“বিরিয়ানির ঘ্রাণ পাচ্ছি। আজ বাড়িতে বিরিয়ানি রান্না হয়েছে নাকি? খেতে দাও, খুব খিদে লেগেছে।”
হিয়া বাবার একহাত টেনে ধরল। বলল,
“একটু পর আমরা সবাই একসাথে বসে খাব পাপা। তার আগে ঘরে চলো দাদু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
প্রণয় হিয়াকে কোলে তুলে নিল। একহাত দিয়ে পারমিতার হাতখানা আলতো করে ধরল। তারপর দুজনকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ঘরে চলে গেল। ঘরে গিয়ে প্রণয় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। হিয়া বলল,
“হ্যাপি বার্ডডে পাপা..”
“রোগী দেখার চত্ত্বরে আমার তো মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। যে আজ আমার জন্মদিন।”
“মা সবকিছু করেছে।”
প্রণয়ের ভালো লাগছে খুব। এই মেয়েটা আর কতভাবে প্রণয়কে মুগ্ধ করবে। প্রণয় হিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। পরেশ বাবু ছেলের মাথায় হাত রাখল। বলল,
“আমি তোকে মন ভরে আশীর্বাদ করি সুখী হও জীবনে।”
পারমিতা রেখাকে ডেকে নিয়ে এলো। কাজের মাসি দুজনকেও ডাকল। সবার সামনে কেক কাটল প্রণয়। এক টুকরো কাটা কেক উঠিয়ে প্রথমে নিজের বাবাকে খাইয়ে দিল। তারপর হিয়াকে ও পারমিতাকে খাইয়ে দিল। রেখাকে ও কাজের মাসি দুজনকেও কেক খাইয়ে দিল প্রণয়। প্রণয়কেও সবাই কেক খাইয়ে দিল। তারপর সবাই একসাথে খেতে বসল। এমন করে জন্মদিন পালন করা হতো সেই ছোটোবেলায়। মা ঘরোয়া ভাবে আয়োজন করত। প্রণয়ের পছন্দের সব খাবার নিজের হাতে রান্না করত মা। কি যে আনন্দ হতো।
ওদের বিয়ের পর হৈমন্তী আর ও বাইরে খেত। ওখানেই কেক কাটত। হৈমন্তী মারা যাওয়ার পর বাবা শুধু একটা কেক কিনে এনে প্রণয়কে দিয়ে কাটাত। অনেকগুলো বছর পর সেই ছোটোবেলার মতো আনন্দ হচ্ছে। কী যে ভালো লাগছে প্রণয়ের বলার মতো না।
সবাই গিফট দিয়েছে প্রণয়কে। কাজের মাসি দুজনও গিফট দিয়েছে। একজন কলম দিয়েছে, আরেকজন একটা বক্সে করে কি দিয়েছে এখনো দেখেনি। গিফট, ছোটো হোক কিংবা বড়ো। গিফট পেতে কার না ভালো লাগে।
হিয়ার আগেই ঘুমানোর অভ্যাস। আজ বাবার জন্মদিন পালন করার জন্য অনেক কষ্টে জেগে ছিল মেয়েটা। খাওয়ার সময়ই ঘুমে দুচোখ বুঁজে আসছিল। কোনমতে খাওয়া শেষ করে সোফায় গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে হিয়া। প্রণয় খাওয়া শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। পারমিতাকে ইশারায় কাছে ডেকে বলল,
“ধন্যবাদ পারমিতা। আমি ভাবতেই পারিনি আমার রাতটা আজ এত সুন্দর করে দেবে তুমি। সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে মনে খুব প্রশান্তি অনুভব করছি। সবাই গিফট দিল। তুমি তো কিছু দিলে না আমাকে?” প্রণয় ইচ্ছে করেই কথাটা বলল। পারমিতার মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রণয় গাঢ় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“মন খারাপের কিছু নেই। দ্রুত কাজ শেষ করে ঘরে চলে আসো। আমার গিফট আজ তোমার কাছ থেকে চেয়েই নেব আমি। না দিলেও জোর করে আদায় করে নেব।” প্রণয়ের কণ্ঠে আবেগ, চোখে একরাশ মুগ্ধতা। পারমিতার গা শিরশির করে উঠল।
(চলবে)
#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ২৮
তখন প্রণয় আবেগঘন কণ্ঠে যে কথা বলে গেছে। চটপটে হাতে কাজ সেরে এখন ঘরে যেতে পারমিতার খুব লজ্জা লাগছে। পারমিতা কি করবে বুঝতে না পেরে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসল। টেলিভিশন ছেড়ে আনমনা হয়ে একেক পর এক চ্যানেল পাল্টাতে লাগল। যদিও টেলিভিশন দেখায় পারমিতার মনযোগ নেই।
“পারমিতা?’’
প্রণয়ের ডাক শুনে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাল পারমিতা৷ বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। প্রণয় হেঁটে এসে পারমিতার গা ঘেষে বসল। বলল,
“কি করছ?”
পারমিতা ইতস্তত করে বলল,
“কিছু না।”
“তাহলে ঘরে যাচ্ছ না কেন?”
পারমিতা কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। প্রণয় আলতো করে পারমিতার একহাত ধরল। পারমিতা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। প্রণয় বলল,
“তুমি কি আমার উপরে এখনো রেগে আছো পারমিতা?”
পারমিতা প্রয়ণের চোখের দিকে তাকাল। মাথা এপাশ-ওপাশ করে ইশারায় না বোঝাল। প্রণয় হাসল। মুখটা উপরের দিকে তুলে দিয়ে ঘাড়ের সাথে মাথা এলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রণয়।
বলল,
“মিথ্যা বলছ তুমি।”
পারমিতা মাথা নিচু করে ফেলল। সত্যি বলতে, প্রণয়ের উপরে এখন আর কোনো অভিযোগ নেই। তবে অভিমান আছে। প্রণয় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“অনেক রাত হয়েছে। শুতে চলো প্লিজ…”
পারমিতা উঠে দাঁড়াল। ঠিক সেই মুহূর্তে পারমিতার হাতে ধরে রাখা ফোনটা তারস্বরে বেজে উঠল। দুজনই চমকে উঠে ফোনের দিকে তাকাল। প্রণয় ঘড়ি দেখল। বলল,
“এতরাতে কে ফোন দিয়েছে?”
ভয়ে ঘামছে পারমিতা। প্রণয় বলল,
“ফোনটা কেটে যাচ্ছে তো, ধরো…দরকারি ফোনও তো হতে পারে।”
তবুও ফোনটা রিসিভ করল না পারমিতা। প্রণয় বলল,
“ফোনটা আমার হাতে দাও? দেখি, এতরাতে কে ফোন দিয়েছে।”
পারমিতা কাঁপা হাতে ফোনটা প্রণয়ের কাছে দিয়ে দিল। প্রণয় ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলার আগে ফোনের অপর পাশ থেকে অনিরুদ্ধ বলল,
“এতবার ফোন দিচ্ছি ফোনটা ধরছ না কেন? শুয়ে শুয়ে বরের আদর খাচ্ছ বুঝি। খুব আদর করে নাকি তোমার বর তোমাকে? তাই হয়তো আমার কথা একটুও মনে পড়ে না তোমার।”
প্রণয় হতভম্ব হয়ে গেল। ফোনটা কানের সাথে আর একটু শক্ত করে চেপে ধরে, অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পারমিতার দিকে। পারমিতা ইশারায় জিজ্ঞেস করল। ‘কি হয়েছে?’
অনিরুদ্ধ বলল,
“কি হলো কথা বলছ না কেন, পারু? পাশে তোমার বর শুয়ে আছে নাকি? শালা এখনো ঘুমায়নি? তোমাকে বড্ড মিস করছি পারমিতা৷ তুমি প্লিজ আমার কাছে চলে আসো পারু। গড প্রমিস সারাজীবন মাথায় করে রাখব তোমাকে।”
আর কিছু শোনার রুচি হলো না প্রণয়ের। ফোনের লাইন কেটে দিল। পারমিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“তোমার প্রাক্তনের সাথে কতদিন যাবৎ যোগাযোগ রাখছ?”
অজানা ভয়ে পারমিতার বুকে ভেতর কি যেন কামড়ে ধরল। মুখটা আতঙ্কে একটুখানি হয়ে গেছে। চোখদুটো ছলছল করছে। জানোয়ারটা আর কতভাবে পারমিতার গুছানো জীবনটা দূর্বিষহ করে দেবে। ও কি একটুও শান্তিতে বাঁচতে দেবে না পারমিতাকে?
“কথা বলছ না কেন পারমিতা?”
পারমিতার বুকের ভেতর ভেঙে এলো। দুইহাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে দিল মেয়েটা। পারমিতার কান্নার অন্য মানে বের করে প্রণয় বোধহয় ভুল বুঝল পারমিতাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“প্রথম বিয়ে বা ভালোবাসা সহজে ভোলা যায় না। অপর পাশের মানুষটা যতই খারাপ হোক। যতই ঠকিয়ে দূরে সরিয়ে দিক, মনের কোথাও না কোথাও মানুষটার জন্য একটা টান কিংবা সফট্ কর্ণার ঠিকই থেকে যায়।”
পারমিতা শব্দ করে কেঁদে দিল। প্রণয় মলিন কণ্ঠে বলল,
“তুমি কি এখনো তোমার প্রাক্তনকে ভালোবাসো?”
পারমিতা কথা বলল না। হয়তো প্রণয়ের কথাটা শুনতেই পায়নি। প্রণয় বলল,
“ ইশ, আমি কি বোকা! এখন বুঝতে পারছি তুমি কেন আমাদের বিবাহিত সম্পর্কে আগ্রহ দেখাওনি। আসলে এখনো তুমি তোমার প্রাক্তনকে ভুলতে পারোনি। তাই এতদিন আমাকে তোমার কাছে যেতে দাওনি। কেন এমন করলে পারমিতা? লোকটা তো তোমাকে খুব বাজে ভাবে ঠকিয়েছে। তারপরও…
পারমিতা ফুঁপিয়ে উঠল। বলল,
“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”
প্রণয় রেগে গেল। আচমকা পারমিতার দুইকাঁধ চেপে ধরে বলল,
“তাহলে ঠিকটা তুমিই বলো? কেন ওই লোকটা এতরাতে তোমাকে ফোন দিয়েছে?”
“আমি জানি না।”
“তুমি জানো পারমিতা। শুধু আমাকে বলছ না।”
প্রণয় পারমিতাকে ছেড়ে দিল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“অনেক রাত হয়েছে। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
কথাগুলো বলে প্রণয় চলে যেতে নিল। পেছন থেকে প্রণয়ের শার্টের কোণা টেনে ধরল পারমিতা। প্রণয় দুচোখ বুঁজে ফেলল। পারমিতা কয়েকপা হেঁটে এসে প্রণয়ের মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল,
“আপনি আমাকে ভুল বুঝে এভাবে চলে যেতে পারেন না।”
“(নিশ্চুপ।)”
“লোকটা বেশকিছু যাবৎ আমাকে ডিস্টার্ব করছে।”
“মিথ্যা বলো না।”
“সত্যি বলছি।”
“তুমি আমার স্ত্রী। তোমার ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার। কথা ছিল, অতীতে আমাদের জীবনে যা কিছু হয়ে যাক না কেন! বর্তমানের কোনো কথা আমরা একে-অপরের কাছে কখনো গোপন রাখব না। একটা লোক তোমাকে বেশকিছুদিন যাবৎ ডিস্টার্ব করছে। অথচ আমি তোমার হাজবেন্ড৷ সবার আগে কথাটা আমার জানা উচিত ছিল। আমি কিছুই জানি না। কেন আমাকে আগে বলোনি?”
“বলিনি তার কারণ…
“তার কারণ কি পারমিতা? এখনো ভালোবাসো তুমি তোমার প্রাক্তনকে?”
“চুপ করুন আপনি। ওই লোকটাকে ঘৃণা করি আমি। প্রচণ্ড ঘৃণা করি।”
“ঘৃণাই যদি করতে তাহলে আমাকে একবারও বললে না কেন?”
পারমিতা অধৈর্য হয়ে বলল,
“আমি কি করে বোঝাই আপনাকে। এই কয়দিন আপনার উপর দিয়ে যা গেল, নতুন করে আমি আর মানসিক অশান্তি দিতে চাইনি।”
“এখানে মানসিক অশান্তির কিছু নেই। আমার একটাই আফসোস তুমি আমাকে আগে কেন বললে না?”
“বলতাম তো। কেন এভাবে কথা বলছেন আপনি? আমার কথা বিশ্বাস করছেন না কেন আপনি?”
“বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছ তুমি?”
“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন৷ আপনি যা ভাবছেন তা নয়।”
“ওকে আমি মেনে নিলাম। তুমি ঠিক। তাহলে এতরাতে ঘরে না গিয়ে এখানে কি করছ? তোমার তো ঘরে যাওয়ার কথা ছিল। আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম পারমিতা। তুমি যে আমাকে ফাঁকি দিয়ে তোমার প্রাক্তনের ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলে একদম বুঝতে পারিনি।”
প্রণয় চলে যেতে নিল। আবারও পেছন থেকে প্রণয়ের একহাত শক্ত করে ধরে ফেলল পারমিতা। মরিয়া হয়ে বলল,
“আপনি আমাকে ভুল বুঝে কিছুতেই চলে যেতে পারেন না।”
“অনেক রাত হয়েছে আমি ঘুমাব।”
পারমিতা অভিমান করে প্রণয়ের হাতখানা ছেড়ে দিল। প্রণয় ভেবেছিল, পারমিতা আরও কিছু বলবে। সত্যিই যদি পারমিতাকে ভুল বুঝে থাকে প্রণয় সেই ভুল ভাঙাবে। তার কিছুই হলো না। মনোকষ্ট গোপন করে শুতে চলে গেল প্রণয়।
পারমিতা সোফায় বসে পড়ল। দুইহাতে নিজের চুল টেনে ধরে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাল মেয়েটা। কেন পারমিতাকে কেউ বুঝে না। সবাই কেন ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দেয়। কেন দোষ না করেও বার বার কষ্ট পেতে হয় পারমিতাকে? কি করে প্রণয়কে বোঝাবে পারমিতা। কি করে প্রণয়ের ভুল ভাঙাবে। ভুল হয়েছে। বড্ড ভুল হয়েছে। ফোনের রেকর্ড অপশনটা চালু করে রাখা উচিত ছিল। অমানুষটা প্রণয়কে কি এমন বলেছে কে জানে!
না … এভাবে ভুল বুঝে দূরে সরে যেতে পারে না প্রণয়।
যেভাবেই হোক প্রণয়ের ভুল ভাঙাতে হবে।
এখুনি কথা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলবে পারমিতা। পারমিতা নিজের মনকে শক্ত করে চোখের জল মুছে ফেলল। ঘরে গিয়ে দেখল, প্রণয় কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে। চোখদুটো খোলা। পারমিতা বড়ো সাহস করে প্রণয়ের গা ঘেঁষে পেটের কাছে গিয়ে বসল। প্রণয় চোখ তুলে পারমিতার ফোলা ফোলা চোখের দিকে তাকাল। পারমিতা বলল,
“আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে।”
“আগামীকাল শুনব তোমার কথা। আমার সকালে ডিউটি আছে।”
পারমিতা জেদি কণ্ঠে বলল,
“সারারাত লাগবে না আপনার সাথে কথা বলতে। জাস্ট দশ মিনিট কথা বলব।”
প্রণয় কিছুই বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল পারমিতার দিকে। আবারও সেল ফোনটা বেজে উঠল। পারমিতা ফোন কেটে দিল। ফোনটা যতবার কেটে দেয় পারমিতা। ফোনটা ততবার বেজে উঠে। প্রণয় উঠে দাঁড়াল। অন্যঘরে যেতে যেতে বলল,
“তোমার বোধহয় আমার সামনে কথা বলতে অসুবিধা হবে। তারজন্য ফোনটা ধরছ না। ঠিকাছে আমি অন্যঘরে যাচ্ছি। তুমি প্লিজ কথা বলো।”
আবারও ভুল বুঝে চলে গেল প্রণয়। পারমিতা হতাশায় ডুবে গেল। ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দিল।
বালিশে মুখ গুঁজে অঝরে কাঁদতে লাগল পারমিতা।
সারারাত না ঘুমানোর ফলে ভোরের দিকে চোখটা লেগে গেল। ঘুম ভাঙল হিয়ার ডাকে। পারমিতা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। অস্ফুট স্বরে বলল,
“কি..কি হয়েছে?”
“কিছু না মা। তবে ঘুম থেকে উঠে পাপাকে কোথাও দেখলাম না। তাই তোমার কাছে জিজ্ঞেস করতে এলাম।”
“তোমার পাপা কোথায় গেছে হিয়ামনি?” পারমিতার খুব চিন্তা হচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে ফোনটা খুঁজতে লাগল পারমিতা। হিয়া ফোনটা ফ্লোরে পেল। পারমিতার হাতে দিয়ে বলল,
“পাপাকে একটা ফোন দাও তো মা।”
পারমিতা ফোন চালু করে প্রণয়কে ফোন দিল। প্রণয় ফোন রিসিভ করল না। দুইবার রিং হওয়ার পর এখন ফোনটা বন্ধ বলছে।
“পাপা ফোন ধরছে না কেন মা?”
পারমিতা হিয়াকে ভরসা দিয়ে বলল,
“তোমার বাবা হয়ত রোগী দেখায় ব্যস্ত আছে মা। পরে নিশ্চয়ই ফোন দেবে। চলো তোমাকে রেডি করে দেই। স্কুলে যেতে হবে তো।”
সারাটাদিন প্রণয়ের সাথে কথা হলো না পারমিতার। এই প্রথম মানুষটার শূণ্যতা মন থেকে অনুভব করছে পারমিতা।
(চলবে)