#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ৩৩
“মা..মা কোথায় তুমি?”
পারমিতা বাথরুমে অসচেতন হয়ে পড়ে আছে। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। হিয়ার ব্যাকুল হয়ে মাকে ডাকার শব্দ পারমিতা শুনতে পাচ্ছে, তবে দরজা খুলে মেয়ের কাছে আসার শক্তিটুকু শরীরে অবশিষ্ট নেই। পারমিতা ফুঁপিয়ে উঠল। চোখে-মুখে একরাশ উচ্ছ্বাস।
প্রণয় ঘরে এসে হিয়াকে বলল,
“কি হয়েছে সোনা?”
হিয়া তখনো বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়ানো। ভীতু কণ্ঠে বলল,
“মা তো দরজা খুলে না পাপা।”
প্রণয় মেয়েকে ভরসা দিল। বলল,
“তুমি একটু সরে দাঁড়াও মা। আমি দেখছি।”
হিয়া মাথা নেড়ে সরে দাঁড়াল। প্রণয় বাথরুমের দরজায় নক করে বলল,
“পারমিতা, হলো তোমার? মেয়ে ডাকছে তো।”
পারমিতা কত কষ্টে যে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতেই মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। চোখে ঝাপসা দেখে, মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিল। অল্পের জন্য পড়ল না। একহাতে দেয়াল ধরে ফেলল। দেয়াল ধরে ধরে দরজা পর্যন্ত আসল। তারপর কোনমতে ছিটকানি খুলে দিল। হিয়া মাকে জড়িয়ে ধরল। হিয়াকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে পারমিতা হিয়াকে আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল। বিড়বিড় করে বলল,
“আমার মেয়ে…আমার মেয়ে ফিরে এসেছে।” উত্তেজনায় পারমিতার কণ্ঠ কাঁপছে। পারমিতা সোজা হয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দুর্বল হাতে হিয়াকে আদর করতে করতে প্রণয়ের গায়ের উপর ঢলে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল পারমিতা। হিয়া ভয় পেয়ে ‘মা’ বলে চিৎকার করে উঠল। প্রণয় আঁতকে উঠল। পারমিতার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“মায়ের কিছু হয়নি। ভয় পেও না।”
প্রণয় পারমিতাকে কোলে তুলে নিল। তারপর খাটের মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে, অনেকক্ষণ মাথায় জলপট্টি দিল। জ্বর কমার নাম নেই। তরতর করে জ্বর বাড়ছে। জ্বর বোধহয় মাথায় উঠেছে, মুখ দিয়ে সাদা ফেণা বের হচ্ছে। চোখদুটো বন্ধ। প্রণয় বাথরুম থেকে বালতি ভর্তি জল নিয়ে এলো। পারমিতার মাথায় জল ঢালল অনেকক্ষণ। তারপর ভেজা মাথা মুছিয়ে দিল। এখন গা একটু শীতল হয়ে আসছে। জ্ঞান ফিরেছে। হিয়াকে একহাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে পারমিতা। চোখ দিয়ে অঝরে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। প্রণয় পারমিতাকে ধরে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। জোর করে স্যুপ খাইয়ে দিয়ে জ্বরের ঔষধ দিল। পারমিতা হিয়াকে ইশারায় নিচু হতে বলল। তারপর চুমোয় চুমোয় হিয়ার সারামুখ ভরিয়ে দিল পারমিতা। বিড়বিড় করে বলল,
“মাকে না বলে, কোথায় চলে গিয়েছিলে হিয়ামণি? তুমি জানো না, তোমাকে না দেখলে মায়ের কষ্ট হয়। মা থাকতে পারে না।”
হিয়া পারমিতার চোখের জল মুছিয়ে দিল। বলল,
“কেঁদো না মা।”
পারমিতার চোখের জল বাঁধ মানছে না। বলল,
“তুমি আমাকে রেখে চলে গেলে আমিও হারিয়ে যাব। আর কখনো আমাকে খুঁজে পাবে না। কথা দাও, মাকে কিছু না বলে, কোথাও যাবে না তুমি।”
প্রণয় হকচকিয়ে গেল। পারমিতাকে কিছু বলতে চাইল। পারমিতা ভুলেও প্রণয়ের মুখের দিকে তাকাল না। হিয়াকে খুঁজে না পেয়ে, প্রণয় রাগের মাথায় পারমিতাকে যা-তা বলে অপমান করেছে। হয়তো তারজন্যই পারমিতা প্রণয়ের দিকে তাকাচ্ছেও না। কথাও বলছে না। এখনো অভিমান করে আছে মেয়েটা। হিয়া পারমিতার বুকে মাথা রাখল। বলল,
“আমি আর কখনো কোথাও যাব না মা। প্রমিস।”
পারমিতা হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
পরেশবাবু নাতনিকে ডাকতে এলো। বলল,
“চলো দিদিভাই, খেয়ে নেবে।”
“পরে খাব দাদু।”
“পরে না এখুন চলো তো। স্নান করে খেয়ে নেবে। তারপর মায়ের সাথে গল্প করবে।”
পারমিতা হিয়াকে বলল,
“যাও হিয়ামণি খেয়ে নাও।”
পরেশবাবু হিয়াকে নিয়ে চলে গেল। ওরা চলে যেতেই পারমিতা পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বুঁজল। যেন ও ছাড়া এখন এইঘরে আর কেউ কোথাও নেই।
প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে চাপিয়ে দিয়ে এলো। তারপর পারমিতার খুব কাছে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। প্রণয়ের আলতো স্পর্শে কেঁপে উঠল পারমিতা। প্রণয় খানিক ঝুঁকে গিয়ে পারমিতার কাঁধে হাত রাখল। পারমিতা ওপাশ ফিরে শক্ত হয়ে শুয়ে রইল। ভুলেও এদিকে তাকাল না। প্রণয় পারমিতার বাহু ধরে সামনের দিকে জোর করে ঘুরিয়ে নিল। নিচু হয়ে পারমিতার গলার ভাঁজে মুখ গুঁজল। আবেগঘন কণ্ঠে বলল,
“কথা বলবে না, আমার সাথে?”
পারমিতা উত্তর দিল না। অভিমানে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। প্রণয় মাথা তুলে পারমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে গালে একহাত রাখল। আদুরে কণ্ঠে বলল,
“সরি পারমিতা। তখন মাথা এত গরম ছিল কি বলতে কি বলেছি…
পারমিতা বলল,
“আপনি সরি বলছেন কেন! ভুল তো আমার। আসলে কি বলুন তো, বাচ্চা পেটে ধরিনি তো। তাই হয়তো মেয়ে হারানোর যন্ত্রণা অতোটা বুঝে উঠতে পারিনি।”
প্রণয়ের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। অনুশোচনা নিয়ে বলল,
“এভাবে বলো না পারমিতা। তুমিই হিয়ার মা।”
“আমি না হিয়ার মা হওয়ার যোগ্য না। আর আপনি তো হিয়ার জন্যই আমাকে বিয়ে করেছেন। হিয়ার দায়িত্ব যখন ঠিকভাবে পালন করতে পারছি না।
এককাজ করুণ, আমাকে বরং রেখে আসুন।”
প্রণয় আঁতকে উঠে পারমিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“কোথাও যেতে দেব না তোমাকে। কে বলেছে, শুধু হিয়ার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি? তুমি আমার সন্তানের মা হওয়ার আগে আমার স্ত্রী পারমিতা। আমার যেমন হিয়াকে দরকার৷ তেমন তোমাকেও দরকার। খুব দরকার। হিয়া-তুমি আমার হৃদপিণ্ডে মিশে গেছো। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারব না। আমার দুজনকেই লাগবে। সারাজীবনের জন্য লাগবে। ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। আমি আমার সন্তানের মাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।”
প্রণয়ের চোখে জল। পারমিতা আর নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখতে পারল না। শাড়ির আঁচল দিয়ে খুব যত্ন করে প্রণয়ের চোখের জলটুকু মুছিয়ে দিল। প্রণয়ের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। প্রণয় পারমিতার মাথায় চিবুক রেখে একহাতে জড়িয়ে ধরে রাখল পারমিতাক। বলল,
“বেলাশেষে একটুখানি সুখের মুখ দেখেছি। তুমি আমাদের জীবন থেকে চলে গিয়ে এই সুখটুকু থেকে বঞ্চিত কোরো না আমাদের। অনেক হারিয়েছি। আর কিছু হারাতে পারব না। তোমাকে হারানোর সহ্য ক্ষমতা আমার আর নেই পারমিতা।” কথাগুলো বলে পারমিতার কপালে গভীর চুমু এঁকে দিল প্রণয়। উত্তরে পারমিতা কি বলবে ভেবে পেল না। তবে ওর ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে।
রাতে আবারও গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো পারমিতার। জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বলছে। পারমিতার অবস্থা বেগতিক। প্রণয় কি করবে বুঝতে পারছে না। তবে এই অবস্থায় পারমিতাকে বাড়িতে রাখাও ঠিক হবে না। রাতেই পারমিতাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। কিছু টেস্ট দেওয়া হলো। শরীর দুর্বল থাকার জন্য হাতে স্যালাইন চলছে। টেস্টের রিপোর্ট স্বাভাবিক। তবে ভাইরাস জ্বর। ভয়ের কিছু নেই। ঔষধ, পথ্য ও যত্ন পেলে খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে পারমিতা। প্রণয় সারারাত পারমিতার মাথার কাছে বসে রইল। পারমিতার যত্নের কোনো ক্রুটি রাখল না। পারমিতাকে একদিন পর বাড়িতে নিয়ে এলো। এবং পারমিতার সেবাযত্ন করার জন্য একজন নার্সও নিয়ে এসেছে। তিনিই পারমিতার সেবাযত্ন করছে, টাইমে টাইমে খাবার ও ঔষধ খাওয়াচ্ছে।
পারমিতার সুস্থ হয়ে উঠতে খুব বেশিদিন লাগল না।
ওরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেল। হিয়াটা খুব পারমিতার ন্যাওটা হয়েছে। মাকে চোখের আড়াল করতে চায় না মেয়েটা।
একদিন প্রণয়ের ফোনে আননোন নম্বর থেকে ফোন এলো। ছুটির দিন। প্রণয় ঘরেই ছিল। পারমিতা রান্নাঘরে। প্রণয় ফোন রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো কে?”
“পারমিতাকে ফোনটা দেওয়া যাবে?”
“যাবে। কিন্তু কে আপনি?”
“আপনি আমাকে চিনবেন না৷ আমি পারমিতার প্রতিবেশী কাকি। খুব দরকারে ফোন করেছি। দয়া করে একটু ফোনটা ওকে দিন না।”
বলে রাখা ভালো, পারমিতা যখন সুস্থ হয়ে নিজের বাড়িতে প্রণয়ের সাথে গিয়েছিল, তখন আসার সময় প্রণয়ই নিজের ফোন নম্বরটা পারমিতার প্রতিবেশী কাকিমাকে দিয়ে এসেছিল। বলেছিল, যদি কোনোদিন পারমিতার দাদা ফিরে আসে অথবা পারমিতার খোঁজ করে। তখন যেন এই নম্বরে যোগাযোগ করে।
প্রণয় চিনতে পেরে বলল,
“সিরিয়াস কিছু কি? কি হয়েছে আমাকে বলুন, সমস্যা নেই।”
“পারমিতার দাদা ফিরে এসেছে। পারমিতার হাসপাতালে গিয়েছিল। ওখানে পারমিতাকে না-পেয়ে খুব কান্নাকাটি করছে। আপনি কি জানেন, পারমিতা এখন কোথায়?”
প্রণয় চমকে উঠে বলল,
“ওনি না ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল?”
“হ্যাঁ। নিশ্চয়ই বড়ো কোনো সমস্যা হয়েছে৷ নাহলে এতদিন পর এসে বোনকে খুঁজবে কেন?”
“আপনাকে কিছু বলেনি?”
“তেমন কিছু বলছে না। শুধু একবারের জন্য হলেও পারমিতার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। আর বার বার বলছে, ও নাকি অনেক বড়ো পাপ করেছে। পারমিতার পা ধরে মাফ না চাইলে এই পাপ কখনো মুছবে না।”
“আপনি এককাজ করুন উনাকে আমার ঠিকানা দিয়ে, এই ঠিকানায় আসতে বলুন। পারমিতার সাথে দেখা হয়ে যাবে। আমি ঠিকানা মেসেজ করে দিচ্ছি।”
কাকিমা ফোন রাখার আগে বলল,
“পারমিতা ভালো আছে তো?”
“ভালো আছে পারমিতা।”
“আপনি কি সেই ডাক্তার? যে পারমিতার সাথে এসেছিলেন।”
“হুঁ।”
“পারমিতা কি আপনাদের বাড়িতেই থাকে এখন।”
“পারমিতা আমার স্ত্রী।”
ভদ্রমহিলা মনে হয়, খুব চমকালেন। অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না। ভেজা কণ্ঠে বলল,
“মা-বাপ মরা মেয়েটাকে দেখে রাখবেন।”
পারমিতা রান্না করছিল। আজ প্রণয়ের বন্ধের দিন। পারমিতা প্রণয়ের পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করছে। খাবারের সুঘ্রাণে সারাবাড়ি ম ম করছে। প্রণয় আশপাশটা ভালো করে দেখে, পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল পারমিতাকে। পারমিতার চুলের ভাঁজে মুখ গুঁজে দিয়ে আবেশ জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“খাবারের ঘ্রাণের থেকেও তোমার শরীরের ঘ্রাণটা মারাত্মক বউ। একদম বুকে গিয়ে লাগে।”
পারমিতা নিঃশব্দে হেসে ফেলল। মিছিমিছি রাগের অভিনয় করে বলল,
“দেখি সরো তো।”
“উঁহু…সরতে ইচ্ছে করছে না।”
“তাহলে কি ইচ্ছে করছে?”
“অন্যকিছু ইচ্ছে করছে খুবউ..”
“ইশ, সরো তো। মেয়ে দেখলে কি ভাববে।”
“কিছুই ভাববে না। মেয়ে জানে, পাপা তার নিজের বউকেই আদর করছে।”
“ইশ, মুখে কিছু আটকায় না তোমার।”
“না।”
“এখন ছাড়ো…”
“পারমিতা?”
“হুঁ..
প্রণয় পারমিতাকে ছেড়ে দিয়ে চেয়ার টেনে বসল। বলল,
“প্রকৃত প্রতিশোধ খুব ভয়াবহ তাই না?”
পারমিতা বেশ অবাক হলো। বলল,
“হঠাৎ একথা বলছো কেন?”
প্রণয়ের মুখে হাসি। বলল,
“আমি না কর্মফলে খুব বিশ্বাসী।”
“যেমন?”
“যেমন ধরো, তুমি যারজন্য যতটুকু করবে, সে ভালো-খারাপ যাইহোক, একদিন আগে হোক বা পরে, তার দ্বিগুণ পরিমাণ ফেরত পাবে।”
“কি হয়েছে বলোতো?”
“যারা তোমাকে ঠকিয়েছে, তাদের সামনাসামনি দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না, কেন এভাবে ঠকালো তোমাকে।”
পারমিতা অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
“খুব ইচ্ছে করে।”
প্রণয় দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আই উইশ, তোমার ইচ্ছেগুলো খুব তাড়াতাড়ি পূরণ হোক।”
(চলবে)
#বেলাশেষে
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ৩৪
প্রণয় হাসপাতালে। হিয়া স্কুলে। পরেশবাবু আদরের নাতনিকে আর একা স্কুলে রেখে আসে না। সাথে করে নিয়ে যায়। আবার সাথে করে নিয়ে আসে। সারাবাড়িতে এখন পারমিতা একা। কতক্ষণ শুয়ে ছিল। আজ কেন যেন মনটা খুব উদাস হয়ে আছে। শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না। প্রতিদিন এই সময়ে ফ্রি হয়ে ফোন দেয় প্রণয়। আজও অভ্যাসমতো ফোন দিল। ফোনের স্ক্রীনে প্রণয়ের নম্বর দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। পারমিতা ফোন রিসিভ করল। প্রণয় বলল,
“কি করো?”
“কিছু না।”
“মেয়ে স্কুল থেকে এসেছে?”
“না।”
“মেয়ের মায়ের কি মন খারাপ?”
“তুমি কীভাবে জানলে?”
প্রণয় হেসে ফেলল। বলল,
“মাঝে মাঝে জানতে হয়। বাড়িতে কেউ এসেছে কি?”
“না তো। কারো আসার কথা ছিল নাকি?”
“বোধহয় আসবে একজন।”
পারমিতা বলল,
“কে?”
প্রণয় হেয়ালি করে বলল,
“আসলে দেখতে পাবে।”
“কে বলোতো?”
“তোমার খুব আপন কেউ।”
পারমিতা হকচকিয়ে গেল। ও বুঝতেই পারছে না হঠাৎ কার কথা বলছে প্রণয়। পারমিতা আপন কেউ তো বেঁচেই নেই। এক দাদা ছিল। সেও পারমিতার সাথে প্রতারণা করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। তাহলে আর কে হতে পারে? অনিরুদ্ধ… অসম্ভব। প্রণয় তো জানে, অনিরুদ্ধ এখন আর পারমিতার আপন কেউ না। একসময় যতটা ভালোবাসতো এখন ঠিক ততটাই ঘৃণা করে। সত্যি বলতে অনিরুদ্ধকে মন থেকে কোনোদিন ভালোইবাসেনি পারমিতা। অনিরুদ্ধ ছিল পারমিতার অল্প বয়সের আবেগ, মোহ, ভ্রম। যা কেটে যেতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। এখন আর মনের কোথাও অনিরুদ্ধ নেই। চোখ বুঁজলে একটা অবয়ব চোখে ভাসে। তা হলো ‘প্রণয়’। এই মানুষটাকে পারমিতা ভালোবাসে নাকি ঠিক বলতে পারবে না। তবে খুব সম্মান করে। মানুষটার অমায়িক ব্যবহারে রীতিমতো মুগ্ধ পারমিতা। মানুষটা যখন পারমিতার গা ঘেষে বসে, হেসে হেসে কথা বলে, কি যে ভালো লাগে।
“কি গো…কোথায় হারিয়ে গেলে?’’
“কি..কি বলছিলে যেন?”
“না কিছু না।”
“এখন রাখি কেমন? রাউন্ডে যাব।”
“আচ্ছা।”
প্রণয় ফোন রেখে দিল। পারমিতা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। খোলা চুলগুলো মনের সুখে বাতাসে উড়ছে।
প্রণয় থাকলে নিশ্চয়ই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পারমিতার চুলের ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে দিত। নিঃশ্বাসে টেনে নিত পারমিতার চুলের ঘ্রাণ। প্রণয়ের কথা ভাবতেই লজ্জায় লাল হলো পারমিতা। মনে রোমাঞ্চকর অনুভূতি খেলে গেল। বুকের ভেতর সুখের আনাগোনা। এই মানুষটা পারমিতা ব্যর্থ জীবনে সফলতা হয়ে ধরা দিয়েছে। একটা মেয়ের সুখে থাকার জন্য একজীবনে যতটুকু দরকার তার থেকে বেশিই দিয়েছে।
“পারু….পারমিতা…ও পারমিতা…
চিরচেনা কণ্ঠটা কানে ভেসে আসতেই পারমিতার বুকের রক্ত ছলকে উঠল। নিঃশ্বাসে চঞ্চলতা। বিস্ময় ঝরা দুচোখে দুফোঁটা নোনাজল বোধহয় গড়িয়ে পড়ল। অস্ফুট স্বরে বলল,
“দাদা..”
পারমিতা চোখের জল মুছে পাগলের মতো ছুটে গেল।
ড্রয়িং রুমে এসে হাঁপাতে লাগল। দেখল, পরাগ দাঁড়িয়ে আছে। পারমিতা নিজেকে সামনে নিল। মুখে কথা নেই। শুধু একদৃষ্টিতে পরাগের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড… পারমিতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরাগ পারমিতার সামনে হামাগুড়ি দিয়ে বসে, পারমিতার পা’দুটো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল। পারমিতা হতভম্ব হয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
“পা ছাড় আমার। পাপ হবে তো।”
“পাপ তো আমি করেছি। মহাপাপ করেছি। আমাকে তুই ক্ষমা করে দে পারু…”
পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুই ইন্ডিয়া থেকে কবে এসেছিস?”
“তিনদিন আগে।”
“এখানে এসেছিস কেন?”
“তোর কাছে ক্ষমা চাইতে। আমাকে তুই মন থেকে ক্ষমা করে দে বোন।”
“পা ছাড় দাদা।”
“আগে বল ক্ষমা করেছিস?”
“আমার ক্ষমা করা দিয়ে তুই কি করবি। বউদি, পাখি কোথায়?”
পরাগ পারমিতার পা ছেড়ে দিয়ে, দুইহাতে মুখ ঢেকে আবারও শব্দ করে কেঁদে দিল। বলল,
“পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আমি তোকে ঠকিয়েছি, তোর বউদি আমাকে ঠকিয়েছে। আমার যতটাকা পয়সা ছিল। সব তোর বউদির নামে। আমি ভাবতেও পারিনি নমিতা আমাকে ফেলে অন্যকারো হাত ধরে পালিয়ে যাবে। গেছে তো গেছে সাথে আবার আমার মেয়েটাকেও নিয়ে গেছে।”
পারমিতা চমকে উঠল। বলল,
“এসব কি বলছিস তুই?”
“আমি ঠিকই বলছি। সব আমার পাপের ফল। আজ সব হারিয়ে নিঃস্ব আমি। আমি নমিতার ভালোবাসায় অন্ধ ছিলাম। ইশ, কি বোকা আমি। নমিতা যে আমার সাথে এতবড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।”
পারমিতা বিদ্রুপ করে বলল,
“তুই যে আমার এক মায়ের পেটের ভাই হয়ে আমার সাথে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবি, আমিও ভাবতে পারিনি। আসলে কি বলতো, আমরা যা কোনোদিন ভাবতে পারি না। আমাদের সাথে ঘুরে ফিরে তাই হয়।”
“তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ারও কোনো মুখ নেই আমার। তবুও পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস। কত টাকা পয়সা নিয়ে ওইদেশে গিয়েছিলাম। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায়। অথচ ফিরে এলাম নিঃস্ব হাতে। আমার কাছে গাড়ি ভাড়াও ছিল না। কতগুলো দিন হোটেলে কাজ করে গাড়িভাড়া জোগাড় করে তারপর দেশে ফিরেছি।”
“বউদির আর কোনো খোঁজ পাসনি?”
“না।”
“থানায় ডায়েরি করতি।”
“হাতে টাকা পয়সা নেই। থাকতাম ভাড়া বাসায়। তিনমাসের ভাড়া বাকি পরে যাওয়ায় বাড়ি থেকে বের করে দিল। একে তো ভীনদেশ। তারউপর আমি একা। একা একা কি করব আমি।”
“কর্মফল কতটা ভয়ানক হয় দেখলি তো?”
পরাগ মাথা নিচু করে ফেলল। পারমিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কিছু খেয়েছিস?”
পরাগ না সূচক মাথা নাড়ল। পারমিতা বলল,
“চল খাবি।”
পরাগ দ্বিমত করল না। পেট খিদেয় চু চু করছে। চোখের জল মুছে পারমিতার পিছুপিছু গেল। হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসে বাহারি পদের আইটেম দেখে পরাগের চোখে জল এসে গেল। যে বোনকে একদিন ঠকিয়ে সব সয়সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিয়েছিল। আজ তার কিছুই নেই। অথচ এইবোনের সেদিন কিছুই ছিল না। আজ সব আছে। এবং আজ সব হারিয়ে এই বোনের কাছেই আসতে হয়েছে পরাগকে।
“আর কাঁদিস না। খেয়ে নে…”
পরাগ খেতে খেতে বলল,
“তোর বিয়ে হয়েছে কতদিন? এখানে কে সম্বন্ধ করল?”
“কেউ না। এগুলো জেনে তুই কি করবি। ফেলেই তো গিয়েছিলি. একবারও চিন্তা করিসনি। আমি সুস্থ হয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব৷ এসব কথা নাহয় বাদই দিলাম। মা যে মারা গেল। তুই কি পারতি না। মাকে একবার শেষ দেখা দেখাতে। দেখালি না। আমাকে আনলে যদি আর না যাই। আমার দায়িত্ব নেওয়ার ভয়ে যার কথায় আমাকে রাস্তায় ছেড়ে গিয়েছিস। আজ সে-ও তোকে ছেড়ে গেছে। প্রকৃত প্রতিশোধ বুঝি একেই বলে। এত তাড়াতাড়ি যে তোর পতন দেখব, এটা ছিল দুঃস্বপ্ন। যদিও এতকিছুর পরও চাইতাম তুই ভালো থাক। কিন্তু মন তো অন্যকিছু চাইতো। আর হলোও তাই।”
পরাগ কিছু বলল না। একমনে খেতে লাগল। কতদিন এত ভালো-মন্দ খাওয়া হয় না।
পরাগ খাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে এসে বসল। পারমিতা এঁটো থালাবাটি গুছিয়ে রেখে এলো। পরাগকে বলল,
“তুই কি এখুনি যাবি? নাকি ওর সাথে দেখা করে যাবি?”
“তোর বরের সাথে দেখা করে যাব।”
“আচ্ছা তাহলে এখানে বসে থাক।”
ততক্ষণে হিয়া চলে এসেছে। মেয়েটা ঘরে এসেই প্রথমে মাকে জড়িয়ে ধরল। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
“জানো মা… আজ স্কুলে কি হয়েছে…
হিয়া পুরো কথা শেষ করতে পারল না। পরাগকে দেখে থেমে গেল। পরেশবাবু বলল,
“ওনি কে বউমা?”
পারমিতা নিচু কণ্ঠে বলল,
“সম্পর্কে আমার দাদা হয়।”
হিয়া বলল,
“তোমার দাদাকে তো আমি চিনি মা।”
পারমিতা কথা ঘুরিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল,
“আমার পিসাতো ভাই। ইন্ডিয়া থেকে বেড়াতে এসেছে। এই প্রথম এলো। তুমি তাই হয়তো চিনতে পারছ না। যাও সোনা ঘরে যাও…ড্রেস চেঞ্জ করে নাও। আমি আসছি।”
“আচ্ছা।”
পরাগ ওদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না। বেশ অবাক হলো। হিয়া চলে যেতেই পরাগ বলল,
“মেয়েটা কে পারমিতা?”
“আমার মেয়ে।”
পরাগ চমকে উঠল। পারমিতা বলল,
“হিয়া জানে আমিই ওর মা। নিজের মা। ওর সামনে এমন কিছু বলিস না, যেন আমাকে সন্দেহ করে। আর তুই যেমন নিজের স্বার্থের কথা ভেবে আমাকে বোন বলে পরিচয় দিতে চাসনি। আমিও আমার মেয়ের সামনে তোকে আমার আপন দাদা বলে কখনো পরিচয় দেব না।”
“পারমিতা…?”
“অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোর করা প্রতিটা অন্যায়ের হিসাব আমি মনে রেখেছি। বেশি খারাপ লাগে, আমার মায়ের মরা মুখটাও শুধুমাত্র তোর জন্য দেখতে পারিনি আমি। আমার মা আমাকে কত ভালোবাসতো, কত আদর করতো। অথচ তোরা আমাকে মায়ের শেষ কাজেও থাকতে দিলি না। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে যেদিন প্রথম বাড়ি গেলাম। আর গিয়ে শুনলাম, আমার মা বেঁচে নেই৷ আর সেই সুযোগে তুই বাড়িঘর বিক্রি করে দূরদেশে পাড়ি জমিয়েছিস। বিশ্বাস কর, তখন বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। সমস্ত পৃথিবী উলোটপালোট হয়ে গিয়েছিল। আমি মানতেই পারছিলাম না। তখন আমাকে আমার বর দেবদূতের মতো আমার হাত ধরে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানিস, এই মানুষটাকে আমি কোনোদিন দেখেনি। আগে থেকে চিনতামও না। ও ছিল আমার ডাক্তার। ওনার দেওয়া ঔষধ খেয়ে আমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলাম। ওনার স্ত্রী মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। আর আশ্চর্যজনক ভাবে আমার সাথে ওনার স্ত্রীর চেহারার খুব মিল। মানুষটা আগেপিছে না ভেবে আমাকে বউ করে এই বাড়িতে নিয়ে এলো। নতুন জীবন দিল। সুন্দর একটা সংসার দিল। যে আমি জীবনেও মা হতে পারব না। সেই আমাকেও মাতৃত্বের স্বাদ দিল। মেয়েটা যখন আমাকে গাঢ় কণ্ঠে মা.. মা বলে চিৎকার করে ডাকে। মা ডাকটা সরাসরি আমার কলিজায় গিয়ে লাগে। একদম ভেতর পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এইজীবনে যা কিছু হারিয়েছি। তার থেকে শতগুন বেশি ঈশ্বর আমাকে পাইয়ে দিয়েছে। আমার আর কোনো আক্ষেপ নেই, আফসোস নেই। আর তোকেও ধন্যবাদ দেই। তুই সেদিন আমাকে না ঠকিয়ে গেলে, আমি এতকিছু একসাথে কখনো পেতাম না। একজীবনে সুখে থাকার জন্য আমার এতটুকুই যথেষ্ট।”
“মা… ঘরে আসো?”
“আসছি হিয়ামণি।”
পারমিতা ইশারায় পরাগকে বসতে বলে ঘরে চলে গেল। পরাগ অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর হাহাকার। সবকিছু পেয়ে হারানোর কষ্ট যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা পরাগের থেকে ভালো আর কেউ বুঝে না। পরাগ মন থেকে আশীর্বাদ করে, পারমিতা যেন সুখী হয়। সত্যিকারের সুখী হোক পারমিতা। ওর জীবনের সমস্ত না পাওয়া গুলো পাওয়ায় পরিপূর্ণ হোক।
(চলবে)