#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#পর্ব-২
#শারমিন আঁচল নিপা
পুলিশ আমার পাশে বসলো। উনি পুলিশ অফিসার মাহির। দেখতে কিছুটা শ্যাম বর্ণের। উচ্চতায় বেশ লম্বা। ৬ ফুটের মতো হবে। মুখে কোনো দাঁড়ি মোচ নেই। একদম ক্লিন সেভ করা। চুলগুলোও বেশ ছোটো করা। উনার চুলের কাটটা কিছুটা আর্মি কাটের মতো। আমি উনাকে দেখে শুয়া থেকে উঠতে নিলে তিনি না করলেন। বেশ নম্র গলায় বললেন
“আপনি শুয়েই কথা বলুন। শরীরের উপর প্রেসার দিয়ে উঠতে হবে না৷ আমি জানি আপনি খুব খারাপ অবস্থায় আছেন৷ এ অবস্থায় এসব প্রশ্ন করা আমার উচিত হবে কি’না জানি না। তবে ইনভেস্টিগেশনের জন্য প্রশ্নগুলো করায় লাগবে। কারণ যিনি আত্ম/হত্যা করেছেন তিনি একজন সম্মানিত লোক। এ এলাকার একজন ডাক্তার। কোনো কিছুর কমতি উনার নেই। কিন্তু এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় উনি আত্ম/হত্যা কেন করলেন? আপনার সাথে উনার পরিচয় কতদিনের? এবং শেষ কথা কী হয়েছিল?”
আমি হালকা একটা নিঃশ্বাস টেনে তা ছেড়ে বললাম
“আমার নিজেকে একটা পাথর মনে হচ্ছে। অনুভূতি শূন্য হয়ে গেলে মানুষ যেমনটা হয় আমিও ঠিক তেমন হয়ে গেছি। আমি বুঝতেই পারছি না মেঘ কেন আত্মহত্যা করল। তার সাথে আমার পরিচয় অনেকদিন। গতকাল আমাদের বিয়ের কথাও ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে সে বিয়ে ভেঙে দেয়। এর কারণ তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় আমার বয়স বেশি তাই সে আমাকে চায় না। এটাই তার সাথে আমার শেষ কথা ছিল। এরপর লক্ষ্য করি সে আমাকে ব্লক লিস্টে ফেলে দেয়। এত বছরের সম্পর্ক আর সে সম্পর্কের পর বিয়ে। আর বিয়ের দিন হঠাৎ করে একটা অজুহাত দেখিয়ে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া। এসব কিছু এত দ্রূত হয়েছে যে আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে গতকাল থেকে অজ্ঞান ছিলাম। মাত্রই আমার জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরার পর এ সংবাদ। আমি কাঁদতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে কাঁদতে পারলে শান্তি লাগত। সে প্রতারণা করেছে। তারপরও আমি তাকে ভালোবাসতাম, এখনও ভালোবাসা অন্তরে জিইয়ে আছে আমার। ভালোবাসার মানুষের মৃ/ত্যু সংবাদ শুনা যে কত বড়ো যন্ত্রণাদায়ক সেটা আমি আপনাকে বর্ণণা করতে এ মুহূর্তে সক্ষম না৷ তবে আমি একটু কাঁদতে চাই।”
মাহির সাহেব আমার দিকে তাকালেন। তিনি লক্ষ্য করলেন আমার চোখ দিয়ে কোনো জল পড়ছে না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমি কথা বলছি। আমার কথা শুনে কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
“বিষয়টা কী এমন যে বিয়ে ভাঙার আক্রোশে আপনিই আপনার হবু স্বামীকে খু/ন করে আত্ম/হত্যা প্রমাণের জন্য এরকম করেছেন।”
মাহির সাহেবের কথা শুনে কিছুটা হাসলাম। যদিও হাসিটা উপসাহাসের হাসি৷ হাসির রেশ টেনে আবারও একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম
“ভালোবাসার মানুষের প্রতারণা সওয়া যায় মৃত্যু সওয়া যায় না। আর আপনি যাকে ভালোবাসবেন সে যত খারাপেই করুক আপনি তার ক্ষতি করতে পারবেন না। আপনার তার প্রতি জেদ আসবে, রাগ আসবে, নিজ হাতে খু/ন করার ইচ্ছা জাগবে। কিন্তু যখন সেটা করতে যাবেন আপনার হাত না সাথে আপনার বুকও কাঁপবে। খু/ন করা কী এতই সোজা? তাও আবার নিজের স্বামীকে। তার উপর যে স্বামীর সাথে ১০ টা বছরের সুখের মুহূর্ত। সে স্বামীর একদিনের একটা কষ্টের বিনিময়ে প্রাণ নেওয়া যায়? গতকাল তো কেবল বিয়ে হত সবার চোখে কিন্তু আমরা তো বিয়ে করি আরও আগে। কেউ কী চায়বে বিধবা হতে? যেখানে মেঘের কোনো পরকিয়া সম্পর্ক পর্যন্ত আমি ধরতে পারিনি।”
মাহির সাহেব আমার কথাগুলো ভালো করে শুনে বললেন
“আপনার কথার সাথে মেঘের কথার অনেক অমিল পাচ্ছি আমি।”
আমি বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম
“মেঘ যদি সুই/সাইড করে তাহলে কীভাবে আপনি দুজনের কথা মিল অমিল পান? আপনি মৃত মানুষের সাথে কীভাবে কথা বললেন?”
মাহির সাহেব তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মেঘের মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন
“নিশ্চয় মোবাইলটা চিনেন?”
আমি উত্তর দিলাম
“মেঘের। কিন্তু কেন?”
” এই মোবাইলের গ্যালারিতে শুধু আপনার ছবি। এ মোবাইলে আপনার নম্বরটা সেভ করা হুররাম লিখে। আপনার প্রতিটা ভালো দিক উনি নিজের মেসন্জার থেকে নিজেকেই মেসেজ দিয়ে বলে রাখতেন। এমনকি মৃত্যুর আগেও সে আপনার নামে নোটপ্যাডে লিখেছেন।
“আমার চোখে অপরূপা তুমি। তোমার হাত ধরে আমি পারি দিব সহস্র পথ। তোমাকে ভালোবাসায় আমি মুড়িয়ে নিব। আমি যখন নিঃশ্বাস নেই তোমার ঘ্রাণ পাই। সে নিঃশ্বাস ছাড়তে ইচ্ছা করে না। মনে হয় নিঃশ্বাসের সাথে তোমার ঘ্রাণ যদি বের হয়ে যায় তাখন তোমার ঘ্রাণ পাব কোথায়? আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত হলো তোমার সাথে কাটানো মূহুর্ত। তোমাকে আমি আমার জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসি। তোমার চোখের মায়ায় আমি সহস্র বছর ডুবে থাকতে পারব। ভালোবাসি তোমায়।”
যে মানুষটার মোবাইলের সবটা জুড়ে আপনি সে কেন আপনার বিয়ে ভেঙে দিবে? আর আমরা পুরো মোবাইলটা ঘেটে এমন কিছুই পাইনি যে আপনি ছাড়া সে অন্য মেয়ের সাথে কথা বলেছে। তাহলে কেন আপনাকে ছাড়ার কথা চিন্তা করবে? যদিও এটা সঠিক তাদের দিক থেকে বিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন? আপনি কী মেঘের পরিবারের কাউকে সন্দেহ করেন? অথবা আপনার পরিবারের কাউকে?
মাহির সাহেবের কথা শুনে আমি আর কথা বলতে পারছি না। একটা মানুষ আমাকে কতটা ভালোবাসলে মৃত্যুর আগেও আমাকে ভালোবাসি বলে। এত ভালোবাসার পরও কেন সে বিয়ে ভাঙলো সে উত্তরেই আমি মিলাতে পারছি না। আমি একটু হাইপার হতে লাগলাম৷ আমার শ্বাস ঘন হতে লাগল। মেঘের মুখটা চোখে ভাসতে লাগল। আমার অবস্থা দেখে মাহির সাহেব আমাকে বললেন
“আপনি রিলাক্স হন৷ আপনার সাথে আমি আবারও কথা বলব। আপাতত মেঘের লা/শটা মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসলে বুঝা যাবে এটা খু/ন নাকি আত্ম/হত্যা। আমি উঠলাম।”
কথাগুলে বলে বসা থেকে উঠে গেলেন। উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারও ফিরে আসলেন আমার কাছে। আমার কাছে এসে আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন
“এখানে আমার নম্বর আছে। ভাবুন, চিন্তা করুন। এরপর যদি কাউকে সন্দেহ হয় তাহলে জানাবেন৷ আর আপনার নম্বর তো আমি জানিই। ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসলে আপনাকে আমি জানাব। আর নিজের যত্ন নিয়ে সু্স্থ হন। এত দুর্বল হলে তো চলবে না।”
কথাগুলো বলে তিনি চলে গেলেন। তবে আমার বুকে ভীষণ ব্যথা হতে লাগল। আমি বুঝতেই পারছি না মেঘ কেন বিয়ে ভাঙলো আবার কেনই বা আত্মহত্যা করল! বিয়ে ভাঙনের সময় মেঘের সাথে আমি আগে এবং মৃত্যুর পরের মেঘকে মিলাতে পারছি না৷ এ প্রশ্নগুলো আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে৷ এত কষ্ট হচ্ছে তবুও আমি কান্না করতে পারছি না। মেঘকে এক নজর দেখার জন্য আমি ব্যকুল হয়ে যাচ্ছি। কখন মেঘের লা/শটা আনবে আমি তাকে দেখব সেটাই আমার মনে ঘুরছে। আমি নিজেকে আর এভাবে রাখতে পারলাম না। বেশ শক্তি নিয়েই আমি উঠলাম। এরপর সোজা ঘর থেকে বের হলাম। ঘর থেকে বের হয়ে চৌকাঠের কাছে আসতেই আমার ছোটো বোন তরী আমাকে বলল
“আপু গতকাল মিলন ভাইয়া এ কাগজটা তোমাকে দিতে বলেছিল। কিন্তু তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমি দিতে পারিনি।”
মিলন হলো মেঘের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমি তরীর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে খুললাম। কাগজটা খুলে নিজের চোখকেও যেন আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না…
শারমিন আক্তার
শারমিন নিপা