মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব-০৩

0
1

#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৩

মেঘ চিঠিতে লিখেছে

“তোমার বাড়ির পেছনে গিয়ে দেখবে একটা গোলাপ গাছ আছে। সেখানে দুটো কলি ধরেছে। এ দুটো কলি হচ্ছে আমি আর তুমি। বৃষ্টি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে আমি তোমাকে এটা পাঠালাম। এখানে আমি চাইলেই ডিজিটাল ওয়েতে পাঠাতে পারতাম। তবে আধুনিকতার ছোঁয়া সবাই চায়লেও মাঝে মাঝে আদি যুগের কিছু রিতীনীতিতে অসম্ভব টান খুঁজে পাই। স্নিগ্ধতা খুঁজে পাই। আমি জানি উপহারটা এভাবে পেলে তুমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। তাই মিলনকে দিয়ে তোমার জন্য ছোটো এ ভালোবাসার প্রতীক পাঠালাম। গাছটা তোমার বেলকনিতে রেখে দিও। তুমি চলে আসলেও তোমার ঘরে আমাদের ভালোবাসার প্রতীক ফুটে থাকবে। সুবাস ছড়াবে। আর এভাবেই আমাদের ভালোবাসার সুবাস ছড়িয়ে পড়ুক পুরো পৃথিবীতে। তুমি আমার দুনিয়াতে থাকা বেহেশতের হূর। আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর রমণী। তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ আমি সারপ্রাইজে ভরে দিব।”

চিঠিটা পড়ে আমার হাত কাঁপতে লাগল। আমার প্রতি মেঘের এত ভালোবাসা ছিল। এমনকি সে আমাকে বিয়ের দিন সারপ্রাইজও পাঠিয়েছিল। তাহলে সে কেন বিয়ে ভাঙল? ১০ বছরের পরিচয় আমাদের। আমাকে নিয়ে কেউ কোনো বাজে কুৎসা বললেও তো যাচাই ছাড়া বিশ্বাস করে বিয়ে ভাঙার পাত্র সে না। সে তো যথেষ্ঠ বিচক্ষণ। শত প্রশ্ন যেন আমার মাথায় ঘুরছে। আমার চোখ দিয়ে পানির সাগর বয়েই যাচ্ছে। এ সাগর কবে থামবে জানি না। কাগজটাকে ভাজ করে আমার ঘরে এসে ডায়রিতে রাখলাম। তারপর সরাসরি চলে গেলাম বাড়ির পেছন দিকটায়৷ সেখানে গিয়ে দেখলাম একটা গোলাপ ফুলের গাছ সুন্দর টবে রাখা। সাদা গোলাপ। মেঘ জানত আমি সাদা গোলাপ ভীষণ পছন্দ করি। তাই সে সাদা গোলাপেই পাঠিয়েছিল। গোলাপ গাছটার কলি ছিল দুটি। গতকালকের কলি আজকে ফুটে জ্বল জ্বল করছে। অথচ বাস্তবে এখানের একটা ফুল ঝরে গিয়েছে আর আরেকটা ফুল নেতিয়ে পরেছে।

আমি টবটা হাতে নিলাম। টবটা মাটির৷ কিছু কারুকাজ দিয়ে টবের সৌন্দর্য় বাড়ানো হয়েছে। টবটাকে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। তারপর ডান হাতের তালু দিয়ে একবার চোখ মুছলাম আবার উল্টো পিঠ দিয়ে আরেকবার চোখ মুছলাম। এরপর টবটা নিয়ে এসে বেলকনিতে রাখলাম।

বেলকনি থেকে ঘরে এসে মেঘের দেওয়া সকল গিফট গুলো বের করে দেখতে লাগলাম। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না মেঘ নেই। আমার বার বার মনে হচ্ছে আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি। কিন্তু দীর্ঘ এ দুঃস্বপ্ন যেন শেষ হচ্ছে না। আমি এ দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি চাই। এটা বলে বলে জোরে কাঁদতে লাগলাম। পাশের রুম থেকে মা আসলেন। আমার পাশে বসলেন। কোনো কথা বলেনি প্রথম ৫ মিনিট। কেবল পাশে বসে আমার কান্না দেখছেন। আমার ছটফট, হাহাকার দেখছেন। ৫ মিনিট পর আমাকে শান্ত গলায় বললেন

“কেঁদে আর কী হবে। যা হওয়ার হয়েছে। তবে তুই যদি আগে আমাদের কথা শুনে বিয়ে করতি তাহলে আজকের এ দিন দেখতে হত না।”

মায়ের এ কথাটা শুনে আমার অনেক রাগ উঠে গেল। আমি রাগে জোরে চিৎকার দিয়ে বললাম

“আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আমার মেঘ আর নেই। আমি মেঘকে ছাড়া কীভাবে থাকব? মেঘকে ছাড়া আমার দম বন্ধ লাগছে। আমার জীবন আমি বুঝব কী করব। তুমি কেন নাক গলাচ্ছ? আমার জীবন আমি যাকে ইচ্ছা বিয়ে করব। প্রয়োজনে বিয়ে করব না। এখানে তুমি হস্তক্ষেপ করার কে? আমাকে বোঝা মনে হলে বলো চলে যাই এ বাড়ি ছেড়ে। তারপরও এসব বলা বন্ধ করো। আমি একটু স্বস্তি চাই। এত এত কটু কথা আমি নিতে পারছি না। এ বয়সে এত ভার সহ্য করতে পারছি না। মায়েরা শুনেছি মেয়েদের কষ্ট বুঝে। কিন্তু তুমি তো তোমার মেয়ের হাহাকার বুঝছো না। প্লিজ মা তুমি আমার চোখের সামনে থেকে যাও।”

আমার চিৎকারে মা চলে গেল। আমি প্রখরভাবে কাঁদতে লাগলাম। জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। তবুও যেন আমি শান্তি পাচ্ছি না। মেঘ আমাকে ছেড়ে গেলেও সয়ে নিতাম। কিন্তু এ মৃত্যু যে সইতে পারছি না। ১০ বছরের ভালো স্মৃতির কাছে একদিনের প্রশ্নবিদ্ধ তিক্ততাকে তুলনা করলে হবে না। মেঘ কেন বিয়ে ভেঙেছিল এটা এখন প্রশ্নবিদ্ধ ছাড়া কিছু না।

আমি আমার ফোনটা নিয়ে মিলনকে কল দিলাম। মিলন আমার কল ধরেই বলল

“তুমি ঠিক আছো তো? দেখো যা হয়েছে এটার জন্য আমরা সবাই দুঃখ প্রকাশ করছি। তোমাকে আল্লাহ এ শোক সইবার ক্ষমতা দিক৷”

আমি কান্না গলায় জিজ্ঞেস করলাম

“মিলন ভাইয়া মেঘ কেন বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল জানেন? বিয়ের সব আয়োজনের পর বিয়ে ভেঙে দেওয়া। তারপর মেঘের চলে যাওয়া। সবকিছুতেই একটা কিন্তু থেকে যায়। অফিসার মাহির এসেছিলেন৷ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গিয়েছে। আবার সন্দেহও করে গিয়েছেন। উনার ধারণা বিয়ে ভাঙার আক্রোশে আমি মেঘকে খুন করেছি।”

বলেই আমি আমার চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। মিলন ভাইয়া আমাকে স্বান্তণা দিয়ে বললেন

“আমাকে শুধু গোলাপের গাছটা আর চিঠিটা দিয়ে বলেছিল পৌঁছে দিতে। তোমাকে বিয়ে করা নিয়ে সে ভীষণ খুশি ছিল। আমি তো গোলাপের গাছটা বাড়ির পেছনে রেখে তোমার বোনকে চিঠিটা দিয়ে বলেছিলাম তোমাকে দিতে। চিঠিটা দিয়ে বাইকে পা রাখতেই শুনি মেঘ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম৷ হুট করে কী এমন হলো যে বিয়ে ভেঙে গেল। আমি মেঘকে কল দিলাম সে রিসিভ করল না। আমি বাইকে উঠে সরাসরি ওদের বাড়ি গেলাম৷ বাড়ি যাওয়ার পর কেন জানিনা বাড়ির গেইটের দারোয়ান আমাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখে। বলছিল ভেতর থেকে নিষেধ আছে। তাই ঢুকতে পারব না। আমি বারবার বললাম

” দারোয়ান চাচা আমি মেঘের বন্ধু আমাকে তো আপনি চিনেন। রোজ আসি এখানে। তাহলে কেন আমাকে আটকাচ্ছেন? আর আজকে বিয়ে বাড়ি, মানুষ যাওয়া আসা তো করবেই।

কিন্তু দারোয়ান সাফ জানিয়ে দেয়। ভেতরে আর কোনো গেস্ট নেই। সবাইকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বাইরে থেকে কাউকে ঢুকতে না করা হয়েছে। ”

আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েই মেঘকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলাম। মেঘ আমার ডাকে সারা দিল। সে দারোয়ানকে বলল আমাকে যেন ঢুকতে দেয়। আমি বাসায় ঢুকার পর সবকিছু কেমন জানি অদ্ভুত লাগছিল। সবাইকেই ভীষণ অস্থির লাগছিল আর সবাই কিছু একটা নিয়ে ভাবছিল। আমি মেঘকে টান দিয়ে এক পাশে আনলাম৷ তারপর জিজ্ঞেস করলাম

“বিয়ে ভেঙেছিস কেন? তুই তো বৃষ্টিকে ভালেবাসিস। তুই তো বৃষ্টির বয়সের কথা জানিস। তাহলে বিয়ে কেন ভাঙলি?”

তারপর মেঘের জবাব শুনে আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে যাই। সে বলেছিল

“আমার মোহ কেটে গেছে। তাই বৃষ্টিকে বিয়ে করছি না। এছাড়া আর কিছু বলবি? না বললে বাসা থেকে বের হয়ে যা।”

মেঘের এরকম অদ্ভুত কথার টোন, আচরণ আমাকে অনেকটা বিব্রত করে। রাতে ওর উপর ভীষণ রেগে ছিলাম আমি। কিন্তু সকালে এ সংবাদ পাওয়ার পর এটাই মনে হচ্ছে মেঘের সাথে খারাপ কিছুই হয়েছে। যেটা আমরা আন্দাজ করতে পারিনি।

আমি হুম বলে কথার সমাপ্তি টেনে কলটা কেটে দিলাম। তারপর বেলকনিতে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালম। লক্ষ্য করলাম আকাশে মেঘ জমেছে। আকাশের মেঘ দেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম

“মেঘ তুমি কেন চলে গেলে? চলে যাওয়ার আগে কারণটা তো বলে যেতে পারতে। মেঘ তোমাকে ছাড়া বড্ড অসহায় আমি। তোমাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো প্লিজ। মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো প্লিজ।”

এমন সময় আমার মোবাইলটা বেজে উঠল।।আমি চমকে উঠলাম। মেঘের নম্বর থেকে কল এসেছে। প্রথমে চমকালেও পরে ধরে নিলাম অফিসার মাহির হয়তো মেঘের নম্বর থেকে কল দিয়েছে। তাই কলটা ধরে হ্যালো বললাম। তবে হ্যালো বলে মেঘের কণ্ঠ শুনে আঁৎকে উঠলাম।

….

শারমিন আক্তার
শারমিন নিপা