#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#পর্ব-১০
#শারমিন আঁচল নিপা
সামির সাহেব লক্ষ্য করলেন একটি ডাকবাক্স দেয়ালে ঝুলানো। ডাক বাক্সের অবস্থানটা গেইটের ঠিক কাছাকাছি। তালা লাগানো নেই তাতে। অর্থাৎ ডাক বাক্সের গেইটটা খোলায় আছে। সামির সাহেব ডাক বাক্সটা খুলে একটা চিঠি পেল। চিঠিটা এসেছিল মেঘ যেদিন মারা গিয়েছিল তার পরদিন। অহনা নামের একটা মেয়ের চিঠি। চিঠিটা মেঘকে উদ্দেশ্য করেই লেখা হয়েছিল। আর সেখানে লেখা ছিল
“তুমি অন্ধকার আকাশে গর্জন দিয়েই আমার জীবনে এসেছিলে। চাঁদনী রাতের কালো বর্ষণে তুমি আমার মনের গহীনে জায়গা করে নিয়েছিলে। তোমার শরীরে আমি বেলী ফুলের সুবাস পাই। তোমাকে ছাড়া সত্যিই আমার জীবন ছন্নছাড়া। আমি জানি আমাদের মধ্যে যা হয়েছে ভুল হয়েছে। এ ভুলটাকে এগিয়ে নেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব না। তবে বৃষ্টিকে আমার আর তোমার বিষয়টা জানালে ভালো হত না? অন্তত তার স্বামীর একটা অজানা রহস্য সে জানল। জানি আজকে তুমি বৃষ্টির হয়ে গেছো। তোমার থেকে আমি কয়েকশ মাইল দূরে। কিন্তু আমার বুকের দহন যেন পুরো পৃথিবীকে দগ্ধ করে ফেলেছে। তাই হয়তো সূর্যি মামার এত ত্যাজ বেড়েছে। আমার মনের গহীনে বিচরণ করা তুমিটাকে আমি ভীষণ মিস করি। আমি চাই আবারও আমাদের দেখা হোক। আমাদের ভালোবাসা হোক। আমাদের সেই স্মৃতির সন্নিবেশ হোক। আমরা দুই থেকে তিন হই। ভালো থাকবে।”
সামির সাহেব এটা বুঝতে পারছিল অহনা মেয়েটির সাথে মেঘের একটা বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। চিঠিটা এসেছে লালমনিরহাট থেকে। মেয়েটার ঠিকানা ধরে এগুলে হয়তো অনেক কিছুই পাওয়া যাবে। এসব চিন্তায় সে করছে। এমন সময় দারোয়ানের কর্কশ গলায় সামির সাহেব সম্ভিত ফিরে পায়। দারোয়ান বেশ কড়া গলায় বলল
“বড়ো সাহেব আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছে।”
সামির সাহেব গেইটের ভেতরে ঢুকলো। বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে একটা বাড়ি বলা যায়। চারপাশটা বেশ খোলামেলা আর গাছের সন্নিবেশে আচ্ছাদিত। মূল গেইট থেকে বাড়িতে প্রবেশ করতে হেঁটে ৯০ সেকেন্ড সময় লেগেছে সামির সাহেবের। সে বাড়ির দরজার সামনে আসতেই মেঘের বাবাকে দেখে সালাম দিল। সালাম দিয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠল
“আমি সত্যিই দুঃখিত এমন একটা সময়ে আসার জন্য। আমি মেঘের বিষয়টা জানতে পেরেছি হুট করে। দেশের বাইরে থাকায় আমি এতদিন আসতে পারিনি। আজকে সরাসরি এয়ারপোর্ট থেকে চলে এসেছি। মেঘ বলেছিল বাংলাদেশে এসে এখানে যেন থাকি। যেহেতু আমার পুরো পরিবার বিদেশ স্যাটল, বাংলাদেশে কেউ নেই৷ কিন্তু কীভাবে যে সব এলোমেলো হয়ে গেল আমি বুঝতে পারছি না৷ খুব দম বন্ধ লাগে এসব ভাবলে। আমার বাংলাদেশে কেউ নেই৷ তাই সরাসরি এখানে চলে এসেছি। কাল আমি একটা হোটেলের ব্যবস্থা করে এ বাসা থেকে চলে যাব। আজকের রাতটা আশ্রয় দরকার।”
আকরাম সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল
” যে কয়দিন বাংলাদেশে থাকো আমার বাসায় থাকো। মেঘ ছাড়া আমার কোনো সন্তান নেই৷ তুমি থাকলে আমার ভালোই লাগবে। মেঘকে হারিয়ে রেহনুমাও অনেক কষ্ট পাচ্ছে। একমাত্র সন্তান হারিয়ে সেও শোকে আছে। তবে শান্তি পেতাম যদি মেঘের খু/নীটা শাস্তি পেত।”
সামির সাহেব বেশ শান্ত গলায় মাথা নাড়ল। তারপর হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল
“আঙ্কেল আপনি কী জানেন মেঘের খু/নী কে?”
বেশ রুষ্ঠ গলায় আকরাম সাহেবের উত্তর আসলো
“মেয়েটার নাম বৃষ্টি। ভীষণ ত্যাজী মেয়ে। আমার ছেলে পছন্দ করেছিল তাই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। তবে একটা সময় পর আমার ছেলেরেই রিয়েলাইজেশন আসে এমন মেয়েকে বিয়ে করবে না। তাই বিয়ে ভেঙে দেয়। আর সে জের ধরেই আমার কলিজার টুকরোটাকে খুন করে মেয়েটা। ”
সামির সাহেব দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছে। মেঘের বাবা কথা শেষ করল। তার চোখে অশ্রুর বিন্দু জমেছে। সেটা সে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে বলল
“তোমাকে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ভেতরে এসে বিশ্রাম করো। আমি সুরাইয়াকে বলছি তোমাকে খাবার দিতে।”
সামির সাহেব ভেতরে গিয়ে বসলো। রাত অনেক হয়েছে। খাওয়াটা দরকার। সুরাইয়া বসতে বসতেই খাবার তৈরী করে নিয়ে এসেছে। খুব বেশি বয়স না মেয়েটার। আকরাম সাহেব সুরাইয়াকে সামির সাহেবের সবকিছু গুছিয়ে দিতে বলে নিজের রুমে চলে গেলেন। সামির সাহেব খেতে বসলেন। খেতে বসে সুরাইাকে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলেন
“আচ্ছা সুরাইয়া তোমার মেঘ স্যার কেমন ছিল? সে কি অনেক রাগী ছিল?”
সুরাইয়া এক পাশে দাঁড়িয়ে চুপ গলায় জবাব দিল
“স্যার অনেক ভালো ছিল। স্যার যতদিন বাসায় থাকত আমাদের সবার খোঁজ নিত। বৃষ্টি ম্যাডামকে অনেক পছন্দ করত। এ বাসায় অনেকবার এসেছিল। বিয়ের দিনও স্যার অনেক খুশি ছিল। কিন্তু বড়ো স্যার একদম চাইতেন না বিয়েটা হোক। বিয়ের দিনেই ঝামেলা শুরু হলো এটা নিয়ে। এ ঝামেলা বেড়ে মেঘ স্যার রাগ করে বিয়েটা ভেঙে দেয়। এটা নিয়ে তুলকালাম শুরু হয়। দুই পক্ষে হাতাহাতিও হয়। মেহমানরা সবাই চলে যায়। পরিস্থিতি সন্ধ্যার মধ্যে ঠান্ডাও হয়ে যায়। সন্ধ্যায় খবর আসে বৃষ্টি ম্যাডাম অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মেঘ স্যার এটা শুনে পুনরায় বিয়েটা ঠিক করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর বৃষ্টিকে দেখতে তিনি বাইরেও গিয়েছিল। কিন্তু কী জন্য যেন আধা ঘন্টার মধ্যেই চলে আসে। আর এসেই অনেকটা চুপ হয়ে যায়। এরপর পরের দিন সকালে ঝুলন্ত অবস্থায় স্যারকে উদ্ধার করা হয়। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না স্যারের মতো মানুষ আত্মহত্যা করেছে। খুব কষ্ট হয় এটা মনে হলেই। একটা সময় অনেক অশান্তিতে ছিলাম আমি। স্বামীর মার খেয়ে খেয়ে নিজের জীবন শেষ হচ্ছিল। অত্যাচার সইতে না পেরে আমিও আত্মহত্যার চেষ্টা করি। তখন এ মেঘ স্যারেই আমাকে বাঁচিয়ে তার বাসায় কাজ দেয়। তিনি একটা মানুষকে বেঁচে থাকার এত অনুপ্রেরণা দিয়ে কীভাবে নিজে মারা গেল সে হিসাবেই আমি মিলাতে পারি না।”
কথাগুলো বলা শেষে সুরাইয়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। বুঝাই যাচ্ছিল সে যা বলছে সত্য বলছে৷ সামির সাহেব এবার একটা উত্তর পেয়ে গেল। আর সেটা হলে মেঘ কেন বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। এবার তার আরেকটা উত্তরের প্রয়োজন আর সেটা হলো মেঘ কী সত্যিই আত্মহত্যা করেছিল নাকি খু/ন হয়েছিল৷ আর খু/ন হলে কে করেছে?
এদিকে বৃষ্টির মা অর্ধেক মৃত হয়ে আছে৷ নিজের মেয়ের একটু সন্ধানও সে জানে না। সে জানে না তার মেয়ে কোথায় আছে কী করছে। একটা ধমকা হাওয়া যেন তার পুরো পরিবারটাকে তছনছ করে দিল। অনেক কষ্ট করে বৃষ্টিকে সে পড়িয়েছে। দুটো মেয়ে মানুষ করেছে। একটা মেয়ে হয়ে সে পুরুষদের মতো খেটেছে। আর সে খাটুনির টাকা দিয়ে প্যারালাইজড স্বামীর চিকিৎসা করেছে আর নিজের দুই মেয়ের পেছনে সব দিয়েছে৷ কিন্তু এত কিছুর পরও যে বিধাতা তাকে এত কষ্ট দিবে এটা তিনি মানতে পারছেন না।
ডাক্তার আবীরও বৃষ্টির চিন্তায় মগ্ন। বৃষ্টির ঐ নীল চোখ তাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। কখন যে বৃষ্টির সাথে সাথে কথা বলতে বলতে তার প্রতি দুর্বলতা চলে এসেছে সে নিজেও জানে না। খুব কাছ থেকে নিজের ভালোবাসা উপলব্ধি করে সেটা হারিয়ে ফেলার ভীষণ যন্ত্রণা হয়। আর সেটা সে খুব ভালোই বুঝতে পারছে। এখন সে বৃষ্টির কষ্টটা ভেতর থেকে অনুভব করতে পারছে।
বৃষ্টি তিতির পাখির মতো শুধু ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরনো স্মৃতিগুলো তাকে খুব তাড়া করছে। মেঘ চলে গেছে কিন্তু স্মৃতিগুলো তাড়া করার জন্য সে তার পেটে একটা অস্তিত্ব রেখে গেছে। এখন চায়লেও সে নিজেকে শেষ করতে পারবে না৷ বাচ্চার জন্য হলেও বাঁচতে হবে তাকে। ভীষণ মনে পড়ে তার আগের সে স্মৃতিগুলো। যেখানে মেঘ আর সে সুখের গল্প বুনেছিল৷ বেলী ফুল পছন্দ করত বলে মেঘ একবার বৃষ্টির জন্য নার্সারীর সব বেলী গাছ কিনে তাকে উপহার দিয়েছিল। দামী কিছুই সে মেঘের থেকে আশা করত না। ছোটো ছোটো জিনিসগুলো তাকে ভীষণ টানত। আর সে ছোটো বিষয়গুলোকে বড়ো করে উপস্থাপন করত মেঘ। আজ যেন সবই স্মৃতি। এ বিষাদ যেন তার পিছু ছাড়ছে না। ভীষণ দম বন্ধ লাগে তার।
চোখ গড়িয়ে এক বিন্দু পানি গালে গড়িয়ে পড়ল। সে তার ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সেটা মুছে নিল। তারপর কান্না আটকানোর অনেক চেষ্টা করেও পারল না৷ একটা সময় জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
সামির সাহেবের খাওয়া প্রায় শেষ। সে খাওয়া শেষে হাতটা ধুয়ে টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বলল
“সুরাইয়া একটা সাহায্য করবে?”
সুরাইয়া নম্র গলায় উত্তর দিল
“কী করতে হবে বলেন স্যার। সাধ্যের মধ্যে থাকলে করব।”
সামির সাহেব একটু কৌশলে বলল
“আমার মেঘকে ভীষণ মনে পড়ছে। ওর রুমে গেলে একটু ভালো লাগত। নিশ্চয় ওর রুমে প্রবেশ নিষেধ তাই তো?”
সুরাইয়া ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল
“রুমটা তালা দেয়া। চাবি কোথায় আছে আমি জানি। তবে বড়ো স্যার সবাইকে নিষেধ করেছে ঐ রুমে ঢুকতে। এর বাইরে কথা অমান্য করে যদি ঢুকে কেউ তাহলে তার মাথা গলা থেকে আলাদা করবে বলে হুমকিও দিয়েছে।”
সামির সাহেব অসহায় ভঙ্গিতে বলল
“কেউ জানবে না তুমি আমাকে কী চাবিটা দিবে? আমি নাহয় এক সময় ঢুকে পড়ব৷ একটু মেঘের ঘ্রাণ নিব। ওর ঘরটা দেখে নিজের অশান্ত মনটাকে শান্ত করব। ভীষণ মনে পড়ছে ওকে।”
সুরাইয়া সামির সাহেবের কথায় গলে গেল। সে হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে স্থান পরিবর্তন করল। এরপর ২ মিনিটের মধ্যেই সে মেঘের ঘরের চাবিটা সামির সাহেবকে দিল। আর মৃদু গলায় বলল
“স্যার আপনি ঢুকেন৷ আমি নাহয় পাহাড়া দেই। দুই মিনিটের মধ্যে চলে আইসেন দয়াকরে৷ নাহয় আমার জীবনে দুঃখ নেমে আসবে। আপনাকে নেহাত ভালো মানুষ মনে হচ্ছে। আর আপনি মেঘ স্যারকে অনেক ভালোবাসেন বুঝতে পারছি। তাই না দিয়ে পারলাম না।”
সামির সাহেব সুরাইয়ার কথা শুনে বেশ দ্রূত মেঘের ঘরের তালা খুলে প্রবেশ করল। সে মেঘের ঘরের চারপাশরা অবলোকন করল। খাটের পাশের ড্রয়ারটা খুলে সে চমকে উঠল। নেশার কিছু দ্রব্য ড্রয়ারে৷ ইয়াবা, হিরোইন, গাজা ছিল৷ সামির সাহেব ভাবতে লাগল পুলিশ নিশ্চয় এ ঘর তল্লাশি করেছে। তাহলে এগুলো তো পুলিশের দৃষ্টির আড়াল হয়ে যাওয়ার কথা না৷ তদন্ত কীভাবে করেছে তারা এটাই এখন সন্দিহান লাগছে তার। তাহলে কী মেঘ নেশা করত? মাথায় ভীষণ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে চিন্তায় ছেদ পড়ে আকরাম সাহেবের কণ্ঠ স্বরে। সে সুরাইয়াকে জিজ্ঞেস করছে
“সামির ছেলেটা কী খেয়েছে?”
সুরাইয়া আকরাম সাহেবের আচমকা আগমনে ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে উত্তর দেওয়ার সাহসও পাচ্ছিল না। এদিকে সামির সাহেবও বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। এখানে যদি আকরাম সাহেব তাকে দেখে তাহলে পুরো পরিকল্পনাটায় নষ্ট হয়ে যাবে। সে এসব ভাবতে ভাবতেই কারও উপস্থিতি টের পেল খুব কাছাকাছি। সে ভেবেছিল হয়তো আকরাম সাহেব। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিকোণে একটি বিশেষ বিষয় আটকে যায়…