মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব-১৩+১৪

0
21

#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#পর্ব- ১৩
#শারমিন আঁচল নিপা

কারণ বৃষ্টি বলেছিল সে মেঘের বাড়ির দেয়ালটা শরীর দুর্বলতার জন্য টপকাতে পারে নি। তবে এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে দেয়াল টপকে ওপাশে গেছে। ওপাশ থেকে এ পাশে আসতে সে ৩০ মিনিটের মতো সময় নিয়েছে। এ ৩০ মিনিট সে বাড়ির ভেতরেই ছিল। বের হওয়ার সময় সে গেইট দিয়েই বের হয়েছে। সে সময় দারোয়ান নাকি তার রুমে ঘুমাচ্ছিল। সামির সাহেবের মাথা ঘুরছে৷ এত বড়ো সত্য কীভাবে বৃষ্টি তার থেকে লুকালো সেটাই ভাবছে সে। এখানে আরও খেয়াল করলে লক্ষ্য করা যায় রাত ১২ টা ৪৭ থেকে ১ টা ৫৭ পর্যন্ত সিসিটিভি বন্ধ ছিল। এর কারণ হিসেবে জানানো হয় সে সময় জেনারেটন নষ্ট ছিল৷ বৃষ্টি ১২ টা ৪৭ এর আগেই সেখান থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। আর এর পর পরই সিসিটিভি প্রায় এক ঘন্টা বন্ধ ছিল৷ হুট করে জেনারেটর নষ্ট হওয়া, কারেন্ট চলে যাওয়া কাকতালীয় কেনো বিষয় না। এতে বুঝা যাচ্ছে হয় বৃষ্টির পর মেঘকে কেউ খুন করেছে নাহয় বৃষ্টি মেঘকে খু/ন করে বের হয়েছে এরপর সব অফ করে দিয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির কথা এবং কাজের মধ্যে অনেক অসংলগ্নতা স্পষ্ট যেটা সামির সাহেবকে বেশ ভাবাচ্ছে। তবে এখানে অনেকগুলো দিক ফোকাস করতে হবে৷ কাউকেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাবে না৷ বৃষ্টি, মেঘের পরিবার, যারা তদন্ত করেছে সেসব পুলিশ অফিসার এমনকি বিরোধী দলের জুলফিকার সহ সবাইকেই সন্দেহের তালিকায় রেখে খুটে খুটে পর্যবেক্ষণ করতে হবে৷

বৃষ্টির ফুটেজটা আরও ভালো করে সামির সাহেব দেখল। সে খেয়াল করল বৃষ্টি যখন দেয়াল টপকাচ্ছিল সে বারবার তার মাথায় হাত দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তার মাথায় কেউ আঘাত করেছে। সে যখন দেয়াল টপকে পার হয় তার কনুইয়ে কেটে যায়। আবার যখন সে গেইট দিয়ে বের হয় তখন তার মুখ উড়না দিয়ে পেঁচানো থাকে। কনুয়েই কাটা দাগটাও অস্পষ্ট। কিছুটা মাতাল মাতাল লাগছিল তাকে৷ মনে হচ্ছিল কোনো নেশাগ্রস্ত মেয়ে বের হচ্ছে। যদি সে নশাগ্রস্ত হয়ে থাকত তাহলে সে তার বাসা অবধি আসতে পারত না। সবকিছুই এখন প্রশ্নের বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে।

সিসিটিভি ফুটেজটা সে নিজের ফোনে ডাউনলোড করে নেয়। এরপর আকরাম সাহেবকে লেপটপ সহ পুরো ডকুমেন্টস টা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সুরাইয়া এসে ডকুমেন্টস গুলো নিয়ে যায়। সুরাইয়া যখন ডকুমেন্টস গুলো নিয়ে বের হচ্ছিল। সুরাইয়ার হাতে হুট করে একটা কাটা দাগ সামির সাহেবের চক্ষুগোচর হয়। সে ভেবে খেয়াল করে দেখল একই রকম দাগ বৃষ্টিও পেয়েছিল দেয়াল টপকাতে গিয়ে। সামির সাহেব সুরাইয়াকে পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করল

“হাতে ব্যথা পেলে কী করে?”

সুরাইয়া বেশ সাবলীল গলায় উত্তর দিল

“কনুইয়ে লোহার পেরেক লেগে ব্যাথা পেয়েছি। এই গেস্টে রুমের দরজাতেই একটা পেরেক লাগানো ছিল। কাঠ শুকিয়ে পেরেকটা হালকা বের হয়ে গিয়েছিল ঐটাই পরিষ্কার করতে ব্যাথা পেয়েছি। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। এখন শুকিয়ে গিয়েছে।”

কথাগুলো বলে দরজার পেরেকটাকে হাত দিয়ে নির্দেশ করে বলল

“এই যে এই পেরেকটা। আমি ব্যথা পাওয়ার পর হাতুরি দিয়ে পেরেটাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে”

সামির সাহেব আর কথা বাড়াল না। যতটুকু ইনফরমেশনের দরকার সে এখান থেকে কালেক্ট করে ফেলেছে। এসেছিল কয়েকদিন থাকার উদ্দেশ্যে। তবে এত দ্রূত সব পেয়ে যাবে বুঝতে পারে নি। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল আজকেই নিজের বাড়ি ফিরবে। এরপর অহনার সাথে দেখা করতে যাবে।

ভাবনার অবসান ঘটিয়ে সে নিজেকে গুছিয়ে নিল। আকরাম সাহেবের কাছে গিয়ে নম্র সুরে বললেন

“আমি যে কাজে এসেছি আপনি বুঝতে পেরেছেন। সেটার উত্তর যেহেতু পেয়ে গিয়েছি তাহলে আর এখানে থেকে কী করব। আমি চলে যাচ্ছি। তবে আমার স্ত্রী সন্তানকে বিনা কারণে হ/ত্যার প্রতিশোধ একদিন না একদিন নিবই আমি। আমি আপনার সন্তানের খুনীকেও বের করে দিব। সময় দিবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। আপনার আশেপাশেই অনেক শত্রু আছে আপনি বুঝতে পারছেন না। ছেলে হারিয়েছেন সে আবেগে জর্জরিত না হয়ে নিজের দিকে শক্তভাবে খেয়াল রাখুন। অন্তত ছেলের খু/নীকে যেন শাস্তি দিয়ে মরতে পারেন। এর আগে যেন আপনার খু/ন নাহয়। রাজনীতিবিদ আপনি। ছেলের খু/নীর ব্যাপারে যেমন কঠোর তেমনি নিজের এবং নিজের স্ত্রী এর নিরাপত্তার ব্যাপারেও কঠোর হন। ভালো থাকবেন।”

কথাগুলো বলা শেষ করেই সে বের হয়ে গেল। সে এখন তার নিজের বাসায় যাবে না। সরাসরি যাবে তার বন্ধু অনিকের বাসায়। কারণ এখান থেকে বের হলে কেউ যে তাকে অনুসরণ করবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তাই বৃষ্টির খোঁজ যেন না পায় সেজন্য সে এ গেমটা খেলবে। যাতে করে প্রতিপক্ষ তাকে লক্ষ্য করলেও লক্ষ্যচ্যুত হয়। দাবার গুটিতে রাজাকে যেভাবে চেক দেওয়া হয় সেভাবেই যেন তারাও আটকে যায়।

সামির সাহেব বিদায় নিয়ে অনিকের বাসায় প্রথম উঠল। এরপর সেখানে বেশ কিছুক্ষণ থেকে নিজের বাসায় গেল। দরজার ডাবল লক তার কাছে ছিল। তাই সে লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। বৃষ্টি ডাইনিং এ বসে খাবার প্লেটে নিয়ে তাতে হাত দিয়ে নাড়াচ্ছে। সামির সাহেব সে সময়টায় বৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললেন

“খাবার হাত দিয়ে না খুটে খেয়ে নিন৷ খাবার এভাবে নাড়লে পেটের বাচ্চা কষ্ট করবে। সে তো আর মায়ের মন ভালো না এটা বুঝবে না।”

সামির সাহেবের কণ্ঠ সুরে বৃষ্টি চমকে পেছনে তাকলো। এত দ্রূত তিনি ফিরে আসবেন বুঝতে পারে নি । সে কিছুটা বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল

“আপনি এত দ্রূত চলে আসছেন? আপনি কী জানতে পেরেছেন মেঘের খু/নী কে?”

বৃষ্টির অস্থিরতা দেখে সামির সাহেব কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর বেশ সাবলীল গলায় উত্তর দিল

“এখনও না৷ জানলে অবশ্যই জানাব।”

বৃষ্টি মাথা নাড়াল। মুখে লোকমা তুলার জন্য তার মুখের কাছে হাত নিল। সামির সাহেব বৃষ্টির হাতের দিকে তাকাল। ডান হাতের কনুইয়ে কাটা দাগটা স্পষ্ট। সামির সাহেব বৃষ্টির পাশে চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করলেন

“হাতে এটা কিসের কাটা দাগ বৃষ্টি?”

বৃষ্টি প্রথমে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল

“মেঘদের বাড়িতে ঢুকার জন্য দেয়াল টপকাতে চেয়েছিলাম। কখন যে হাত কেটে রক্ত বের হয়ে গিয়েছে খেয়াল করিনি। এমনকি আমার এখনও মনে পড়ে না আমি ঐ বাসা থেকে ফেরার পথে কোন পথে ফিরেছি। কীভাবে কী দিয়ে বাসায় এসেছি। অনুমানের ভিত্তিকে যদিও অনেক কিছু বলেছি। তবে আমার স্মৃতি থেকে মনে হচ্ছে ঐখানে থাকা ৩০ টা মিনিট চলে গেছে। অনেক হিসাব মেলানোর চেষ্টা করেছি। তবে পারিনি৷ খুব অস্বস্তি হয় সেসব মনে করলে। আমার ভেতরটা অনেক হাহাকার করে। সন্তানের জন্য নিজেকে সামলে রাখা। আচ্ছা একটা কথা দিবেন?”

বৃষ্টির কথা শুনে সামির সাহেবের তার দিকে তুলা আঙ্গুলটা নেমে গেল। এমনও হতে পারে বৃষ্টি দেয়াল টপকানোর পর মাথায় আঘাত পেয়ে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আর সে সময় অন্য কেউ মেঘকে খু/ন করেছে। আর জ্ঞান হারিয়ে ফেলার জন্য সে সব ভুলে গিয়েছে। বৃষ্টির দিকে আঙ্গুল উঠলেও সেটা বেশিক্ষণ তার দিকে তাক করে রাখা যায় না। কোনো না কোনো ভাবে সেটা ভুল প্রমাণিত হয়৷ ভাবনাটাকে এক পাশে রেখে বৃষ্টির কথার প্রতি উত্তরে বলল

“সাধ্যের মধ্যে হলে রাখব৷ বলেন আগে কী চান। এরপর নাহয় জানাব রাখতে পারব কি’না।”

বৃষ্টি খুব অসহায় গলায় উত্তর দিল

“আমার সন্তান হলে যদি আমি মারা যাই তাহলে আপনার কাছে আমার সন্তান রাখবেন৷ ওর দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি কারও ছায়া ওর শরীরে লাগতে দিবেন না। আমার সন্তানকে আপনি মানুষ করবেন। যদি মেয়ে হয় নাম রাখবেন উষ্ণ । আমার একটা প্রিয় গল্পের চরিত্রের নাম এটা। আর ছেলে হলে নাম রাখবেন রোদ। মেঘের একটা প্রিয় গল্পের চরিত্রের নাম এটা।”

সামির সাহেব সন্তানের কথা শুনতেই কেঁপে উঠল। নিজের মেয়ের কথা তার মনে পড়ে গেল। চোখ দুটোতে অশ্রু এসে জড়ো হলো। নিজেকে সামলে উত্তর দিল

“মরে যাবেন কেন? নিজের সন্তানের জন্য বাঁচবেন। সন্তানের জন্য সংগ্রাম করবেন। মা হারা সন্তান এবং সন্তান হারা মা,বাবার জন্য পৃথিবীটা নরক। এ হাহাকার কেউ নেভাতে পারে না। একজনের অপূর্ণতা আরেকজন ফুলফিল করতে পারে না৷ নিজের সন্তানের জন্য হলেও নিজেকে শক্ত করুন। এটা মেঘের শেষ স্মৃতি। আগলে রাখার চেষ্টা করুন বাজে চিন্তা না করে। ”

কথাগুলো বলে সামির সাহেব চলে গেলেন তার রুমে। রুমে এসেই পুরনো এলবামটা বের করে নিজের স্ত্রী আর সন্তানের ছবিগুলো দেখতে লাগলেন। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গাল বেয়ে এলবামে এসে পড়ছে। এতদিন বেঁচে ছিল ভেবে একটা আশা তার মনে ছিল কোনো না কোনোদিন দেখা হবে। আজকে সে আশাটাও নিভে গেল। হারানোর বিষাদ এত কঠিন কেন হয়? এসব ভেবেই তার বুক ভারী হতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে সে হালকা হেলান দিয়ে খাটে চোখ বুজলো৷

আবারও সে সুরেলা হাসি আর মেয়ের কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসে আসল।

“বাবা বলটা দাও না।”

অনেকটা অস্থির হয়ে চোখ খুললো। খাটের পাশে রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিল। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে নিল। তারপর হালকা ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে টুকটাক খাবার গরম করে কিছুটা খেয়ে নিল। এরপর আবারও বৃষ্টির কাছে গিয়ে বলল

“আমি একটু বের হচ্ছি। একটা কাজে লালমনিরহাটে যাব। ফিরতে দুদিন সময় লাগবে। নিজের খেয়াল রাখবেন।”

“লালমনিরহাট কেন? কী কাজ সেখানে? আপনি কী মেঘের বিষয় নিয়ে আর ভাবছেন না? আপনি কিন্তু বলেছেন আমাকে সাহায্য করবেন মেঘের খু/নীকে বের করতে।”

সামির সাহেব কিছুটা বিরক্ত গলায় জবাব দিল

“সবকিছুর কৈফিয়ত চান কেন? আমি কী বলেছি মেঘের বিষয় নিয়ে আমি ভাবছি না? অবশ্যই ভাবছি। সময় মতো সব পেয়ে যাবেন। এত অস্থির হলে সব হারাবেন। নিজের শরীরের যত্ন নিন। আমি গেলাম৷ আর পিছু ডাকবেন না। সব কাজে বাঁধা দেন৷ ”

কথাগুলো বলেই সামির সাহেব ঘর থেকে বের হলেন। বৃষ্টি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামির সাহেবের আচমকা রাগের কারণ সে বুঝতে পারছে না।

এদিকে সামির সাহেব অহনার ঠিকানা ধরে যাচ্ছে৷ এখান থেকে তার যেতে সাত ঘন্টা সময় লাগবে৷ অর্থাৎ রাত ১১ টায় সে পৌঁছাবে। তাই বেশ ক্যালকুলেশন করে গাড়িটা চালাচ্ছে সে। ঢাকা পার হলেই রাস্তা ফাঁকা পাবে। তখন একটু দ্রূত যেতে পারবে৷

রাত ১১ টা। অহনা বসে আছে। সাথে তার তিন বছরের বাচ্চা। বাচ্চাটির নাম ফয়াজ। দেখতে বেশ সুদর্শন এবং নাদুসনুদুস। বাচ্চাটা বারবার জিজ্ঞেস করছে

“মা.. বাবা কবে আসবে? বাবাকে খুব মিস করছি। একদম ভালো লাগে না বাবাকে ছাড়া।”

অহনা চোখের কোণের জলটা মুছে ফায়াজকে উত্তর দিল

“সময় হলেই বাবা আসবে ফায়াজ। তুমি রুমে গিয়ে লক্ষী বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে যাও।”

ঠিক এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ পেল অহনা। সে কিছুটা অবাক হলো এটা ভেবে এত রাতে কে এসেছে! বাসায় কোনো পুরুষ মানুষ নেই । এ সময় কেউ আসলেও ভয়ের বিষয়। সে দরজার গ্লাস দিয়ে চোখ উঁচিয়ে দেখল সামির সাহেব দাঁড়ানো। অহনা সামির সাহেবকে চেনে। কারণ তারই ক্লাসমেট ছিল। হঠাৎ জায়গা পরিবর্তন হওয়ায় প্রায় ৭ বছর তার সাথে যোগাযোগ নেই। এত বছরে সামির সাহেবের চেহারাতেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। সে দরজাটা খুলতেই সামির সাহেবও আঁৎকে উঠল। একটা খুনের ফিতা ধরে এগুতেই যে এত এত অতীত সামনে আসবে কে জানত। অহনা একটা সময় তার বেশ ভালো বন্ধু ছিল৷ সে অহনাকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল

“তুমি কী সেই অহনা যে আমার সাথে পড়াশোনা করেছো?”

অহনা হালকা হেসে জবাব দিল

“হ্যাঁ। কিন্তু তুমি আমার ঠিকানা কী করে পেলে? আর বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসো। কতদিন কথা হয় না৷”

সামির সাহেবের ইনভেস্টিগেশনের কাজটা আরও সহজ হয়ে গেল। সে বেশ খুশি মনে ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে প্রবেশ করতেই দেয়ালে ফায়াজ, অহনা আর মেঘের ছবি দেখে আঁৎকে উঠল। সে অহনার দিকে তাকিয়ে মেঘের ছবিকে নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করলেন,

” উনি কে? কী হয় তোমার?”

এরপর উত্তর আসলো…

#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৪

এরপর উত্তর আসলো

“আমার ছেলের বাবা।”

সামির সাহেব কথাটা শুনে বিস্মিত হলো। ভাবতে লাগল তাহলে কী মেঘ বৃষ্টির সাথে প্রতারণা করেছে? তাহলে কী সে ১০ বছরের সম্পর্ককে তুচ্ছ করে এখানে সংসার পেতেছিল? তবে মেঘ আর অহনার বয়সের পার্থক্য আছে। মেঘ অহনার বয়সে ছোটো হবে। সামির সাহেব বিস্ময়টাকে কাটিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল

“অহনা আমি মেঘকে চিনি। আমার খুব পরিচিত একজন মেয়ে, নাম বৃষ্টি তার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের রাতেই ছেলেটির খুন হয়। তাই বিয়েটা আর হয়নি। আমি সত্যিই বুঝতেছি না এটা যদি তোমার ছেলের বাবা হয় তাহলে বৃষ্টি কে? তোমার সাথে মেঘের পরিচয় কীভাবে? তোমরা কবে বিয়ে করেছো? যদি তুমি তার বউ হও আর ফয়াজ তার ছেলে হয় তাহলে তুমি জেনে শুনে তোমার স্বামীকে অন্যত্র বিয়ে করাচ্ছিলে? এটা খুবই অদ্ভুত লাগছে।”

মেঘের মৃ/ত্যু সংবাদটা শুনে অহনার চোখে আবারও একটু জল চলে আসলো। নিজেকে খানিকটা সামলে সে উত্তর দিল

“মেঘ আমার ছেলের বাবা কিন্তু আমার স্বামী নয়৷ আমার স্বামী মারা গিয়েছে ১ বছর আগে। সেও ডাক্তার ছিল। আমাদের সাজানো সংসার হুট করেই এলোমেলো হয়ে গেল। আমার দুই বছরের বাচ্চা ফায়াজ তার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসত। বুঝ হওয়ার পরেই তার বাবা হারানোটা সে মানতে পারে নি। একটা হার্ট এটাক আমার জীবনটাকে ধ্বংস করে দেয়। কারণ ফায়াজের জন্মদাতা বাবা শিমুল আচমকা হার্ট এটাকে মারা যায়। টানা দুই মাস আমার ছেলে ফায়াজ তার বাবার জন্য কেঁদেছে। অস্বাভাবিক আচরণ করত। বাবার মৃত্যু শোকটা সে সামলে উঠতে পারছিল না। কিছু খেত না। একদম খিটমিট করত। সারাদিন বাবা, বাবা করে চিৎকার করত। ছোটো একটা বাচ্চা এমন করবে কখনও বুঝতেও পারিনি।

আমার স্বামী যেহেতু এ হাসপাতালের ডক্টর ছিল তাই আমার বাসাও হাসপাতাল কোয়ার্টারের ভেতর ছিল। সে সময় মেঘ সবেমাত্র বিসিএস কমপ্লিট করে এ হাসপাতালারে ডাক্তার হিসেবে জয়েন করে। তার প্রথম পোস্টিং এখানেই হয়।

প্রায় সময় আমাকে ফায়াজের অসুস্থতার জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হত। সেদিন ছিল শীতের সকাল। ফায়াজের প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাকে দ্রূত নেবুলাইজার দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাই ফায়াজকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। সে সময় মেঘ ব্যাটমিন্টন খেলছিল। ফায়াজের অবস্থা দেখে সে ছুটে আসে। আমাকে সব কাজেই সাহায্য করে সে। ফায়াজকে সামলাতে সে ভীষণ সাপোর্ট করেছিল আমাকে। ফায়াজকে সেদিন নেভুলাইজার দিয়ে একটু স্বাভাবিক করার পর সে সরাসরি মেঘকে বাবা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরে।

সেই থেকে ফায়াজ মেঘকে যেখানেই দেখত বাবা বলে ডাকত। আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্ক সুন্দর হতে লাগল। মেঘও বাবা ডাকলে বাবার মতোই সাড়া দিত। আর এ সম্পর্কের জের ধরেই আমার আর মেঘের মাঝে একটি সু সম্পর্ক স্থাপন হয়। টানা একটা বছর মেঘ আমাদের বাসায় যাতায়াত করত ফায়াজের জন্য। ব্যাচেলর থাকত তাই আমার বাসা থেকেই খাবার পাঠাতাম ওর জন্য নাহয় সে এসে খেয়ে যেত। সম্পর্কটা তার কাছে বন্ধুত্বের মতোই ছিল। তবে আমি আস্তে আস্তে তার প্রতি দুর্বল হতে শুরু করি। তাকে ভালোবাসতে শুরু করি। একটা সময় কখন যে তাকে ভালোবেসে ফেলেছি জানি না। মনে হচ্ছিল মেঘকে বিয়ে করলে আমার ফায়াজ ভালো থাকবে আমিও ভালো থাকব। নানা ছুঁতোই তাকে স্পর্শ করার অজুহাত আমি খুঁজতাম। জানি না কেন এমন করতাম। খুব বেশি আবেগ কাজ করত তাই।

মেঘ অবশ্য বিষয়টি একদিন বুঝতে পেরে আমাকে সরাসরি জানিয়ে দেয়, আমি যা চাচ্ছি সেটা কোনোভাবেই সম্ভব না। সে বৃষ্টি নামের একটি মেয়েকে ভালোবাসে। আর তাকেই বিয়ে করবে। আর সে শুধু ফায়াজের মন ভালোর জন্য আমাদের সাথে সু সম্পর্ক রেখেছে। এটাকে কখনও বাড়িয়ে দেখে নি। তার জীবনে বৃষ্টিই সব। এতদিন সে আমার সাথে বৃষ্টির বিষয়টি শেয়ার করেনি। একটু চাপা স্বভাবের ছিল সেজন্য হয়তো। তবে যেদিন বৃষ্টির কথা জেনেছি তারপর থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের অনেক চেষ্টা করেছি। তারপরও কেন জানি মনে হতো মেঘ আমার জীবনে থাকলে আমার জীবনটা সুন্দর হয়ে যাবে। মেঘকে বিষয়টি অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করলেও সে এটা এড়িয়ে গিয়েছে।
একটা সময় পর সে এখান থেকে পোস্টিং নিয়ে চলে যায়। নিজের ফোন নম্বরটা পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলে। সে অনাকাঙ্ক্ষিত অসম প্রেমে জড়াতে চায়নি। তবে আমার মনে তো আর কোনো বাঁধা ছিল না। তাই, না চাইতেও আমি জড়িয়ে পড়ি৷
মেঘ যখন অসুস্থ হয় আমি সেবা করি। তার শরীরের গন্ধও আমার চেনা। কখনও সে আমাকে নানা বাহনায় স্পর্শ করার চেষ্টা করেনি৷ বরং আমিই বারংবার তাকে স্পর্শ করার বাহানা খুঁজেছি। সে বৃষ্টির প্রতি অত্যাধিক লয়াল ছিল। তাই বৃষ্টি ছাড়া কারও জায়গা হয়নি তার জীবনে। একমাত্র বৃষ্টিই ছিল তার ভালোবাসার অবলম্বন।
যখন বুঝতে পারলাম শত চেষ্টা করেও আমি তাকে পাব না তখন নিজেকে শুধরে নিয়েছিলাম। তাকে অনুরোধ করেছিলাম আমার সাথে অন্তত স্বাভাবিক সম্পর্কটা বজায় রাখতে। কিন্তু সে তাতেও রাজি হয়নি। শেষ কথা যখন বলেছিলাম তখন সে জানায় বৃষ্টির সাথে কিছুদিন পর তার বিয়ে। আর বৃষ্টি আমাদের ব্যাপারে কিছুই জানে না। কারণ এরকম কিছু জানলে বৃষ্টির মন ভাঙতে পারে। সন্দেহ আসতে পারে। তাই সে কিছুই জানায়নি।
তার ফোন নম্বর পরিবর্তন করায় তার নতুন নম্বর ছিল না। না দেওয়ারও একটা কারণ ছিল কারণ সে আমার থেকে নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছিল। শুধু বাড়ির ঠিকানাটা জানতাম। তাই তাকে উদ্দেশ্য করে একটা চিঠিও লিখেছিলাম। সেটার উত্তর আর মেলে নি। এরপর তার খু/নের খবর টেলিভিশনে প্রচার হলো।

যাকে সে পাগলের মতো ভালোবাসলো সে মানুষটাই তাকে খু/ন করে ফেলল। খুব অদ্ভূত লাগে। মেঘের মতো একটা মানুষের ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। সে ভালোবাসা বৃষ্টি পেয়েও কীভাবে উপেক্ষা করল? কীভাবে খু/ন করল তাকে? আবার এটাও শুনলাম মেঘ নাকি বৃষ্টির আর তার বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিল। আর সে রাগে বৃষ্টি এমনটা করেছে। সে হয়তো বিয়েটা ভেঙেছিল আমাদের জন্যই। কেন জানি না মন বলছিল সে আমাদের কাছে আসতে চাচ্ছিল। আমাকে সে ভুলে গেলেও ফায়াজকে তো ভুলতে পারবে না। একটা বছরের স্মৃতি কি মুছা এত সহজ?”

অহনা কথা থামালো। সামির সাহেবের মেঘকে কেবল সুপার হিরো লাগছে এখানে। এমন একটা হিরো যে যার জীবনেই যায় সুবাসিত করেই ছাড়ে। বৃষ্টির প্রতি তার ভালোবাসা এটা জানান দেয় বিয়ে ভাঙার প্রশ্নই আসে না৷ তবে মেঘ কেন খু/ন হয়েছে এদিকে ফোকাস না দিয়ে বরং এখন ফোকাস দেওয়া জরুরি মেঘ কেন বিয়েটা ভেঙেছিল! কেন সে বৈশাখীকে এমন একটা মেসেজ দিয়েছিল! সেদিন দুপুরে কী হয়েছিল? এ মুহুর্তে মেঘের কল রেকর্ড বের করা জরুরি হয়ে যাচ্ছে তার কাছে। ভাবনায় ডুবে গেল সে। অহনার কথায় তার ভাবনার ঘোর কাটলো। অহনা জিজ্ঞেস করল

“কিন্তু তুমি হঠাৎ এখানে? কীভাবে আমার ঠিকানা জেনেছো? আর আমার কাছেই বা কেন এসেছো? কিছু কী হয়েছে?”

সামির সাহেব পকেট থেকে অহনার লেখা চিঠটা তার হাতে দিয়ে উত্তর দিল

” চিঠিটা মেঘের হাতে পৌঁছায় নি। পৌঁছেছিল আমার হাতে। ভাবলাম মেঘের সাথে কী কানেক্ট তোমার তাই জানতে এসেছিলাম। পুরনো গোয়েন্দাগিরির অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি। তোমার চিঠি দেখে মনে হয়েছিল মেঘ আর তোমার মাঝে গভীর কোনো সম্পর্ক ছিল। মেঘ হয়তো বৃষ্টিকে ঠকিয়েছিল। তবে এখন তোমার কথা শুনার পর মেঘের প্রতি থাকা অভিযোগ গুলো উঠে গেল। সত্যিই মেঘ অসাধারণ একজন মানুষ ছিল। সে যার জীবনে যায় তাকে রাঙিয়ে দেয়। যাইহোক অনেক কথায় বলে ফেললাম। সাবধানে থেকো। তবে অনেক সময় আমরা ভুল মানুষের প্রেমে পড়ি। তোমার জীবনে মেঘও সেই ভুল প্রেম। ফয়াজকে সময় দাও। স্মৃতিগুলো মুছে দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করো। তোমার জন্য অনেক শুভকামনা। আমি চললাম।”

অহনা পিছু ডেকে বলল

“অনেক রাত হয়েছে। এত রাতে তুমি না গিয়ে কাল সকালে যাও। এসেছো, বসো, কিছু খেয়ে বিশ্রাম করো। কাল নাহয় সকাল সকাল চলে যেও। এত তাড়া তো নেই।”

সামির সাহেব ডান হাত দিয়ে তার মাথায় হালকা চুলকিয়ে উত্তর দিল

“তাড়া ভীষণ আছে। আর সে তাড়ার তাড়নায় যেতে হবে। অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালোই লাগল। নম্বর তো নিয়ে নিয়েছি। ঠিকানাও জানি। অন্য একদিন চলে আসব তোমার কাছে আড্ডা দিতে। সে সময় পর্যন্ত ভালো থাকো। ”

কথাগুলো বলে সামির সাহেব চলে গেল। অহনা চেয়ারে বসে আছে স্থির হয়ে। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।

“মানুষের জীবনে সত্যিই একটা প্রেম আসে। যেটা সঠিক সময়ে আসে না। অসময়ে আসে অসম প্রেম হয়ে। আর সে অসম প্রেমের নাম হয় ভুল প্রেম”

এদিকে সামির সাহেব ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলো। ঢাকায় গিয়েই সে মেঘের কল লিস্ট চেক করবে সবার প্রথমে। অনেক ভাবনায় তার মাথায় আসছে। একটা খুন যেন তার মাথা পাগল করে তুলছে।

সকাল ৯ টায় সে ঢাকায় পৌঁছেছে। বাসায় ঢুকেই সে লক্ষ্য করল বৃষ্টি মেঝেতে পড়ে আছে আর তার নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সামির সাহেব দ্রূত তিন্নিকে কল দিল। তিন্নি এসে বৃষ্টিকে একটা স্যালাইন দিল প্রথম। তার প্রেসার অত্যাধিক লো ছিল। সে সাথে বৃষ্টির সাথে কথা বলে একটি বিষয় আবিষ্কার করল। যা সামির সাহেবকে অনেকগুলো প্রশ্নের গোলকধাঁধা থেকে বের করে আনে। আর সে সাথে অজানা একটি আশঙ্কাও তাকে ঝেঁকে ধরে।