#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৫
তিন্নি সামির সাহেবকে জানায় বৃষ্টি বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিস অর্ডারে ভুগছে আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে সে বাইপোলার ডিস অর্ডারে আক্রান্ত । এ রোগী গুলো নিজেকে দু রকম চরিত্রে কল্পনা করে। একটা তার নিজস্ব চরিত্র যেটা সে ছোটো থেকে বহন করে নিয়ে আসে। অন্যটি হলো তার কল্পনায় থাকা চরিত্র যেটা সে কল্পনা করে ডাবল রোল প্লে করে। সিজোফ্রেনিয়ার প্রকোপ আকার ধারণ করলে মূলত এমন হয়।
বৃষ্টি নিজেকে আঘাত করেছে তার মানসিক অসুস্থতার জন্যই। বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিস অর্ডার হলে মূলত রোগীর আচরণ হুটহাট পরিবর্তন হয়ে যাবে। নিজের জীবন নিয়ে ঝুঁকি নিতেও সে ভয় পাবে না। আবার মেজাজ ও কড়া হয়ে য়াবে। ক্ষণে ক্ষণে মুড পরিবর্তন হবে। এসব রোগীরা যেকোনো সময় নিজের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। সাবধানে রাখতে হয় রোগীদের। অনেক সময় তারা কী করে সেটাও তারা মনে করতে পারে না। তাই বৃষ্টিকে চোখে চোখে রাখতে হবে। ওর বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।”
সামির সাহেব শুধু একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। সে ভাবছে এমন তো না বিষয়টা… বৃষ্টি রাগের মাথায় মেঘকে খু/ন করে দিয়েছে আর এরপর সব ভুলে গিয়েছে। যেহেতু সে একটি মানসিক রোগে আক্রান্ত। প্রশ্নটা তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে তাকে। তবে এটাও প্রশ্ন তুলে বৃষ্টির পক্ষে মেঘের বডিটাকে তুলা আদৌ সম্ভব না।
তিন্নি চলে গেল। বৃষ্টির হাতের দিকে সামির সাহেব ভালো করে তাকিয়ে লক্ষ্য করল তার হাতে আঁচড়ের দাগ। নিজের হাতে নিজেই নখ দিয়ে খুটেছে। হয়তো সে ট্রমাটা নিতে পারছে না তাই এমন করছে। বৃষ্টিকে অন্য কোনো ডাক্তার দেখানোর উপায় নেই। কারণ বাইরে নিয়ে গেলেই কোনোভাবে পুলিশ জানলে তাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যাবে। ভীষণ চিন্তা তাকে গ্রাস করছে। অকালে একটা প্রাণ চলে যাবে এটা সে মানতে পারছে না।
সামির সাহেব রুম থেকে বের হয়ে নিজেকে একটু ফ্রেশ করে নিল। এরপর সরাসরি রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে নিল। কফির প্রতি তার ভীষণ নেশা আছে। হট কফি সে খায় না কনকনেও শীতেও সে কোল্ড কফি খায়।
সামির সাহেব কফিতে চুমুক দিয়ে খাচ্ছে আর ভাবছে। এদিকে মেঘের কল লিস্ট বের করে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সেটার কাজ চলছে। বলা হয়েছে আজকে রাতের মধ্যেই লিস্টটা চলে আসবে। কল লিস্ট আসলে কোনো না কোনো সত্য প্রকাশ পাবেই।
মাথাটা ঘুরছে তার। শরীর কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগছে। এত অলস কখনও লাগেনি তার। নিজ সন্তান আর স্ত্রীর কণ্ঠ কেবল কানে ভাসছে তার। সাজানো একটা বাগান যেন হুট করেই রক্তে লাল হয়ে গেল। ঘুমও পাচ্ছে ভীষণ। সারা রাত ঘুম হয়নি৷ হালকা ক্ষুধা পেলেও সেটা প্রাধান্য পাচ্ছে না ঘুমের তাড়নায়। পরপর দুটো হাই তুলে চোখ বন্ধ করল সে।
কখন ঘুমিয়ে গেল টের পেল না। যখন উঠল সে তার মোবাইলটা হাতে নিয়ে খেয়াল করল তার মোবাইলে ৯ টা কল এসেছে। কলটা এসেছে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে। সে সাথে সাথে কল ব্যাক করল। কল ব্যাক করতেই জানতে পারে গুয়েন্দা বিভাগের নিনাদ কল দিয়েছে। সে সামির সাহেবকে মেঘের কল লিস্ট থেকে শুরু করে বিস্তারিত লোকেশন পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছে।
সন্ধ্যা ৬ টা বেজে গেছে। এত লম্বা সময় সে ঘুমিয়েছে ভেবেই ব্যাকুল হচ্ছে। বিছানা ছেড়ে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বৃষ্টির রুমে উঁকি দিল। বৃষ্টি চুপ হয়ে বসে আছে। আনমনা হয়ে ফ্যানের দিকেই তাকিয়ে আছে। সামির সাহেব বৃষ্টিকে ডাকল না। সে প্রথমে রান্না ঘরে গিয়ে রাতের জন্য রান্না করে নিল। এরপর পেট ভরে খেয়ে নিল। কারণ কাল থেকে তার ভালো খাওয়া হয়নি।
এরপর সে মেঘের কল লিস্ট চেক করল। লিস্টে সন্দেহজনক কিছুই পেল না সে। সবগুলো নম্বর পরিচিত এবং স্বাভাবিক কথাবার্তায়। মেসেজ লিস্টে দেখা যায় বৈশাখীকে পাঠানো হয়েছিল একটা মেসেজ। বৃষ্টির ভাষ্যমতে বৈশাখী মেঘকে পছন্দ করত। কিন্তু মেঘ তাকে পাত্তা দিত না। তবে বিয়ের দিন মেঘ বৈশাখীকে মেসেজ দিয়ে জানিয়েছিল সে তাকে বিয়ে করতে চায়। এরপর খু/নের রহস্য আসে।
সামির সাহেবের একটু খটকা লাগে। বৈশাখী মেসেজ করার সময়টা সে চেক করে এবং সে সয়ম মেঘের ফোনের লোকেশন সে চেক করে। মেঘের ফোনের লোকেশন তখন বৃষ্টির বাড়ি দেখাচ্ছিল। এটা কী করে সম্ভব। সিসি ক্যামেরাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেঘ তখন তার বাসায় ছিল। তবে মেঘের ফোন কী করে বৃষ্টির বাসায় আসলো। সামির সাহেবের এবার মনে হলো হয়তো মেঘের ফোন কেউ নিয়ে নিয়েছিল। এরপর বৈশাখীকে মেসেজ সেই দিয়েছিল। কিন্তু সে কে? সামির সাহেবের মাথা একদম কাজ করছে না। সব মিলিয়ে আবারও জট পাঁকাতে শুরু করল।
সে তার রুম থেকে বের হয়ে বৃষ্টির রুমে গেল। বৃষ্টিকে উঁকি দিয়ে দেখল। সে এখনও ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। সামির সাহেব গলাটা একটু খাকিয়ে বৃষ্টির কাছে ভেতরে ঢুকার অনুমতি চাইলো। বৃষ্টি একটু নড়েচড়ে বসে সামির সাহেবকে আসার অনুমতি দিল।
সামির সাহেব ভেতরে ঢুকে বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করল
“আমাকে কী বলতে পারবে তোমাদের বাসা থেকে মেঘদের বাসায় যেতে রিকশা দিয়ে যেতে কেমন সময় লাগে? বাইক দিয়ে যেতে কেমন সময় লাগে? আর গাড়ি দিয়ে যেতে কেমন সময় লাগে?”
বৃষ্টি নম্র গলায় উত্তর দিল
“রিকশা দিয়ে যেতে সময় লাগে ৩০ মিনিট, বাইক দিয়ে যেতে ১৫ মিনিটের মতো। কিন্তু কেন?”
সামির সাহেব ভাবার্থ গলায় উত্তর দিল
” বৈশাখীকে যখন মেসেজ করা হয় তখন মেঘের ফোনটা তোমাদের বাড়িতে লোকেশন দেখাচ্ছিল। অবশ্য সুরাইয়া বলেছিল মেঘ বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পর আবারও সব ঠিক করার জন্য বের হয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে। এই ৩০ মিনিটের মধ্যে। আর সেটা ছিল বৃষ্টির অসুস্থতার সংবাদ পাওয়ার পর। তার মানে বিয়ে ভাঙার অনেক সময় পর। তাহলে নিশ্চয় মেঘ বাইকে করে তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েও ফিরে এসেছিল। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় মেঘ যদি তোমার সাথে বিয়ে ঠিক করার জন্যই যায় তাহলে সে সময় বৈশাখীকে কেন সে মেসেজ দিবে। সে তো বৈশাখীকে চায়তো না। আর বৈশাখীকে যখন মেসেজ দেওয়া হয় তখন সিসিটিভি ফুটেজ লক্ষ্য করলে দেখা যায় মেঘ সে সময় বাসায় ছিল। তাহলে সে যদি বাসায় থাকে তাহলে তোমার বাসার সামনে মেঘের ফোনের লোকেশন কেন দেখাবে? এটা ভাবার বিষয়৷”
বৃষ্টি সামির সাহেবের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তার ভেতরটা বুঝে গেল খু/নটা কে করেছে। যাকে সে কোনোদিন খু/নী মনে করেনি। যাকে সে ভাবতে পারেনি এমন একটা কাজ করবে। যে সবার সন্দেহের আড়ালে ছিল। মাঝে মাঝে খু/নী আমাদের আশেপাশেই থাকে কিন্তু আমরা সেটা বুঝতে পারি না। বৃষ্টি নিজেকে সামলে বলল
“বৈশাখীর সাথে মেঘের কিছু ছিল না। বৈশাখীকে দেওয়া মেসেজটাও কখনও আমার বিশ্বাস হয়নি। আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছিল এটা সাজানো কোনো ফাঁদ। যে ফাঁদে বৈশাখীকে কেবল ব্যবহার করা হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি খু/নী কে? মেঘের খুব কাছের একটা মানুষেই খু/নী। যে সবার আড়াল থেকে গিয়েছিল। তাকে কখনও আমি সন্দেহের তালিকায় আনিনি। এমন কী আপনিও না। তবে এখন সব দিক মিলিয়ে দেখলে মনে হয় খুন টা সে করেছে। আমি নিশ্চিত আমার এ ধারণা ভুল না৷ আচ্ছা আমি যদি কাউকে তুলে আনতে বলি আপনি পারবেন?”
সামির সাহেবের বিস্ময় বেড়ে গেল। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল
“খুনটা কে করেছে আপনার ধারণা?”
এরপর বৃষ্টি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল
“অনেক সময় শর্ষের মধ্যেও ভুত থাকে।”
বর্তমানে ফিরে আসে সামির সাহেব। সে লক্ষ্য করে উষ্ণ চুপ করে বসে আছে তার পাশে। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সামির সাহেব থেমে যেতেই উষ্ণ বলে উঠে
“খু/নটা কে করেছিল বাবা? আর আমার মা কী বেঁচে আছে? নাকি মেঘের মতোও মা চলে গিয়েছে? মা যদি বেঁচে না থাকে তাহলে এতদিন আমি যার সাথে কথা বলেছি উনি কে? আর মা যদি জেলে থাকে তাহলে উনাকে তো কখনও আমি ভিডিও কলে জেলে দেখিনি। আমার বাবা কী তুমি নাকি মেঘ? আর মা কী বাবাকে খুন করেছিল? মা যদি এমনটা করে আমি আমার মাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃনা করব।”
এমন সময় হাসপাতাল থেকে কল আসে। নার্স জানায় রোগীর অবস্থা অনেক খারাপ। সে যেন দ্রূত যায়। সামির সাহেব ফোনটা রেখে উষ্ণকে উত্তর দিল
“আমার এখন হাসপাতালে যেতে হবে। ভাইয়ের শরীর ভীষণ খারাপ। তোমার সকল প্রশ্নের জবাব হাসপাতাল থেকে এসে দিব৷ আর মায়েরা যত বড়ো অন্যায় করুক না কেন তাদের কখনও ঘৃনা করতে হয় না। তারা মা। মা জাতি সকল সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা রাখে৷ বৃষ্টি তোমার মা। সে তোমার কাছে সবসময় সম্মানের থাকবে এটাই মাথায় রাখবে৷ আর বৃষ্টি যদি মেঘকে খু/ন করেও থাকে সেটারও একটা রহস্য থাকবে৷ পুরো ঘটনা না জেনে মাকে ঘৃনা করতে হয় না। ১৪ টা বছর পার করেছি তোমাকে নিয়ে। সত্যিটা এজন্যই বলতে চাইনি মায়ের প্রতি তোমার বিরূপ ধারণা আসতে পারে তাই। কিন্তু যথেষ্ঠ বুঝবান হয়েছো। এ সময় তোমাকে সত্যটা জানানো উচিত তাই জানাচ্ছিলাম। প্রথম থেকে ঘটনা এজন্যই বলেছিলাম যাতে তুমি পুরো ঘটনা বিবেচনা করে জাজ করতে পারো।”
কথাগুলো বলে সামির সাহেব বাসা থেকে বের হয়ে হাসপাতালে গেলেন। উষ্ণ বৃষ্টির মেয়ে। বয়স ১৪। সে কখনও মাকে সামনাসামনি দেখেনি৷ কেবল ভিডিও কলে কথা বলেছে। কিন্তু মায়ের প্রতি তার ভীষণ ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করে। আজকে স্কুলের প্যারেন্টস মিটিং কে কেন্দ্র করে উষ্ণ বেশ ডেসপারেট হয়ে যায়। তার মায়ের প্রতি থাকা সকল ক্ষোভ সে প্রকাশ করে। এমন একটা সময় সামির সাহেবও চিন্তা করে সত্যটা আর বেশিদিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। তাই প্রথম থেকে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনায় উষ্ণকে তিনি বলছিলেন। তবে হাসপাতাল থেকে ইমারজেন্সি কল আসার পুরোটা বলা সম্ভব হয়নি।
এদিকে উষ্ণের মনে অনেক প্রশ্নই জমা হয়েছে। সে জানতে চায় সত্যিই তার বাবা কে? মেঘ যদি তার বাবা হয় তাহলে তার বাবার খু/নী কে? আর তার বাবাকে যদি তার মা খু/ন করে থাকে তাহলে যার সাথে কথা বলে সে কে? অনেক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনে।
এমন সময় তার চোখ গেল বাবার সে নিষিদ্ধ রুমের দিকে। যে রুমে কারও ঢুকা নিষেধ। উষ্ণ ও কখনও সে রুমে প্রবেশ করেনি। বাবার অনুমতি ছিল না তাই। রুমটা লক না। তবুও সে বাবার অনুমতি উপেক্ষা করে প্রবেশ করেনি। আজকে সে তার বাবার অনুমতির আশা করলো। সরাসরি সে রুমে প্রবেশ করল। সেখানে ঢুকে সে অনেকটায় বিস্মিত হয়ে গেল। বুক ধুক ধুক করে উঠল।
মেঘের আকাশ ভেদ করে নেমে আশা বৃষ্টির মতো যে সে সত্যের মুখোমুখি হবে কে জানত?
#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৬
উষ্ণ খেয়াল করল ঘরটার একটি কোণে একটা মেয়ের ছবি রাখা। ভালো করে ছবির চোখ গুলো লক্ষ্য করলে বুঝা যায় এটাই বৃষ্টির ছবি। কারণ ছবিতে থাকা মেয়েটির চোখ নীল। তবে প্রশ্ন দাঁড়ায় উষ্ণ যাকে মা বলে জানে সে কে? সে তো দেখতে বৃষ্টির মতো না। চারপাশটায় খেয়াল করলে একটা পারিবারিক ছবি পাওয়া যায় যেখানে সামির সাহেব এবং তার স্ত্রী, সন্তানের সাথে ছবিটা তুলা। একটা বোর্ডে চারজন মানুষের ছবি লাল দাগ দিয়ে কাটা। ছবির নীচের নামগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় একটা ছবি আকরাম সাহেবের, একটা ছবি রেহনুমা রশিদের, একটা ছবি জমশেদ সাহেবের, একটা ছবি বৃষ্টির।
ছবিগুলোর মানে সে বুঝতে পারছে না। সে ছবিগুলো দেখার জন্য বোর্ড বরাবর সামনে যেতেই টেবিলে হালকা ধাক্কা খেল। সাথে সাথে টেবিল থেকে একটা ডায়রি নীচে পড়ে যায়। সে ডায়রিটা তুলতেই সামির সাহেব পিছু ডেকে কিছুটা রাগান্বিত গলায় বলে উঠল
“উষ্ণ এটা তোমার কাছে আমি আশা করিনি। এ ঘরে তোমাকে আমি ঢুকতে নিষেধ করেছিলাম। তারপরও কেন ঢুকলে? আমি যদি এখন ফিরে না আসতাম তাহলে তো এ ঘরে তুমি এটা সেটা নিয়ে নিশ্চয় গবেষণা করতে। গুরুজন যখন কোনো কিছু নিষেধ করে এটাতে নিশ্চয় কারণ থাকে। তোমাকে এতদিন আমি এ শিক্ষা দিয়েছি? তোমার জন্য নিজের জীবনের সব বিসর্জন দিয়ে এ প্রতিদান পেলাম।”
উষ্ণ হালকা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল
“আমি জানতে চাই মেঘকে কে খুন করেছে? এক বিন্দু ধৈর্য আমার হচ্ছে না। তাই এখানে চলে এসেছি। প্লিজ বাবা তুমি বলে যাও। আর হাসপাতালে তুমি প্রায় সময় কাকে দেখতে যাও?”
সামির সাহেব রাগটা দমিয়ে উত্তর দিল
“এদিকে আসো। আপাতত হাসপাতালে যেতে হবে না আমাকে। এত অস্থিরতা ভালো না। সব বলব বলেছি যখন তখন বলব। তবে তোমার এ অস্থিরতায় তোমার জীবনে বিপদ ডেকে আনবে। সব বলার আগে প্রমিজ করো আর কখনও বাবার কথা ছাড়া কোনো কিছুতে হাত দিবে না। ”
উষ্ণ হালকা গলায় বলল
“প্রমিস বাবা আর এরকম হবে না। অধিক কৌতুহলে এমনটা করে ফেলেছি। এজন্য সত্যিই আমি সরি।”
এরপর সামির সাহেব আর উষ্ণ আবারও একই জায়গায় বসলো। কাহিনির শুরু হলো ফেলে আসা জায়গা থেকে,
সামির সাহেব বৃষ্টির কথা শুনে জিজ্ঞেস করল
“কাকে তুলে আনতে হবে? আর কে খুন করেছে?”
বৃষ্টি দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল
” মিলন খুন করেছে। ঐ তো আমার বাসায় ফুলের টব নিয়ে এসেছিল। নিশ্চয় ওর কাছে মেঘের ফোন ছিল। আর ও তো মেঘের বেস্ট ফ্রেন্ড। মেঘের সবকিছু ও জানত। তাই সে বৈশাখীকে মেসেজ দিয়েছে যাতে করে সে যেন এ ঝামেলায় ফেঁসে না যায়। আর ও এমনিতে মেঘকে অনেক হিংসা করত। মেঘ জীবনে এত দ্রূত সাকসেস পেয়ে গেছে এটা ওর সহ্য হত না। আমাকে নিয়েও মেঘ হ্যাপি ছিল এটাও সে মানতে পারত না। উপরে উপরে মিল দিয়ে থাকত। ওকে দেখেই বুঝা যেত। অনেকবার মিলনের ব্যাপারে মেঘকে বলেছি মেঘ বিশ্বাস করতে চাইত না। বিয়ে ভাঙাকে সে টোপ হিসেবে নিয়ে সে মেঘকে খুন করেছে।”
সামির সাহেব বৃষ্টির কথা শুনে হালকা গলায় জবাব দিল
“বৃষ্টি তুমি নিজেই একটা ঘোরে আছো। তোমার কী ধারণা মিলনের বিষয়টা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে? চোখ এড়িয়ে যায়নি। আমি মিলনের ফোনের লোকেশন দেখেছি। মেঘের ফোন যখন তোমাদের বাড়ির লোকেশন দেখাচ্ছিল তখন মিলনের ফোনের লোকেশন দেখাচ্ছিল মেঘদের বাড়ি। মিলন যা বলেছে সত্যি।
সে তোমাদের বাড়ি থেকে সরাসরি মেঘের বাড়ি গিয়েছিল। এর আগে মেঘের ফোন তার কাছে ছিল সে সময় তার লোকেশন মেঘের বাড়িতেই ছিল। আর মিলনের লোকেশন ছিল তোমাদের বাড়ি। আর সে সময় মিলন মেঘকে কল করেছিল কয়েক মিনিট কথাও বলেছিল। এরপর মিলন যখন মেঘের বাড়িতে যায় সে সময় মেঘের লোকেশন দেখাচ্ছে তোমাদের বাড়ি। তার মানে এখানে মিলন পুরোপুরিভাবে নির্দোষ। বৃষ্টি তুমি তোমার কল্পনার জগত থেকে বের হও। কল্পনায় ডুবে থাকা একটা রোগ। এ রোগটা তোমাকে আরও শেষ করে দিবে। জীবনটা নরক করে দেবে। এ রোগ থেকে বের হওয়ার জন্য তোমাকেই চেষ্টা করতে হবে৷ ”
বৃষ্টি থেমে গেল। কারণ সে বুঝতে পারল ক্রমশই তার ধারণা মিথ্যা হয়ে গেছে। বৃষ্টির ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শুধু একটা বার জানতে চায় মেঘকে কে খু/ন করেছে আর কেন?
সামির সাহেব বৃষ্টির রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে আসলো। ভালোভাবে আরেকটাবার সবকিছু মেলানোর চেষ্টা করল। মেঘের পরিবারের দিকে আবারও নজর দিল। মেঘের বাবা কেন চাচ্ছিল না বৃষ্টির সাথে বিয়ে হোক সে বিষয় নিয়ে ঘাটতে শুরু করল। ঘাটতে ঘাটতেই সে দারুণ একটা তথ্য পেল। আর সেটাই চূড়ান্ত খুনীর কাছে তাকে নিয়ে গেল। এখন কেবল সবটা প্রমাণের পালা।
বিরতিহীন ভাবনায় রাত বেশ হয়েছে। সে বৃষ্টির রুমে তথ্যটা দিতে গিয়ে লক্ষ্য করল বৃষ্টি ঘরে নেই। পুরো বাড়ি সে বৃষ্টিকে খুঁজলো। বৃষ্টির দেখা মিলল না। ফোনে কল দিয়ে দেখল ফোনটাও রেখে গিয়েছে সে। এটা একটা ভয়ংকর সংকেত দিচ্ছে। এমনিতেই বৃষ্টি মানসিক রোগে ভুগছে। এ সময় যেকোনো একটা ভুল তার জীবনে খারাপ কিছু বয়ে আনবে, ভালো কিছু না। ভয় পেতে লাগল সামির সাহেব। নিজেকে কিছুটা সামলে সে তড়িগড়ি হয়ে বের হলো রাস্তায়।
হঠাৎ তার মনে হলো বৃষ্টি হয়তো তার আগেই কিছু একটা বুঝতে পেরেছে। তাই সে সময় নষ্ট না করে সরাসরি মেঘের বাসায় গেল। সেখানে গিয়ে সে থমকে গেল। প্রমাণের আগেই সবকিছু এভাবে বিনাশ হয়ে গেল সে মানতে পারছে না। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করল সে ধারালো রক্তাক্ত ছুরি হাতে নিয়ে সোফায় বসে আছে। সুরাইয়াকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মেঘের বাবা, মা আর মেঘের মামা জমশেদ সাহেবের লাশটা মেঝেতে পড়ে আছে।
সামির সাহেব বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
“কেন তুমি এ কাজ করলে?”
বৃষ্টি কোনো উত্তর দিল না। সামির সাহেব পুনরায় জিজ্ঞেস করল
“কোর্টে প্রমাণ হওয়ার আগেই এ কাজ কেন করলে? তোমাকে কে বাঁচাবে এখন? আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কত বড়ো অন্যায় তুমি জানো? কী করেছো এটা? পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি? তুমি যে প্র্যাগনেন্ট তুমি জানতে না? তোমার বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা ভাবলে না? একে একে তিনটি খুন করে ফেললে? বৃষ্টি একটা বারও মনে হলো না আমাকে বলা উচিত ছিল।”
বৃষ্টির হাত থেকে ছুড়িটা ফেলে দিল। সে কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল
“আমি মেঘের খু/নী হয়ে মরতে চাই না। আমি তো ধারণায় করতে পারছিলাম না এ খু/নের পেছনে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে কে? অনেক ভেবে আমি একটা সূত্র পেলাম। আর আমি জানি এ সূত্রে কোনো ভুল নেই।
আমি তো এটাও ভুলে গিয়েছিলাম আমাকে তারা কেন বউ হিসেবে চায়তো না। এই যে বৈশাখীর বাবা জমশেদ সাহেবের জন্য এতকিছু হয়েছে। আর এই যে আকরাম সাহেব ক্ষমতার লোভে পড়ে নিজের সন্তানের খু/নকেও ধামাচাপা দিতে পিছ পা হয়নি। তারা মেঘের প্রাণ নিয়ে আমাকেও মারতে চেয়েছিল। ভুলভাবে আমাকে উপস্থাপন করেছিল। আমার অসুস্থতাকে তারা হাতিয়ার করে নিয়েছিল। আইন কী করবে? এত প্রভাবশালী লোককে আইন কেবল তারিখের পর তারিখ দিবে আর একটা সময় পর জামিন দিবে। এদের খু/ন করে একটা না তিন তিনটি খু/নের প্রতিশোধ নিয়েছি। আপনি জানেন আপনার স্ত্রী সন্তানকে কে খু/ন করেছে?”
সামির সাহেব জবাব দিল
“সবকিছুই বের করেছিলাম বৃষ্টি। আকরাম সাহেবের কথায় আমি তাকে বিশ্বাস করে নিইনি। বরং আমি আরও বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি।।আমার স্ত্রী একজন সাংবাদিক ছিল। সে আকরাম সাহেবের নারী পাচারের একটা প্রতিবেদন কালেক্ট করেছিল। আর সেটা জুলফিকার সাহেব জেনে যায়। দলের দূর্নাম হবে তাই তাকে দল থেকে বের করে দেয়। আর সেখান থেকে সে নিজে দল গঠন করে। জুলফিকার সাহেবের কাছে আকরাম সাহেব যখন জানতে পারে আমার স্ত্রী এর কছে তার কুকর্মের প্রতিবেদন আছে তখন সে আমার সাথে একটা মাইন্ড গেইম খেলে। সে আমার স্ত্রীকে এমন ভাবে সরিয়ে দেয় যে আমার মনে যেন সন্দেহ না আসে। স্বাভাবিক খু/ন হলে আমি যেহেতু গোয়েন্দা অবশ্যই বের করতাম কে খু/ন করেছে। আর সেজন্যই আমার স্ত্রী এর পরকিয়া প্রেম দেখিয়ে আমার জীবন থেকে তাদের কেড়ে নিল। এখানে স্বয়ং জড়িত ছিল মেঘের মা রেহনুমা রশিদ। কিন্তু তুমি কেন আইন নিজের হাতে তুলে নিলে? সবকিছুরেই শাস্তি ছিল। আমি ব্যবস্থা করতাম। আমাকে কেন সময় দিলে না? তিন তিনটে খুনের জন্য তোমাকে ফাঁসি দিবে। তুমি কীভাবে প্রমাণ করবে এরা মেঘকে খুন করেছে? প্রমাণগুলোকেই তো তুমি খুন করে দিলে।”
বৃষ্টি কোনো কথা বলছে না। চুপ করে রইল শুধু। এর মধ্যেই অফিসার মাহির আসলেন। বৃষ্টির পাশে ছুরি দেখে সে কিছুটা ব্যহত হলো। হালকা গলায় বলল
“আমিও ভেবেছিলাম তুমি এত হিংস্র হতে পারো না। তোমার হিংস্র রূপটা তুমি দেখিয়ে দিলে৷ যাইহোক পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিলে। এবার তো শান্তি পেয়েছো নিশ্চয়?”
কথাগুলো বলেই আবারও বৃষ্টিকে অফিসার মাহির এরেস্ট করলো। সুরাইয়ার বাঁধন খুলে দিয়ে নিরাপদ স্থানে নিল। এরপর অফিসার মাহির সামির সাহেবের দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করল
“কী হয়েছে পুরো কাহিনি খুলে বলুন। বাইরে চলুন এখান থেকে। ভিকটিমদের দেখে বৃষ্টিকে একদম স্বাভাবিক লাগছে না। তিনজনকেই ধারালো ছুরি দিয়ে শতাধিকবার আঘাত করেছে। বাড়ির দারোয়ান আমাদের খবর দিয়ে এনেছে। আসার পূর্বেই সব শেষ হয়ে গেল। সাধারণ একটা মেয়ে এত হিংস্র কী করে হলো। আর ওদের খুনেই বা কেন করা হলো?”
এরপর সামির সাহেব মেঘের খুনের রহস্যের জট খুলল। যা শুনে অফিসার মাহিরও চমকে গেল। এত বড়ো রহস্যের জট লুকিয়ে ছিল সেটা সে ভাবতেই পারেনি।