#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৭
সামির সাহেব অফিসার মাহিরকে বলা শুরু করল।
“এ খু/নটা করেছে মেঘের মামা জমশেদ সাহেব। আর এ খুনের জন্য ইন্দন দিয়েছে মেঘের সৎ মা রেহনুমা রশিদ। আর পরবর্তীতে যোগ হয়েছে মেঘের বাবা আকরাম সাহেব।”
অফিসার মাহির অবাক হয়ে সামির সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন
“মেঘের মা তার সৎ মা ছিল? তিনি তার আসল মা ছিল না? এটা তো কেউ শেয়ার করেনি। এমনকি এ পরিবারের কেউ এ বিষয়ে কিছু বলেনি। আর আমি তাকে এত শোকাহত দেখেছি যে তাকে সন্দেহ করার অবকাশ পাইনি৷ এটা কী করে জানলেন?”
সামির সাহেব নম্র গলায় আবারও কাহিনি বলতে লাগল
“মেঘের মা রেহনুমা রশিদকে আকরাম সাহেব বিয়ে করেন মেঘের যখন বয়স ৭ দিন ছিল। মেঘের জন্মদাত্রী মা মেঘকে জন্ম দিতে গিয়েই মারা যায়। আর তখন রেহনুমা রশিদকে মেঘকে দেখাশোনা করার জন্যই বিয়ে করেন আকরাম সাহেব। তার একটা শর্ত ছিল বিয়ের সময়। শর্তটা হলো রেহনুমা রশিদ কখনও মা হতে পারবে না। এ শর্ত মেনেই রেহনুমা রশিদ আকরাম সাহেবকে বিয়ে করে। একমাত্র ছেলে মেঘকে নিয়েই সে জীবন পার করে দেয়। যার দরুণ রেহনুমা রশিদ যে মেঘের জন্মদাত্রী মা না বিষয়টি সবার চোখ এড়িয়ে যায়। রেহনুমা রশিদের মেঘের উপর একটা ক্ষোভ ছিল। কারণ মেঘের জন্য সে মা হতে পারেনি। এ ক্ষোভটা তাকে সবসময় কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। তবুও সে নিজেকে দমিয়ে রাখত। সংসারের কথা চিন্তা করে নিজের ক্ষোভটাকে সে চাপা দিয়ে রাখত। মেঘের মা রেহনুমা রশিদ না এটা আমি জানতে পারি মেঘ যে হাসপাতালে হয়েছে সে হাসপাতাল থেকে। সেখানের প্রবীণ নার্স ফাইরোজা আমাকে বিষয়টি জানান।
রেহনুমা রশিদ চেয়েছিলেন বৈশাখীর সাথে মেঘের বিয়ে দিয়ে এ পুরো সম্পত্তি সে ভোগ করবে। কিন্তু বৈশাখীকে মেঘের পছন্দ ছিল না। মেঘ পছন্দ করত বৃষ্টিকে। আর বৃষ্টির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অটল। আর সেজন্য বৈশাখী শত চেষ্টা করেও মেঘের হতে পারেনি। রেহনুমা রশিদ মন থেকে বৃষ্টিকে মানতে পারেনি। প্রথম থেকেই দ্বিমত দেখিয়ে আসছেন। তবে মেঘের জেদ আর বৃষ্টির প্রতি মেঘের অসম্ভব ভালোবাসার দরুণ বৃষ্টির সাথে বিয়ের ব্যাপারটা মানতে বাধ্য হয়।
তবে বিয়ের দিন রেহনুমা রশিদ একটা বড়ো চাল চালেন। সে আকরাম সাহেবকে ইন্দন দিয়ে বলেন মেঘের সাথে বৃষ্টির বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আরও ভালোভাবে কথা বলা উচিত। তিনি আরও বলেন
” মেঘের ভবিষ্যৎ এখানে জড়িয়ে আছে। ঐ পরিবার আমাদের সমতুল্য না। মেয়ের গার্ডিয়ান কেবল তার মা। ওদের আর্থিক অবস্থাও খারাপ। তার উপর মেয়ে পড়াশোনাতেও তেমন ভালো না। বয়সও বেশি। তুমি শেষবারের মতো মেঘকে বুঝাও। যদি সে এখন মতের পরিবর্তন করে অমত করে, তাহলে তার জীবনটা বেঁচে যাবে।”
আকরাম সাহেব রেহনুমা রশিদের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলেন। তারপর আস্তে গলায় বললেন
“আমি দেখছি কী করা যায়।”
বাইরে খাঁ খাঁ কড়া রোদ নেমে গিয়ে মেঘের গর্জন দিচ্ছে আকাশে। বৈশাখ মাসের এ এক দশা কখনও মেঘ, কখনও বৃষ্টি আবার কখনও খাঁ খাঁ রোদ। এক রঙে ঢঙ বদলায় বারংবার। বিয়ের তোড়জোড় চলছে। চারপাশে বিয়ের আমেজে মুখরিত। এখন কনের বাড়ি যাওয়ার পালা। কনের বাড়ি যাওয়ার জন্য মেঘ প্রস্তুত হয়ে সবাইকে ডাক দিলে তখন সবাই মুখ গোমরা করে রাখে। আকরাম সাহেব মেঘকে জানায়
“এ বিয়েতে আমাদের মত নেই। শেষবার ভাবো। ঐ মেয়ে এখানে এসে আমাদের সাথে মানাতে পারবে না। মেয়ের হাজারও সমস্যা আছে। ভালো কোনো গার্ডিয়ান নেই। এরকম একটা মেয়ে আমার ছেলের বউ মানতে গেলেই আমার বুক ভার হয়ে যাচ্ছে। ”
রেহনুমা রশিদ এ কথাগুলোতে একদম চুপ থাকতেন। তিনি সবসময় আকরাম সাহেবকে লেলিয়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত রাখতেন। আকরাম সাহেবের কথা শুনে মেঘ কিছুটা বিরক্ত নিয়ে উত্তর দেয়
“বাবা বৃষ্টির প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। আমি চাইলেই এখন সম্পর্ক নষ্ট করতে পারব না। আর এ মুহুর্তে আমি বিয়ে ভাঙবই বা কী করে? এটা ঠিক না। এ মুহূর্তে তোমার এ কথাগুলো আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বিয়ে আর তুমি এখন এসব বলছো? মাথা থেকে এসব নামাও। বাবা বিয়ে বাড়ি এটা। চলো এবার যাওয়া যাক। বাসায় অনেক মেহমান আছে৷ বিষয়টিকে সবার সামনে আর জটিল করো না।”
কিন্তু নাছোরবান্দা আকরাম সাহেব মানতে নারাজ। আকরাম সাহেবের প্রেসারে পড়ে মেঘ কিছুটা রাগান্বিত হয়েই বলেছিল সে বিয়ে করবে না। আর মেঘের এ কথাটাকে কেন্দ্র করেই আকরাম সাহেব বিয়েটা ভেঙে দেয়। এরপর যখন মেঘ জানতে পারে বিয়েটা আকরাম সাহেব ভেঙে দিয়েছে তখনও মেঘের সাথে আকরাম সাহেবের কথা কাটাকাটি হয়। রাগারাগির সময় মেঘকে বৃষ্টি কল দেয়। আর সে সময় মেঘ অনেকটা রাগ করেই বৃষ্টিকে কথাগুলো বলে। বৃষ্টির বয়স নিয়ে মেঘের কথা বলার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তবে মেঘের বাবা বৃষ্টির বয়স নিয়েই কথা বলে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিল। যেটা মেঘের সে মুহুর্তে মানতে কষ্ট হলেও নিজেকে দমিয়ে নিয়েছিল। সে ভেবেছিল পরবর্তীতে সব সামলে বৃষ্টিকে নিয়ে আলাদা সংসার শুরু করবে৷ তাই বৃষ্টির মনটা পরীক্ষার জন্যও সে এ কথাগুলো বলেছিল। বৃষ্টিকে সাময়িক একটা কষ্ট দিতে দিয়েছিল৷ ভেবেছিল পরে অজস্র ভালোবাসা দিয়ে সেটা পুষিয়ে দিবে।
এদিকে আকরাম সাহেবের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়। বৃষ্টির অবস্থার অবনতির একটা বার্তা আসে মেঘের কাছে। তাই মেঘ বৃষ্টির সাথে সব ঠিক করে নেওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়। সে সময় জমশেদ সাহেব মেঘের সাথে বের হয়৷ আর একটা বড়ো পরিকল্পনা করার জন্য মেতে উঠে। সে মেঘের সাথে বৃষ্টির বাসা পর্যন্ত যায়। কিন্তু সেখানে মেঘকে সে ঢুকতে দেয় না৷ সে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলে
“আমি যা করার করছি। তুমি যাও বাসায়। কালকের মধ্যে সব ঠিক করে দিব৷ হঠাৎ করে তোমাকে দেখলে অনেকে তেড়ে আসতে পারে। আমি সবার সাথে নিজ দায়িত্বে কথা বলে কালকের মধ্যেই তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তোমার পরিবারও রাজি হবে। তুমি বাসায় যাও। ”
মূলত জমশেদ সাহেব সে সময়েই খু/নের পরিকল্পনা করে ফেলেছিল। সে বুঝে গিয়েছিল মেঘ বৃষ্টিকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। আর বৈশাখীকে মেঘ কখনও মানতে পারবে না৷ আর বৈশাখীর সাথে মেঘের বিয়ে না হলে সে কখনও এ বাড়ির সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে না। আর সেটার সূত্র ধরেই সে মেঘকে এমনভাবে খু/নের পরিকল্পনা করে যাতে সব দোষ বৃষ্টির উপর পড়ে।
সে চেয়েছিল মেঘকে খু/নের মাধ্যমে মেঘের সব সম্পত্তি ভোগ দখল করতে। তাই সে সময় মেঘের কাছ থেকে মেঘের ফোনটা রেখে দেয় কৌশলে। এরপর মেঘকে পাঠিয়ে দেয় বাসায়। সে সময় সে বৈশাখীকে মেঘের ফোন থেকে নিজে মেসেজ করে। যাতে করে এ ঘটনায় তার মেয়ে ফেঁসে না যায়৷ সবাই যেন ভেবে নেয় বৈশাখীর সাথে সম্পর্ক ঠিক করতেই মেঘ বিয়ে ভেঙেছে। আর সে রেশ ধরেই বৃষ্টি মেঘকে খু/ন করেছে৷ এ মেসেজের ফলে বৈশাখী আর তার পরিবার সন্দেহের তালিকা থেকে সরে যাবে৷ যেটা গিয়েও ছিল। তাদেরকে কেউ সন্দেহ করেনি এ ঘটনায়। এরপর কিছুক্ষণ সেখানে থেকে বাসায় ফিরে৷ এদিকে তখন মিলন বাসায় ঢুকে৷ আকরাম সাহেব বাইরের কাউকেই বাসায় ঢুকতে নিষেধ করে দিয়েছিল। মিলনকে এজন্যই ঢুকতে দিচ্ছিল না। তবে মেঘের কথায় মিলন ঢুকতে পারে বাসায়।
আর মিলন ঢুকে মেঘকে বিয়ে ভাঙা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করাতে মেঘ ইচ্ছা করেই এমন টোনে কথা বলেছিল। কারণ মেঘ বৃষ্টিকে আরও একটা সারপ্রাইজ দিয়েই বিয়ে করতে চেয়েছিল। সে চেয়েছিল বৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য ভেবে নিক তাদের পথ আলদা এরপর যখন দেখবে তারা এক পথে হাঁটছে তখন সে অনেক বেশি খুশি হবে। সম্পর্কের মর্ম বুঝবে৷ তাই সে মিলনের সাথে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে। কারণ সে জানত মিলনের কাছে বৃষ্টি কল দিয়ে ইনফরমেশন নেওয়ার চেষ্টা করবে৷
মিলন চলে যাওয়ার পর জমশেদ সাহেব বাসায় গিয়ে মেঘকে জানায় সব কিছু ঠিক করা শেষ। সে যেন নিশ্চিন্তায় থাকে৷ কাল সকালের মধ্যে সব সমাধান করে বৃষ্টিকে প্রথমে এ বাসায় আনবে তারপর এ বাসায় বিয়ে হবে৷ আর বৃষ্টি যেহেতু একটু অসুস্থ হয়ে গিয়েছে সেহেতু বৃষ্টিকে এখন কল বা মেসেজ দিয়ে বা কোনোভাবে বিরক্ত করা উচিত হবে না।
জমশেদ সাহেবের কথা মেঘ বিশ্বাস করে নিয়েছিল। সে কিছুটা নিশ্চন্তায় ছিল। ততক্ষণে রাত হয়ে গিয়েছে। রেহনুমা রশিদ মেঘের খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে মেঘকে খাইয়ে দেয়। মেঘ খাবার খেয়ে রুমে যেতেই অতি কড়া ঘুমের ঔষধের জন্য সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ে।
সে সময় বৃষ্টি ঐ বাসায় প্রবেশ করে। বৃষ্টি চেয়েছিল মেঘের সাথে দেখা করতে। আর সে গিয়েছিলও মেঘের রুম পর্যন্ত তবে সে মেঘকে ঘুম থেকে জাগাতে পারেনি। এ সময় জমশেদ সাহেব এসে বৃষ্টিকে আঘাত করে। তার শরীরে নেশার দ্রব্য ইনজেক্ট করায়। আর সে সময় জমশেদর সাহেবেই নেশার দ্রব্যগুলোই তাড়াহুড়ো করে মেঘের ড্রয়ারে রাখে। এরপর সিসি ক্যামেরা অফ করা হয়৷ বৃষ্টিকে গেইটের সামনে এনে রাখা হয়। জমশেদ সাহেব, রেহনুমা রশিদ মিলে মেঘকে ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয়। এ ফ্যানে ঝুলানো তাদের জন্য ভীষণ কঠিন ছিল৷ তাই তাড়া দঁড়িটাকে প্রথমে জানালার গ্রিলে আটকায় তারপর ফ্যানে। এরপর মেঘের বডিটাকে দঁড়িতে বেধে উপরে তুলা হয় দঁড়ি টান দিয়ে। দঁড়িটা জানালার বাইরে বের করে বাইরের দিক দিয়েই টানা হয়। সেটা করে জমশেদ সাহেব। আর সে সময়েই মেঘের বাবা বিষয়টি দেখে ফেলে। আর নিজের একমাত্র সন্তানকে খুন করার জন্য তিনি ভীষণ রেগেও যান।
কিন্তু জমশেদ সাহেব বুঝায়। যা হয়েছে সেটা মেনে নিতে। এখন চায়লেও সে জমশেদ সাহেবের কিছু করতে পারবে না। কারণ জমশেদ সাহেব বিরেধী পার্টির লোক ছিল৷
তাই সে মেঘের বাবাকে বুদ্ধি দেয়। সে যেন তার কথা মেনে নেয়। এ খু/নকে সে বৃষ্টির উপর যেন চাপিয়ে দেয়। এরপর বৃষ্টিকে জেলের মধ্যেই খুন করে পুনরায় তদন্তের উসিলায় যেন জুলফিকার সাহেবের উপর খুনের ভার চাপায়। এখানে খুব সহজেই বুঝানো যাবে রাজনৈতিক জের ধরেই জুলফিকার সাহেব এ কাজ করেছে। এতে করে তার দূর্নাম হবে আর সে সুযোগে আকরাম সাহেব সিমপ্যথী অর্জন করে দলটাকে এগিয়ে নিবে৷ ক্ষমতাতেও এসে যাবে। আর সে সময় জমশেদ সাহেবও তার দলে যোগ দিবে৷
আকরাম সাহেবের ক্ষমতার লোভ ছিল প্রখর। সে বুঝে গিয়েছিল তার ছেলে ফিরে আসবে না। আর রাজনীতিতে মাঝে মাঝে নিজের চরম শত্রুকেও আপন করে নিতে হয়। আর সে ক্ষমতার লোভেই সে জমশেদ সাহেবকে মেঘের লাশটা ঝুলাতে সাহায্য করে৷
এরপর এক ঘন্টা পড়ে সিসি ক্যামেরা অন করা হয়। সে সময় দেখা যায় বৃষ্টি বের হচ্ছে। বৃষ্টির জ্ঞান ফেরার পর সে তার রোগের জন্য সব ভুলে গিয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল না এখানে কীভাবে এসেছে। কিছুটা ছন্নছাড়া হয়ে মুখে কাপড় দিয়ে সে বের হয়৷ শরীরে নেশার মাতালতাও ছিল। যেহেতু নেশার ইনজেকশন পুশ করা হয়৷ এরপর বাসায় এসে সে আবারও জ্ঞান হারায় আর সবকিছু ভুলে যায়। যেটা তার স্মৃতিতে মাঝে মাঝে আসে আবার চলে যায়। হয়তো রাতে সে সবটা মনে করতে পেরেছিল। তাই অপরাধীকে শাস্তির জন্য নিজেই চলে এসেছে।
সামির সাহেব একটু থেমে আবার অফিসার মাহিরকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল
“সেদিন ড্রয়ারে যে নেশা দ্রব্য পেয়েছিলাম তাতে জমশেদ সাহেবের হাতের ছাপ রয়েছে। জানালার বাইরে কিছু দঁড়ি ছিল যে দড়ি দিয়ে মেঘকে ঝুলানো হয়। সে দঁড়িটাই ছিল। সেটাতেও জমশেদ সাহেবের হাতের ছাপ আছে। মেঘের বাবার হাতের ছাপ আছে৷”
সামির সাহেব থেমে গেল। অফিসার মাহিরও চুপ হয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারছে না।
ঘটনা চলে আসে বর্তমানে। সামির সাহেবের নীরবতায় উষ্ণ জিজ্ঞেস করল
“তারপর কী হয়েছিল বাবা? আর সেদিন তুমি যে ঐখানে গিয়েছিলে জানালার বাইরে কার ছায়া দেখেছিলে? সেটা কী তুমি বের করতে পেরেছিলে?”
আবারও নীরবতা ভেঙে সামির সাহেব বলতে শুরু করল। আর সেখান থেকে আরও কয়েকটি রহস্যের জট খুলল।
#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৮
সামির সাহেব উষ্ণকে জড়িয়ে ধরে আবারও কাহিনি বলা শুরু করল। অফিসার মাহির সামির সাহেবকে জিজ্ঞেস করল
“একমাত্র সন্তানকে কেউ খুন করতে রাজি হয়ে যাবে এত সহজে? এটা বেমানানা লাগছে না? আর মেঘেই বা কেন এতকিছুর পর সারপ্রাইজের চিন্তা করেছে। এটাও বেমানান লাগছে। আপনি বৃষ্টিকে বাঁচাতে গাজাখুরি একটা গল্প সাজিয়ে ফেলেছেন সামির সাহেব। যেটা একটা বাচ্চাও বিশ্বাস করবে না।”
সামির সাহেব হাসলো। এমন একটা পরিস্থিতিতে সামির সাহেবের হাসিটা ভীষণ বেমানান লাগছে। অদ্ভুত ভাবে হেসে উত্তর দিল
“উত্তরটা আপনার জানা। তারপরও আমাকে জিজ্ঞেস করছেন?”
অফিসার মাহির কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল
“আমার জানা মানে?”
“আপনি তো পর পর দুইবার ময়না তদন্ত করিয়েছেন। লাশের ডি এন এ টেস্ট করিয়েছেন। তাহলে আপনি তো জানেনেই কেন…।”
সামির সাহেবের কথা শুনে অফিসার মাহির ঢোক গিলল। সামির সাহেব আবারও বলল
“যেহেতু জানতে চেয়েছেন আবারও বলি। প্রথম ময়না তদন্তের সময় আপনাকে দিয়ে মেঘের পরিবার কেন ডি এন এ টেস্ট করিয়েছিল সেটা নিশ্চয় জানেন?
অফিসার মাহির কিছুটা ঘাবড়ে গেল। সে নম্র গলায় বলল
” ডি এন এ টেস্ট কেন করাবে? ডি এন টেস্ট হয়নি। শুধু ময়না তদন্ত হয়েছে। প্রথমবার রিপোর্টটা জাস্ট পাল্টে গিয়েছিল। সেটা সংশোধনও করা হয়েছে।”
সামির সাহেব আবারও একটু ব্যাঙ্গাত্নক হাসলো। তারপর বলল
” আমার মুখ থেকেই শুনতে চাচ্ছেন তো? তাহলে শুনুন। মেঘের বাবা আকরাম সাহেব না। মেঘের বাবা আকারাম সাহেবের ভাই আমজাদ সাহেব।
মেঘের মা তাহিরা বেগমের প্রথম স্বামী আমজাদ সাহেব ছিলেন। তিনি একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। নববধু তখন তাহিরা বেগম। বিয়ের ২ মাসের মাথায় স্বামীর মৃত্যু। সব মিলিয়ে তিনি খুব ভেঙে পড়েন।
এদিকে আমজাদ সাহেবের মৃত্যুর পর মেঘের দাদা হাসেম সাহেব চিন্তায় পড়ে যায়। কারণ এ পুরো সম্পত্তির মালিক তাহিরা বেগম। তাহিরা বেগম তার বাবার একমাত্র মেয়ে ছিল আর সেজন্য এ পুরো সম্পত্তির মালিক ছিলেন তিনি। আমজাদ সাহেব আর তাহিরা বেগমের প্রেমের বিয়ে ছিল। আমজাদ সাহেবের সামাজিক অবস্থান তেমন ভালো ছিল না। তবে একমাত্র মেয়ের সুখের জন্য তাহিরা বেগমের বাবা বিয়েটা মেনে নেয় এবং তার মেয়েকে সকল সম্পত্তির ওয়ারিশ করে দিয়ে যান।
তাহিরা বগমের মা ও উনাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। এরপর তাহিরা বেগমের বাবা আর বিয়ে করেনি। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সব কিছু বিসর্জন দেয়। কিন্তু মেয়ের বিয়ের এক মাস পরেই হার্ট এটাকে তার মৃত্যু হয়। একদিকে বাবার মৃত্যু এরপর স্বামীর মৃত্যু। দুটো শোক সে কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। তার জীবনের কষ্ট শুরু হতে লাগল। স্বামীর মৃত্যুর একমাস পর তাহিরা বেগম জানতে পারেন তিনি সন্তান সম্ভাবা। তার পেটে দেড় মাসের সন্তান। সবমিলিয়ে উনার অবস্থা দিশেহারার মতো হয়ে যায়।
অপরদিকে হাসেম সাহেবও বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তাহিরা বেগম যদি অন্যত্র চলে যায় তাহলে এ পুরো সম্পত্তি তারা কেউ ভোগ করতে পারবে না। অনেক চিন্তা করে তার মাথায় বুদ্ধি আসে। সে বুঝতে পারে আকরাম সাহেবের সাথে যদি তাহিরা বেগমের বিয়ে দিতে পারে তাহলেই এ সম্পত্তি তারা ভোগ করতে পারবে।
এদিকে তাহিরা বেগমের সন্তান হওয়ার বিষয়টা সে তার শ্বশুড়কে জানায়। হাসেম সাহেব বুঝতে পারে একে তো তাহিরা বেগম সন্তান সম্ভাবা তার উপর স্বামীর মৃত্যুর ১ মাস পার হয়েছে। এখন যদি আশেপাশের মানুষ জানতে পারে তাহলে আকরাম সাহেবের সাথে তাহিরা বেগমের বিয়েতে সবাই ব্যাগরা বসাবে। কারণ এলাকায় প্রচলিত নিয়ম আছে সন্তান সম্ভাবা মেয়ের সাথে বিয়ে যায়েজ না। এ বিষয়ে ইসলাম কী বলে আমার জানা নেই। তবে প্রচলিত নিয়মনুযায়ী বিয়ে করতে হলে সন্তান হবার পর করতে হবে। এ মুহুর্তে হাসেম সাহেবের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। সে তাহিরা বেগমকে নিজের মেয়ের মতো বুঝায়। সে তাহিরা বেগমকে বলেন
“মা যা হওয়ায় হয়ে গেছে। তোমার স্বামী গেছে আমার সন্তান গেছে। এ সমাজে একা একটা মেয়ে সন্তান নিয়ে বেড়ে উঠা কঠিন। তুমি আমার বংশের প্রদীপ আনতেছো। আমি চাইব না আমার বংশের প্রদীপ অন্য কোথায় ফুটুক।।আমার বংশের প্রদীপ আমার বংশেই থাকুক। তুমি আমার একটা কথা রাখো। আমি তোমার পায়ে ধরলাম।”
কথাটা বলেই সে তাহিরা বেগমের পায়ে ধরে ফেলেন।তাহিরা বেগম ইতস্তত হয়ে নিজের পা থেকে শ্বশুড়ের হাতটা সরিয়ে উত্তর দেয়।
“বলেন কী চান। ”
তখন হাসেম সাহেব তাহিরা বেগমকে.. আকরাম সাহেবকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তাহিরা বেগমের মত ছিল না। দেবরকে বিয়ে করাটা তার কাছে বেশ খারাপ লাগছিল। তবে একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে সে রাজি হয়। আর সে সময় মেয়েদের এত সাহসও ছিল একা সন্তান পালন করার। তার উপর পরিবারেও কেউ ছিল না৷ তবে হাসেম সাহেব তাহিরা বেগমকে নিষেধ করে তার সন্তান হওয়ার ব্যাপারে যেন সে না জানায়। যদি আকরাম সাহেব তা জানতে পারে তাহলে তার সন্তানের প্রতি মায়াটা সেভাবে কাজ না ও করতে পারে। তাহিরা বেগমও সেটা মেনে নেয়। তার কাছে হসেম সাহেবকে তখন সবচেয়ে আপন মনে হত। মনে হত এ মানুষটা তার ভালোর জন্যই সব করছে।
এদিকে হাসেম সাহেবের কথায় আকরাম সাহেবও বিয়েতে রাজি হয়। ইদ্দতের ৪ মাস পার না করেই আমজাদ সাহেবের মৃত্যুর একমাসের মাথায় তার স্ত্রীর সাথে তার ভাই আকরাম সাহেবের বিবাহ সম্পন্ন করা হয়৷ আর প্রচলিত নিয়মের জন্য সন্তান হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি চেপে যাওয়া হয়।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাহিরা বেগমও সন্তান জন্মদানের সময় মারা যায়। তাহিরা বেগমের মৃত্যুতে সকল সম্পত্তির ওয়ারিশদার তখন মেঘ হয়ে যায়। আর আকরাম সাহেব অবশ্য অনেক বছর পর্যন্ত জানত না মেঘ তার সন্তান না। মেঘ তার ভাইয়ের সন্তান। তাহিরা বেগম যে তার কাছে এত বড়ো সত্য লুকিয়ে গেছে সে টা সে জানতে পারে না। জানতে পারে মেঘের বয়স যখন ২৫ বছর হয়। আর মেঘের দাদা হাসেম সাহেবের যখন মৃত্যু হয়। তখন মেঘের দাদা মেঘের বাবাকে বিষয়টি খোলাসা করে যায়। এরপর থেকে মেঘের প্রতি আকরাম সাহেবের মায়াটা মারা যেতে থাকে। সন্তান পালনের যে মায়া সেটাও চলে যায়। সে মানতেই পারছিল না মেঘ তার সন্তান না। অন্যের সন্তানের জন্য সে ২৫ বছর নিজের সন্তান নেয় নি বিষয়টি তাকে ভীষণভাবে যন্ত্রণা দিত। আর এখন চায়লেও বয়সের জন্য সন্তান নিতে পারবে না। যার দরুণ মেঘের প্রতি তার টান মায়া ধীরে ধীরে কমতে লাগল।
এরপরও যতটুকু মায়া অবশিষ্ট ছিল সেটাও মেঘের কিছু কর্মকান্ডে নষ্ট হয়ে যায়। আকরাম সাহেব সব সময় চায়তো রাজনীতি করতে। রাজনীতি করতে তার টাকার প্রয়োজন ছিল ভীষণ। সে চেয়েছিল ঢাকার একটা জমি যার মূল্য ৫৫ কোটি । সেটা বিক্রি করতে। যেহেতু মেঘ এর ওয়ারিশদার তাই চায়লেও আকরাম সাহেব এটা বিক্রি করতে পারছিল না। সে মেঘকে বলেছিল তবে মেঘের রাজনীতি পছন্দ ছিল না। সে চায়তো না তার বাবা এসবে জড়িয়ে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনুক। মেঘ তার বাবার ভালো চায়তো বলেই সে জমি বিক্রিতে রাজি হত না। এসব কারণেই মেঘকেই তার জীবনের বাঁধা মনে হত।
রেহনুমা রশিদও একটা সময় পর বুঝতে পারে মেঘের বাবা আকরাম সাহেব না। তাই মেঘকে মারার পরিকল্পনা করতে তার বুক কাঁপেনি।
এদিকে জমশেদ সাহেব মেঘকে মারার মূখ্যম সময় খুঁজতেছিল। কিন্তু সে সময় কয়েকবার পেয়েও সাকসেস হয়নি। এ নিয়ে মোট তিনবার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়েছে। তবে চারবারের চেষ্টায় সে সফল হয়। একটা বিয়েকে কেন্দ্র করে জীবনটা অনেক রঙিন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে বিয়েটায় জীবনটা ধ্বংস করার পথে নিয়ে গেল।
মেঘের ও এখানে একটা ভুল ছিল সে বৃষ্টিকে সবটা খুলে বলতে পারত। তবে ঝগড়ার মুহূর্তে মেঘকে যখন বৃষ্টি কল দিয়েছিল তখন রাগের মাথায় সে বৃষ্টিকে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য ভেবেছিল সবটা সে সুন্দর করে নিবে। রাগের মাথায় বলা আঘাত দেওয়া কথাগুলো সে সুন্দর করে নিয়ে বৃষ্টির কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে বড়ো সারপ্রাইজ দিবে। সে বুঝতে পারেনি তার জীবনে এত বড়ো সমস্যা নেমে আসবে। বুঝতে পারেনি বৃষ্টির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগেই সে পাবে না। বুঝতে পারলে হয়তো গল্পটা ভিন্ন হত।
সামির সাহেব আরেকটু টেনে বলল
“আমি তো ভেবেছিলাম আমার কথার মাঝের রহস্য গুলো আপনিই বলে উঠবেন। তাই অনেক রহস্য ঢেকে ঢেকে আপনাকে বলেছি। তবে আপনি ভীষণ চালাক। তাই ঢেকে যাওয়া রহস্য আর বলেন নি। আমার মুখ থেকেই শুনতে চাইলেন। এবার বলেন সেদিন মেঘের ঘরের জানালার বাইরে কেন গিয়েছিলেন? কী খু্ঁজার চেষ্টা করেছিলেন? মেঘের তো মৃত্যু হয় ঘুমের ঔষধের জন্য। তাহলে ময়না তদন্ত রিপোর্টে কেন গলায় দঁড়ি দিয়ে মৃত্যুর ব্যাপার লেখা হয়েছে?
আপনি অবশ্যই জানেন অতিরিক্ত পরিমাণে ঘুমের ঔষধ প্রোয়োগের ফলের মেঘের মৃত্যু হয়। এরপর শুধু নাটকের বাস্তব রূপ দিতে গলায় দঁড়ি দিয়ে ঝুলানো হয়। কেন এমন টা করা হলো মাহির সাহেব? আপনি বলবেন নাকি আমাকেই বলতে হবে?”
অফিসার মাহিরের চেহারা পাল্টে গেল। সেদিন জানালার বাইরে যার ছায়া দেখা গিয়েছিল সেটা অফিসার মাহিরেই ছিল। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। কিছুটা ভয়ার্ত দেখালেও সে নিজেকে সামলে বেশ জোরালো গলায় কিছু কথা বলল। যা আরও রহস্যের সমাধান দিল।