#চলার_শেষ_প্রান্তে(৫)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
মহিলার কথায় স্মৃতির দরজা খুললেও, আজ ফারিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর আগের মতো চুপ থাকবে না। আশপাশের মানুষের বারবার এক প্রশ্ন, এক কৌতূহল যেন তার ব্যক্তিগত কষ্টকে খেলনা বানিয়ে না ফেলে, তাই ফারিয়া নিজেকে শক্ত করে সত্যিটা বলে দেবে সোজা, স্পষ্ট।
ভদ্রমহিলা তখনো উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছেন, উত্তর শোনার জন্য যেন মুখিয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারিয়া। গলায় ভার জমে থাকা কষ্টটা ঠেলে সে বলল,
–” আন্টি আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তাই স্বামী বা শ্বশুরবাড়ি নিয়ে কথা না বললে আমি বেশি খুশি হবো।
এক মুহূর্তে যেন নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
রিজিয়া খালা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মুখটা হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল তাঁর। কথার জায়গায় নীরবতা।
ফারিয়া আর কিছু বলল না। মাথা নিচু করে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল। সেই নীরবতা বলার চেয়ে অনেক বেশি কিছু বলে গেল।
দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল ফারিয়ার ছোট বোন, নূরাইন। নূরাইন আগামীতে এস এস সি দিবে।
ভেতরের কথোপকথনটা তার কানে গিয়েছিল পুরোপুরি। পাশের বাসার আন্টির প্রশ্ন, ফারিয়ার দীর্ঘশ্বাস, আর তারপর সেই কঠিন সত্য, সব কিছু।
শুনে নূরাইন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না তার আপুর সাথে এরকম হয়েছে? সেই হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, সবসময় মজায়-হাসিতে ভরা আপুটা কি স্বাভাবিক হতে পারবে?
গতকাল থেকেই ফারিয়ার আচরণে কিছু একটা অস্বাভাবিক লেগেছিল তার। কথা কম, হাসি কম, চোখে একটা চাপা বিষণ্নতা।
এতক্ষণে সবকিছুর মানে বুঝে গেল নূরাইন।
বাবা-মা তাদের কিছুই বলেননি। কোনো কিছু আঁচ করতে দেয়নি ছোটদের।
সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, মনে মনে সিরাজের চেহারা ভেসে ওঠে। মানুষটা তো তাদের আপন খালাতো ভাই। তবে কিভাবে পারলো এমন করতে? আর খালা মনি সেও মেনে নিল?
নূরাইন আপুর বিয়ের সময় দেখেছে তার আপু কত্ত খুশি ছিল এই বিয়েতে। সবকিছু এভাবে শেষ হয়ে গেল? নূরাইন আর কিছু ভাবতে পারছে না।
শুধু একটুকরো কষ্ট জমে রইল দু’চোখে।
.
.
বিচ্ছেদের পর প্রথম কিছুদিন ফারিয়া যেন দম বন্ধ করে বেঁচে ছিল। চারপাশের লোকজনের কথা, প্রশ্ন, দৃষ্টির চাপ সব মিলিয়ে সে ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু একদিন আয়নায় নিজের চোখে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল ওর ভেতরে এখনো অনেক শক্তি আছে।
সে নিজেকে বলল,
–” আমি কোনো দোষে দোষী নই। আমি যেমন, আমি তেমন করেই সম্মানের যোগ্য।
নিজেকে সম্মান করা, নিজের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া শিখে যায় ফারিয়া। এখন আর কারো কথা গায়ে মাখে না।
তাছাড়া যখন কেউ পাশে থাকে না, তখন একমাত্র যে সম্পর্কটা কখনো ভাঙে না, সেটা হলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক। ফারিয়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আরো মনোযোগী হয়ে উঠলো, গভীরভাবে কুরআন পড়তে শুরু করল, চোখের জলে দোয়া করে,
–” হে আল্লাহ, তুমি আমার অন্তরের শান্তি হও, তুমি আমার পথ দেখাও।
এই আত্মিক শক্তিই ধীরে ধীরে তাকে ভেতর থেকে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এইবার ফারিয়া আর কারো চোখে নিজের মূল্য খুঁজে না। সে নিজেই নিজের জীবনের চালক হতে চায়। সে খুঁজে বের করল, সে কী করতে ভালোবাসে, কোথায় তার আগ্রহ, কী করলে তার দিনটা সুন্দর যায়। হয়তো সে বই পড়ে, গল্প লেখে, কিংবা ছোট্ট একটা হ্যান্ডক্রাফটের পেজ খুলে ফেলে অনলাইনে।
নিজের মতো করে বাঁচার আনন্দই তাকে দিন দিন হাসতে শেখালো।
ছোট বোন নূরাইন তার চোখে ফারিয়া একজন আদর্শ। তাই ফারিয়া সিদ্ধান্ত নিল, সে মনমরা হয়ে থাকলে নূরাইনও কষ্ট পাবে। সে আবার বোনের সঙ্গে গল্প করতে শুরু করল, হাসিমুখে পাশে বসে খেতে লাগল, মাঝেমধ্যে একসাথে দোয়া পড়ে।
একটা শক্ত বোন যেন আরেকটা ছোট মেয়ের আশ্রয় হয়ে উঠল।
সবকিছুর পর নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় ফারিয়া। এইবার আর কেবল মনটাকে নয় নিজেকে গড়ে তুলবে মানসিকভাবে, আর্থিকভাবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য দরকার প্রথমেই শিক্ষা। তাই সে ঠিক করল, আবার পড়াশোনা শুরু করবে।
এইচএসসি পরীক্ষার পরেই তার বিয়ে হয়ে যায় সিরাজের সঙ্গে। তখনও তার স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে নিজের জন্য কিছু একটা করবে। কিন্তু সেই স্বপ্নে ছাই পড়ে যায় খুব অল্প সময়েই।
সিরাজের মা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ঘরের বউ পড়াশোনা করবে না। আর সিরাজও চুপ থাকল।
সে নিজে থেকেও কোনো উৎসাহ দেখায়নি ফারিয়াকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে।
ফারিয়া তখন বাধ্য হয়েই বইপত্র ছেড়ে দেয়। নিজের ইচ্ছেগুলোকে চুপ করিয়ে সংসারের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলে।
কিন্তু আজ, আর না। এইবার সে নিজের স্বপ্নগুলোকে মরতে দেবে না। সে ঠিক করেছে ফের শুরু করবে পড়াশোনা, গড়ে তুলবে নিজেকে, যেন আর কখনো কারো কথায় নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে না হয়।
ফারিয়া সিদ্ধান্ত নেয় আর দেরি নয়। নিজেকে গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই নিজের শিক্ষাটাকে ফের শুরু করতে হবে। বাবাকে দিয়ে খোঁজ করতে শুরু করলো, কোথায়? কোন কলেজে ভর্তি হওয়া যায়,
শুরুটা সহজ ছিল না। অনেক প্রশ্ন, অনেক বাঁধা কেউ বলল,
–” দুই বছর পিছিয়ে পড়ে এখন কী করতে পারবে?অযথাই টাকা নষ্ট হবে বাপের।
কেউ হাসল, কেউ তাচ্ছিল্য করল।
কিন্তু এবার ফারিয়া আর থামলো না। কারণ তার পরিবার তার পাশে আছে।
একটা কলম, একটা খাতা, আর একরাশ সাহস নিয়ে সে যাত্রা শুরু করল। বইয়ের পাতায় ডুবে যেত সারাদিন। বাংলা সাহিত্যের কবিতাগুলো যেন তার পুরোনো সাথির মতো ফিরে এল।
রাতের নিরবতায় যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, ফারিয়া তখন আলো জ্বেলে পড়ে। কিছু বুঝতে না পারলে ইউটিউব ভিডিও দেখে, গুগল ঘেঁটে নেয়।
প্রতিটা শেখার পেছনে তার থাকে একটা প্রেরণা, নিজেকে প্রমাণ করার ইচ্ছা।
এই সময়ে তার ভেতরের আত্মবিশ্বাসও ধীরে ধীরে ফিরতে লাগল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজের চোখে চোখ রেখে হাসতে শিখল। আর ভয় লাগে না কে কী বলবে, তাতে তার কিছু যায় আসে না।
সে জানে, আল্লাহ তার মেহনত দেখছেন।
আর আল্লাহর কাছেই সে প্রতিদিন হাত তুলে দোয়া করে,
–” হে আল্লাহ, তুমি আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও, আমাকে হিদায়াত দাও, এবং আমাকে শক্ত রাখো এই পথে।
পড়াশোনার ফাঁকে ফারিয়া ছোট ছোট কাজও খুঁজে নিতে লাগল অনলাইনে গল্প লেখা, প্রাইভেট টিউশন। কিছু টাকা জমতে লাগল হাতে।
যেটুকুই হোক, সেটা তার নিজের অর্জন, নিজের ঘামে উপার্জন। এই অর্থের প্রতি তার আলাদা গর্ব।
একদিন নূরাইন বলল,
–” আপু, তোমাকে আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে এখন!
ফারিয়া হেসে বলল,
–” জানি না আমি দেখতে কেমন, কিন্তু এখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলিনি এটাই বড় কথা।
এভাবেই ফারিয়া নতুন জীবনের পথে হাঁটতে শুরু করল, শক্ত হাতে কলম ধরে, মনের ভেতর আল্লাহর উপর ভরসা রেখে। সে জানে, এখনও অনেক পথ বাকি, কিন্তু সে একা নয়, আল্লাহ তার সাথেই আছেন।
বছর খানেক পর,
পড়াশোনা আর নিজেকে গড়ে তোলার ব্যস্ততায় সে আর আগের মতো হাহাকার করে না, চোখের জল ফেললেও সেটা কেবল আল্লাহর দরবারেই।
ফারিয়া বুঝে গিয়েছে, মানুষের কাঁধ খুঁজে জীবনের ভার নামানো যায় না, আল্লাহই একমাত্র ভরসা।
একদিন ফারিয়া ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার পাশে, রোদে ঘামছে, কিন্তু তার মুখে একচিলতে হাসি।
কারণ সে জানত এই হাসিটা এসেছে নিজের কষ্ট, পরিশ্রম, এবং লড়াইয়ের পুরস্কার হিসেবে।
হঠাৎ পেছন থেকে এক আওয়াজ,
–” ফারিয়া আপু, আপনি কি সত্যি এবার পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন?
চোখ ফেরাতেই দেখা গেল পাড়ার এক মেয়ে তন্বী।
অনার্স প্রথম বর্ষের ই ফাইনাল পরীক্ষা দিবে।অনেকদিন ধরেই ফারিয়াকে দেখে মুগ্ধ।
ফারিয়া মৃদু হেসে বলল,
–” হ্যাঁ, রেজিস্ট্রেশন করেছি। এবার তোদের সাথেই পরীক্ষা দিব।
তন্বীর চোখে অবাক বিস্ময়,
–” আপু, আপনাকে দেখে সাহস হয় আমার। ভাবতাম বিয়ে হলে সব শেষ। কিন্তু আপনি তো উল্টো প্রমাণ করলেন।
ফারিয়া তন্বীর কাঁধে হাত রাখে, চোখে কোমল দৃঢ়তা,
–” জীবনে কিছুই শেষ হয় না, যদি ইচ্ছা থাকে। শুধু মানুষের নয়, আল্লাহর উপর ভরসা রাখবি। দেখবি, পথ খুলে যাবে ইনশা আল্লাহ।
এইভাবে ফারিয়া হয়ে উঠছিল অনেকের অনুপ্রেরণা। নূরাইন এখন বেশি করে বোনকে অনুসরণ করে, মাও আগের তুলনায় অনেক বেশি কাছের হয়ে উঠেছেন। রাতের বেলায় ফারিয়া বসে বসে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ছোট ছোট লেখালেখি শুরু করেছে। হয়তো কোনো একদিন নিজের গল্প বই আকারে প্রকাশ করবে!
সেই গল্পে থাকবে বেদনা, ভাঙা সম্পর্ক, আবার ঘুরে দাঁড়ানো আর অটুট বিশ্বাসের কথা।
এভাবেই ফারিয়ার জীবন এক নতুন সূর্যের আলোয় আলোকিত হতে লাগল। এটা ভাঙনের গল্প না, এটা ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। আল্লাহর রহমতে, একজন মেয়ে কীভাবে নিজের স্বপ্নকে আবার কাঁধে তুলে নিতে পারে সেটার নামই “ফারিয়ার জার্নি।”
এর মাঝে খবর এসেছে সিরাজ আবার বিয়ে করেছে! এ কথা শুনে ফারিয়ার মন খারাপের বদলে হাসি পেল, কারণ সিরাজ বলেছিল ফারিয়া কে ছাড়া নাকি সে বাঁচবে না। কোথায় গেল তার সেই ডায়লগ?..…..
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।