#চলার_শেষ_প্রান্তে(৬)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
একদিন নূরাইন হঠাৎ এসে বলল,
–” সিরাজ ভাই আবার বিয়ে করেছে!
কথাটা শুনে ফারিয়া এক মুহূর্ত চুপ করে গেল।
হয়তো কেউ ভাববে সে ভেঙে পড়বে, চোখে জল আসবে, বুক ফেটে কান্না বের হবে। কিন্তু অবাক করার মতো, ফারিয়ার মন খারাপ হলো না বরং ঠোঁটের কোণে একটুকরো তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল।
–” আচ্ছা, সে তো বলেছিল, আমাকে ছাড়া নাকি সে বাঁচতে পারবে না? কোথায় গেল তার সেই ডায়লগগুলো?
ফারিয়া জানে, মানুষ বদলে যায়। মুখের কথা দিয়ে জীবন চলে না, চলে আস্থা, মুল্যবোধ আর সত্যিকারের ভালোবাসায়।
সিরাজ হয়তো তার জীবন থেকে সরে গেছে, কিন্তু সেই ফাঁকা জায়গা আর শূন্য নেই। সেই জায়গা এখন পূর্ণ হয়েছে আত্মসম্মান, আল্লাহর উপর ভরসা, আর নিজের প্রতি বিশ্বাস দিয়ে।
ফারিয়া চুপ করে দোয়া করল,
“হে আল্লাহ, আমার মতো আর কোন মেয়েকে কষ্ট পেতে দিও না, তাকে তুমি হিদায়াত দাও।
আর আমাকে তুমি আগের চেয়ে আরও বেশি শক্ত করো, যেন আমি নিজেকে হারিয়ে না ফেলি আর কখনো।
.
.
কয়েক মাস পর ফারিয়ার পরীক্ষা শুরু হলো। সবার চোখের আড়ালে, নিঃশব্দে এক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সে। সকালে উঠে নামাজ পড়ে শুরু হয় তার পড়াশোনা তারপর একের পর এক অধ্যায়, অনুশীলন, রিভিশন। নিজেকে সে ভেঙে গড়ে নিচ্ছে, এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায়।
এই সময়েই একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে মতিন সাহেবের কাছে। কেউ বলছে ছেলেটা ডাক্তার, কেউ বলছে বিদেশে থাকে, কেউ আবার পারিবারিকভাবে খুব সম্ভ্রান্ত। কিন্তু মতিন সাহেব প্রতিবারই মাথা নেড়ে বলেন,
–” আমার মেয়েটা এখন পড়ছে। এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না।
তবে একদিন সাহানা বেগম আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। ধীরে ধীরে পাশে এসে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন,
–” মেয়ে হয়ে জন্মেছে। আজ না হোক কাল ওকে শশুর বাড়িতেই যেতে হবে। আমরা তো আর সারাজীবন থাকবো না। আজ আছি, কিন্তু কাল থাকবো এর কোনো গ্যারান্টি কি আছে?”
তার কণ্ঠে ভেজা কষ্ট, একধরনের মায়াভরা দুশ্চিন্তা।
ওপাশে বসে থাকা ফারিয়া কথাগুলো শুনে চুপ করে যায়। মা যেন একটা অদৃশ্য বাস্তবতার মুখোমুখি করলো তাকে। চোখের সামনে বই খোলা, কিন্তু অক্ষরগুলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে। বুকের ভেতর হালকা একটা কষ্ট জমে নিজের স্বপ্নের পাশে মা-বাবার শঙ্কাও বুঝে যায় সে।
একজন নারী যতই শিক্ষায়, কর্মে কিংবা প্রতিষ্ঠায় শিখরে পৌঁছাক না কেন দিনের শেষে সে চায় এমন এক আশ্রয়, যেখানে থাকবে নির্ভরতার শক্ত একটা হাত, থাকবে ভালোবাসায় ভরা হৃদয়। এই দুনিয়ার রুক্ষতা থেকে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে যে পুরুষ, তার ভরসায় গড়ে উঠবে জীবনের নিরাপদ এক ঘর।
নারীর হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এই চাওয়াই প্রমাণ করে, সে একা পরিপূর্ণ নয়। তাই তো পরম করুণাময় আল্লাহ নারী-পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক করে সৃষ্টি করেছেন। তিনি পুরুষকে করেছেন নারীর অভিভাবক, আর নারীকে করেছেন পুরুষের প্রশান্তির উৎস। এভাবেই ইসলাম নারীকে দিয়েছে মর্যাদা, নিরাপত্তা আর ভালোবাসার এক অনন্য ছায়া।
.
.
ভালো ভাবেই সবগুলো পরীক্ষা দিয়ে শেষ করেছে ফারিয়া আলহামদুলিল্লাহ। এবার রেজাল্টের অপেক্ষা। শেষ পরীক্ষা দিয়ে এসে মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে ফারিয়ার। তাই মায়ের হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। এমনিতেও সে মাকে সাহায্য করে কাজে কিন্তু পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে সাহানা বেগম মেয়েকে কাজ করতে দিতেন না। মেয়ের যেন পড়ায় ব্যাঘাত না ঘটে সে জন্য।
আজকে সন্ধ্যার আলোয় রান্নাঘর জুড়ে ব্যস্ততা। মেয়ের পরীক্ষা শেষ হওয়াতে সাহানা বেগম আজকের নাস্তার জন্য তৈরি করছেন আলুর চপ, বেগুনি আর পেঁয়াজু। পাশে ফারিয়া দাঁড়িয়ে ভাঁজছে একে একে সবকিছু। কড়াইয়ের গরম তেলে ভাঁজতে ভাঁজতে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে সারা ঘরে। নূরাইন আর তাদের ছোট ভাই রনি একটু পর পর এসে দেখছে বানানো শেষ হলো কিনা।
নাস্তা তৈরি হয়ে গেলে সবাই একসাথে বসে যাবে খেতে। প্রায়ই এমন গল্প-হাসির ছোট্ট এক আড্ডা জমে উঠে চায়ের কাপ আর মচমচে নাস্তার সাথে। কিন্তু ফারিয়ার পরীক্ষার জন্য এতো দিন বন্ধ ছিল সেসব।
এমন সন্ধ্যা যেন হয়ে ওঠে তাদের পরিবারিক বন্ধনের এক মধুর প্রতিচ্ছবি।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মা-মেয়ে আবার নেমে পড়ে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে। ফারিয়া প্লেট ধুচ্ছে, মা টেবিল গুছিয়ে রাখছে। চারপাশে আবার ফিরে আসছে ঘরোয়া শান্ত এক ছন্দ।
হঠাৎ থেমে গিয়ে সাহানা বেগম মায়াময় কণ্ঠে বললেন,
–” মা, এভাবে আর কতদিন চলবে? তোকে একটা স্থায়ী ঠিকানায় না দেখলে যে শান্তি পাই না। সবসময় বুকের ভেতর দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খায়। এই দুনিয়ার মানুষ যেমন সবাই ভালো না, তেমনি সবাই খারাপও না। অনেক সময় দ্বিতীয় বিয়ে মেয়েদের ভাগ্য খুলে দেয়। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ, দেখবি তোকে আল্লাহ অনেক সুখ দেবেন।
মায়ের কথাগুলো যেন ফারিয়ার হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয়। সে একমুহূর্তের জন্য থেমে যায়, হাতের কাজও স্তব্ধ হয়ে পড়ে। চোখের কোণে জমে ওঠে অনুভবের এক নীরব জলরাশি, মুখে কোনো কথা না থাকলেও মনে চলতে থাকে না বলা অনেক কিছু।
কিছুক্ষণ নীরবতা ভেঙে আবার কাজের গতি ফেরে ফারিয়ার হাতে। প্লেটগুলো ধুয়ে একপাশে রাখে, টুকটাক সব গুছিয়ে নিয়ে, এরপর ধীরে ধীরে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে,
–” আম্মু, এখনই না… প্লিজ। আমাকে আর কয়েক বছর সময় দাও। আমি এখন মন দিয়ে পড়ালেখা করতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আর যদি কখনো মনে হয় কাউকে আবার বিশ্বাস করা যায় তখন ভেবে দেখবো, ইনশা আল্লাহ।
সাহানা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। কিছু না বললেও তাঁর চোখে মুখে মিশে থাকে মায়া, চিন্তা আর দোয়ার ছায়া। মেয়ে যেন সত্যিই নিজের মতো করে জীবন গুছিয়ে নিতে পারে। তাই মেয়ের কথাগুলো শুনে নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। তিনি জানেন, ফারিয়া মনের দিক থেকে এখনও ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। মেয়ের চোখে যে গভীর ক্লান্তি আর সতর্কতা, তা একজন মায়ের চোখ এড়িয়ে যায় না।
ঘর নিস্তব্ধ, ফারিয়া নিজের ঘরের বারান্দায় গিয়ে গ্রিলের পাশে বসে যায়। বাইরে তাকিয়ে চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া গাছের ছায়া দেখে সে ভাবতে থাকে,
–” জীবনটা কি আবার নতুন করে শুরু করা যায়?
কত স্বপ্ন, কত ভরসা ভেঙে গিয়েছিল তার। তবুও সে আজ আর সেই আগের মতো ভেঙে পড়া ফারিয়া নয়। নিজেকে তৈরি করার লড়াইয়ে সে এখন আরও দৃঢ়, আরও স্থির।
রাতের নিস্তব্ধতায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ফারিয়া একটি ছোট্ট দোয়া করে,
–” হে আল্লাহ, আমাকে হিদায়াত দাও। আমাকে সেই পথ দেখাও, যা আমার জন্য কল্যাণকর। আমাকে এমন কাউকে দিও, যে আমার ভাঙা বিশ্বাস জোড়া দিতে পারে।
.
.
কিছুদিন পর সাহানা বেগমের ফোনে কল দেয় তার ছোট ভাইয়ের বউ । শুরুতে কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর আচমকাই প্রশ্ন করে বসলেন,
–” আপা, আপনি কিছু শুনেছেন?
সাহানা বেগম কিঞ্চিৎ চমকে উঠে বললেন,
–” না তো কী শুনব?
ওপাশ থেকে ভ্রু কুঁচকে গলা নামিয়ে বললেন,
–” সিরাজ তো নাকি নতুন বউকে নিয়ে বিদেশে চলে গেছে! আপা কল দিয়ে আপনার ভাইয়ের সাথে কতক্ষণ বিলাপ করল, আর নতুন বউয়ের নামে যাচ্ছে তাই বলল।
সাহানা বেগম কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকলেন। স্মৃতির গহীনে ভেসে উঠলো মেয়ের ভাঙা সংসার, অশ্রুসিক্ত চোখ, হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখটা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন,
–” আমার মেয়ে সুখী হতে পারেনি, ঠিক আছে। হয়তো কপালে ছিল না। কিন্তু তাতে কি? আমি তো চাই, দুনিয়ার সব মেয়েরা সুখী হোক।
তার কণ্ঠ ধরে এলো। চোখের কোণে জমে উঠলো অপ্রকাশিত কষ্টের জল। ধীরে বলে উঠলেন,
–” মেয়েরা যখন অশান্তিতে থাকে, তাদের মনটা কেমন করে জানো? তা শুধু মেয়েরা নয়, তাদের বাবা-মাও বুঝতে পারে। একটা মেয়ের কষ্ট আসলে একটা পুরো পরিবারের বুক ভেঙে দেয়।
–” আপা? ওপাশ থেকে স্তব্ধ গলা।
সাহানা বেগম আবারো বললেন,
–” কারও ঘর ভাঙুক এমন কথা আমার মন চায় না। সে আমার মেয়ে হোক আর পরের মেয়ে। আল্লাহ যেন সব নারীর কপালে শান্তি লেখে, এটাই চাই।
–” হ আপা এটাই। আমার ননস একদিন ঠিকই বুঝতে পারবো যে কি হারাইছেন তিনি।
–” সেসব কথা থাক। এখন রাখছি অনেক কাজ বাকি আছে।
কল কেটে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন সাহানা বেগম।
আত্মীয়তার সম্পর্ক হওয়ায় যা ঘটে সবই চলে আসে সাহানা বেগমের কাছে। তবে তিনি ঠিক করলেন এ কথা ফারিয়াকে জানাবেন না। নতুন করে মেয়েটা কষ্ট পাক তিনি চান না।…..
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।