চলার শেষ প্রান্তে পর্ব-০৭

0
1

#চলার_শেষ_প্রান্তে(৭)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

বিয়ের রাতেই সিরাজ বুঝতে পারে, তার দ্বিতীয় স্ত্রী একজন অতিমাত্রায় বদমেজাজি নারী। তার যা চাই, তা পেতেই হবে যেকোনো মূল্যে, যেকোনো উপায়ে। এই আচরণে মুহূর্তেই সিরাজের মনে পড়ে যায় ফারিয়ার কথা। কত শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিল সে! সংসারের শেষ দিনের আগে পর্যন্ত কখনও উচ্চস্বরে কথা বলেনি, কখনও দাবি করেনি কিছু। শুধু নীরব স্নেহে, গভীর সহানুভূতিতে ভালোবেসে গেছে তাকে।

সিরাজের বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন যেন চিনচিন করে ওঠে। ফারিয়ার সেই নিরব ভালোবাসা, মোলায়েম চোখের চাহনি, আর বিনা অভিযোগে সব সহ্য করে যাওয়ার অভ্যাসটা আজ তাকে কষ্ট দিয়ে মনে করিয়ে দেয় সে একজন সোনার মানুষকে হারিয়ে এসেছে।

সামনের সোফায় বসে থাকা রুবিনা তার বর্তমান স্ত্রী এখনও রা/গে ফোঁসফোঁস করছে। কথায় কথায় তিরস্কার, চোখে-মুখে তীব্র অসন্তোষ, যেন বিয়েটা কোনো ভালোবাসা নয়, বরং একপ্রকার চুক্তি।

সিরাজের দ্বিতীয় স্ত্রী রুবিনা বিয়ের প্রথম রাতেই চোখে চোখ রেখে বলল,
–” শোনো, আমি বিদেশে তোমার সঙ্গে যাব এটাই আমার একমাত্র শর্ত।

সিরাজ একটু থমকে গিয়ে শান্ত গলায় বলল,
–” রুবিনা, মা’কে দেশে ফেলে রেখে আমি কখনোই স্ত্রীকে নিয়ে বিদেশ যেতে পারবো না। সেটা অসম্ভব।

রুবিনার চোখে তখন ঠান্ডা আগুন। ঠোঁট কেঁপে উঠল তার শব্দে,
–” তাহলে শোনো, ভোরের আলো ফোটার আগেই আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তুমি বিদেশে আরামে থাকবে আর আমি তোমার মায়ের দাসী হয়ে পড়ে থাকবো এটা হতে পারে না! আমাকে তোমার প্রথম স্ত্রীর মতো সরল ভেবে ভুল কোরো না। শুনেছি, তোমার মায়ের অবিচারে সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

সিরাজ চুপ করে গেল। রুবিনার চোখে তখন প্রতিবাদের অশান্ত জ্বালা। সিরাজ আর কিছু বলে না। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ছাদের দিকে। মনের গহীনে আজ নতুন করে একটা প্রশ্ন দোলা দেয় ভুল কি আমি তখনই করেছিলাম? মায়ের কথা শুনে ফারিয়াকে কষ্ট দিয়ে?

সিরাজ এবার বিয়ে করেছে ভেবেছিল নতুন করে জীবন শুরু করবে। পুরোনো সম্পর্কের যন্ত্রণা ভুলে এবার নতুন স্ত্রী রুবিনার সঙ্গে একটা সুন্দর জীবন গড়বে। কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতেই যেন সেই স্বপ্নটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।
.
.
বিয়ের আজকে দ্বিতীয় রাতে,
রুবিনা চুপ করে বসে ছিল বেশ কিছুক্ষণ, তারপর সরাসরি বলল,
–” আমার শর্ত একটাই, আমাকে তোমার সাথে বিদেশে নিয়ে যাবে। আমি এই বাড়িতে পড়ে থাকতে পারবো না।

সিরাজ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
–” রুবিনা, আমি তো আগেই বলেছি মা’কে ফেলে যেতে পারবো না। উনি এখন একা, বয়স হয়েছে। বিদেশে ওনাকে নেওয়াও সম্ভব নয়।”

রুবিনার চোখে বিদ্রুপ।
–” তুমি সবসময় মায়ের জন্যই তো সব করো। ঠিক এই কারণেই তোমার প্রথম স্ত্রী চলে গেছে তাই না? সে তো মায়ের সব কথায় মাথা নত করেও শেষমেশ অপমান সয়ে সয়ে বিদায় নিয়েছে। আমি সেরকম নই, সিরাজ।

সিরাজ গলা শক্ত করল,
–” তুমি কি বলছো এসব? মা তোমার শত্রু নন। তিনি শুধু চান, সংসারটা যেন ভেঙে না যায়, যেমন আগেরবার হয়েছিল।

রুবিনা উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল, পর্দা সরিয়ে ভোরের দিকে তাকিয়ে বলল,
–” তোমার মা চায়, সংসারটা তার মতো করে চলুক। আর আমি চাই, একটা স্বাভাবিক জীবন যেখানে আমি আমার স্বামীকে নিজের করে পেতে পারি। আমাকে নিয়ে যদি তোমার কোনো দায়বদ্ধতা না থাকে, তাহলে এই সম্পর্ক নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

সিরাজ নীরব। তার চোখে তখনো ভেসে উঠছে প্রথম স্ত্রী ফারিয়ার মুখ।

রুবিনা আবার বলল,
–” ভোরের আলো ফোটার আগে সিদ্ধান্ত নাও, সিরাজ। আমি তোমার মা’র ছায়ায় নিজেকে হারাতে রাজি নই।

শেষমেষ অশান্তি আটকাতে সিরাজ বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে যায় রুবিনা কে বিদেশে নিয়ে যেতে।

ভোরের আলো ফোটার আগ মুহূর্তে ঘরজুড়ে যেন একটা থমথমে নীরবতা। রুবিনা তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, মুখে দৃঢ়তা, চোখে অপেক্ষা।

সিরাজ সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। বিছানায় এলিয়ে থাকা শরীরটায় যেন শত কিলোর ভার। মা একপাশে, রুবিনা আরেক পাশে। দুজনের মাঝে আটকে গেছে সে। কিন্তু আরও একটা সংসার ভেঙে যাক এটা সে চায় না।

নিরবে উঠে এসে রুবিনার সামনে দাঁড়াল সিরাজ। গলার স্বর শান্ত, কিন্তু গভীর।
–” তুমি চাও, আমি তোমাকে বিদেশে নিয়ে যাই, তাই তো?

রুবিনা মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। কিছু বলল না, শুধু তাকিয়ে থাকল তার দিকে।

সিরাজ গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
–” ঠিক আছে, আমি তোমাকে নিয়ে যাব। তবে শুধু তোমার জন্য নয়, এই সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্য।

রুবিনার চোখে তখন একঝলক বিস্ময়। সে ভাবেনি সিরাজ এত সহজে রাজি হবে। কিন্তু মুখে জয়ের হাসি ঝুলিয়ে সিরাজ কে জরিয়ে ধরে বলল,
–” দেখবে এবার আমরা অনেক সুখী হবো। আমি তোমার পাশে থাকবো, যদি তুমি আমার প্রাপ্য সম্মানটা দাও।

সিরাজ মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।
ভেতরে কোথাও একটা হাহাকার জেগে উঠল, আগেই যদি এই সিদ্ধান্ত টা নিতে পারতো, ফারিয়াকে যদি তার সাথে নিয়ে যেত তাহলে সংসার টা ভেঙে যেতো না নিশ্চয়ই?

রুবিনা এবার সিরাজ কে ছেড়ে ফুরফুরে মনে ঘর গুছিয়ে, রান্না ঘরের দিকে গেল।

আর সিরাজ দাঁড়িয়ে রইল ভাঙা এক দ্বিধার মধ্যে। বাইরে তখন ভোরের আলো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েছে।
.
.
সকালবেলা। ঘরের কোণে চুপচাপ বসে ছিলেন শাহীনা বেগম। হঠাৎ করেই ছেলের মুখে শুনলেন সেই কথা, যেটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত হয়ে এলো।

সিরাজ নিচু গলায় বলেছিল,
–” মা, রুবিনাকে আমার সঙ্গে বিদেশে নিয়ে যাব ভেবেছি। অনেক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।

শুনেই শাহীনা বেগমের মুখ থমকে গেল। কপালে হাত ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। চোখে জ্বলজ্বলে রা/গ, কণ্ঠে অভিমানের বিস্ফোরণ,
–” তুই কি বললি সিরাজ? তোর বউ বিদেশে যাবে? আমি বেঁচে থাকতে এই বাড়ির বউ পা বাড়াতে পারবে না দেশের বাইরে!

সিরাজ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এ রকম তীব্র কণ্ঠে মা তাকে কতদিন পর ডেকেছে কে জানে!

শাহীনা বেগম ধীরে ধীরে সামনে এসে বললেন,
–” একটা সংসার ভাঙলি তোর মাথা গরমির জন্য, এখন আবার আরেকটা সংসার নিয়ে খেলতে যাচ্ছিস! এই বউ তোর সঙ্গে যাবে আর আমি একা পড়ে থাকবো এই বৃদ্ধ বয়সে? কোন সাহসে বলিস এসব?”

সিরাজ গলা নিচু করে বলল,
–” মা, আমি এবার সব ঠিক রাখতে চাই। ঝগড়া, দ্বন্দ্ব, ভাঙন আর নয়। ওকে না নিয়ে গেলে সংসারে আবার অশান্তি শুরু হবে।

শাহীনা বেগম কেঁপে কেঁপে বললেন,
–” তুই তো সেই ছেলে, যে মায়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলতি না কখনো! আজ তুই মায়ের মুখের ওপর বলছিস তোর বউয়ের ইচ্ছেই শেষ কথা?

ঘরে তখন থমথমে নিস্তব্ধতা। বাইরে পাখিরা ডাকছে, অথচ ভিতরে এক অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এক মা, এক স্ত্রীর মধ্যে, আর মাঝখানে জর্জরিত এক ছেলে।

শাহীনা বেগমের কণ্ঠ তখনও গমগম করে ঘরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। রুবিনা সব শুনছিল রান্না ঘর থেকে। আর সহ্য হলো না তার। ধীর পায়ে সে বসার ঘরে প্রবেশ করল, মুখে স্বাভাবিক দৃঢ়তা, চোখে আত্মবিশ্বাস।
–” আমার কথাই ঠিক হয়েছে তাহলে। আমি জানতাম, একদিন না একদিন আমাকে এভাবে থামানোর চেষ্টা হবে। তাই প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

শাহীনা বেগম তাচ্ছিল্যের চোখে তাকিয়ে বললেন,
–” এই ঘরের নিয়ম আমি করি। বউদের জেদে ঘর চলে না।

রুবিনা বিন্দুমাত্র ভয় পেল না। শান্ত গলায়, কিন্তু তীব্র সুরে বলল,
–” আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, আমি আপনার পুত্রবধূ, আপনার দাসী নই। আমি কোনো অন্যায় দাবি করিনি। আমি শুধু আমার স্বামীর পাশে থেকে একটা সম্মানজনক জীবন চেয়েছি। তা যদি না পাই, তবে এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মানে কী?

সিরাজ হস্তক্ষেপ করতে চাইল,
–” রুবিনা, তুমি চুপ করো।

কিন্তু রুবিনা থামাল তাকে,
–” না সিরাজ, আজ আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই। আমি কোনো ভান করে সংসার করতে পারি না। আগেও বলেছি আমি তোমার প্রথম স্ত্রীর মতো নই। আমি নিজের সম্মান জানি, জানি আমার অধিকারও। তুমি যদি তোমার মায়ের কথার বাইরে যেতে না পারো, তাহলে আমিও আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো।

শাহীনা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
–” তাহলে বেরিয়ে যা এই ঘর থেকে। আমি তোর মতো মেয়েকে এই সংসারে রাখতে চাই না।

রুবিনার ঠোঁটে হালকা একটা তিক্ত হাসি ফুটে উঠল। বলল,
–” আপনি নিজেই ভাবুন, বারবার ঘর ভাঙার কারণ আপনি নিজে নন তো?

ঘরে আবারও নীরবতা। এক অদৃশ্য বিস্ফোরণ ঘটে গেছে, যার শব্দ কেবল হৃদয়ের গভীরে শোনা যায়….

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।