#চলার_শেষ_প্রান্তে(৮)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
রুবিনার জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয় সিরাজকে। সংসারের শান্তি আর সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সে সিদ্ধান্ত নেয় রুবিনাকে নিয়েই বিদেশে যাবে।
চোখের কোণে পানি নিয়ে শাহীনা বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছেলেকে বিদায় দিচ্ছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে নিজের জীবনের সব সুখ, সব শান্তিকে বিদায় জানাচ্ছেন।
তিনি শুধু বলেছিলেন,
–” আমার কথা ভাবতে হবে না কারো।
সিরাজ কেবল মাথা নিচু করে চুপচাপ বেরিয়ে যায় মায়ের চোখে চোখ রাখার সাহস তার হয় না।
কয়েকদিন কাটে,
শাহীনা বেগম একা একা ঘরের কোণে বসে থাকেন। যাদের জন্য এতো কিছু ত্যাগ করলেন, তাদের সঙ্গটাই এখন তাঁর জীবনে অনুপস্থিত। হঠাৎ একদিন রান্নাঘর থেকে উচ্চস্বরে কলহের শব্দ আসে। বড় ছেলের বউ গর্জে উঠে বলে,
–” আমি আর এ সংসারে রান্না বান্না করতে পারবো না। আমার আলাদা হাড়ি-পাতিল লাগবে। সবাই যার যার মতো চলুক!
শাহীনা বেগম যেন মুহূর্তেই বোঝেন সংসার এখন ভেঙে পড়েছে নিঃশব্দে। ছোট ছেলের বউ বিদেশে চলে গেছে। বড় ছেলের বউ এখন নিজের জন্য আলাদা গণ্ডি টেনে নিতে চাইছে।
তিনি স্তব্ধ হয়ে যান। তাঁর সামনে যেন পুরো জীবনটা ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যায়। মনে মনে ভাবলেন,
–” এটা কি সেই সংসার? যেখানে তার কথাই শেষ কথা ছিল।
আলাদা হাড়ির শব্দ, চায়ের কাপে চামচ নাড়ার আলাদা ছন্দ, সবকিছু যেন বলে দিচ্ছে, তিনি এখন এই বাড়িতে ‘মা’ নন, একজন বোঝা। আরও একবার একা হয়ে গেলেন শাহীনা বেগম।
.
.
বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম কয়েক মাস সবকিছু বেশ ভালোই চলছিল। সিরাজ নিয়মিত মোটা অংকের টাকা পাঠাতো। শাহীনা বেগমও একা একাই কিছুটা স্বস্তি নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। মনে হতো, ছেলেটা দূরে থাকলেও মায়ের প্রতি দায়িত্ব ভুলে যায়নি।
কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু বদলে যেতে লাগল।
পরের মাসের শেষ তারিখ পেরিয়ে গেলেও টাকা এলো না। শাহীনা বেগম ভেবেছিলেন, হয়তো সিরাজ ব্যস্ত, কালই পাঠাবে। কিন্তু এরপর দিন গেল সপ্তাহ গেল টাকার কোনো হদিস নেই।
ফোন করে বলার পর সিরাজ একদিন শুধু বলল,
–” রুবিনার কিছু শারীরিক অসুবিধা চলছে মা, খরচ একটু বেড়েছে। সামলাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
শাহীনা বেগম কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না।
এদিকে ঘরে চাল, ডাল, তেল সব ফুরিয়ে আসছে। হাতের গয়না, কিছু সঞ্চয় সেইসব আগেই গিয়েছে ছেলেদের ভবিষ্যতের পেছনে।
বড় ছেলে?
সে তো এমনিতেই কিছু দিত না। মুখে বলত,
–” ছোট ভাই তো বিদেশে, ওর দায়িত্ব। আমার ও তো নিজের সংসার চালাতে হয়।
যা কিছু আসত, সবই সিরাজের হাত ধরে আসত। এখন তাও বন্ধ। শাহীনা বেগম চুপচাপ বসে থাকেন বারান্দায়। আগের সেই গর্বিত মুখ আর নেই। এখন তিনি শুধু ভাবেন,
–” আমি যে এই সংসারটা গড়েছিলাম বুক পেতে আজ আমি এই ঘরেই এত বোঝা হয়ে গেলাম কেন?
.
.
ফারিয়া মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করেছে। প্রথম বর্ষের ফলাফল দেখে সে নিজেই নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এখন সে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে, আর তার চোখে শুধু এখন একটাই লক্ষ্য ফাস্ট ক্লাস পেতেই হবে!
দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে মেয়েটা। ক্লাস, নোট তৈরি, লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা।সবকিছুতেই সে এখন অনেক বেশি মনোযোগী। পরিবারের দায়িত্ব, নিজের ভবিষ্যত, আর একটু সম্মানজনক জায়গা দখলের তাগিদ যেন তাকে দৌড়ের উপর থাকতে হয়।
সে জানে, সাফল্য সহজে ধরা দেয় না। তাই ফারিয়া হার মানতে শেখেনি সে বিশ্বাস করে, পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না।
ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারিয়ার নতুন কয়েকজন বান্ধবী হয়েছে। ক্লাসে তার নিয়মিত উপস্থিতি ও ভালো পারফরম্যান্স সবার নজর কেড়েছে। বিশেষ করে ছেলেরা মাঝে মাঝেই সেধে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু ফারিয়া সৌজন্য বজায় রেখেই কৌশলে তাদের এড়িয়ে চলে। কারণ, সে জানে ইসলামে বেপর্দা মেলামেশা নিষিদ্ধ। একজন প্রকৃত মুসলিমা হিসেবে এই বিধান মেনে চলা তার জন্য শুধু দায়িত্ব নয়, বরং ইমানেরই একটি অংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণবন্ত পরিবেশে যেখানে অনেকেই নিজেদের আদর্শ হারিয়ে ফেলে, সেখানে ফারিয়া যেন ব্যতিক্রম এক দৃষ্টান্ত। তার চলনে, বলনে এবং ব্যবহারিক জীবনেও ইসলামি আদর্শের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। সামাজিক মাধ্যমেও নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে, অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন বা প্রদর্শন থেকে দূরে থাকে সে।
তার এমন জীবনযাপন দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়, কেউ কেউ প্রশ্নও করে,
–” সবকিছু পাওয়ার এই বয়সে তুমি এত কঠোর কেন?
ফারিয়া তখন শান্ত স্বরে বলে,
–” এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, আর আমি চিরস্থায়ী জিন্দেগীর প্রস্তুতি নেওয়ার চেষ্টা করছি শুধু।
তার বান্ধবীরা অনেক সময় বলে, ফারিয়া একটু খোলামেলা হলে ক্ষতি কী? থ্রিপিস এর সাথে হিজাব পড়লেই হয়।
ফারিয়া তখন মুচকি হেসে বলে,
–” আমার সৌন্দর্য আমার পর্দা। আমার আত্মমর্যাদা আমার সীমাবদ্ধতায়।
অনেকেই তার এই আচরণকে কঠোরতা ভাবে, আবার কেউ কেউ ব্যতিক্রম মনে করে। কিন্তু ফারিয়া জানে, একজন মুসলিম নারীর পরিচয় শুধু তার পোশাকে নয়, বরং তার চরিত্র, লজ্জা এবং সংযমেই প্রকাশ পায়। তাই সে নিজের আদর্শ থেকে একটুও সরে আসে না।
.
.
নূরাইন এখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। সে সবকিছুতে বড় বোন ফারিয়াকে অনুসরণ করে, চলার ধারা, পর্দা, আদব-কায়দা সবকিছুতেই যেন ফারিয়া তার আদর্শ। দুই বোনকে একসাথে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় মতিন সাহেবের। কিন্তু বড় মেয়েটিকে নিয়ে তার হৃদয়ে এখনো একরাশ আফসোস রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ভাবেন যদি ফারিয়ার বিয়ে এত কম বয়সে না দিতেন, তবে হয়তো তার জীবনটা এমন হতাশায় ডুবে যেত না।
তবুও মতিন সাহেব আল্লাহ তাআলার উপর পূর্ণ ভরসা রাখেন। তার বিশ্বাস আল্লাহ যেভাবে চান, ঠিক সেভাবেই সবকিছু ঘটে। তিনি দোয়া করেন, একদিন নিশ্চয়ই তার ফারিয়া সুখী হবে ইনশা আল্লাহ।
.
.
ফারিয়াদের বাড়িটা একটি দোতলা পাকা ঘর। তারা নিজেরা থাকে উপর তলায়, আর নিচতলাটি ভাড়া দিয়ে রাখে। এই মাসেই নতুন এক ভাড়াটিয়া আসছে। যে বাসা ভাড়া নিয়েছেন, সে নিজে এসেই মতিন সাহেবের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করেছে। জানা গেল, ছেলেটি তার পরিবারসহ এখানে থাকবে।
পড়াশোনা শেষ করে সে এখন চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। মূলত এই অপেক্ষার সময়টুকু পার করার জন্যই সে এই ছোট্ট বাসাটি ভাড়া নিয়েছে। নয়তো এমন সাধারণ একটি বাসায় থাকাটা তার পছন্দ হতো না বলে মনে করলেন মতিন সাহেব। এই কথাই বলেছিলেন স্ত্রীর সাথে।
বাবার মুখে ভাড়াটিয়ার কথা শুনে নূরাইন ছুটে গেল বোনের কাছে। ফারিয়া তখন অবসরের মুহূর্তটুকু কাজে লাগিয়ে গল্পের বই নিয়ে বসেছে। বইয়ের পৃষ্ঠায় ডুবে থাকা সে যেন এক অন্য জগতে। বাস্তবের নূরাইনের ডাক তার কানে পৌঁছালেও, মনের একাগ্রতা তাকে সেই জগতেই আটকে রাখে।
বোনের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মুখ ভার করে ফিরে যায় নূরাইন। কিঞ্চিত অভিমান জমে ওঠে তার মনে। আর তখনই হঠাৎ ফারিয়ার হোশ ফিরে আসে। বই থেকে মুখ তুলে আশপাশে তাকিয়ে বোনের অনুপস্থিতি টের পায় সে।
নূরাইন কী বলেছিল মনে করার অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই ঠিকমতো মনে করতে পারে না ফারিয়া। শুধু অনুভব করে, বোনের কণ্ঠে যেন কিছু একটার উত্তেজনা ছিল, যার গুরুত্ব সে তখন বোঝেনি।
.
.
সকালের নরম রোদে এক টিউশনির উদ্দেশ্যে বের হয় ফারিয়া। মাথার ছয় পার্ট হিজাব গুছিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল সে। ঠিক তখনই হঠাৎ করেই এক ছেলের মুখোমুখি পড়ে যায়। ছেলেটির পরনে ছিল লুঙ্গি আর সেন্টু গেঞ্জি, হাতে একটি বালতি ভর্তি ভিজে কাপড়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ছাদে কাপড় শুকাতে যাচ্ছে।
দু’জনে একই সময়ে একে অপরকে পাশ কাটাতে গিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। ফারিয়া ডানদিকে সরতে যায়, ছেলেটিও যায় ডানদিকে। আবার ফারিয়া বাঁদিকে সরতেই ছেলেটিও যায় সেদিকে। যেন এক অদ্ভুত সমন্বয়হীনতার খেলা! মুহূর্তের জন্য দু’জনই কিংকর্তব্যবিমূঢ়…….
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।