চলার শেষ প্রান্তে পর্ব-১১

0
1

#চলার_শেষ_প্রান্তে(১১)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সন্ধ্যার কোমল আলোয় দরজায় কড়া নাড়া পড়তেই সাহানা বেগম ধীরে দরজা খুললেন। চোখ মেলতেই দেখলেন সাগরিকা চৌধুরী দাঁড়িয়ে, হাতে এক বাক্স মিষ্টি, মুখে প্রশান্তির মায়াভরা হাসি।

তিনি এগিয়ে এসে বললেন,
–” ভাবি, আমার ছেলেটার চাকরি হয়েছে। ভাবলাম, এই খুশির খবরটা আপনাকে জানিয়ে আসি। মিষ্টি নিন, দুআ করবেন ওর জন্য‌ যেন ও আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে ইনশা আল্লাহ।

সাহানা বেগম মিষ্টি গ্রহণ করে আনন্দভরা কণ্ঠে বললেন,
–” আলহামদুলিল্লাহ! খুবই সুখবর, ভাবি। কিন্তু মিষ্টি আনার কী দরকার ছিল? এমনিতেই তো দুআ করি সব সময়। শুনেছি, আপনার ছেলে অনেক পরিশ্রম করেছে। পরিশ্রমের ফল একমাত্র আল্লাহই দেন, আর তিনি সুবিচারক।

সাহানা বেগম নিয়ে বসালেন সাগরিকা চৌধুরী কে। বসিয়ে কিছু নাস্তা আনতে উদ্যত হলে সাগরিকা চৌধুরী তাকে বাধা দিয়ে বললেন,
–” আমি এখন কিছু খাব না আপনি বসেন গল্প করি।

ওদের কথাবার্তার মাঝেই হঠাৎ বসার ঘরে ঢুকল ফারিয়া। মুখে একরাশ তাড়াহুড়োর ছাপ, কিন্তু ভদ্রতা ভুলে যায়নি সে।
–” আম্মু! বলে ডাকতে ডাকতেই চোখ পড়ল তাহসান এর মায়ের দিকে। সাথে সাথেই সালাম দিল,
–” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।

তাহসানের মা, মমতা ভরা কণ্ঠে সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
–” ওয়ালাইকুমুস সালাম, এসো মা বসো।

যদিও ফারিয়ার পড়ার তাড়া ছিল, তবুও আদব রক্ষা করে শান্তভাবে বসে পড়ল সে।

সাগরিকা চৌধুরী তখন মুখভরে হাসি নিয়ে বললেন,
–” জানো ফারিয়া, আমার ছেলেটা চাকরি পেয়েছে আলহামদুলিল্লাহ, অনেক পরিশ্রম করেছে ছেলেটা।

ফারিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
–” আলহামদুলিল্লাহ আন্টি, এটা তো দারুণ খবর!

সাগরিকা চৌধুরী স্নেহভরে বললেন,
–” আমার ছেলেটার জন্য দুআ কইরো মা। আর এই যে মিষ্টি এনেছি, খাবে কিন্তু!

ফারিয়া হালকা মুচকি হেসে মাথা নাড়ল,
–” ফি আমানিল্লাহ। জ্বী আন্টি, খাব ইনশাআল্লাহ।

এরপর সাহানা বেগম ও সাগরিকা চৌধুরী গল্পে মেতে উঠলেন। তাদের আলোচনা গড়িয়ে গেলো রান্নাবান্না, বাজারদর, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে নানান সাংসারিক বিষয়ে। মাঝখানে কয়েকবার ফারিয়া কিছু বলার চেষ্টা করেও থেমে গেল।

সে পড়ার তাড়ায় মনস্থির করে উঠতে পারছিল না, আবার মাঝখান থেকে উঠে যাওয়াটাও ভদ্রতা-বিরুদ্ধ হবে এমন দ্বিধায় পড়ে চুপচাপ বসে রইল। সময় যেন থেমে গেছে তার জন্য।

ঠিক তখনই ভেতর দিক থেকে মতিন সাহেবের গলা শোনা গেল,
–” ফারিয়া মা, এক গ্লাস পানি দিয়ে যা তো।

ডাক শুনেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ফারিয়া। মনে হলো মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পা বাড়াল রান্নাঘরের দিকে।

পানি হাতে নিয়ে ফারিয়া গেল বাবার কাছে। গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল,
–” আব্বু, তোমার আর কিছু লাগবে?

মতিন সাহেব গ্লাসটা হাতে নিয়ে একটু হাসলেন,
–” না রে মা, তুই গিয়ে পড়তে বস। তোকে ওখান থেকে উঠিয়ে আনার জন্যই ডেকেছি। তোর পরীক্ষা সামনে, আর তোর মা কিনা তোকে বসিয়ে রেখেছে ওখানে।

ফারিয়া হালকা হাসল,
–” আম্মুর দোষ নেই। নিচ তলার আন্টি তো জানেন না আমার পরীক্ষা, তাই উনিই বসতে বলেছিলেন।

মতিন সাহেব কিছুটা বিরক্ত মুখে বললেন,
–” তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোর মা তো বলতেই পারত যে তোর পড়ার তাড়া আছে! যাক, যা তুই, পড়তে বস এখন।

ফারিয়া মাথা নেড়ে শান্ত গলায় বলল,
–” আচ্ছা, যাই।
.
.
চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাহসানের জীবনে যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। এখন সে প্রতিদিন নিয়ম করে সকালবেলা অফিসে যায়। জামাকাপড় গুছিয়ে পরিপাটি হয়ে বেরিয়ে পড়ে সময়মতো। চোখে একরাশ স্বপ্ন, মনে দায়িত্বের গভীর অনুভব।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার মুখে থাকে এক শান্ত, আত্মবিশ্বাসী হাসি যেন নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই এগিয়ে চলছে সে। নতুন এই পথচলায় তাহসান দিনদিন আরও পরিণত হয়ে উঠছে।

তাহসানের অফিসে যাওয়া, কাজ শেখা সবই যেন ধীরে ধীরে তার জীবনের অভ্যস্ত নিয়মে পরিণত হলো। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত মুখেও একরকম তৃপ্তির ছাপ থাকে।

সাগরিকা চৌধুরী ছেলের মুখে সেই পরিশ্রম আর পরিণতির আভাস দেখে মনে মনে দোয়া করেন,
–” আল্লাহ, আমার ছেলেটাকে হিফাজতে রাখো। ওর কষ্ট যেন সার্থক হয়।

সাথে প্রতিদিন তাহসানের জন্য পছন্দের খাবার রান্না করে রাখেন। ছেলের হাসিমুখ দেখলেই তার বুকটা ভরে যায়। তাহসানও মাঝে মাঝে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বলে,
–” তোমার দোয়াতেই আজ এই পর্যন্ত আসা আম্মু।

সাগরিকা চৌধুরীর চোখে তখন পানি এসে যায়। তিনি হাত তুলে বলেন,
–” তুই শুধু সৎপথে থাকিস বাবা, আল্লাহ তোর জন্য উত্তমটাই রেখেছেন।”

এদিকে ফারিয়ার দিনগুলো কেটেই চলেছে পড়ার চাপ আর প্রস্তুতির ব্যস্ততায়। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। সকাল থেকে রাত বই, খাতা আর নোটে ডুবে থাকে সে। মাঝে মাঝে ক্লান্ত চোখে ছাদে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যেন মনের কোথাও এক টুকরো শান্তি খোঁজে।

তবে যত ব্যস্ততাই থাকুক, তাহসানের চাকরির খবর তার মন ছুঁয়ে গেছে। সে প্রায়ই ভাবে,
–” আল্লাহ, উনার যেন সবকিছু ভালোভাবে এগোয়। উনি তো সত্যিই পরিশ্রম করেছেন।

তাহসানের প্রতি তার একটা অদৃশ্য টান তৈরি হয়েছে খুব স্পষ্ট না হলেও একটা প্রশংসা, সম্মান আর অচেনা অনুভূতির ছায়া যেন তার মনে ধীরে ধীরে গেঁথে যাচ্ছে।

রাতের পড়াশোনার মাঝে হঠাৎ তাহসানের কথা মনে পড়লে এক অজানা হাসি খেলে যায় ফারিয়ার মুখে। সে নিজেও বুঝতে পারে না, কেন এমন হয়।চোখ বন্ধ করে মনে মনে দোয়া করে,
–” আল্লাহ, তুমি জানো আমার মনের কথা। আমি এখনি এমন কিছুতে জড়াতে চাইছি না।
.
.
সেদিন বিকেলবেলা। ফারিয়া বারান্দায় বসে পড়ছিল। হালকা বাতাস বইছে, আকাশে মেঘের খেলা। সে পড়ায় মন বসাতে পারছিল না কিছুতেই। হঠাৎ নিচের দিক থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠস্বর,
–” আসসালামু আলাইকুম আন্টি!

ফারিয়া চমকে উঠল। বুক ধক করে উঠল। ধীরে নিচে তাকিয়ে দেখে, তাহসান দাঁড়িয়ে আছে তার মায়ের সঙ্গে, হাতে বাজারের ব্যাগ।

সাহানা বেগম হেসে জবাব দিলেন,
–” ওয়ালাইকুমুস সালাম । অফিস থেকে ফিরলে নাকি? ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

তাহসান মুচকি হেসে বলল,
–” জ্বি আন্টি।

উপরে থাকা ফারিয়ার চোখ আটকে যায় তাহসানের মুখে। পরিপাটি পোশাক, ক্লান্ত মুখে একরাশ প্রশান্তি। একটা সম্মানের অনুভূতি যেন আবারও মন ছুঁয়ে যায়।

তাহসান হঠাৎ চোখ তুলে বারান্দার দিকে তাকাল। ফারিয়াকে ঝাপসা দেখতে পেয়ে হালকা হাসল।

চোখাচোখি হ‌ওয়ার আগেই ফারিয়া সরে যায় আর সেই ছোট্ট মুহূর্তটাই ফারিয়ার বুকের মধ্যে এক অজানা কম্পন জাগিয়ে দিল।

তাহসান আবার সাহানা বেগমের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর ফারিয়া নিজের বুকের শব্দ শুনতে শুনতে মনে মনে বলল,
–” আল্লাহ, এ অনুভূতির মানে কি?
.
.
পরদিন বিকেলে ফারিয়া কিছু দরকারি খাতা কেনার জন্য পাশের দোকানে যাচ্ছিল। গলির মোড় ঘুরতেই হঠাৎ চোখে পড়ল সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তাহসান, এক হাতে ফোন, আরেক হাতে বাজারের ব্যাগ।

তাকে দেখে থমকে দাঁড়াল ফারিয়া। দম নিতে একটু কষ্ট হচ্ছিল যেন। সে ভাবছিল পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, কিন্তু ঠিক তখনই তাহসান চোখ তুলে তাকাল। এক মুহূর্তেই চিনে ফেলল ফারিয়াকে।হালকা হাসি নিয়ে তাহসান বলল,
–” আসসালামু আলাইকুম।

ফারিয়া একটু দ্বিধা নিয়ে জবাব দিল,
–” ওয়ালাইকুমুস সালাম।

তাহসান জিজ্ঞেস করল,
–” লাইব্রেরীতে যাচ্ছেন?

ফারিয়া মাথা নাড়ল,
–” হ্যাঁ, কিছু নোটবুক শেষ হয়ে গেছে।

তাহসান হেসে বলল,
–” ভালো। পরীক্ষার সময় এগুলা ঠিকঠাক থাকা দরকার। আপনার পড়াশোনার প্রতি দায়িত্বশীলতা দেখে ভালো লাগল।

ফারিয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
–” আলহামদুলিল্লাহ… চেষ্টা করছি।

একটা মুহূর্ত নীরবতা নেমে এল। তারপর তাহসান বলল,
–” আচ্ছা, দোয়া রইল আপনার জন্য। আল্লাহ যেন সফলতা দেন পরীক্ষায়।

ফারিয়ার চোখে তখন একরাশ বিস্ময় আর ভেতরভেতর একরকম অনির্বচনীয় অনুভব। সে ধীরে মাথা নাড়ল,
–” জাযাকাল্লাহু খাইরান। আপনাকেও আল্লাহ ভালো রাখুন।

তাহসান হালকা মাথা নেড়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেল নিজের পথে। আর ফারিয়া হৃদয়ের গভীরে এক মধুর কম্পন নিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে সামনে পা বাড়ায়…

#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।