#চলার_শেষ_প্রান্তে(১৩)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
মাস খানেক পর বিকেলের দিকে,
সাহানা বেগম তখনো রান্না ঘরে চা বানাতে ব্যস্ত। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চেনা মুখ দেখে চমকে উঠলেন তিনি তাহসানের মা, সাগরিকা চৌধুরী।
–” আরে ভাবি! আপনি? এতো দিনে আমাদের কথা মনে পড়লো তাহলে?
সাগরিকা চৌধুরী হেসে বললেন,
–” আসবো আসবো করে আসা হচ্ছিলো না। আজকে হুট করেই চলে আসলাম। মনটা কেমন করছিল। তাই ভাবলাম একটুখানি দেখে যাই। ফারিয়া বাসায় আছে?
সাহানা বেগম তাঁকে ভেতরে নিয়ে বসালেন।
–” ভিতরে আসুন ভাবি, ফারিয়া তো টিউশনিতে গেছে। আজকাল খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মেয়েটা।
সাগরিকা চৌধুরী বললেন,
–” আচ্ছা! আমি তো ভেবেছিলাম ফারিয়ার সাথে একটু দেখা হবে।
সাহানা বেগম মৃদু হাসলেন,
–” মেয়েটা এখন পড়াশোনা, টিউশনি নিয়ে বেশ ব্যস্ত। তবুও ফিরতে দেরি হবে না আশা করি। আপনি বসুন, আমি চা দিচ্ছি।
বিকেলের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকছিল। বাতাসে ছিল এক ধরনের পুরনো দিনের সম্পর্কের গন্ধ, সংবেদনশীলতার আর না বলা কিছু গল্পের।
বিকেলের নরম আলোয় ঘরটা শান্ত।
সাগরিকা চৌধুরী চায়ের কাপ হাতে চুপচাপ বসে আছেন। সাহানা বেগম মুখোমুখি এসে বসলেন। দুজনের মাঝখানে একরাশ নীরবতা। হঠাৎ সাগরিকা চৌধুরী নরম গলায় বললেন,
–” ভাবি, আজ আসার একটা কারণ ছিল। শুধু দেখা করতেই আসিনি।
সাহানা বেগম একটু অবাক হয়ে বললেন,
–” বলুন ভাবি, কী বিষয়?
সাগরিকা চৌধুরী একটু ইতস্তত করে বললেন,
–” ভাবি একটা কথা বলার ছিল, অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, আজ সাহস করে বলেই ফেলি।
সাহানা বেগম আগ্রহ নিয়ে বললেন,
–” বলুন ভাবি, আপনি এমন ভাবে বলছেন কেন?
সাগরিকা চৌধুরী এবার সরাসরি বললেন,
–” ভাবি, আমি চাই আমার ছেলের জন্য একটা ভালো মেয়ে, বউ করে আনি। আর আমার চোখে সেই উপযুক্ত মেয়েটা হচ্ছে আপনার বড় মেয়ে ফারিয়া।
কথাটা শুনে সাহানা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। চোখে-মুখে বিস্ময় ও ভাবনা একসাথে।
সাগরিকা চৌধুরী আবার বললেন,
–” ফারিয়া যেভাবে বড় হয়েছে, ওর ব্যবহার, পরিশ্রম, ভদ্রতা সব দেখে মনে হয়েছে ও আমার সংসারের জন্য উপযুক্ত হবে ইনশা আল্লাহ। তাহসান এখন ভালো চাকরিতে আছে, মনের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে। তাই চাচ্ছি, দুই পরিবারের মধ্যে এই বন্ধনটা আরও গভীর হোক।
সাহানা বেগম এবার হালকা হেসে বললেন,
–” ভাবি, আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মানিত বোধ করছি। তবে আপনি তো জানেন, মেয়েদের ব্যাপারে তাদের মতামতটাই মুখ্য। ফারিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নেবো।
সাগরিকা চৌধুরী মাথা নাড়লেন,
–” ঠিক বলেছেন। আমি তো শুধু আমার ইচ্ছেটা জানালাম। সবই আল্লাহর হুকুম।
ঘরজুড়ে একটা শান্ত ভাব বিরাজ করছিল। প্রস্তাবটা যেন আচমকা হলেও, তা বাতাসে নতুন ভাবনার রং ছড়িয়ে দিল।
এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে সাগরিকা চৌধুরী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। এবং ফারিয়া আর তাদের মতামত জানতে বলে গেলেন।
সন্ধ্যার দিকে ফারিয়া টিউশন শেষ করে বাসায় ফিরে এলো। ব্যাগটা নামিয়ে যখন ড্রইংরুমে ঢুকল, তখন তার মাকে একটু গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখল।
ফারিয়া কাছে গিয়ে বলল,
–” আম্মু, তোমার মুখ এতটা ভাবনাচিন্তায় ভর্তি কেন?
সাহানা বেগম ধীরে ধীরে তাকালেন মেয়ের দিকে। তারপর মৃদু গলায় বললেন,
–” তুই একটু বস মা, তোর সঙ্গে একটু কথা আছে।
ফারিয়া কৌতূহল নিয়ে বসে পড়ল। সাহানা বেগম একটু থেমে, ধীরে ধীরে বললেন,
–” আজ তাহসান এর মা এসেছিলেন। ওর জন্য তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। ছেলেটা ভালো, চাকরিও করছে, কিন্তু আমি জানি মা, এসব সিদ্ধান্ত তোকে না জানিয়ে নেয়া যায় না। তাই বলেছি তোর সাথে কথা বলে জানাবো।
কথাটা শুনে ফারিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। একরাশ অতীত স্মৃতি তার চোখে ভেসে উঠল।
তারপর ধীরে গলা নামিয়ে বলল,
–” আম্মু, আমি নিজেই উনাকে সবটা বলতে চাই।
সাহানা বেগম কিছুটা অবাক হলেন,
–” তুই নিশ্চিত?
ফারিয়া মাথা নাড়ল,
–” হ্যাঁ, সত্যটা জানানো উচিত।
মতিন সাহেব বাসায় ফিরে আসলে তাঁকেও সবকিছু জানান সাহানা বেগম। তিনিও মেয়ের সাথে একমত পোষণ করেন।
.
.
কিছুদিন পর সাগরিকা চৌধুরী আবার আসেন। ফারিয়া তখন বাসায় ছিল। সাহানা বেগম তখন ফারিয়াকে ডেকে নিয়ে আসেন।
সাগরিকা চৌধুরী ফারিয়াকে দেখে হাসিমুখে বললেন,
–” আয় মা, বস। আজ অনেকদিন পর দেখা হলো।
ফারিয়া সালাম দিয়ে একপাশে বসে। তারপর সাগরিকা চৌধুরী আর কথা না বাড়িয়ে বললেন,
–” তোমার মায়ের থেকে সব শুনেছো নিশ্চয়ই?
ফারিয়া শান্ত গলায় বলল,
–” জ্বী আন্টি, সে কারণেই আপনাকে একটা কথা জানানো জরুরি মনে করলাম। আপনার ছেলের জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন আমি সম্মানিত বোধ করছি। কিন্তু আমি চাই আপনি সত্যিটা জানুন।
সাগরিকা চৌধুরী ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,
–” সত্যি মানে?
ফারিয়া গভীর চোখে তাকিয়ে বলল,
–” আমার এর আগেও একটা বিয়ে হয়েছিল আন্টি। কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি। আমার আর তার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখন আমি পড়াশোনা আর নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছি। এসব না জানলে কোনো সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না। আমি চাই না কেউ অন্ধকারে থাকুক।
ঘরে কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর সাগরিকা চৌধুরী ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। তার মুখে হতাশা নয়, বরং একপ্রকার শ্রদ্ধার ছাপ ফুটে উঠল।
–” তুমি তোমার সত্যিটা সাহস করে বলেছো মা, সেটা আমি কদর করি। সবকিছু আল্লাহ্র ইচ্ছা।
কিন্তু বিয়েটা তো তোমাদের দুজনের তাই আমি একা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আমার ছেলের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে জানাবো।
সাগরিকা চৌধুরীর কথার পর ফারিয়া ধীরে মাথা নিচু করল। মুখটা ছিল শান্ত, কিন্তু চোখে ছিল দৃঢ়তা। একটু থেমে সে বলল,
–” আন্টি, আমি আপনার মত একজন ভালো মায়ের সামনে সত্য বলার সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞ। তবে আমার অতীত জানার পরেও একটা কথা বলতেই হয়, আমি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই।
সাগরিকা চৌধুরী কিছুটা অবাক হয়ে তাকালেন। ফারিয়া নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে গেল,
–” আমি এখন আমার পড়াশোনা শেষ করতে চাই। নিজের জন্য একটা স্থির অবস্থান তৈরি করতে চাই। আপনার ছেলে ভালো একজন মানুষ, কিন্তু আমি মনে করি, আপনি আমার থেকে অনেক ভালো, স্থির, আর নির্ভরযোগ্য কাউকে পাবেন ওনার জন্য ইনশা আল্লাহ।
একটু নীরবতা নামল ঘরে। ফারিয়ার চোখে ছিল একরাশ আত্মবিশ্বাস। সাগরিকা চৌধুরী তার দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলেন,
–” তুমি খুব বোঝদার মেয়ে মা। আমি তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। আল্লাহ তোমার জন্য উত্তম কিছু রাখুন।
ফারিয়া মাথা নিচু করে বলল,
–” দুআ রাইখেন আন্টি।
.
.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সাগরিকা চৌধুরী দরজার চাবি ঘুরিয়ে বাসায় ঢুকলেন। তাহসান সোফায় বসে চা খাচ্ছিল, মাকে দেখে উঠে দাঁড়াল,
–” মা! অনেকক্ষণ বাইরে ছিলে, কোথায় গিয়েছিলে?
সাগরিকা চৌধুরী হালকা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
–” ফারিয়াদের বাসায় গিয়েছিলাম।
তাহসান ভুরু কুঁচকে তাকাল,
–” ওদের বাসায়? হঠাৎ?
সাগরিকা বসলেন চুপচাপ। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন,
–” তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম।
তাহসান অবাক হয়ে গেল,
–” কী! আমার সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা না করেই চলে গেলে তুমি?
সাগরিকা চৌধুরী মাথা নিচু করে শান্তভাবে বললেন,
–” হ্যাঁ, সেটা ভুল হয়েছে। কিন্তু আমার মন বলেছিল, ওটাই ঠিক হবে। ফারিয়া খুব ভদ্র মেয়ে। বিনয়ী, মায়াবী। কিন্তু আজ ও যা বললো!
তাহসান এবার একটু চিন্তিত হয়ে বলল,
–” সে কী বলেছে?
সাগরিকা ধীরে বললেন,
–” সে বলেছে, এখনো পড়াশোনার মাঝখানে আছে। বিয়ে করতে চায় না এখন। আর তার অতীতের একটা সম্পর্কের কথা খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। এমন সৎ মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। শেষে ও বলল, আপনি আমার থেকে বেটার কাউকে পাবেন আপনার ছেলের জন্য।
তাহসান কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। সাগরিকা তখন ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।
–” তোর ইচ্ছা থাকলে আমি ওর কথাটা আরেকবার ভাবতে পারি। কিন্তু কোনো চাপ নেই বাবা। আমি তোকে জোর করব না।
তাহসান আস্তে করে বলল,
–” আমি ওর অতীতের ব্যপারে সবটা আগেই জেনেছি মা!
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।